বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫

এমন মেরুদন্ড ও মূল্যবোধ দিয়ে গণতন্ত্র হবে না


‘এই মূল্যবোধ দিয়ে গণতন্ত্র হবে না’- বক্তব্যটি কোনো রাজনীতিবিদের নয়। বক্তব্যটি রেখেছেন দেশের বইপড়া আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত করে দিয়েছে, আজকে সবকিছু দ্বিখন্ডিত বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গত ২৪ মে রোববার বাংলা উৎসব ও বইমেলার শেষ দিনে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন। বরাবরই সবরকম রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থাকা এই বিশিষ্টজন তার বক্তৃতায় আরও বলেন, স্বাধীনতার পর গত সাড়ে চার দশকে যেভাবে দেশ এগিয়ে যাবে বলে আমরা আশা করেছিলাম বস্তুত দেশ  সেভাবে আগায়নি। যে ব্যর্থতার জন্য দেশ এগুতে পারছে না, সেটা হলো রাজনৈতিক ব্যর্থতা। আর পরের সমস্যাটা হলো সংবিধান। যে সংবিধানের শিকার হয়ে রাজনীতি বিপাকে পড়েছে। এর থেকে রাজনীতি বের হতে পারছে না।
বস্তুনিষ্ঠতার গুণে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তব্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। এ কারণেই নিউইয়র্কে বাংলা উৎসবে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা দেশের সচেতন মহল গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন। তিনি যে বলেছেন, ‘এই মূল্যবোধ দিয়ে গণতন্ত্র হবে না’- তা যে কতখানি বাস্তব তা সেদিনের বাংলা উৎসব মঞ্চেও উপলব্ধি করা গেছে। তিনি যখন বক্তব্য পেশ করছিলেন, তখন চিরকুট দিয়ে বার বার তাকে বক্তব্য শেষ করতে বলা হয়। এমনকি এক পর্যায়ে কয়েক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে হইচই করে তার বক্তব্য থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। এরপর তিনি দ্রুত তার কথা শেষ করতে বাধ্য হন। আমাদের রাজনীতি যে কতটা অসহিষ্ণু ও অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেল নিউইয়র্কের বাংলা-উৎসব মঞ্চেও। নইলে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থাকা এমন এক বিশিষ্টজনের বক্তব্যে বাধা প্রদান করা হবে কেন? আমরা তো একথা জানি যে, জনমনে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ আছে বলেই উদ্যোক্তারা সুদূর নিউইয়র্কে তাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গেছেন।  তার বক্তব্যের গুরুত্ব আছে, এ কথা তো উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই জানতেন। কিন্তু তিনি যে দলকানা নন কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থাকেন, সে কথাটি কি তারা জানতেন না? সব জেনেশুনেই যদি তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে, তাহলে মঞ্চে বারবার চিরকুট দিয়ে তার বক্তব্যে বাধা প্রদান করা হলো কেন? উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ কি এমনটি ভেবেছিলেন যে, বর্তমান সময়ে অন্য অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো তিনিও বিশেষ ঘরানার গুণগান গেয়ে যাবেন? কিন্তু আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাননি, এ কারণেই হয়তো সেদিন বক্তব্য প্রদানকালে তাকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আসলে বড় বড় অট্টালিকা, উড়াল-সেতু কিংবা লাইট পোস্টের আলোর ঝলকানি কোনো জাতির প্রকৃত উন্নয়নের মানদ- হতে পারে না। জাতিকে প্রকৃত উন্নয়ন ও স্বাধীনতার সুফল দিতে হলে প্রয়োজন যে নৈতিক মেরুদ-, বর্তমান সময়ে তার অভাব খুবই প্রকট। লোভ-লালসাক্লিষ্ট মানসিকতা ও জীর্ণশীর্ণ মেরুদন্ড নিয়ে জাতিকে পথ দেখানো যায় না, গণতান্ত্রিক উন্নয়নও সম্ভব হয় না। তাই বলতে হয়, নিউইয়র্কের বাংলা উৎসব মঞ্চে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে সেদিন যে আচরণ করা হয়েছে, তা শুধু আমাদের রাজনৈতিক দৈন্য নয়, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক দৈন্যও বটে। এমন দৈন্য নিয়ে আমরা যত উৎসবের আয়োজন করি না কেন, যত মঞ্চ সাজাই না কেন- তা কখনও বাতিঘরের ভূমিকা পালনে সমর্থ হবে না। আমাদের এইসব কথার অর্থ আবার এই নয় যে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বা অন্য কারো সবকথা আমাদের মেনে নিতে হবে, কিংবা কারো কথার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করা যাবে না। জ্ঞান ও তথ্যের ভিত্তিতে যে কোনো মানুষই কারো বক্তব্যের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। তবে সেই দ্বিমত প্রকাশের পদ্ধতি হতে হবে গণতান্ত্রিক। জোরজবরদস্তি, চাতুর্য কিংবা শক্তি প্রদর্শন কোনো সভ্য মানুষ কিংবা সভ্য-সমাজের সংস্কৃতি হতে পারে না।
দেশের মন্দ রাজনীতির প্রভাব আমরা নিউইয়র্কেও লক্ষ্য করলাম। নীতিনিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে আমাদের রাজনীতি এখন প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারছে না। নানা অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতি, আত্মসাৎ আর স্বজনপ্রীতির কারণে ডুবছে দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে শুরু করে বাংলাদেশ বিমান, বিটিসিএল, বস্ত্র ও পাটখাত, ডাক বিভাগ, বিদ্যুৎখাত, বিটিভি ও ওয়াসাসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই সমানে চলছে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অনৈতিকতার দৌরাত্ম্য। এমনকি ছাত্ররাও তা থেকে মুক্ত নয়।
‘ওরা বাস্টার্ড’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে মানব জমিন পত্রিকায়। ২৩ মে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, সিলেটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ক্ষোভ দেখালেন অর্থমন্ত্রী। বললেন, ‘ওরা বাস্টার্ড, ওদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছি। কোনোভাবেই ছাড় নয়।’ এর আগে ছাত্রলীগের একাধিক বিতর্কিত ঘটনায় নিজ নির্বাচনী এলাকা সিলেটেও বিব্রত হন অর্থমন্ত্রী। এমন কি মন্ত্রীর সমাবেশস্থলেও ভাংচুর করা হয়েছে। এসব ঘটনার পর নতুন দু’টি কমিটি গঠনের মাধ্যমে ছাত্রলীগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফের বেসামাল হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের সখ্যভাবের কারণে নগর জুড়ে নানা বিতর্কিত কাজ করেই চলেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। ওই ছাত্রলীগের হাত থেকে রেহাই পেলেন না ছাত্রলীগের এককালের নেতা ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্তও।
সিলেটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে খুবই ক্ষুব্ধ তা তার ভাষা ব্যবহার থেকেও উপলব্ধি করা যায়। দেশের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী সন্ত্রাসের  বিরুদ্ধে কথা বলবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস তো শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা দেশেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের খবর পাওয়া যায়। একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের অনাকাক্সিক্ষত এমন চিত্রে দেশের যে কোনো সচেতন নাগরিকেরই ব্যথিত হওয়ার কথা। আমরা মনে করি, ছাত্রলীগ কিংবা কোনো দলকে ছোট করার লক্ষ্যে এ জাতীয় খবর তুলে ধরার মধ্যে তেমন কোনো কল্যাণ নেই। শুধু ছাত্রলীগ কেন, বিভিন্ন সময় আমরা অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত থাকতে দেখেছি। শুধু আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই যে এখন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কমীরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেযুক্ত হচ্ছে তা নয়; টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করেও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। যে সমস্ত কর্মকান্ড ছাত্রদের সাথে যায় না সেই সব কর্মকান্ডে ছাত্রনেতারা কীভাবে জড়িয়ে পড়ছে জাতীয় স্বার্থেই তা গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দলীয় ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং ব্লেম গেম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আমরা জানি, জাতীয় রাজনীতির প্রভাব ছাত্র-রাজনীতিতেও পড়ে থাকে। একসময় তো মেধাবী এবং যোগ্য ছাত্ররাই ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকতো। তারা লেখাপড়াকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতো, এমন কি জাতীয় প্রয়োজনে রাজনীতিতেও অবদান রাখতো। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তখন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের যেনতেনভাবে ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত ছিলেন। তারা ছাত্রদের স্বার্থ যেমন দেখতেন, তেমনি দেখতেন জাতীয় স্বার্থও। ক্ষমতাকেন্দ্রিক বর্তমান রাজনীতিতে সেই সুবাতাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জাতীয় স্বার্থ ও আদর্শ-নিষ্ঠা এখন গৌণ হয়ে পড়ায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মন্দ প্রভাবে ছাত্র সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা এখন নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে পদ-পদবী ও অর্থলিপ্সায় মত্ত হয়ে উঠেছে। ফলে তারা কাউকে মারতে, অপমান করতে কিংবা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে মোটেও কুণ্ঠিত হয় না। দেশের জনগণ তো দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি চায় না, তারা চায় নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত, গণতান্ত্রিক রাজনীতি। কিন্তু তেমন আকাক্সক্ষা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতো যে ছাত্র সমাজ, তাদের চিত্রই বা কেমন? কালান্তরের এই সময়টায় আমাদের রাজনীতিবিদরা কি তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন না? দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন আসলে প্রথমেই তাকাতে হয় নিজের দিকে। আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজের দিকে তাকিয়ে আত্মসমালোচনার দায়িত্ব পালন করে যদি রাজনীতির গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে এগিয়ে আসেন, তাহলে তাদের আর কোনো সন্ত্রাসী বা তাবেদার বাহিনী পুষতে হবে না। তখন ছাত্র রাজনীতিও রাহুমুক্ত হয়ে আপন মহিমায় ঐতিহ্যের উজ্জ্বল ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে। আমাদের রাজনীতিবিদরা সময়ের দাবি পূরণে এগিয়ে আসেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে সময়ের দাবি পূরণে যদি তাঁরা ব্যর্থ হন, তাহলে আমাদের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায় বলতে হবে, ‘এই মূল্যবোধ দিয়ে গণতন্ত্র হবে না’। জানি না মূল্যবোধের এই সংকট থেকে জাতি কখন মুক্তি পাবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads