আগামী ০৬ জুন ৩৬ ঘণ্টার সফরে বাংলাদেশে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। তার এই সফর নিয়ে শাসক মহলে উত্তেজনার শেষ নেই। ভারতের কংগ্রেস ও ইন্দিরা পরিবারের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ সরকার মোদিকে তুষ্ট করার জন্য যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেছে। এমনকি নিরামিষভোজী নরেন্দ্র মোদির জন্য পানিশূন্য পদ্মার ইলিশ রান্নার ব্যবস্থাও করেছে সরকার। আমার জানা নেই যে, নিরামিষভোজীরা ইলিশ মাছ বা অন্য কোনো মাছ খান কিনা। তবে সরকার আয়োজন রেখেছে। সেটা অবশ্য ভালো কথা।
আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় রাখার জন্য কংগ্রেস সরকার করেনি হেন কোনো অপকর্ম নেই। আর এতে তাদের কোনো রাখঢাক ছিলো না। যে কোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে এবং শেখ হাসিনার যে কোনো বিপদে তাকে প্রয়োজনে জঙ্গি বিমান পাঠিয়ে উদ্ধার করে আনা হবে, এই ছিলো কংগ্রেস সরকারের ঘোষণা। এই ঘোষণাকালে তারা বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার দিকে ফিরে তাকায়নি। তারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে নয়, বন্ধুত্ব চেয়েছেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জনগণ কংগ্রেস সরকারকে তাদের বন্ধু বলে কখনও ভাবতে পারেনি।
উপরন্তু কংগ্রেস তাদের বড় ভাইসুলভ মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার দিকে কখনও মনোযোগ দেয়নি। ভারত একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে গঙ্গাসহ ৫৪ টি নদীর পানি। অথচ ভাটির দেশ হিসাবে এসব নদীর বেশির ভাগ পানির হিস্যা বাংলাদেশের পাবার কথা। ভারত নানা ধরনের অজুহাত তুলে সে দেশে আমাদের পণ্য রফতানি বাধাগ্রস্ত করে বাড়িয়েছে বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা। সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশীদের হত্যা করে সীমান্তকে করে তুলেছে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্তে। শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি দিয়ে সম্পাদন করে নিয়েছে বহু সংখ্যক গোপন চুক্তি, যা বাংলাদেশের স্বার্থের সম্পূর্ণ প্রতিকূল। এমনি আরও সব কর্মকা-ের ফলে বাংলাদেশী মানুষের কাছে ভারত এক আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। যা শুধু ঘৃণাই বাড়িয়েছে, ভালোবাসার বিস্তার ঘটাতে পারেনি।
কংগ্রেস সরকার সর্বশেষ ২০১৪ সালে যে ন্যক্কারজনক কা- করেছিল, তাতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। গত বছরের ৫ জানুয়ারি জোর করে ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা যে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করেছিলেন সে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল পচে যাওয়া বামপন্থী ইনু-মেনন ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক দল। এমনকি ১৯৮২ সাল থেকে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও ঐ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সকল রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে সে নির্বাচন কোনোভাবেই বৈধতা পাবে না Ñ এই আশঙ্কা থেকে ভারতের কংগ্রেস সরকার একেবারে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো শেখ হাসিনার নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার ‘গুরু দায়িত্ব’ নিজের কাঁধেই তুলে নেয়। শেখ হাসিনার চৌদ্দ দলের মিত্রদের মধ্যে পতিত স্বৈরাচার হলেও এরশাদেরই খানিকটা উত্তরবঙ্গভিত্তিক জনসমর্থন ছিল। সুতরাং এরশাদকে যদি অনন্ত নির্বাচনে আনা যায় তাহলেও শেখ হাসিনার খানিকটা মুখ রক্ষা হয়। কিন্তু ঐ নির্বাচনে শেখ হাসিনা নিজে এরশাদকে কোনোভাবেই রাজি করাতে পারছিলেন না। তার তাই কংগ্রেস সরকার ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন এরশাদকে ঐ নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করানোর জন্য। সুজাতা সিংও যখন এরশাদকে ঐ পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন তিনি এরশাদকে এমন কথাও বলেছিলেন যে, এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নিলে মৌলবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিবে। এরশাদ তাতেও রাজি হননি। জবাবে তিনি বলেছিলেন যে, মৌলবাদীরা যদি ক্ষমতায় আসে সে দায়িত্ব সরকারের, এরশাদের নয়। আর এরশাদ মিডিয়ায় এ কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন।
ফলে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় ভারতের কংগ্রেস সরকার। ঐ ঘটনাটি ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। তারপর সম্ভবত ভারতের পরামর্শেই রওশন এরশাদকে দিয়ে জাতীয় পার্টির মধ্যে এক ধরনের ভাঙনের সৃষ্টি করা হয়। এরশাদকে অসুস্থ বলে জোর করে সিএমএইচ-এ বন্দী রাখা হয়। যে কথা এরশাদ বার বার হাসপাতাল থেকে তার প্রতিনিধির মাধ্যমে বলেই গেছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য এরশাদের লোকেরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিল। এরশাদ সিএমএইচ-এ বন্দী অবস্থায় নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকে বিধি মোতাবেক জানিয়ে দেন। একই সঙ্গে তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ার নির্দেশ দেন। অনেকেই তা প্রত্যাহার করে নেন। কেউ কেউ চুপচাপ থাকেন। রওশন ঘোষণা করেন জাতীয় পার্টি তার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এতে এরশাদ জাতীয় পার্টিতে একেবারেই শূন্য হয়ে যান। এরপর নির্বাচন কমিশন এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ ৩০০ আসনের ১৫৩ জনকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য ঘোষণা করে দেয়। সেই হলো বাংলাদেশের সংসদ।
এমনই এক পরিস্থিতিতে গত বছর এপ্রিল মাসে ভারতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে যে, ঐ নির্বাচনে কংগ্রেসকে জেতানোর জন্য শেখ হাসিনা অবদান রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অপশাসন, দুঃশাসনের কারণে কংগ্রেসের প্রতি সম্পূর্ণ বিরূপ হয়ে পড়েছিল ভারতীয় জনগণ। আর তারই পরিণতি হলো কংগ্রেসের ১০০ বছরের ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে শোচনীয় পরাজয় ঘটে। বিরোধী দল হওয়ার মতো মাত্র ৫৪ টি আসনে জয়লাভ করতেও ব্যর্থ হয় কংগ্রেস। ৪৩টি আসনে তারা জয়ী হয়। শেখ হাসিনার জন্য এটা ছিল একটা বড় ধরনের ধাক্কা। তিনি কল্পনাও করেননি যে, কংগ্রেস এই রকম শোচনীয় পরাজয় বরণ করবে। নরেন্দ্র মোদির অভিষেক অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত সকল দেশ যোগদান করলেও যোগ দিতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম।
বিগত এক বছরে নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশে ৫৪ দিন সফরে ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সফরে আসছেন ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পর। এ কথা প্রচার করা হয়েছিল যে, মোদি বাংলাদেশের জনগণের জন্য কিছু একটা হাতে নিয়ে আসতে চান। সেই কিছু একটা হলো, ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভায় স্থল সীমানা চুক্তি অনুমোদন। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে জাতীয় সংসদে সে চুক্তি অনুমোদন করিয়ে ভারতকে বেরুবাড়ি দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু গত ৪১ বছরে ভারতের কোনো সরকার তাদের সংসদে ঐ চুক্তি পাস করাতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে রাজ্যসভা ও লোকসভায় চুক্তিটি পাস করিয়ে ছিটমহলবাসীদের জন্য এক সুসংবাদের সৃষ্টি করেছেন। এরা শুধু বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী নয়, ভারতের ছিটমহলবাসীরও এর অন্তর্ভুক্ত। এই চুক্তির ফলে উভয় দেশের ছিটমহলবাসী উপকৃত হয়েছে। বাংলাদেশ একা কোনো সুবিধা পায়নি। তা সত্ত্বেও এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায় যে, এই চুক্তির অনুমোদন উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকবে।
কিন্তু এর চাইতেও যেটি বড় সমস্যা তা হলো তিস্তার পানি বণ্টন। ভারত তিস্তার পানি বণ্টনে এখন পর্যন্ত গড়িমসিই করে আসছে। ফলে বাংলাদেশের এক বিশাল এলাকা চাষাবাদ, জীবন-জীবিকা, প্রাণবৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। তিস্তা যেন শুধুই এক ধূ ধূ বালুচর। কংগ্রেস সরকার বলেছিল, পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী সরকারের আপত্তির কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্ভব হচ্ছে না। মমতা ঢাকায় এসে বলে গেছেন, এই পানি বণ্টনের ব্যাপারে তার উপর আস্থা রাখি। আস্থা রেখেছি। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে গেছে। নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কেবল আশার বাণীই শুনিয়ে যাবেন। আমরা পানি কবে পাবো সেটি নিশ্চিত নয়।
এদিকে মেঘালয়ের একটি আদালত বাংলাদেশে কয়লা রফতানি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে জ্বালানি ক্ষেত্রে এক নতুন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তার উপর পদ্মাসেতু নির্মাণে ভারত থেকে পাথর ও নুড়ি-পাথর আমদানির যে কথা হয়েছিল ভারত সরকার তা সাময়িকভাবে স্থগিত করে রেখেছে। প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এই পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ চীনকে দেয়ার ঢাকার সিদ্ধান্তের পর পরই মেঘালয় সরকার বাংলাদেশে পাথর ও নুড়ি পাথর রফতানি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু অনেক কাল ধরেই এই রফতানি চালু ছিল। এর কোনোটাই বন্ধুত্বের স্মারক নয়।
সালাহ উদ্দিন কাহিনী
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ উত্তরার একটি বাসা থেকে অপহৃত হন গত ১০ মার্চ রাতে। সালাহউদ্দিনের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য সন্ধ্যা থেকেই বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর ছিল। তারপর রাত সাড়ে ৯ টার দিকে ঐ বাসার সব লাইট নিভিয়ে দিয়ে কয়েকজন যুবক তার চোখ ও মুখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নেয়। ‘প্রায় ঘণ্টা দুই মতো গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে একটি ঘরে। ঘরের একটি রুমে আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাত-পা ও চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। রুমটিতে প্রবেশের একটি মাত্র দরজা ছিল। সঙ্গে এটাচ বাথরুম। রুমের ভিতর আসবাবপত্র বলতে একটি খাট, মাথার ওপরে ছিল বৈদ্যুতিক পাখা। ঐ রুমে আমাকে রেখে যুবকরা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে যায়। ঐ বাসায় আমাকে ৬১ দিন আটক রাখা হয়। আমাকে নিয়মিত খাবার ও ওষুধ দিয়ে যাওয়া হতো। যারা খাবার ও ওষুধ নিয়ে আসতো, তাদের কেউই আমার সঙ্গে কথা বলতো না। আমিও ভয়ে তাদের কিছু জিজ্ঞেস করতাম না।’
উত্তরার বাসা থেকে অপহরণের সময় তার চোখ, কান ও হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। আর ঐ ঘরটিতে বন্দী করার পর তার বাঁধন খুলে দেয়া হয়। ঐ বাড়ির অবস্থান সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা গত ২৫ মে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে রিপোর্টটি প্রকাশ করেন। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘যে ঘরে আমাকে বন্দী রাখা হয়েছিল, ঐ ঘরে আবারও আমার হাত, পা, চোখ ও কান বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। তখন আমার মনে হয়েছে খুন করার জন্য হয়তো আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে নিয়ে চার ঘণ্টা না দশ বারো ঘণ্টা ড্রাইভ করা হয়েছে তা ঠিক অনুমান করতে পারিনি। তবে রাস্তায় একবার গাড়ি বদল করা হয়। রাতের আঁধারে আমাকে একটি খোলা জায়গায় ছেড়ে দেয়া হয়। খুলে দেয়া হয় হাত ও পায়ের বাঁধন। ভয়ে আমার বুক কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমাকে শ্যুট করা হবে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শুনি। এরপরও আতঙ্ক কাটছিল না। নিজের ভিতর শক্তি সঞ্চয় করে চোখের বাঁধন খুলি। চারদিকে অন্ধকার দেখতে পাই। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পথচারীকে দেখতে পেয়ে তাদের জিজ্ঞেস করি আমার অবস্থান সম্পর্কে। তারা জানায় আমি ভারতের শিলং-এ অবস্থান করছি। আমি তাদের অনুরোধ করি পুলিশে খবর দিতে। এরপর পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়।’
তিনি পুলিশকে বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী এবং এমপি বলে পরিচয় দেন। কিন্তু তারা তার কথা বিশ্বাস না করে স্থানীয় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। তবে হাসপাতালের চিকিৎসকগণ বাংলাদেশে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর সালাহউদ্দিনের কথা বিশ্বাস করেন। এবং তাকে শিলং হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। সে হাসপাতাল থেকে হৃদরোগ, মূত্রথলির সংক্রমণ ও কিডনির জটিলতার জন্য তাকে শিলং-এর ইন্দিরা গান্ধী বিশেষায়িত হাসপাতালে এখন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো যা লেখে, তাতে কখনও কখনও মনে হয় সালাহউদ্দিন অসুস্থতার ভান করে আছেন। কিন্তু পুলিশ ও বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসকরা মনে করছেন তার হাসপাতালে চিকিৎসা আরও কিছুদিন করতে হবে।
এটি সালাহউদ্দিনের অপহরণের বাইরের দিক। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা এই যে, সালাহউদ্দিনের এই অপহরণের পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে। এবং আমরা দেখেছি ভারতের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে বাসা বাড়ি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সকল জায়গা থেকে নাগরিকদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশী মানুষের ধারণা সালাহউদ্দিন অপহরণের পেছনে ঐ গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে। হয় তারা নিজেরাই এ কাজ করেছে অথবা এই অপকর্মকারীদের তারা ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছে। কেননা বাংলাদেশ সরকার বরাবরই অস্বীকার করে আসছে যে, বাংলাদেশী কোনো গোয়েন্দা সংস্থা সালাহউদ্দিনকে অপহরণ করেনি। বাংলাদেশ সরকারও জানতে চায় গত ১১ মে সালাহউদ্দিন কীভাবে মেঘালয়ের শিলংয়ে পৌঁছলেন। আর এর ফলে বাংলাদেশীদের মনে জন্ম নিয়েছে বহুবিধ প্রশ্নের। বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায় সালাহউদ্দিন আহমেদ স্বেচ্ছায় অবৈধভাবে ভারতে চলে গেছেন নাকি কেউ তাকে অপহরণ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় শিলং নিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। যদি তিনি স্বেচ্ছায় কোথায়ও আত্মগোপন করতেই চান তাহলে ভারতে যাওয়ার ঝুঁকি তিনি কেন নিবেন? ভারতে তাকে নিয়ে যাওয়া হোক বা তিনি যদি স্বেচ্ছায়ও গিয়ে থাকেন তাহলে ঢাকায় কারা তাকে অপহরণ করলো, এবং ভারতের মেঘালয়ে নিয়ে গেল সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। কিংবা স্বেচ্ছায় তিনি গেলে ভারতের কোন গোয়েন্দা সংস্থা তাকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শিলং যেতে সাহায্য করলো? এই প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের সচেতন মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। উপরন্তু শিলং-এর পুলিশ প্রধান বলেছেন, সালাহউদ্দিন এমন মাপের কোনো লোক নন যে, তিনি পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া শিলং এসে পৌঁছবেন। তার অর্থ দাঁড়ায়, কোনো না কোনো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে শিলং এনে ফেলে গেছে।
সালাহউদ্দিন শিলং পুলিশকে জানিয়েছেন যে, ঢাকা উত্তরা থেকে তাকে গ্রেফতারের পর দু’ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে অজ্ঞাত কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ৬১ দিন পরে প্রায় ১০/১২ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ও একবার গাড়ি বদল করে হাত পায়ের বাঁধন খুলে তাকে শিলং ছেড়ে দেয়া হয়। এখন শিলং পুলিশ তার বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনতে যাচ্ছে। আর তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে।
এদিকে সাপ্তাহিক হলিডে তাদের নিজস্ব তদন্ত থেকে জানতে পেরেছে যে, ভারতভিত্তিক কোনো একটি গোয়েন্দা সংস্থা সালাহউদ্দিনকে অপহরণ করেছিল। তাদের ধারণা ছিল গোপন স্থান থেকে বিএনপির অবরোধ ও হরতাল আন্দোলনের মধ্যে সালাহউদ্দিনের ধারাবাহিক প্রেস বিজ্ঞপ্তি হাসিনা সরকারকে বিপদে ফেলতে যাচ্ছিল। ভারতের যে গোয়েন্দা সংস্থাটি এই কাজ করেছিল, তারা র’ বা রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইং নয়। ঐ সংস্থা প্রধানত আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, নেপাল এবং আরও অনেক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থানে কাজ করে। এই কাউন্টার গোয়েন্দা সংস্থা ২০১২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে সকলভাবে সতর্ক করেছিল।
এ সমস্ত কারণেই মনে করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাংঘর্ষিক অবস্থানের জন্যই সালাহউদ্দিন অপহৃত হয়ে থাকতে পারে। মোদি সরকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সম্পর্কে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই নিরীখে বাংলাদেশে আসার আগে সালাহউদ্দিনের অপহরণ ও শিলং-এ তাকে উদ্ধার বিষয়ে অবশ্যই স্বচ্ছতারই আশ্রয় নিবেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় রাখার জন্য কংগ্রেস সরকার করেনি হেন কোনো অপকর্ম নেই। আর এতে তাদের কোনো রাখঢাক ছিলো না। যে কোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে এবং শেখ হাসিনার যে কোনো বিপদে তাকে প্রয়োজনে জঙ্গি বিমান পাঠিয়ে উদ্ধার করে আনা হবে, এই ছিলো কংগ্রেস সরকারের ঘোষণা। এই ঘোষণাকালে তারা বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার দিকে ফিরে তাকায়নি। তারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে নয়, বন্ধুত্ব চেয়েছেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জনগণ কংগ্রেস সরকারকে তাদের বন্ধু বলে কখনও ভাবতে পারেনি।
উপরন্তু কংগ্রেস তাদের বড় ভাইসুলভ মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার দিকে কখনও মনোযোগ দেয়নি। ভারত একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে গঙ্গাসহ ৫৪ টি নদীর পানি। অথচ ভাটির দেশ হিসাবে এসব নদীর বেশির ভাগ পানির হিস্যা বাংলাদেশের পাবার কথা। ভারত নানা ধরনের অজুহাত তুলে সে দেশে আমাদের পণ্য রফতানি বাধাগ্রস্ত করে বাড়িয়েছে বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা। সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশীদের হত্যা করে সীমান্তকে করে তুলেছে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্তে। শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি দিয়ে সম্পাদন করে নিয়েছে বহু সংখ্যক গোপন চুক্তি, যা বাংলাদেশের স্বার্থের সম্পূর্ণ প্রতিকূল। এমনি আরও সব কর্মকা-ের ফলে বাংলাদেশী মানুষের কাছে ভারত এক আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। যা শুধু ঘৃণাই বাড়িয়েছে, ভালোবাসার বিস্তার ঘটাতে পারেনি।
কংগ্রেস সরকার সর্বশেষ ২০১৪ সালে যে ন্যক্কারজনক কা- করেছিল, তাতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। গত বছরের ৫ জানুয়ারি জোর করে ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা যে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করেছিলেন সে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল পচে যাওয়া বামপন্থী ইনু-মেনন ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক দল। এমনকি ১৯৮২ সাল থেকে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও ঐ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সকল রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে সে নির্বাচন কোনোভাবেই বৈধতা পাবে না Ñ এই আশঙ্কা থেকে ভারতের কংগ্রেস সরকার একেবারে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো শেখ হাসিনার নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার ‘গুরু দায়িত্ব’ নিজের কাঁধেই তুলে নেয়। শেখ হাসিনার চৌদ্দ দলের মিত্রদের মধ্যে পতিত স্বৈরাচার হলেও এরশাদেরই খানিকটা উত্তরবঙ্গভিত্তিক জনসমর্থন ছিল। সুতরাং এরশাদকে যদি অনন্ত নির্বাচনে আনা যায় তাহলেও শেখ হাসিনার খানিকটা মুখ রক্ষা হয়। কিন্তু ঐ নির্বাচনে শেখ হাসিনা নিজে এরশাদকে কোনোভাবেই রাজি করাতে পারছিলেন না। তার তাই কংগ্রেস সরকার ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন এরশাদকে ঐ নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করানোর জন্য। সুজাতা সিংও যখন এরশাদকে ঐ পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন তিনি এরশাদকে এমন কথাও বলেছিলেন যে, এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নিলে মৌলবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিবে। এরশাদ তাতেও রাজি হননি। জবাবে তিনি বলেছিলেন যে, মৌলবাদীরা যদি ক্ষমতায় আসে সে দায়িত্ব সরকারের, এরশাদের নয়। আর এরশাদ মিডিয়ায় এ কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন।
ফলে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় ভারতের কংগ্রেস সরকার। ঐ ঘটনাটি ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। তারপর সম্ভবত ভারতের পরামর্শেই রওশন এরশাদকে দিয়ে জাতীয় পার্টির মধ্যে এক ধরনের ভাঙনের সৃষ্টি করা হয়। এরশাদকে অসুস্থ বলে জোর করে সিএমএইচ-এ বন্দী রাখা হয়। যে কথা এরশাদ বার বার হাসপাতাল থেকে তার প্রতিনিধির মাধ্যমে বলেই গেছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য এরশাদের লোকেরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিল। এরশাদ সিএমএইচ-এ বন্দী অবস্থায় নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকে বিধি মোতাবেক জানিয়ে দেন। একই সঙ্গে তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ার নির্দেশ দেন। অনেকেই তা প্রত্যাহার করে নেন। কেউ কেউ চুপচাপ থাকেন। রওশন ঘোষণা করেন জাতীয় পার্টি তার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এতে এরশাদ জাতীয় পার্টিতে একেবারেই শূন্য হয়ে যান। এরপর নির্বাচন কমিশন এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ ৩০০ আসনের ১৫৩ জনকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য ঘোষণা করে দেয়। সেই হলো বাংলাদেশের সংসদ।
এমনই এক পরিস্থিতিতে গত বছর এপ্রিল মাসে ভারতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে যে, ঐ নির্বাচনে কংগ্রেসকে জেতানোর জন্য শেখ হাসিনা অবদান রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অপশাসন, দুঃশাসনের কারণে কংগ্রেসের প্রতি সম্পূর্ণ বিরূপ হয়ে পড়েছিল ভারতীয় জনগণ। আর তারই পরিণতি হলো কংগ্রেসের ১০০ বছরের ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে শোচনীয় পরাজয় ঘটে। বিরোধী দল হওয়ার মতো মাত্র ৫৪ টি আসনে জয়লাভ করতেও ব্যর্থ হয় কংগ্রেস। ৪৩টি আসনে তারা জয়ী হয়। শেখ হাসিনার জন্য এটা ছিল একটা বড় ধরনের ধাক্কা। তিনি কল্পনাও করেননি যে, কংগ্রেস এই রকম শোচনীয় পরাজয় বরণ করবে। নরেন্দ্র মোদির অভিষেক অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত সকল দেশ যোগদান করলেও যোগ দিতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম।
বিগত এক বছরে নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশে ৫৪ দিন সফরে ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সফরে আসছেন ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পর। এ কথা প্রচার করা হয়েছিল যে, মোদি বাংলাদেশের জনগণের জন্য কিছু একটা হাতে নিয়ে আসতে চান। সেই কিছু একটা হলো, ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভায় স্থল সীমানা চুক্তি অনুমোদন। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে জাতীয় সংসদে সে চুক্তি অনুমোদন করিয়ে ভারতকে বেরুবাড়ি দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু গত ৪১ বছরে ভারতের কোনো সরকার তাদের সংসদে ঐ চুক্তি পাস করাতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে রাজ্যসভা ও লোকসভায় চুক্তিটি পাস করিয়ে ছিটমহলবাসীদের জন্য এক সুসংবাদের সৃষ্টি করেছেন। এরা শুধু বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী নয়, ভারতের ছিটমহলবাসীরও এর অন্তর্ভুক্ত। এই চুক্তির ফলে উভয় দেশের ছিটমহলবাসী উপকৃত হয়েছে। বাংলাদেশ একা কোনো সুবিধা পায়নি। তা সত্ত্বেও এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায় যে, এই চুক্তির অনুমোদন উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকবে।
কিন্তু এর চাইতেও যেটি বড় সমস্যা তা হলো তিস্তার পানি বণ্টন। ভারত তিস্তার পানি বণ্টনে এখন পর্যন্ত গড়িমসিই করে আসছে। ফলে বাংলাদেশের এক বিশাল এলাকা চাষাবাদ, জীবন-জীবিকা, প্রাণবৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। তিস্তা যেন শুধুই এক ধূ ধূ বালুচর। কংগ্রেস সরকার বলেছিল, পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী সরকারের আপত্তির কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্ভব হচ্ছে না। মমতা ঢাকায় এসে বলে গেছেন, এই পানি বণ্টনের ব্যাপারে তার উপর আস্থা রাখি। আস্থা রেখেছি। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে গেছে। নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কেবল আশার বাণীই শুনিয়ে যাবেন। আমরা পানি কবে পাবো সেটি নিশ্চিত নয়।
এদিকে মেঘালয়ের একটি আদালত বাংলাদেশে কয়লা রফতানি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে জ্বালানি ক্ষেত্রে এক নতুন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তার উপর পদ্মাসেতু নির্মাণে ভারত থেকে পাথর ও নুড়ি-পাথর আমদানির যে কথা হয়েছিল ভারত সরকার তা সাময়িকভাবে স্থগিত করে রেখেছে। প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এই পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ চীনকে দেয়ার ঢাকার সিদ্ধান্তের পর পরই মেঘালয় সরকার বাংলাদেশে পাথর ও নুড়ি পাথর রফতানি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু অনেক কাল ধরেই এই রফতানি চালু ছিল। এর কোনোটাই বন্ধুত্বের স্মারক নয়।
সালাহ উদ্দিন কাহিনী
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ উত্তরার একটি বাসা থেকে অপহৃত হন গত ১০ মার্চ রাতে। সালাহউদ্দিনের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য সন্ধ্যা থেকেই বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর ছিল। তারপর রাত সাড়ে ৯ টার দিকে ঐ বাসার সব লাইট নিভিয়ে দিয়ে কয়েকজন যুবক তার চোখ ও মুখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নেয়। ‘প্রায় ঘণ্টা দুই মতো গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে একটি ঘরে। ঘরের একটি রুমে আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাত-পা ও চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। রুমটিতে প্রবেশের একটি মাত্র দরজা ছিল। সঙ্গে এটাচ বাথরুম। রুমের ভিতর আসবাবপত্র বলতে একটি খাট, মাথার ওপরে ছিল বৈদ্যুতিক পাখা। ঐ রুমে আমাকে রেখে যুবকরা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে যায়। ঐ বাসায় আমাকে ৬১ দিন আটক রাখা হয়। আমাকে নিয়মিত খাবার ও ওষুধ দিয়ে যাওয়া হতো। যারা খাবার ও ওষুধ নিয়ে আসতো, তাদের কেউই আমার সঙ্গে কথা বলতো না। আমিও ভয়ে তাদের কিছু জিজ্ঞেস করতাম না।’
উত্তরার বাসা থেকে অপহরণের সময় তার চোখ, কান ও হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। আর ঐ ঘরটিতে বন্দী করার পর তার বাঁধন খুলে দেয়া হয়। ঐ বাড়ির অবস্থান সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা গত ২৫ মে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে রিপোর্টটি প্রকাশ করেন। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘যে ঘরে আমাকে বন্দী রাখা হয়েছিল, ঐ ঘরে আবারও আমার হাত, পা, চোখ ও কান বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। তখন আমার মনে হয়েছে খুন করার জন্য হয়তো আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে নিয়ে চার ঘণ্টা না দশ বারো ঘণ্টা ড্রাইভ করা হয়েছে তা ঠিক অনুমান করতে পারিনি। তবে রাস্তায় একবার গাড়ি বদল করা হয়। রাতের আঁধারে আমাকে একটি খোলা জায়গায় ছেড়ে দেয়া হয়। খুলে দেয়া হয় হাত ও পায়ের বাঁধন। ভয়ে আমার বুক কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমাকে শ্যুট করা হবে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শুনি। এরপরও আতঙ্ক কাটছিল না। নিজের ভিতর শক্তি সঞ্চয় করে চোখের বাঁধন খুলি। চারদিকে অন্ধকার দেখতে পাই। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পথচারীকে দেখতে পেয়ে তাদের জিজ্ঞেস করি আমার অবস্থান সম্পর্কে। তারা জানায় আমি ভারতের শিলং-এ অবস্থান করছি। আমি তাদের অনুরোধ করি পুলিশে খবর দিতে। এরপর পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়।’
তিনি পুলিশকে বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী এবং এমপি বলে পরিচয় দেন। কিন্তু তারা তার কথা বিশ্বাস না করে স্থানীয় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। তবে হাসপাতালের চিকিৎসকগণ বাংলাদেশে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর সালাহউদ্দিনের কথা বিশ্বাস করেন। এবং তাকে শিলং হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। সে হাসপাতাল থেকে হৃদরোগ, মূত্রথলির সংক্রমণ ও কিডনির জটিলতার জন্য তাকে শিলং-এর ইন্দিরা গান্ধী বিশেষায়িত হাসপাতালে এখন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো যা লেখে, তাতে কখনও কখনও মনে হয় সালাহউদ্দিন অসুস্থতার ভান করে আছেন। কিন্তু পুলিশ ও বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসকরা মনে করছেন তার হাসপাতালে চিকিৎসা আরও কিছুদিন করতে হবে।
এটি সালাহউদ্দিনের অপহরণের বাইরের দিক। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা এই যে, সালাহউদ্দিনের এই অপহরণের পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে। এবং আমরা দেখেছি ভারতের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে বাসা বাড়ি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সকল জায়গা থেকে নাগরিকদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশী মানুষের ধারণা সালাহউদ্দিন অপহরণের পেছনে ঐ গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে। হয় তারা নিজেরাই এ কাজ করেছে অথবা এই অপকর্মকারীদের তারা ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছে। কেননা বাংলাদেশ সরকার বরাবরই অস্বীকার করে আসছে যে, বাংলাদেশী কোনো গোয়েন্দা সংস্থা সালাহউদ্দিনকে অপহরণ করেনি। বাংলাদেশ সরকারও জানতে চায় গত ১১ মে সালাহউদ্দিন কীভাবে মেঘালয়ের শিলংয়ে পৌঁছলেন। আর এর ফলে বাংলাদেশীদের মনে জন্ম নিয়েছে বহুবিধ প্রশ্নের। বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায় সালাহউদ্দিন আহমেদ স্বেচ্ছায় অবৈধভাবে ভারতে চলে গেছেন নাকি কেউ তাকে অপহরণ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় শিলং নিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। যদি তিনি স্বেচ্ছায় কোথায়ও আত্মগোপন করতেই চান তাহলে ভারতে যাওয়ার ঝুঁকি তিনি কেন নিবেন? ভারতে তাকে নিয়ে যাওয়া হোক বা তিনি যদি স্বেচ্ছায়ও গিয়ে থাকেন তাহলে ঢাকায় কারা তাকে অপহরণ করলো, এবং ভারতের মেঘালয়ে নিয়ে গেল সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। কিংবা স্বেচ্ছায় তিনি গেলে ভারতের কোন গোয়েন্দা সংস্থা তাকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শিলং যেতে সাহায্য করলো? এই প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের সচেতন মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। উপরন্তু শিলং-এর পুলিশ প্রধান বলেছেন, সালাহউদ্দিন এমন মাপের কোনো লোক নন যে, তিনি পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া শিলং এসে পৌঁছবেন। তার অর্থ দাঁড়ায়, কোনো না কোনো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে শিলং এনে ফেলে গেছে।
সালাহউদ্দিন শিলং পুলিশকে জানিয়েছেন যে, ঢাকা উত্তরা থেকে তাকে গ্রেফতারের পর দু’ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে অজ্ঞাত কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ৬১ দিন পরে প্রায় ১০/১২ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ও একবার গাড়ি বদল করে হাত পায়ের বাঁধন খুলে তাকে শিলং ছেড়ে দেয়া হয়। এখন শিলং পুলিশ তার বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনতে যাচ্ছে। আর তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে।
এদিকে সাপ্তাহিক হলিডে তাদের নিজস্ব তদন্ত থেকে জানতে পেরেছে যে, ভারতভিত্তিক কোনো একটি গোয়েন্দা সংস্থা সালাহউদ্দিনকে অপহরণ করেছিল। তাদের ধারণা ছিল গোপন স্থান থেকে বিএনপির অবরোধ ও হরতাল আন্দোলনের মধ্যে সালাহউদ্দিনের ধারাবাহিক প্রেস বিজ্ঞপ্তি হাসিনা সরকারকে বিপদে ফেলতে যাচ্ছিল। ভারতের যে গোয়েন্দা সংস্থাটি এই কাজ করেছিল, তারা র’ বা রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইং নয়। ঐ সংস্থা প্রধানত আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, নেপাল এবং আরও অনেক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থানে কাজ করে। এই কাউন্টার গোয়েন্দা সংস্থা ২০১২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে সকলভাবে সতর্ক করেছিল।
এ সমস্ত কারণেই মনে করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাংঘর্ষিক অবস্থানের জন্যই সালাহউদ্দিন অপহৃত হয়ে থাকতে পারে। মোদি সরকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সম্পর্কে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই নিরীখে বাংলাদেশে আসার আগে সালাহউদ্দিনের অপহরণ ও শিলং-এ তাকে উদ্ধার বিষয়ে অবশ্যই স্বচ্ছতারই আশ্রয় নিবেন তিনি।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন