দেশের ১৬ কোটি মানুষ এখন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে। এই মুহূর্তে জনগণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে আপসহীন সংগ্রামে রত। এই আন্দোলনকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে সরকার বালুর ট্রাকে অবরুদ্ধ করেছে বেগম জিয়াকে, যা গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করারই শামিল। আন্দোলন দমনের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছে মানবাধিকার। বিরোধী মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে এখানে হামলা-মামলা আর বন্দুকের গুলীর জোরে স্তব্ধ করে দিতে চায় আওয়ামী লীগ। স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ ও জনগণকে শাসন করার চেষ্টা চলছে এখানে। খুন-গুম, জীবনের নিরাপত্তাহীনতার আজানা আতঙ্ক তাড়া করছে প্রতিটি নাগরিককে। রাজনীতিবিদ, সুশীলসমাজ, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এই জালিম সরকারের জুলুম-নির্যাতন, বঞ্চনা, অপমান আর লাঞ্চনার শিকার। মানুষের ভোটাধিকার ছিনতাই, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, লুটপাটের ঘটনা বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে প্রতিটি নাগরিককে। জনবিচ্ছিন্ন এই সরকার এখন জনগণকে ভয় দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়। জেফারসনের ভাষায়Ñ ‘যখন সরকার জনগণকে ভয় পায়, তখন এটা স্বাধীনতা’ আর ‘জনগণ যখন সরকারকে ভয় পায়, এটা নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়ন’ এবং জনগণের স্বাধীনতা, অধিকার ও জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন; জর্জ ওয়াশিংটনের ভাষায়- ধর্ম ও নৈতিকতা। যখনই এ দুটি প্রয়োজনীয়তার বিপক্ষে প্রতিবাদ ওঠে এবং আন্দোলনের প্রচেষ্টা হয়, তখন বুঝতে হবে এরা জনগণের কল্যাণ চায় না।”
অ্যাডলফ হিটলার তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে কাল্পনিক শত্রুর সৃষ্টি করতে হবে। তা করে দেখাতে হবে যে দেশ বিপদাপন্ন। এতে জনসাধারণ ভীত হয়ে পড়বে। জনগণ ভীত হলেই তাদের দাসত্বে পরিণত করা সহজ।” আমাদের অনেক সমস্যা এতই নগন্য, তা সহজে সমাধান করা যায়। কিন্তু রাজনীতিবিদগণ সমাধান দিতে চান না। কারণ সমস্যা জটিল করার মধ্যে তাদের ক্ষমতা নির্ভর করে। জনগণের দুর্ভোগ যত বেশি হবে, ততই রাজনীতিবিদগণ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য শক্তিশালী হবে। স্যার অর্নেস্ট বেন তাই বলেছেন, “বিপদ অন্বেষণ করার কৌশলই হচ্ছে রাজনীতি। বিপদ থাকুক আর নাই থাকুক। বর্তমানে অসুস্থ রাজনীতি গোটা জাতির জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।
আজ জাতির সবচেয়ে বড় সমস্যা অনৈক্য আর বিভেদ। আমাদের জাতীয় জীবনে কালো মেঘের আনাগোনা এখন প্রকট। এই অশুভ বৃষ্টি বর্ষিত হলে আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, ও সার্বভৌমত্ব এখন হুমকির মুখে। অসুস্থ রাজনীতি আর ক্ষমতার মোহের কুঠুরিতে বন্দী নাগরিক খাদের কিনারায় দ-ায়মান। আমাদের বড় দুই দল আর জোটের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর এখন অনেক উঁচু। তার সমাধান না হলে পরিণতি হবে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ। দেশের জনগণ ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন দেখেছে। তরুণ প্রজন্ম শুনেছে, বাকশালের অত্যাচার আর নিষ্ঠুরতার কাহিনী। দেখেছে স্বৈরাচারের দীর্ঘ শাসন আর শোষণ। তবু এগিয়ে যাবার স্বপ্ন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ইতিহাস থেকে রাজনীতিবিদরা শিক্ষা না নেবার কারণে বারবার চরম মূল্য দিচ্ছে এ জাতি। কিন্তু কেন? অথচ এইতো সেদিন। ১/১১ মহাপ্রলয় থেকে রেহাই পাননি দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, ছাত্র-শিক্ষক ও দেশের জনসাধারণ। আমরা কি আর এক ২৮ অক্টোবর কিংবা তার থেকে বড় রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছি? আমরা কি বার বার মীমাংসিত ইস্যুগুলো জাগিয়ে জাতিকে বিভেদ আর বিভক্তির দিকে ঠেলে দেব? কারণ আজকের সঙ্কটের অন্যতম কারণ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল। দেশের সকল বিরোধী দল, সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবী, আদালত এমনকি সরকারদলীয় ব্যক্তিদের মতকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। এ রাজনৈতিক খেলা জাতিবিনাশী আর আত্মঘাতী!
আমাদের দেশের আজকের রাজনৈতিক একমাত্র সঙ্কট বৃটিশ পার্লামেন্ট মেম্বার সায়মন ডানসাক বুঝেছেন; কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এমন এক রাষ্ট্র যেখানে নেই কোনো ফ্রিডম, নেই কোনো গণতন্ত্র, জনসাধারণের জন্য নেই কোনো চয়েস। এমন পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন দেয়াই চলমান সংঘাত নিরসনের একমাত্র উপায়। সায়মন ডানসাক বলেন, গত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের এক বছরের মাথায় আমরা এসে দেখলাম, ওই নির্বাচন ছিলো কতকগুলো ভুল কারণের সমষ্টি মাত্র। সেদিনের নির্বাচনের দিন আমরা লক্ষ্য করে ছিলাম অনেকের প্রাণহানির ঘটনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভবিষ্যতের দিকে সামনে এগিয়ে যেতে হলে নতুন এক ফ্রেশ, অবাধ, নিরপেক্ষ এক নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে ফিরে যেতে পারে শান্তি ও প্রগতির পথে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা করতে পারে। সায়মন বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধসহ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী এবং রাজনৈতিক নেতাদের নির্যাতন ও অপমানের নিন্দা জানিয়ে বলেন, এ ঘটনা গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা স্থাপনের পথে অন্তরায়। (উৎস- শীর্ষ নিউজ)
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক জীবনের বাইরে ক্ষমতা ও গৌরবের জন্য সবকিছু করছে। জনকল্যাণ নিয়ে ভাবনা তাদের নেই।’ যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও সংবিধান প্রণেতা থমাস জেফারসন বলেন, ‘একজন মানুষ যখন পদের (ক্ষমতায়) জন্য আকুল আকাক্সক্ষী হয়, তখন তার আচরণে পচন ধরে।’ জেফারসন যেন আজকের এবং তার সময়ের রাজনীতিবিদদের কথাই বলছেন। হয়তো এজন্যই একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘রাজনীতির প্রকৃতিই হলো ভালো মানুষ যেন নির্বাচিত না হয়। কারণ শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোসহ নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে চান না।’ আসলে রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষসহ সব চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রনায়কেরা গভীর আলোচনা করেছেন এবং তারা কেউই এর ওপর সুখপ্রদ মন্তব্য করেননি। যেমন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেন, ‘রাজীতিতে মূর্খ-বোকা-স্থূলবুদ্ধিদের কোনো সমস্যা নেই।’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে এখন চলছে পেশীশক্তি আর গালাগাল প্রতিযোগিতা। তাহলে আমরা দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চাই। আমরা আসলে কি এমন কিছু করতে চাই, যা অন্যের হস্তক্ষেপকে প্রসারিত করে। প্রয়োজনীয় করে তোলে অন্য কোনো শক্তিধর দেশের দুতিয়ালি। সে আমাদের প্রতিবেশী ভারত-আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো শক্তিই হোক। এই ব্যর্থতা আমাদের রাজনীতিবিদদের। এটি বড়ই লজ্জার। আমাদের নতুন প্রজন্ম রাজনীতিবিদদের এমন ব্যর্থতা আর দেখতে চায় না। দেশের সঙ্কট আমরাই সমাধান করতে পারবো। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা। সেটি দেখাতে না পারলে দেশের মানুষ এই নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করবে। সুতরাং সংঘাত আর সংঘর্ষের খেলা বন্ধ করে সমঝোতা, শান্তি আর গণতন্ত্রের পথে আওয়ামী লীগকে আসতে হবে। সে পথে আওয়ামী লীগ আসতে না চাইলে জনগণ রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করতে বাধ্য করবে।
গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানে খচিত হলেও দেশ পরিচালিত হয়েছে কখনও একনায়কতন্ত্র তথা বাকশাল, কখনো সামরিকজান্তা, আবার কখনো স্বৈরশাসনের অধীনে। অনেক আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনের অবসান হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলেও জনগণের চাহিদার সত্যিকারের প্রতিফলন এখনো ঘটেনি। গণতন্ত্র শাসনের এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে কে শাসন করবে এবং কি উদ্দেশ্যে শাসন করবে এ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা হয়। গণতন্ত্র এমন একটি অধিযন্ত্রবাদ যা নিশ্চিত করে মর্যাদাযোগ্য সরকার পাওয়া যায়। কিন্তু ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন সেই সংজ্ঞাকেও পাল্টে দিয়েছে। তাই একবার এক সাহসী যুবক একটি সভায় এক শঠ রাজনীতিবিদকে প্রশ্ন করে জর্জরিত করছিল। অবশেষে রাজনীতিবিদ যুবকটিকে এড়াতে পারলেন না। তিনি বললেন, “আমার সাথে আপনার যে অমিল তা কি শ্রোতাম-লীকে বলবেন? নাগরিকের কি উপকার আপনি করছেন?” যুবকটি দাঁড়িয়ে বলল, “গত নির্বাচনে আমি আপনার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছি।” সেই প্রতিবাদের সুযোগও আজ এখানে অনুপস্থিত। তাই কার্ল পপার বলেছেন- “কে শাসন করবে এ প্রশ্ন করা সঠিক নয়। কু-সরকারকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে বের করতে হবে এ প্রশ্নই প্রধান। এটাই গণতন্ত্র।” দেশ এখন সন্ত্রাস, দুর্নীতি, খুন আর গুমের রাজনীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। তাই অন্যায়, দারিদ্র্য এবং অজ্ঞতা নিরাময়ের জন্য রাষ্ট্রকে হয় সংস্কার পন্থা অবলম্বন করতে হবে, নয় তো বিপ্লবের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প আছে কি?
যেখানে আইনের শাসন, জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে দুর্নীতি জীবনের উপায়ে পরিণত হয়। থাকে না মানুষের মৌলিক অধিকার। আমরা এখন এমন দেশেরই নাগরিক। অথচ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময় মানবাধিকারের তালিকা তৈরি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার-সম্পর্কিত ঘোষণা (United Nations Declaration of Human Rights) এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতারক্ষার্থে ইউরোপীয় কনভেশন (European convention for the Protection of Human Rights and Fundamental Freedoms) ইত্যাদি। মানবাধিকার রক্ষার জন্য মানবাধিকার-সম্পর্কিত ইউরোপীয় আদালত (European Court of Human Rights)-ও গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও নাগরিক অধিকারের নীতি খচিত। কিন্তু এদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন শূন্যের কোঠায়। দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরছে প্রতিদিন। কিন্তু সরকার সেদিকে কোনো কর্ণপাত করছে না। অথচ সাধারণভাবে, কথা বলার স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, পারিবারিক জীবনের অধিকার, ফৌজদারি মামলাও সুবিচার পাওয়ার অধিকার, অমানবিক শাস্তি থেকে নিষ্কৃতির নিশ্চয়তা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতা ইত্যাদিই মানবাধিকারের পর্যায়ভুক্ত। অনুন্নত, একনায়ক বা স্বৈরাচারশাসিত এবং গোঁড়া কমিউনিস্ট দেশেই মানবাধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন তারই অন্তর্ভুক্ত। সারা বিশ্বে এখন বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে এখন আলোচনা সমালোচনা চলছে। যা দেশের জন্য মর্যাদা হানিকর। আর এর ভুক্তভোগী হচ্ছেন দেশের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স অর্জনকারী বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের শ্রমিকরা।
আইনের শাসন বা Rule of Law এর মূল কথা হলো : ১. কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দ্বারা নয়, বরং সুনির্দিষ্ট ও ধারাবাহিক আইনের দ্বারাই রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হবে; ২. আইনের চোখে সকল নাগরিকের অধিকার সমান হবে; ৩. বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে প্রশাসন ও সরকারে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের প্রভাবমুক্ত হবে এবং রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা ও নাগরিক আদালতের কাছে দায়ী থাকবেন এবং ৪. সংবিধানই জনগণের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করবে এবং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের ইচ্ছামাফিক সংবিধান বাতিল, স্থগিত বা পরিবর্তন করা যাবে না। বর্তমানে বাংলাদেশে চলছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত শাসন ব্যবস্থা। আমরা যদি এই চারটি নীতি বাক্য, মৌলিক আইন কিংবা ধারনাকে উল্টিয়ে বলি তাহলে আওয়ামী শাসনামলের পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করা যায়।
শাসকগোষ্ঠী যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আর সামাল দিতে পারে না, তখনই এই পথের আশ্রয় নেয়। ফ্যাসিবাদীরা আঘাত হানে প্রধানত প্রগতিশীল শক্তি, প্রতিবাদী কণ্ঠ ও শ্রমিকশ্রেণীর ওপর। সর্বপ্রথম (১৯২২ সালে) ইতালিতেই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার পর এর গোড়াপত্তন হয় জার্মানিতে (১৯৩৩)। ফ্যাসিবাদের দুই প্রধান মহানায়ক ছিলেন ইতালির বেনিতো মুসোলিনি এবং জার্মানির এডলফ্ হিটলার। তাই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ এবং সংশ্লিষ্ট দেশের আধাকাঁচড়া ও কমবেশি মুৎসুদ্দি চরিত্রসম্পন্ন পুঁজির স্বার্থকে রক্ষার করার উদ্দেশ্যে এবং শোষিত শ্রেণীর আন্দোলন ও ক্ষমতা দখলকে ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই অনুন্নত দেশসমূহের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীও ক্ষেত্রবিশেষে ফ্যাসিবাদের আশ্রয় নেয়। এ কাজে তারা প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে, বিশেষত সামরিক বাহিনীকে। বাংলাদেশ এখন তারই পদযাত্রী।
পৃথিবীতে একনায়কত্বের (Dictatorship) শাসন সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ শাসক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষ যখন শাসিতের মতামতের ধার না ধেরে একচ্ছত্রভাবে শাসনকাজ চালিয়ে যায়। সেখানে অনায়াসে জন্ম হয় একনায়কত্বের। বাংলাদেশের বিরোধীদল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো বরাবরই বলে আসছে, এখানে এখন গণতন্ত্রের লেবাসে এক ব্যক্তির (শেখ হাসিনার) শাসনই বিদ্যমান। রোমান প্রজাতন্ত্রের সময় থেকে এর উৎপত্তি হলেও এখন তা বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় ভর করেছে। একনায়কত্ব সর্বদাই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের একচ্ছত্র স্বার্থে প্রতিপক্ষের ওপর সার্বিক নিষ্পেষণ চালিয়ে দেয়। আর এর মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠে Authoritarianism বা Autocracy বা Despotism-ই হলো স্বৈরতন্ত্র, স্বৈরশাসনবাদ বা স্বেচ্ছাচারবাদ। স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্রের বিপরীত এবং প্রায়ই গণস্বার্থবিরোধী। আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে চিরনিন্দ্রায় শায়িত করে এখন স্বৈরতান্ত্রিক উন্নয়নের কথা বলছে। দেশের মানুষ গণতন্ত্রমুক্ত উন্নয়ন চায় না। এর মধ্য দিয়ে জনগণের ওপর সরকার এক ধরনের শ্বেতসন্ত্রাস White Terror পরিচালনা করছে। শোষক ও স্বৈরচারী শাসকগোষ্ঠী মুক্তিকামী বিপ্লবী বা গণআন্দোলনকে অবদমিত করার উদ্দেশ্যে যে বেপরোয়া নিষ্পেষণ নিপীড়নযজ্ঞ চালায়, পৃথিবীতে সেটাই শ্বেতসন্ত্রাস বলে খ্যাত। আওয়ামী লীগ এবার গদি রক্ষায় সকল ঘৃণ্য, অমানবিক পন্থারই আশ্রয় নিচ্ছে। যার কারণে বিশ্বের দরবারে দেশের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশ পশ্চিমা এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক ভয়াবহ খারপ পর্যায়ে নামিয়ে আনলো, যা এই জাতির জন্য খুবই বেদনাদায়ক।
আমাদের পাল্টাতে হবে বিভেদের রাজনীতি। গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্য। চিত্রাঙ্কন করতে হবে ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধশালী একটি বাংলাদেশের। আমাদের রাজনীতি এখন কলুষিত। আমাদের দেশের সংসদ এখন কারো গুণকীর্তন আর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগারের আড্ডা খানায় পরিণত হয়েছে। অথচ গরীবের টাকায় পরিচালিত এই সংসদ তাদের ভাগ্য-উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারছে। আজ আমাদের জাগতেই হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে দুর্বার প্রতিরোধ। কারণ তরুণ প্রজন্ম এবং জনগণ পরাজিত আর পরাভূত হতে জানে না। এ জাতি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, আর ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে নতি শিকার করেনি। এবারও করবে না, ইনশাআল্লাহ। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করার মধ্যেই দেশের উন্নতি নির্ভর করে।
অ্যাডলফ হিটলার তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে কাল্পনিক শত্রুর সৃষ্টি করতে হবে। তা করে দেখাতে হবে যে দেশ বিপদাপন্ন। এতে জনসাধারণ ভীত হয়ে পড়বে। জনগণ ভীত হলেই তাদের দাসত্বে পরিণত করা সহজ।” আমাদের অনেক সমস্যা এতই নগন্য, তা সহজে সমাধান করা যায়। কিন্তু রাজনীতিবিদগণ সমাধান দিতে চান না। কারণ সমস্যা জটিল করার মধ্যে তাদের ক্ষমতা নির্ভর করে। জনগণের দুর্ভোগ যত বেশি হবে, ততই রাজনীতিবিদগণ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য শক্তিশালী হবে। স্যার অর্নেস্ট বেন তাই বলেছেন, “বিপদ অন্বেষণ করার কৌশলই হচ্ছে রাজনীতি। বিপদ থাকুক আর নাই থাকুক। বর্তমানে অসুস্থ রাজনীতি গোটা জাতির জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।
আজ জাতির সবচেয়ে বড় সমস্যা অনৈক্য আর বিভেদ। আমাদের জাতীয় জীবনে কালো মেঘের আনাগোনা এখন প্রকট। এই অশুভ বৃষ্টি বর্ষিত হলে আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, ও সার্বভৌমত্ব এখন হুমকির মুখে। অসুস্থ রাজনীতি আর ক্ষমতার মোহের কুঠুরিতে বন্দী নাগরিক খাদের কিনারায় দ-ায়মান। আমাদের বড় দুই দল আর জোটের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর এখন অনেক উঁচু। তার সমাধান না হলে পরিণতি হবে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ। দেশের জনগণ ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন দেখেছে। তরুণ প্রজন্ম শুনেছে, বাকশালের অত্যাচার আর নিষ্ঠুরতার কাহিনী। দেখেছে স্বৈরাচারের দীর্ঘ শাসন আর শোষণ। তবু এগিয়ে যাবার স্বপ্ন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ইতিহাস থেকে রাজনীতিবিদরা শিক্ষা না নেবার কারণে বারবার চরম মূল্য দিচ্ছে এ জাতি। কিন্তু কেন? অথচ এইতো সেদিন। ১/১১ মহাপ্রলয় থেকে রেহাই পাননি দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, ছাত্র-শিক্ষক ও দেশের জনসাধারণ। আমরা কি আর এক ২৮ অক্টোবর কিংবা তার থেকে বড় রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছি? আমরা কি বার বার মীমাংসিত ইস্যুগুলো জাগিয়ে জাতিকে বিভেদ আর বিভক্তির দিকে ঠেলে দেব? কারণ আজকের সঙ্কটের অন্যতম কারণ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল। দেশের সকল বিরোধী দল, সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবী, আদালত এমনকি সরকারদলীয় ব্যক্তিদের মতকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। এ রাজনৈতিক খেলা জাতিবিনাশী আর আত্মঘাতী!
আমাদের দেশের আজকের রাজনৈতিক একমাত্র সঙ্কট বৃটিশ পার্লামেন্ট মেম্বার সায়মন ডানসাক বুঝেছেন; কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এমন এক রাষ্ট্র যেখানে নেই কোনো ফ্রিডম, নেই কোনো গণতন্ত্র, জনসাধারণের জন্য নেই কোনো চয়েস। এমন পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন দেয়াই চলমান সংঘাত নিরসনের একমাত্র উপায়। সায়মন ডানসাক বলেন, গত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের এক বছরের মাথায় আমরা এসে দেখলাম, ওই নির্বাচন ছিলো কতকগুলো ভুল কারণের সমষ্টি মাত্র। সেদিনের নির্বাচনের দিন আমরা লক্ষ্য করে ছিলাম অনেকের প্রাণহানির ঘটনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভবিষ্যতের দিকে সামনে এগিয়ে যেতে হলে নতুন এক ফ্রেশ, অবাধ, নিরপেক্ষ এক নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে ফিরে যেতে পারে শান্তি ও প্রগতির পথে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা করতে পারে। সায়মন বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধসহ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী এবং রাজনৈতিক নেতাদের নির্যাতন ও অপমানের নিন্দা জানিয়ে বলেন, এ ঘটনা গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা স্থাপনের পথে অন্তরায়। (উৎস- শীর্ষ নিউজ)
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক জীবনের বাইরে ক্ষমতা ও গৌরবের জন্য সবকিছু করছে। জনকল্যাণ নিয়ে ভাবনা তাদের নেই।’ যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও সংবিধান প্রণেতা থমাস জেফারসন বলেন, ‘একজন মানুষ যখন পদের (ক্ষমতায়) জন্য আকুল আকাক্সক্ষী হয়, তখন তার আচরণে পচন ধরে।’ জেফারসন যেন আজকের এবং তার সময়ের রাজনীতিবিদদের কথাই বলছেন। হয়তো এজন্যই একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘রাজনীতির প্রকৃতিই হলো ভালো মানুষ যেন নির্বাচিত না হয়। কারণ শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোসহ নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে চান না।’ আসলে রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষসহ সব চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রনায়কেরা গভীর আলোচনা করেছেন এবং তারা কেউই এর ওপর সুখপ্রদ মন্তব্য করেননি। যেমন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেন, ‘রাজীতিতে মূর্খ-বোকা-স্থূলবুদ্ধিদের কোনো সমস্যা নেই।’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে এখন চলছে পেশীশক্তি আর গালাগাল প্রতিযোগিতা। তাহলে আমরা দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চাই। আমরা আসলে কি এমন কিছু করতে চাই, যা অন্যের হস্তক্ষেপকে প্রসারিত করে। প্রয়োজনীয় করে তোলে অন্য কোনো শক্তিধর দেশের দুতিয়ালি। সে আমাদের প্রতিবেশী ভারত-আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো শক্তিই হোক। এই ব্যর্থতা আমাদের রাজনীতিবিদদের। এটি বড়ই লজ্জার। আমাদের নতুন প্রজন্ম রাজনীতিবিদদের এমন ব্যর্থতা আর দেখতে চায় না। দেশের সঙ্কট আমরাই সমাধান করতে পারবো। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা। সেটি দেখাতে না পারলে দেশের মানুষ এই নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করবে। সুতরাং সংঘাত আর সংঘর্ষের খেলা বন্ধ করে সমঝোতা, শান্তি আর গণতন্ত্রের পথে আওয়ামী লীগকে আসতে হবে। সে পথে আওয়ামী লীগ আসতে না চাইলে জনগণ রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করতে বাধ্য করবে।
গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানে খচিত হলেও দেশ পরিচালিত হয়েছে কখনও একনায়কতন্ত্র তথা বাকশাল, কখনো সামরিকজান্তা, আবার কখনো স্বৈরশাসনের অধীনে। অনেক আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনের অবসান হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলেও জনগণের চাহিদার সত্যিকারের প্রতিফলন এখনো ঘটেনি। গণতন্ত্র শাসনের এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে কে শাসন করবে এবং কি উদ্দেশ্যে শাসন করবে এ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা হয়। গণতন্ত্র এমন একটি অধিযন্ত্রবাদ যা নিশ্চিত করে মর্যাদাযোগ্য সরকার পাওয়া যায়। কিন্তু ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন সেই সংজ্ঞাকেও পাল্টে দিয়েছে। তাই একবার এক সাহসী যুবক একটি সভায় এক শঠ রাজনীতিবিদকে প্রশ্ন করে জর্জরিত করছিল। অবশেষে রাজনীতিবিদ যুবকটিকে এড়াতে পারলেন না। তিনি বললেন, “আমার সাথে আপনার যে অমিল তা কি শ্রোতাম-লীকে বলবেন? নাগরিকের কি উপকার আপনি করছেন?” যুবকটি দাঁড়িয়ে বলল, “গত নির্বাচনে আমি আপনার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছি।” সেই প্রতিবাদের সুযোগও আজ এখানে অনুপস্থিত। তাই কার্ল পপার বলেছেন- “কে শাসন করবে এ প্রশ্ন করা সঠিক নয়। কু-সরকারকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে বের করতে হবে এ প্রশ্নই প্রধান। এটাই গণতন্ত্র।” দেশ এখন সন্ত্রাস, দুর্নীতি, খুন আর গুমের রাজনীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। তাই অন্যায়, দারিদ্র্য এবং অজ্ঞতা নিরাময়ের জন্য রাষ্ট্রকে হয় সংস্কার পন্থা অবলম্বন করতে হবে, নয় তো বিপ্লবের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প আছে কি?
যেখানে আইনের শাসন, জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে দুর্নীতি জীবনের উপায়ে পরিণত হয়। থাকে না মানুষের মৌলিক অধিকার। আমরা এখন এমন দেশেরই নাগরিক। অথচ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময় মানবাধিকারের তালিকা তৈরি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার-সম্পর্কিত ঘোষণা (United Nations Declaration of Human Rights) এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতারক্ষার্থে ইউরোপীয় কনভেশন (European convention for the Protection of Human Rights and Fundamental Freedoms) ইত্যাদি। মানবাধিকার রক্ষার জন্য মানবাধিকার-সম্পর্কিত ইউরোপীয় আদালত (European Court of Human Rights)-ও গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও নাগরিক অধিকারের নীতি খচিত। কিন্তু এদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন শূন্যের কোঠায়। দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরছে প্রতিদিন। কিন্তু সরকার সেদিকে কোনো কর্ণপাত করছে না। অথচ সাধারণভাবে, কথা বলার স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, পারিবারিক জীবনের অধিকার, ফৌজদারি মামলাও সুবিচার পাওয়ার অধিকার, অমানবিক শাস্তি থেকে নিষ্কৃতির নিশ্চয়তা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতা ইত্যাদিই মানবাধিকারের পর্যায়ভুক্ত। অনুন্নত, একনায়ক বা স্বৈরাচারশাসিত এবং গোঁড়া কমিউনিস্ট দেশেই মানবাধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন তারই অন্তর্ভুক্ত। সারা বিশ্বে এখন বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে এখন আলোচনা সমালোচনা চলছে। যা দেশের জন্য মর্যাদা হানিকর। আর এর ভুক্তভোগী হচ্ছেন দেশের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স অর্জনকারী বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের শ্রমিকরা।
আইনের শাসন বা Rule of Law এর মূল কথা হলো : ১. কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দ্বারা নয়, বরং সুনির্দিষ্ট ও ধারাবাহিক আইনের দ্বারাই রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হবে; ২. আইনের চোখে সকল নাগরিকের অধিকার সমান হবে; ৩. বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে প্রশাসন ও সরকারে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের প্রভাবমুক্ত হবে এবং রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা ও নাগরিক আদালতের কাছে দায়ী থাকবেন এবং ৪. সংবিধানই জনগণের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করবে এবং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের ইচ্ছামাফিক সংবিধান বাতিল, স্থগিত বা পরিবর্তন করা যাবে না। বর্তমানে বাংলাদেশে চলছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত শাসন ব্যবস্থা। আমরা যদি এই চারটি নীতি বাক্য, মৌলিক আইন কিংবা ধারনাকে উল্টিয়ে বলি তাহলে আওয়ামী শাসনামলের পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করা যায়।
শাসকগোষ্ঠী যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আর সামাল দিতে পারে না, তখনই এই পথের আশ্রয় নেয়। ফ্যাসিবাদীরা আঘাত হানে প্রধানত প্রগতিশীল শক্তি, প্রতিবাদী কণ্ঠ ও শ্রমিকশ্রেণীর ওপর। সর্বপ্রথম (১৯২২ সালে) ইতালিতেই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার পর এর গোড়াপত্তন হয় জার্মানিতে (১৯৩৩)। ফ্যাসিবাদের দুই প্রধান মহানায়ক ছিলেন ইতালির বেনিতো মুসোলিনি এবং জার্মানির এডলফ্ হিটলার। তাই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ এবং সংশ্লিষ্ট দেশের আধাকাঁচড়া ও কমবেশি মুৎসুদ্দি চরিত্রসম্পন্ন পুঁজির স্বার্থকে রক্ষার করার উদ্দেশ্যে এবং শোষিত শ্রেণীর আন্দোলন ও ক্ষমতা দখলকে ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই অনুন্নত দেশসমূহের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীও ক্ষেত্রবিশেষে ফ্যাসিবাদের আশ্রয় নেয়। এ কাজে তারা প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে, বিশেষত সামরিক বাহিনীকে। বাংলাদেশ এখন তারই পদযাত্রী।
পৃথিবীতে একনায়কত্বের (Dictatorship) শাসন সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ শাসক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষ যখন শাসিতের মতামতের ধার না ধেরে একচ্ছত্রভাবে শাসনকাজ চালিয়ে যায়। সেখানে অনায়াসে জন্ম হয় একনায়কত্বের। বাংলাদেশের বিরোধীদল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো বরাবরই বলে আসছে, এখানে এখন গণতন্ত্রের লেবাসে এক ব্যক্তির (শেখ হাসিনার) শাসনই বিদ্যমান। রোমান প্রজাতন্ত্রের সময় থেকে এর উৎপত্তি হলেও এখন তা বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় ভর করেছে। একনায়কত্ব সর্বদাই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের একচ্ছত্র স্বার্থে প্রতিপক্ষের ওপর সার্বিক নিষ্পেষণ চালিয়ে দেয়। আর এর মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠে Authoritarianism বা Autocracy বা Despotism-ই হলো স্বৈরতন্ত্র, স্বৈরশাসনবাদ বা স্বেচ্ছাচারবাদ। স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্রের বিপরীত এবং প্রায়ই গণস্বার্থবিরোধী। আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে চিরনিন্দ্রায় শায়িত করে এখন স্বৈরতান্ত্রিক উন্নয়নের কথা বলছে। দেশের মানুষ গণতন্ত্রমুক্ত উন্নয়ন চায় না। এর মধ্য দিয়ে জনগণের ওপর সরকার এক ধরনের শ্বেতসন্ত্রাস White Terror পরিচালনা করছে। শোষক ও স্বৈরচারী শাসকগোষ্ঠী মুক্তিকামী বিপ্লবী বা গণআন্দোলনকে অবদমিত করার উদ্দেশ্যে যে বেপরোয়া নিষ্পেষণ নিপীড়নযজ্ঞ চালায়, পৃথিবীতে সেটাই শ্বেতসন্ত্রাস বলে খ্যাত। আওয়ামী লীগ এবার গদি রক্ষায় সকল ঘৃণ্য, অমানবিক পন্থারই আশ্রয় নিচ্ছে। যার কারণে বিশ্বের দরবারে দেশের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশ পশ্চিমা এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক ভয়াবহ খারপ পর্যায়ে নামিয়ে আনলো, যা এই জাতির জন্য খুবই বেদনাদায়ক।
আমাদের পাল্টাতে হবে বিভেদের রাজনীতি। গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্য। চিত্রাঙ্কন করতে হবে ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধশালী একটি বাংলাদেশের। আমাদের রাজনীতি এখন কলুষিত। আমাদের দেশের সংসদ এখন কারো গুণকীর্তন আর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগারের আড্ডা খানায় পরিণত হয়েছে। অথচ গরীবের টাকায় পরিচালিত এই সংসদ তাদের ভাগ্য-উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারছে। আজ আমাদের জাগতেই হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে দুর্বার প্রতিরোধ। কারণ তরুণ প্রজন্ম এবং জনগণ পরাজিত আর পরাভূত হতে জানে না। এ জাতি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, আর ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে নতি শিকার করেনি। এবারও করবে না, ইনশাআল্লাহ। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করার মধ্যেই দেশের উন্নতি নির্ভর করে।
ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন