বিজ্ঞানে বলে, Every action has its own equal and opposite reaction. অর্থাৎ প্রতিটি কাজেরই তার সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি করে বিএনপি’র মিটিং পণ্ড করে এবং ১২ টি বালুর ট্রাক, দুইটি শক্ত তালা এবং শত শত পুলিশ ও র্যাব দিয়ে বেগম জিয়াকে তার গুলশান অফিসে আটকিয়ে এবং পিপার স্প্রে মেরে আওয়ামী লীগ এই মর্মে হয়তো আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারে যে, তারা প্রথম রাউন্ডে বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যাবে যে, বেগম জিয়া তথা গণতান্ত্রিক শিবির ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে জনতার সর্মথন নিয়ে নৈতিক বিজয় লাভ করেছে। একজন নিরস্ত্র মহিলা কি কোন দিন সরকারের জল কামান এবং পুলিশ ও র্যাব’র বন্দুকের বিরুদ্ধে খালি হাতে লড়াই করতে পারেন? নাকি বেগম জিয়া সেই ধরনের লড়াই করতে চেয়েছিলেন? আমি বরং বলবো, এই রাউন্ডে বেগম জিয়া তথা জনতার জয় হয়েছে। সারা দেশের কোটি কোটি লোক ৫ তারিখে টেলিভিশনের পর্দায় আঠার মতো লেগেছিল। তারা দেখেছে, কি ন্যক্কারজনকভাবে, কি নগ্নভাবে সরকার তার নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। সরকারের এই জুলুমের স্টিম রোলার শুধু দেশবাসী নয়, বিদেশীরাও দেখেছেন। এবং দেখে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর দারুণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রের অসন্তোষ, বিরক্তি এবং ক্ষোভ এখন আর চাপা নেই। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে যে বিবৃতি জারি করেছে সেটি সম্মানিত পাঠক ভাইদের অবগতির জন্য হুবহু তুলে দিলাম- বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী একটি রাষ্ট্র বিধায় তারা বাংলাদেশে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক সহনশীলতা।
মার্কিন কংগ্রেসের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিরোধী দল মতের উপর তার সরকারি বাহিনী দিয়ে যে দমন-নিপীড়ন চালাচ্ছে এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান সরকার কর্তৃক বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে তালাবন্দীসহ তাঁর উপর অন্যায়ভাবে যেসব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন কংগ্রেস। আদালত কর্তৃক বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মিডিয়াগুলোর উপর বাংলাদেশ সরকার ও আদালত কর্তৃক অন্যায়ভাবে আরোপিত বিধি নিষেধে যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
পাশাপাশি বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল, সংবাদ মাধ্যম, এমনকি সোস্যাল মিডিয়ার উপর সরকারি খড়গ নেমে আসায় সে দেশের জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং সরকার কর্তৃক প্রতিপক্ষের উপর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চলার কারণে দেশটির টেকসই উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশটিতে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে এর অর্থনীতি, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পিছিয়ে যাবে। বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র কখনো কামনা করে না।
কংগ্রেসের বিবৃতিটির শেষভাগে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে চলমান সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে অতিদ্রুত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে যে সঠিক গণতন্ত্র বাংলাদেশের উত্তরণকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
মার্কিন কংগ্রেসের পক্ষে মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান এডওয়ার্ড আর রয়েস ও পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির উচ্চ পর্যায়ের অন্য পাঁচজন বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেন। মার্কিন কংগ্রেসের এ গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতির বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ উপদেষ্টা এবং বিএনপির বৈদেশিক দূত যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ড. মুজিবুর রহমান মজুমদার ও জাহিদ এফ সরদার সাদী জানান, ৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং ঐদিন দুপুর ২টা ২২ মিনিটে নিউ ইয়র্ক থেকে পুনঃনির্বাচিত কংগ্রেসম্যান জনাব হাকিম জেফরী বিষয়টি হাউজে উত্থাপন করেন।”
দুই
এর মধ্যে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। একটি হলো, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র সভাপতি অমিত শাহ্ বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক কুশালাদি জানতে চেয়ে বেগম জিয়াকে ফোন করেছেন। আরেকটি হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে যে গুরুতর রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে সেটি সমাধানের জন্য অবিলম্বে সংলাপ অনুষ্ঠান জরুরী বলে ব্রিটেন মন্তব্য করেছে। দেশের চলমান সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আবারো সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। একই সঙ্গে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও সংশ্লিষ্টদের জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বারিধারায় এনার্জিবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ হাইকমিশনার জানান, ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে সারা দেশে যে সহিংসতার সংস্কৃতি আবারো শুরু হয়েছে তা দেশের জন্য মোটেই কাম্য নয়। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ থেকে উত্তরণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নির্বাচনকে ঘিরে প্রতি পাঁচ বছর পর পর দেশে সহিংসতার রাজনীতি ফিরে আসে, সেটি এ দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। অন্যসব বন্ধু রাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনও বাংলাদেশের এ সংস্কৃতির বিলোপ চায়।
বিজেপি’র প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ্ বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেন বলে জানিয়েছেন তার (খালেদা জিয়া) প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে অবরুদ্ধ কার্যালয়ে কয়েকজন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেস সচিব বলেন, বিজেপি প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসনের আশু সুস্থতা কামনা করেন।
মারুফ কামাল খান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ভারতের জনতা পার্টির প্রধান অমিত শাহকে টেলিফোন করে তার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান। প্রেস সচিব বলেন, দেশ-বিদেশের আরো অনেকে টেলিফোন করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেন এবং এভাবে পুলিশের পিপার স্প্রে নিক্ষেপে উদ্বেগ প্রকাশ করে। প্রেস সচিব জানান, অসুস্থ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
বেগম জিয়াকে অন্তরীণ করা, সভায় যেতে না দেয়া, অফিসের দুইটি গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া, তাকে এবং মহিলা নেতৃবৃন্দকে লক্ষ্যে করে পিপার স্প্রে ছুড়ে মারা-প্রভৃতি জবরদস্তিমূলক এবং ন্যক্কারজনক কাজের মাধ্যেমে শেখ হাসিনা এক ভয়াবহ নজির সৃষ্টি করলেন। শুধু এবারেই নয়, অতীতেও তিনি এমন সব ভয়াবহ নজির সৃষ্টি করেছেন যেগুলো অতীতে এই উপমহাদেশে আর কেউ করেননি।
আজ হরতাল এবং অবরোধের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ তার স্বরে চিৎকার করে। অথচ এ দেশে হরতাল কালচারের স্রষ্টা খোদ আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সলে এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয়ে দেশে যখন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় তখন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। বেগম জিয়ার এই সময়েই আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওয়াজ তোলে। দাবী হাসিলের জন্য দুই বছরে, অর্থাৎ ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যে সব নাশকতামূলক এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করে তার একটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ান নিচে দেওয়া হলো:
১. ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ঢাকায় সচিবালয় ঘেরাও করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল। এ সময় সংঘর্ষে নিহত হয় ৩ জন।
২. ১০ এপ্রিল দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হয়।
৩. ২০ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ঢাকা অবরোধ করা হয়।
৪. ৯ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও করলে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে।
৫. ২৮ ডিসেম্বর বিরোধী দলীয় ১৪৭ জন সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।
৬. ২-৩-৪ জানুয়ারি ঢাকায় ৩ দিনব্যাপী হরতাল পালন করা হয়।
৭. ২৩ জানুয়ারি টিভি ভবন ঘেরাও করা হয়।
৮. একই দিন অর্থাৎ ২৩ জানুয়ারী অবরোধকালে আদমজীতে ১ জন নিহত হয়।
৯. ২৪ জানুয়ারি হোটেল সোনারগাঁওয়ে বিনিয়োগ সম্মেলন থেকে ফেরার পথে ফার্মগেটের কাছে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের গাড়ি লক্ষ্য করেও বোমা ছোঁড়া হয়।
১০. ১২ ফেব্রুয়ারি শ্রমিকদের ৯৬ ঘণ্টার হরতাল চলাকালে সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হয়।
১১. ১২ মার্চ ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করা হয়।
১২. ২৬ মার্চ ঢাকা অবরোধে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
১৩. ৯-১০ এপ্রিল সকাল-সন্ধ্যা দু’দিনের হরতাল পালিত হয়।
১৪. ২৭ আগস্ট আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশন অফিস ঘেরাও করলে সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়।
১৫. ২৯ আগস্ট দিনাজপুরে থানা ঘেরাও করা হলে প্রশাসন কারফিউ জারি করে।
১৬. ২ সেপ্টেম্বর ৩২ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল দেয়া হয়। এদিন হরতালের শেষের দিকে ঢাকার মিরপুরে সংঘর্ষে ১ জন রিকশাচালক নিহত হয়।
১৭. এর প্রতিবাদে পরদিন অর্থাৎ ৩রা সেপ্টেম্বর ঢাকায় অর্ধদিবস হরতাল ডাকা হয়।
১৮. ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, সংসদ বাতিল ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ৭২ ঘণ্টার হরতাল শুরু হয়।
১৯. ২-৩ অক্টোবর দেশজুড়ে হরতাল পালিত হয়।
২০. ৭ অক্টোবর পাঁচ বিভাগীয় শহরে ৩২ ঘণ্টার হরতাল পালন করা হয়।
২১. ১৬ থেকে ২০ অক্টোবর ৯৬ ঘণ্টাব্যাপী হরতাল ডাকা হয়।
২২. ৬ নভেম্বর সকাল-সন্ধ্যা সড়ক-রেল-নৌপথ অবরোধ করা হয়।
২৩. ২৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ডিসেম্বর মাসজুড়ে রাজধানীতে আওয়ামী লীগ কর্মীরা তা-ব চালায়।
২৪. ৪ ডিসেম্বর মীরপুরে একটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে ১১ জন যাত্রী পুড়ে কয়লা হয়ে যায়।
২৫. ৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বাস-কার-পিকআপসহ বহু গাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
২৬. ৯-১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবারো লাগাতার ৭২ ঘণ্টার হরতাল পালিত হয়।
২৭. ১৯৯৬ সালে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। ফেব্রুয়ারির ২৯ দিনের মধ্যে ২৩ দিনই রাজধানী অচল থাকে।
২৮. ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
২৯. ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনকালে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে।
৩০. ১৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, শুধুমাত্র ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের দিন হরতাল ও গণ কারফিউ কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত এবং আহত হয় ৬ শতাধিক মানুষ।
৩১. ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় দৈনিক দিনকাল অফিসে বোমা মেরে ও ভাংচুর করে ব্যাপক ক্ষতি করা হয়। নির্বাচন বাতিল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২৫-২৮ ফেব্রুয়ারি লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচি দেয়া হয়।
৩২. ৯ মার্চ থেকে লাগাতার অসহযোগ দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলে। ১৭ মার্চ চট্টগ্রামে তেলবাহী জাহাজে বোমা নিক্ষেপ করে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। অবশ্য সেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। তা না হলে পুরো বন্দর ভস্মীভূত হয়ে যেতো।
৩৩. ১৯৯৪-৯৬ সময়কালে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন দাবিতে বিরোধীদল আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, ২টি ৭২ ঘণ্টা এবং ৫টি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়।
৩৪. ১৯৯৬ সালের ৩ জানুয়ারি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এক জনসভায় বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভেবেছেন রোজার মাসে হরতাল হবে না। ইচ্ছেমতো ভোট চুরি করে একদলীয় নির্বাচন করিয়ে নেবেন। কিন্তু তিনি জানেন না রোজার মাসেও যুদ্ধ হয়েছিল।
৩৫. ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেখানেই নির্বাচনী সফরে গিয়েছিলেন সে জেলাতেই হরতাল ডাকা হয়েছিল। এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক ভাঙচুর, বোমাবাজি, ককটেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ এবং গোলাগুলীর ঘটনা ঘটে এবং সহিংসতায় নিহত হয় ৫০ জন মানুষ, আহত হয় সহস্রাধিক। এর ব্যাপ্তি ছিল সর্বনিম্ন ১২ ঘণ্টা থেকে এক নাগাড়ে ৯৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিস্তৃত।
৩৬. ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের হরতাল ও ২২ দিনের লাগাতার অবরোধে সারা দেশ শুধু অচলই হয়নি, ৩৭ জন লোক এ জন্য প্রাণও দেয়।
৩৭. ১৯৯৪ সাল থেকে কেয়ারটেকার আন্দোলনে নিহত হয় মোট ১২২ জন লোক এবং আহত হয় ৮ সহস্রাধিক।
৩৮. ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয় এবং ২৯ মার্চ প্রেসিডেন্ট এই বিলে স্বাক্ষর করেন। এর ঠিক ১০ বছর পর আওয়ামী লীগ আবার সেই হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করে। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হয়। ঐদিনই বেগম জিয়া বঙ্গভবনে যান এবং প্রেসিডেন্ট মরহুম ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের অনুরোধ করেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৮শে অক্টোবর সংবিধান মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের দায়িত্ব গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ২৮শে অক্টোবর থেকে ৩০শে অক্টোবর- এই ৩ দিন সারা দেশব্যাপী চরম নৈরাজ্য এবং হিংসাত্মক কর্মকা- চালায়। ২৮শে অক্টোবর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে অনুষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর সভায় লগি-বৈঠা নিয়ে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন সমূহ। ঐ হামলায় প্রকাশ্য দিবালোকে জামায়াত ও শিবিরের ৬ জন নেতা ও কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং লাশের ওপর পাশবিক উল্লাসে নৃত্য করে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রমৈত্রীর নেতৃবৃন্দ। পরের ২ দিনও সারা দেশে আওয়ামী লীগ হিংসাত্মক তা-ব চালায়। এই তা-বে ৩২ ব্যক্তি মারা যায়। এর মধ্যে ২৮শে অক্টোবর ১৪ জন, ২৯শে অক্টোবর ১৪ জন এবং ৩০শে অক্টোবর ৪ জন মারা যান। আজ যখন আওয়ামী লীগ শান্তির ললিত বাণী শোনাচ্ছে, তখন সেটি ভূতের মুখে রাম নামের মতো শোনা যাচ্ছে। এখন আওয়ামী লীগ শাসকের ভূমিকায় অধিষ্টিত। এবার তারা লেলিয়ে দিয়েছে পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি। পাখি শিকারের মতো গুলি করে তারা মানুষ মারছে। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ২৬৮ ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের এই রক্ত পিপাসার পরিণতি হলো তাদের জনপ্রিয়তায় বিপুল ধস। সেই ধস প্রতিফলিত হয়েছে ডেইলি স্টার এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের জরিপে। এই জরিপে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিএনপি সারা দেশে আওয়ামী লীগের চেয়ে ২৭ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে আছে।
মার্কিন কংগ্রেসের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিরোধী দল মতের উপর তার সরকারি বাহিনী দিয়ে যে দমন-নিপীড়ন চালাচ্ছে এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান সরকার কর্তৃক বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে তালাবন্দীসহ তাঁর উপর অন্যায়ভাবে যেসব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন কংগ্রেস। আদালত কর্তৃক বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মিডিয়াগুলোর উপর বাংলাদেশ সরকার ও আদালত কর্তৃক অন্যায়ভাবে আরোপিত বিধি নিষেধে যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
পাশাপাশি বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল, সংবাদ মাধ্যম, এমনকি সোস্যাল মিডিয়ার উপর সরকারি খড়গ নেমে আসায় সে দেশের জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং সরকার কর্তৃক প্রতিপক্ষের উপর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চলার কারণে দেশটির টেকসই উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশটিতে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে এর অর্থনীতি, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পিছিয়ে যাবে। বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র কখনো কামনা করে না।
কংগ্রেসের বিবৃতিটির শেষভাগে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে চলমান সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে অতিদ্রুত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে যে সঠিক গণতন্ত্র বাংলাদেশের উত্তরণকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
মার্কিন কংগ্রেসের পক্ষে মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান এডওয়ার্ড আর রয়েস ও পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির উচ্চ পর্যায়ের অন্য পাঁচজন বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেন। মার্কিন কংগ্রেসের এ গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতির বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ উপদেষ্টা এবং বিএনপির বৈদেশিক দূত যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ড. মুজিবুর রহমান মজুমদার ও জাহিদ এফ সরদার সাদী জানান, ৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং ঐদিন দুপুর ২টা ২২ মিনিটে নিউ ইয়র্ক থেকে পুনঃনির্বাচিত কংগ্রেসম্যান জনাব হাকিম জেফরী বিষয়টি হাউজে উত্থাপন করেন।”
দুই
এর মধ্যে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। একটি হলো, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র সভাপতি অমিত শাহ্ বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক কুশালাদি জানতে চেয়ে বেগম জিয়াকে ফোন করেছেন। আরেকটি হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে যে গুরুতর রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে সেটি সমাধানের জন্য অবিলম্বে সংলাপ অনুষ্ঠান জরুরী বলে ব্রিটেন মন্তব্য করেছে। দেশের চলমান সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আবারো সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। একই সঙ্গে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও সংশ্লিষ্টদের জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বারিধারায় এনার্জিবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ হাইকমিশনার জানান, ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে সারা দেশে যে সহিংসতার সংস্কৃতি আবারো শুরু হয়েছে তা দেশের জন্য মোটেই কাম্য নয়। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ থেকে উত্তরণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নির্বাচনকে ঘিরে প্রতি পাঁচ বছর পর পর দেশে সহিংসতার রাজনীতি ফিরে আসে, সেটি এ দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। অন্যসব বন্ধু রাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনও বাংলাদেশের এ সংস্কৃতির বিলোপ চায়।
বিজেপি’র প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ্ বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেন বলে জানিয়েছেন তার (খালেদা জিয়া) প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে অবরুদ্ধ কার্যালয়ে কয়েকজন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেস সচিব বলেন, বিজেপি প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসনের আশু সুস্থতা কামনা করেন।
মারুফ কামাল খান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ভারতের জনতা পার্টির প্রধান অমিত শাহকে টেলিফোন করে তার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান। প্রেস সচিব বলেন, দেশ-বিদেশের আরো অনেকে টেলিফোন করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেন এবং এভাবে পুলিশের পিপার স্প্রে নিক্ষেপে উদ্বেগ প্রকাশ করে। প্রেস সচিব জানান, অসুস্থ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
বেগম জিয়াকে অন্তরীণ করা, সভায় যেতে না দেয়া, অফিসের দুইটি গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া, তাকে এবং মহিলা নেতৃবৃন্দকে লক্ষ্যে করে পিপার স্প্রে ছুড়ে মারা-প্রভৃতি জবরদস্তিমূলক এবং ন্যক্কারজনক কাজের মাধ্যেমে শেখ হাসিনা এক ভয়াবহ নজির সৃষ্টি করলেন। শুধু এবারেই নয়, অতীতেও তিনি এমন সব ভয়াবহ নজির সৃষ্টি করেছেন যেগুলো অতীতে এই উপমহাদেশে আর কেউ করেননি।
আজ হরতাল এবং অবরোধের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ তার স্বরে চিৎকার করে। অথচ এ দেশে হরতাল কালচারের স্রষ্টা খোদ আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সলে এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয়ে দেশে যখন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় তখন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। বেগম জিয়ার এই সময়েই আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওয়াজ তোলে। দাবী হাসিলের জন্য দুই বছরে, অর্থাৎ ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যে সব নাশকতামূলক এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করে তার একটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ান নিচে দেওয়া হলো:
১. ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ঢাকায় সচিবালয় ঘেরাও করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল। এ সময় সংঘর্ষে নিহত হয় ৩ জন।
২. ১০ এপ্রিল দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হয়।
৩. ২০ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ঢাকা অবরোধ করা হয়।
৪. ৯ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও করলে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে।
৫. ২৮ ডিসেম্বর বিরোধী দলীয় ১৪৭ জন সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।
৬. ২-৩-৪ জানুয়ারি ঢাকায় ৩ দিনব্যাপী হরতাল পালন করা হয়।
৭. ২৩ জানুয়ারি টিভি ভবন ঘেরাও করা হয়।
৮. একই দিন অর্থাৎ ২৩ জানুয়ারী অবরোধকালে আদমজীতে ১ জন নিহত হয়।
৯. ২৪ জানুয়ারি হোটেল সোনারগাঁওয়ে বিনিয়োগ সম্মেলন থেকে ফেরার পথে ফার্মগেটের কাছে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের গাড়ি লক্ষ্য করেও বোমা ছোঁড়া হয়।
১০. ১২ ফেব্রুয়ারি শ্রমিকদের ৯৬ ঘণ্টার হরতাল চলাকালে সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হয়।
১১. ১২ মার্চ ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করা হয়।
১২. ২৬ মার্চ ঢাকা অবরোধে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
১৩. ৯-১০ এপ্রিল সকাল-সন্ধ্যা দু’দিনের হরতাল পালিত হয়।
১৪. ২৭ আগস্ট আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশন অফিস ঘেরাও করলে সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়।
১৫. ২৯ আগস্ট দিনাজপুরে থানা ঘেরাও করা হলে প্রশাসন কারফিউ জারি করে।
১৬. ২ সেপ্টেম্বর ৩২ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল দেয়া হয়। এদিন হরতালের শেষের দিকে ঢাকার মিরপুরে সংঘর্ষে ১ জন রিকশাচালক নিহত হয়।
১৭. এর প্রতিবাদে পরদিন অর্থাৎ ৩রা সেপ্টেম্বর ঢাকায় অর্ধদিবস হরতাল ডাকা হয়।
১৮. ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, সংসদ বাতিল ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ৭২ ঘণ্টার হরতাল শুরু হয়।
১৯. ২-৩ অক্টোবর দেশজুড়ে হরতাল পালিত হয়।
২০. ৭ অক্টোবর পাঁচ বিভাগীয় শহরে ৩২ ঘণ্টার হরতাল পালন করা হয়।
২১. ১৬ থেকে ২০ অক্টোবর ৯৬ ঘণ্টাব্যাপী হরতাল ডাকা হয়।
২২. ৬ নভেম্বর সকাল-সন্ধ্যা সড়ক-রেল-নৌপথ অবরোধ করা হয়।
২৩. ২৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ডিসেম্বর মাসজুড়ে রাজধানীতে আওয়ামী লীগ কর্মীরা তা-ব চালায়।
২৪. ৪ ডিসেম্বর মীরপুরে একটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে ১১ জন যাত্রী পুড়ে কয়লা হয়ে যায়।
২৫. ৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বাস-কার-পিকআপসহ বহু গাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
২৬. ৯-১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবারো লাগাতার ৭২ ঘণ্টার হরতাল পালিত হয়।
২৭. ১৯৯৬ সালে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। ফেব্রুয়ারির ২৯ দিনের মধ্যে ২৩ দিনই রাজধানী অচল থাকে।
২৮. ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
২৯. ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনকালে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে।
৩০. ১৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, শুধুমাত্র ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের দিন হরতাল ও গণ কারফিউ কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত এবং আহত হয় ৬ শতাধিক মানুষ।
৩১. ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় দৈনিক দিনকাল অফিসে বোমা মেরে ও ভাংচুর করে ব্যাপক ক্ষতি করা হয়। নির্বাচন বাতিল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২৫-২৮ ফেব্রুয়ারি লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচি দেয়া হয়।
৩২. ৯ মার্চ থেকে লাগাতার অসহযোগ দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলে। ১৭ মার্চ চট্টগ্রামে তেলবাহী জাহাজে বোমা নিক্ষেপ করে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। অবশ্য সেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। তা না হলে পুরো বন্দর ভস্মীভূত হয়ে যেতো।
৩৩. ১৯৯৪-৯৬ সময়কালে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন দাবিতে বিরোধীদল আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, ২টি ৭২ ঘণ্টা এবং ৫টি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়।
৩৪. ১৯৯৬ সালের ৩ জানুয়ারি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এক জনসভায় বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভেবেছেন রোজার মাসে হরতাল হবে না। ইচ্ছেমতো ভোট চুরি করে একদলীয় নির্বাচন করিয়ে নেবেন। কিন্তু তিনি জানেন না রোজার মাসেও যুদ্ধ হয়েছিল।
৩৫. ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেখানেই নির্বাচনী সফরে গিয়েছিলেন সে জেলাতেই হরতাল ডাকা হয়েছিল। এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক ভাঙচুর, বোমাবাজি, ককটেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ এবং গোলাগুলীর ঘটনা ঘটে এবং সহিংসতায় নিহত হয় ৫০ জন মানুষ, আহত হয় সহস্রাধিক। এর ব্যাপ্তি ছিল সর্বনিম্ন ১২ ঘণ্টা থেকে এক নাগাড়ে ৯৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিস্তৃত।
৩৬. ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের হরতাল ও ২২ দিনের লাগাতার অবরোধে সারা দেশ শুধু অচলই হয়নি, ৩৭ জন লোক এ জন্য প্রাণও দেয়।
৩৭. ১৯৯৪ সাল থেকে কেয়ারটেকার আন্দোলনে নিহত হয় মোট ১২২ জন লোক এবং আহত হয় ৮ সহস্রাধিক।
৩৮. ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয় এবং ২৯ মার্চ প্রেসিডেন্ট এই বিলে স্বাক্ষর করেন। এর ঠিক ১০ বছর পর আওয়ামী লীগ আবার সেই হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করে। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হয়। ঐদিনই বেগম জিয়া বঙ্গভবনে যান এবং প্রেসিডেন্ট মরহুম ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের অনুরোধ করেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৮শে অক্টোবর সংবিধান মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের দায়িত্ব গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ২৮শে অক্টোবর থেকে ৩০শে অক্টোবর- এই ৩ দিন সারা দেশব্যাপী চরম নৈরাজ্য এবং হিংসাত্মক কর্মকা- চালায়। ২৮শে অক্টোবর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে অনুষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর সভায় লগি-বৈঠা নিয়ে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন সমূহ। ঐ হামলায় প্রকাশ্য দিবালোকে জামায়াত ও শিবিরের ৬ জন নেতা ও কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং লাশের ওপর পাশবিক উল্লাসে নৃত্য করে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রমৈত্রীর নেতৃবৃন্দ। পরের ২ দিনও সারা দেশে আওয়ামী লীগ হিংসাত্মক তা-ব চালায়। এই তা-বে ৩২ ব্যক্তি মারা যায়। এর মধ্যে ২৮শে অক্টোবর ১৪ জন, ২৯শে অক্টোবর ১৪ জন এবং ৩০শে অক্টোবর ৪ জন মারা যান। আজ যখন আওয়ামী লীগ শান্তির ললিত বাণী শোনাচ্ছে, তখন সেটি ভূতের মুখে রাম নামের মতো শোনা যাচ্ছে। এখন আওয়ামী লীগ শাসকের ভূমিকায় অধিষ্টিত। এবার তারা লেলিয়ে দিয়েছে পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি। পাখি শিকারের মতো গুলি করে তারা মানুষ মারছে। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ২৬৮ ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের এই রক্ত পিপাসার পরিণতি হলো তাদের জনপ্রিয়তায় বিপুল ধস। সেই ধস প্রতিফলিত হয়েছে ডেইলি স্টার এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের জরিপে। এই জরিপে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিএনপি সারা দেশে আওয়ামী লীগের চেয়ে ২৭ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে আছে।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন