বৃহস্পতিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৫

বিদেশীদের উদ্বেগ


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য তাগিদ দিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের ওপর সশস্ত্র হামলার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। এই হামলায় স্তম্ভিত ও মর্মাহত জানিয়ে হামলাকারীদের অবিলম্বে সনাক্ত করে বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি দেয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর প্রতিক্রিয়া এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে। দেশগুলোর ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজেদের উদ্বেগের কথাই শুধু জানাননি, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংলাপ শুরু করার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর দেয়া এক বিবৃতিতে ইইউ বলেছে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ কোনোভাবেই সভা-সমাবেশ, আন্দোলন এবং বাকস্বাধীনতার অধিকারের বিনিময়ে হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে ‘গণতান্ত্রিক স্পেস সংকুচিত হয়ে যাওয়ায়’ ইইউভুক্ত দেশগুলোর মিশন প্রধানরা যে শংকিত- বিবৃতিতে তারও উল্লেখ রয়েছে। ওদিকে ব্রিটেনের হাইকমিশনার পৃথক এক বিবৃতিতে বলেছেন, সহিংসতা এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সংলাপে বসা। তিনি আরো বলেছেন, ব্রিটেন চায় সংযম ও আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বাংলাদেশে পরিমিতিবোধের চর্চা করা হোক।
রিয়াজ রহমান গুলীবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও সংস্থার পক্ষ থেকে। বিবৃতিগুলোর মূল কথায় দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগের প্রকাশই শুধু ঘটেনি একযোগে এসেছে সংলাপে বসার সুনির্দিষ্ট পরামর্শ ও তাগিদও। বলা দরকার, সবই এসেছে অতীতের ধারাবাহিকতায়। স্মরণ করলে দেখা যাবে, গত বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রাক্কালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাতিসংঘ, ইইউ এবং কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়েছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব তার বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দু’বার ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালও। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সে সময়ের বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং দু’জনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছিলেন। বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার ঢাকায় নিযুক্ত দূত ও প্রতিনিধিরা বিশেষ করে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রধান দলগুলো অংশ না নিলে তেমন কোনো নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বাস্তবেও একমাত্র ভারতের কংগ্রেস সরকার ছাড়া অন্য কোনো দেশের সরকারই শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানায়নি যার অর্থ, স্বীকৃতি দেয়নি। উল্লেখ্য, সে সময় সব দেশ ও সংস্থাই সংলাপ ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জোর তাগিদ দিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারো কথাই শোনেননি। তিনি বরং এমন এক নির্বাচনের পথে পা বাড়িয়েছিলেন, যে নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটারও ভোট দিতে যাননি এবং যে নির্বাচনে ১৫৩ জনই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন।
বর্তমান সংকটের শুরুটাও হয়েছিল সেখান থেকেই। তা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়া যথেষ্ট সংযম দেখিয়ে এসেছেন। ব্রিটেনের হাই কমিশনার যে পরিমিতিবোধের কথা বলেছেন, তারও নজীর স্থাপন করেছে ২০ দলীয় জোটই। অন্যদিকে সরকার এগিয়েছে ফ্যাসিবাদী কৌশল নিয়ে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ওপর নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন চালানোর এবং পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে দলীয় গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের দিয়ে মানুষ হত্যার কারণে সরকার যে কার্যত সঙ্গিহীন হয়ে পড়েছে তারই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার প্রতিক্রিয়ায়। আপত্তি ও উদ্বেগের কারণ হলো, এ ধরনের পরিস্থিতিতে উচিত যেখানে ছিল সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও সব দলকে নিয়ে নতুন একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করাসহ গণতন্ত্রসম্মত পথে পা বাড়ানো সরকার সেখানে উল্টো পথে এগিয়ে চলেছে। সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমনকি বেগম জিয়ার মতো প্রধান জাতীয় নেত্রীও। বলা বাহুল্য, এমন নীতি ও কর্মকাণ্ডের পরিণতি সব সময় অশুভ হয়ে থাকে বলেই সরকারকেও বিচ্ছিন্ন ও সঙ্গিহীন হয়ে পড়তে হয়েছে। আমরা মনে করি, সরকারের জন্য এখনো সময় ও সুযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারেও পথের নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন বেগম খালেদা জিয়া। গত ৩১ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে তিনি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মেনে নেয়ার এবং সে সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সাত দফা পেশ করে যে আহ্বান জানিয়েছেন সে আহ্বানে সাড়া দিলেই কেবল সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। এজন্য প্রথমে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বিদ্যমান জাতীয় সংসদের বিলুপ্তি ঘটাতে হবে, মন্ত্রিসভা তথা সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে এবং ২০ দলীয় জোটের  সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। সুষ্ঠু, গণতন্ত্রসম্মত ও সম্ভাবনাময় এ পথটিতে পা বাড়ানোর জন্যই আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানাই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads