বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নেত্রী, একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে শোক নতুন নয়। সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করার ঘটনাও কম নয়। শোক, দুঃখ, বেদনা কখনো কখনো বিপুল শক্তিতে পরিণত হয়, এই প্রমাণ বার বার দিয়েছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ব্যক্তিগত শোকের যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে জাতীয় জীবনে শক্তি সঞ্চারিত করার উদাহরণ তিনি।
১৯৮১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ও স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিপথগামী-ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হলে কেবল জিয়া পরিবার বা বেগম খালেদা জিয়াই নন, পুরো দেশই আক্রান্ত হয় গণতন্ত্র লুণ্ঠনকারীদের দ্বারা। গণঅধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়। সেই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে একাকী, বেদনার্ত, নিঃসঙ্গ বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতে রূপান্তরিত করে গণতন্ত্রের আন্দোলন সফল করেন। শোকার্ত বেগম খালেদা জিয়া অক্লান্ত লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠা করে বিজয়ের হাসি হাসেন।
আবার ১/১১-এর সময় কুচক্রী মহল জিয়া পরিবারকে শুধু শারীরিকভাবে আক্রমণই করেনি; সব কিছু তছনছ করে দেয়। জিয়া পরিবারের উত্তরসুরী তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকে আহত ও ক্ষত-বিক্ষত করে। তাদেরকে দেশ-ছাড়া করে। কিন্তু সেই বেদনার সময়ও বেগম খালেদা জিয়া নিঃশঙ্ক চিত্তে জনতার পাশে হিমালয়ের মতো অটলভাবে উপস্থিত ছিলেন। অনেকেই তখন কুচক্রীদের দোসর ও দালাল হয়ে ক্ষমতার বাটোয়ারায় অংশ নেয়। কুচক্রীদের হালুয়া-রুটিতে উদর পূর্ণ করে। কিন্তু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত-পারিবারিক ক্ষতি মেনে নিলেও জাতীয় ক্ষতি মেনে নেননি। অসৎ চক্রের সঙ্গে কোনো আপোস না করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যেতেই থাকেন। সেই ধারাবাহিকতায় স্বচ্ছ নির্বাচন আর জনঅংশগ্রহণমূলক ভোটের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র, আইনের শাসন আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামরত অবস্থায় দেশ অবরুদ্ধ আর তিনি নিজেও যখন সাহসিক প্রত্যয়ে আন্দোলনের নেতৃত্বরত, তখন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বিদেশের মাটিতে নিঃসঙ্গ ও চিকিৎসারত আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যু বরণ করেন। জীবনের প্রতিটি পরীক্ষা ও সন্ধিক্ষণের মতো এবারও তিনি ব্যক্তিগত শোকের কষ্ট চেপে রেখে জনগণের দাবি ও অধিকার রক্ষার মহান লড়াইকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের শোককে তিনি পরিণত করেছেন জাতীয় প্রতিরোধের শক্তিতে।
অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, একজন জাতীয় নেত্রীর পুত্রশোক ও ব্যক্তিগত বেদনার চরম সময়েও চালবাজির এমন নোংরা রাজনীতি করা হলো যার উল্লেখ করাও সমীচীন নয়। দেশবাসী সেইসব চিত্রাবলি উভয় পক্ষের বক্তব্য, টিভি ফুটেজ ও ঘটনা পরম্পরার মাধ্যমে অবহিত হয়েছেন। একজন জাতীয় নেত্রীর ব্যক্তিগত শোক এবং বিপদগ্রস্ত দেশবাসীর গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরে পাবার চূড়ান্ত লড়াই সফল করার আন্দোলনের চরম সময়ে এ ধরনের বিষয় আলোচনা করাও কাম্য নয়।
এ কথা সকলের জানা যে, ২০ দলীয় জোটের পক্ষে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করা বিএনপি চেয়ারপারসন ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পান সেখানে বসেই। দুপুরের পর পরিবারের সদস্যরা তাকে ছেলের মৃত্যু-সংবাদ দেন। এ খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে ছেলের শোকে মুহ্যমান খালেদা একান্তে নিজ কক্ষে অবস্থান করেন। রাতে খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস জানান, শোকে বিহ্বল খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
মা ও বড় ভাই রাজনীতিতে থাকলেও আরাফাত রহমান কোকো ছিলেন রাজনীতির আড়ালে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উপদেষ্টা করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই বছর ৩রা সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাসের বাড়ি থেকে আরাফাত রহমান কোকোকে আটক করা হয়। ২০০৭ সালের ১৭ই জুলাই কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলী রহমান সিঁথি, দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যান কোকো। এরপর থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়ায় চলে যান তিনি। দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ার একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। বিএনপি ও পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয় অসুস্থ থাকায় তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই কোকোর বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের একটিসহ মোট পাঁচটি মামলা হয়েছিল। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর কোকোর প্যারোলের মুক্তির সময়সীমা আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ২০১১ সালের ৩রা জুন মুদ্রা পাচারের মামলার রায়ে কোকোকে ৬ বছরের কারাদন্ড দেয় বিচারিক আদালত। সেই সঙ্গে ১৯ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অসুস্থ অবস্থায় জামিনে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করলেও বর্তমান সরকার জামিনের মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ায় পলাতক হিসেবে বিবেচিত হন তিনি। পলাতক দেখিয়েই তার বিচার এবং সাজার রায় হওয়ায় আপিলের সুযোগ পাননি তিনি। এভাবেই একদা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র আরাফাত রহমান কোকো নীরবে, নিঃসঙ্গ ও অসুস্থ অবস্থায় স্বদেশের প্রিয় মৃত্তিকা থেকে বহুদূরের প্রবাসের বিরূপ পরিস্থিতিতে মৃত্যুর শীতল কোলে ঢলে পড়েন। চিরদিনের জন্য চলে যান না ফেরার দেশে।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, দলীয় চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর জন্য নয়া পল্টনের কার্যালয়ে মিলাদ পড়তে চাইলেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে। বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিলের জন্য কার্যালয়ের নিচতলায় অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু পল্টন মডেল থানা পুলিশ বলেছে, অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়। মিলাদের অনুমতি না দেয়া নিয়ে বিএনপির অভিযোগের পর এই বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি, একেক জন অন্যজনকে দেখিয়ে দেন। গত ৩ জানুয়ারি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পুলিশ তুলে নেয়ার পর সেখানে পুলিশ তালা লাগিয়ে দেয়। ওই রাতে বের হতে বাধা পাওয়ার পর খালেদা জিয়াও গুলশানে তার কার্যালয়ে রয়েছেন। অবরুদ্ধ অবস্থা থেকেই সারাদেশে লাগাতার অবরোধ ডাকেন তিনি। পরে কার্যালয় ঘিরে থাকা পুলিশ সরানো হলেও বিএনপি চেয়ারপারসন এক প্রকার অবরুদ্ধই আছেন। অবশেষে বিকাল থেকে গুলশানের কার্যালয়ে পাশের একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া-কালামের মাধ্যমে আরাফাত রহমানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করেন।
রাত সাড়ে ১১টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়া মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে আছেন। তিনি শোকার্ত ও অসুস্থ। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। ‘ঘুম থেকে জেগে’ যখন তিনি জানলেন প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন, তখন তিনি তাঁকে আসার জন্য ধন্যবাদ জানান। মারুফ কামাল খান বলেন, খালেদা জিয়া তাঁদের বলেছেন- এরপর যখনই প্রধানমন্ত্রী আসতে চাইবেন তখনই তাঁকে স্বাগত জানানো হবে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রীর স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুতে খালেদা জিয়া সমবেদনা জানাতে ছুটে গিয়েছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া জীবনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক নির্যাতন, বিপদ নতুন নয়। ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা নিহত হন তাঁর স্বামী। বার বার তিনি আক্রান্ত হন গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তির দ্বারা। তাঁকে দীর্ঘ জীবনের স্মৃতি বিজড়িত বাসভবন থেকে নির্মমভাবে উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করা হয়। তাঁর পরিবার-পরিজনকে তছনছ করে দেয়া হয়। তাঁর দুইটি মাত্র পুত্রকে দেশছাড়াও করা হয়। একের পর এক মামলায় একাধিক বারের একজন সফল সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নাজেহালও করা হয়। বছরের পর বছর তাঁকে তাঁর পুত্রদ্বয় ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবু গণতন্ত্রের আপোসহীন নেত্রী, জাতীয় সাহসের প্রতীক, ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনাকে জয়-করা ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া নিজের শোকের জন্য জাতীয় স্বার্থের আন্দোলনকে জলাঞ্জলী দেন নি। ব্যক্তিগত বেদনাকে বুকে চেপে তিনি জাতীয় স্বার্থের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের ইতিহাসে এমন ধৈর্য্য, ত্যাগ, সাহস ও প্রত্যয় অনেক নেতাই দেখাতে পারেন নি। বেগম খালেদা জিয়া নিজের ব্যক্তিগত শোককে বরং জাতীয় প্রতিরোধের শক্তিতে পরিণত করেছেন। এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অনমনীয়তা, আপোসহীনতা ও সাহসের জন্য তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত জনআন্দোলন সফলতার মোহনা স্পর্শ করবেই। ব্যক্তিগত শোকে নিঃসঙ্গ বেগম খালেদা জিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা। অতীতের মতো এবারও তিনি জনতার সংগ্রামকে সকল বাধা-বিঘ্ন-বেদনা অতিক্রম করে সফল করবেন।
১৯৮১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ও স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিপথগামী-ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হলে কেবল জিয়া পরিবার বা বেগম খালেদা জিয়াই নন, পুরো দেশই আক্রান্ত হয় গণতন্ত্র লুণ্ঠনকারীদের দ্বারা। গণঅধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়। সেই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে একাকী, বেদনার্ত, নিঃসঙ্গ বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতে রূপান্তরিত করে গণতন্ত্রের আন্দোলন সফল করেন। শোকার্ত বেগম খালেদা জিয়া অক্লান্ত লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠা করে বিজয়ের হাসি হাসেন।
আবার ১/১১-এর সময় কুচক্রী মহল জিয়া পরিবারকে শুধু শারীরিকভাবে আক্রমণই করেনি; সব কিছু তছনছ করে দেয়। জিয়া পরিবারের উত্তরসুরী তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকে আহত ও ক্ষত-বিক্ষত করে। তাদেরকে দেশ-ছাড়া করে। কিন্তু সেই বেদনার সময়ও বেগম খালেদা জিয়া নিঃশঙ্ক চিত্তে জনতার পাশে হিমালয়ের মতো অটলভাবে উপস্থিত ছিলেন। অনেকেই তখন কুচক্রীদের দোসর ও দালাল হয়ে ক্ষমতার বাটোয়ারায় অংশ নেয়। কুচক্রীদের হালুয়া-রুটিতে উদর পূর্ণ করে। কিন্তু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত-পারিবারিক ক্ষতি মেনে নিলেও জাতীয় ক্ষতি মেনে নেননি। অসৎ চক্রের সঙ্গে কোনো আপোস না করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যেতেই থাকেন। সেই ধারাবাহিকতায় স্বচ্ছ নির্বাচন আর জনঅংশগ্রহণমূলক ভোটের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র, আইনের শাসন আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামরত অবস্থায় দেশ অবরুদ্ধ আর তিনি নিজেও যখন সাহসিক প্রত্যয়ে আন্দোলনের নেতৃত্বরত, তখন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বিদেশের মাটিতে নিঃসঙ্গ ও চিকিৎসারত আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যু বরণ করেন। জীবনের প্রতিটি পরীক্ষা ও সন্ধিক্ষণের মতো এবারও তিনি ব্যক্তিগত শোকের কষ্ট চেপে রেখে জনগণের দাবি ও অধিকার রক্ষার মহান লড়াইকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের শোককে তিনি পরিণত করেছেন জাতীয় প্রতিরোধের শক্তিতে।
অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, একজন জাতীয় নেত্রীর পুত্রশোক ও ব্যক্তিগত বেদনার চরম সময়েও চালবাজির এমন নোংরা রাজনীতি করা হলো যার উল্লেখ করাও সমীচীন নয়। দেশবাসী সেইসব চিত্রাবলি উভয় পক্ষের বক্তব্য, টিভি ফুটেজ ও ঘটনা পরম্পরার মাধ্যমে অবহিত হয়েছেন। একজন জাতীয় নেত্রীর ব্যক্তিগত শোক এবং বিপদগ্রস্ত দেশবাসীর গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরে পাবার চূড়ান্ত লড়াই সফল করার আন্দোলনের চরম সময়ে এ ধরনের বিষয় আলোচনা করাও কাম্য নয়।
এ কথা সকলের জানা যে, ২০ দলীয় জোটের পক্ষে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করা বিএনপি চেয়ারপারসন ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পান সেখানে বসেই। দুপুরের পর পরিবারের সদস্যরা তাকে ছেলের মৃত্যু-সংবাদ দেন। এ খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে ছেলের শোকে মুহ্যমান খালেদা একান্তে নিজ কক্ষে অবস্থান করেন। রাতে খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস জানান, শোকে বিহ্বল খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
মা ও বড় ভাই রাজনীতিতে থাকলেও আরাফাত রহমান কোকো ছিলেন রাজনীতির আড়ালে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উপদেষ্টা করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই বছর ৩রা সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাসের বাড়ি থেকে আরাফাত রহমান কোকোকে আটক করা হয়। ২০০৭ সালের ১৭ই জুলাই কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলী রহমান সিঁথি, দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যান কোকো। এরপর থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়ায় চলে যান তিনি। দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ার একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। বিএনপি ও পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয় অসুস্থ থাকায় তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই কোকোর বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের একটিসহ মোট পাঁচটি মামলা হয়েছিল। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর কোকোর প্যারোলের মুক্তির সময়সীমা আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ২০১১ সালের ৩রা জুন মুদ্রা পাচারের মামলার রায়ে কোকোকে ৬ বছরের কারাদন্ড দেয় বিচারিক আদালত। সেই সঙ্গে ১৯ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অসুস্থ অবস্থায় জামিনে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করলেও বর্তমান সরকার জামিনের মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ায় পলাতক হিসেবে বিবেচিত হন তিনি। পলাতক দেখিয়েই তার বিচার এবং সাজার রায় হওয়ায় আপিলের সুযোগ পাননি তিনি। এভাবেই একদা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র আরাফাত রহমান কোকো নীরবে, নিঃসঙ্গ ও অসুস্থ অবস্থায় স্বদেশের প্রিয় মৃত্তিকা থেকে বহুদূরের প্রবাসের বিরূপ পরিস্থিতিতে মৃত্যুর শীতল কোলে ঢলে পড়েন। চিরদিনের জন্য চলে যান না ফেরার দেশে।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, দলীয় চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর জন্য নয়া পল্টনের কার্যালয়ে মিলাদ পড়তে চাইলেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে। বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিলের জন্য কার্যালয়ের নিচতলায় অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু পল্টন মডেল থানা পুলিশ বলেছে, অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়। মিলাদের অনুমতি না দেয়া নিয়ে বিএনপির অভিযোগের পর এই বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি, একেক জন অন্যজনকে দেখিয়ে দেন। গত ৩ জানুয়ারি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পুলিশ তুলে নেয়ার পর সেখানে পুলিশ তালা লাগিয়ে দেয়। ওই রাতে বের হতে বাধা পাওয়ার পর খালেদা জিয়াও গুলশানে তার কার্যালয়ে রয়েছেন। অবরুদ্ধ অবস্থা থেকেই সারাদেশে লাগাতার অবরোধ ডাকেন তিনি। পরে কার্যালয় ঘিরে থাকা পুলিশ সরানো হলেও বিএনপি চেয়ারপারসন এক প্রকার অবরুদ্ধই আছেন। অবশেষে বিকাল থেকে গুলশানের কার্যালয়ে পাশের একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া-কালামের মাধ্যমে আরাফাত রহমানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করেন।
রাত সাড়ে ১১টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়া মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে আছেন। তিনি শোকার্ত ও অসুস্থ। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। ‘ঘুম থেকে জেগে’ যখন তিনি জানলেন প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন, তখন তিনি তাঁকে আসার জন্য ধন্যবাদ জানান। মারুফ কামাল খান বলেন, খালেদা জিয়া তাঁদের বলেছেন- এরপর যখনই প্রধানমন্ত্রী আসতে চাইবেন তখনই তাঁকে স্বাগত জানানো হবে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রীর স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুতে খালেদা জিয়া সমবেদনা জানাতে ছুটে গিয়েছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া জীবনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক নির্যাতন, বিপদ নতুন নয়। ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা নিহত হন তাঁর স্বামী। বার বার তিনি আক্রান্ত হন গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তির দ্বারা। তাঁকে দীর্ঘ জীবনের স্মৃতি বিজড়িত বাসভবন থেকে নির্মমভাবে উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করা হয়। তাঁর পরিবার-পরিজনকে তছনছ করে দেয়া হয়। তাঁর দুইটি মাত্র পুত্রকে দেশছাড়াও করা হয়। একের পর এক মামলায় একাধিক বারের একজন সফল সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নাজেহালও করা হয়। বছরের পর বছর তাঁকে তাঁর পুত্রদ্বয় ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবু গণতন্ত্রের আপোসহীন নেত্রী, জাতীয় সাহসের প্রতীক, ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনাকে জয়-করা ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া নিজের শোকের জন্য জাতীয় স্বার্থের আন্দোলনকে জলাঞ্জলী দেন নি। ব্যক্তিগত বেদনাকে বুকে চেপে তিনি জাতীয় স্বার্থের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের ইতিহাসে এমন ধৈর্য্য, ত্যাগ, সাহস ও প্রত্যয় অনেক নেতাই দেখাতে পারেন নি। বেগম খালেদা জিয়া নিজের ব্যক্তিগত শোককে বরং জাতীয় প্রতিরোধের শক্তিতে পরিণত করেছেন। এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অনমনীয়তা, আপোসহীনতা ও সাহসের জন্য তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত জনআন্দোলন সফলতার মোহনা স্পর্শ করবেই। ব্যক্তিগত শোকে নিঃসঙ্গ বেগম খালেদা জিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা। অতীতের মতো এবারও তিনি জনতার সংগ্রামকে সকল বাধা-বিঘ্ন-বেদনা অতিক্রম করে সফল করবেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন