মঙ্গলবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৫

নাটক করছেন খালেদা জিয়া?


এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে, কি ঘটছে বাংলাদেশে জানিনা। অথবা স্বঘোষিত অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলতে পারেন, কই, কিছুই তো ঘটল না। আপনারা এত রং-ঢং করলেন কেন? ভাষাটাও হুবহু এরকমই হতে পারে। কারণ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া দারুণ এক অভিনেত্রী। তিনি গ্রেফতার বা অবরুদ্ধের অভিনয় করছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা যা দেখলাম, তাতে প্রমাণিত হয় যে, খালেদা জিয়া কোনো অভিনয় করছেন না, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সত্য নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একেবারেই মুক্ত। তিনি যখন খুশি গুলশানে তার রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে বের হয়ে যেখানে খুশি যেতে পারেন।
কিন্তু খালেদা জিয়া যাতে তার গুলশানস্থ কার্যালয় থেকে বের না হতে পারেন, সেজন্য  তার অফিসের ফটকে তালা  ঝুলানো হয়েছে। তার কার্যালয়ের সড়কের মুখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার অফিসের আশপাশের চতুর্দিকের সড়ক বন্ধ করে দিয়ে প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এক অসহনীয় অবস্থা সৃষ্টি করেছে সরকার। তার অফিসে ঢোকার মুখে মূল সড়কের সামনে ইটভর্তি ও বালুভর্তি ট্রাক দিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। ঐসব ট্রাকের ড্রাইভাররা জানিয়েছেন, বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশ তাদের গতিরোধ করে বেগম খালেদা জিয়ার অফিসে নিয়ে আসে। কোনোটা বালুভর্তি ট্রাক। কোনোটা ইটভর্তি ট্রাক। ঐ চালক-হেলপারদের বলা হয়, তাদের এখানেই থাকতে হবে, কারণ এটাই হবে তাদের ডিউটির জায়গা। ঐসব ট্রাক ড্রাইভার হাজার হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে চলেন না। পুলিশ তাদের খাওয়া-দাওয়াও দিচ্ছে না। তাদের কোনো টাকা পয়সাও দিচ্ছে না। তারা হয়তো অভুক্ত অনাহারে দিনযাপন করছেন। এই ভয়ঙ্কর সরকারের সেদিকে কোনো দৃষ্টি নেই। এমনকি তারা অকারণে গ্রেফতারকৃত সন্দেহভাজনদের ১২-২০ ঘণ্টায়ও কোনো খাবার সরবরাহ করেনি তারা।
প্রথম নিষ্ঠুরতা হলো, বিনা অভিযোগে গ্রেফতার। ধরা যাক, আমি রাস্তায় বের হয়েছি। পুলিশ আমাকে ধরল এবং বলল, আপনি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার হলেন। কিংবা কিছুই বলল না। আমার ওপর নানাভাবে নির্যাতন শুরু হলো। কিন্তু আমার প্রতিকার কী? আমি একজন কলমজীবী সাধারণ সাংবাদিক। আমি কোথায় যাবো, কার কাছে প্রতিকার চাইবো, কার কাছে বলবো যে, আমি সন্ত্রাস কিংবা অন্য কোনো ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নই। এমনকি দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের যে আমার পক্ষে নিয়োগ করবো, সেরকম অর্থনৈতিক সামর্থও আমার নেই। তাহলে আমার মতো একজন নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে সমাজে কীভাবে টিকে থাকা সম্ভব?
এই উদাহরণটা শুধু আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সরকার যে উন্মত্ত গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে, কারো কোনো টুঁ শব্দটি করারও ক্ষমতা নেই। এদেশের ষোলো কোটি মানুষই এখন এভাবেই এক ফ্যাসিবাদী সরকারের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে। কিন্তু দুই লাখ পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব দিয়ে কী ষোলো কোটি লোকের মুখ বন্ধ করে দেয়া যাবে? দেয়া যে যাবে না, সে প্রমাণ আমরা পেলাম গত ৫ জানুয়ারিতে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশদলীয় জোট ৫ জানুয়ারি সারা দেশে অবরোধের ডাক দেয়। এই ডাকে সরকার এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে যে, তারা সারা দেশে এক যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করেছিল, ডান্ডা মেরে সকল ভাষা ঠান্ডা করে  দেবে। কিন্তু দেশব্যাপী ভিন্ন চিত্র দেখলাম। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দেশের সকল জায়গায় এমন সব হানাহানির পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো যে, এই কর্মসূচি সংঘাতে রূপ নিল। নাটোরে দুই, রাজশাহীতে এক, চাঁপাইয়ে একজনের প্রাণ কেড়ে নিল সরকারের পুলিশ বাহিনী। পুলিশকে এখন আর পুলিশ বলে মনে হয় না। তাদের মনে হয় আওয়ামী ঘাতক বাহিনী।
কিন্তু আওয়ামী লীগ কোনো অবস্থাতেই চিরস্থায়ী কোনো সরকার ব্যবস্থা নয়। এই পুলিশকে ভিন্ন কোনো সরকার এলেও চাকরি চালিয়ে যেতে হবে। এরা খুব সম্পন্ন ঘরের লোক নন। এরা সাধারণ মানুষ। অপহরণ প্রভৃতি ঘটনার সঙ্গে তারা ধারাবাহিকভাবে জড়িয়ে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে এই কারণে যে, সরকার তাদের বিরোধী দল দমনে নানাভাবে ব্যবহার করছে।
একদিকে সরকার বলছে বেগম খালেদা জিয়াকে আটক বা অন্তরীণ করা হয়নি। তিনি একেবারে মুক্ত। অপরদিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, খালেদা জিয়া আটক নেই। তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্যই তাকে পুলিশ বেষ্টনীর ভেতর রাখা হয়েছে এবং যতদিন প্রয়োজন হবে ততদিন তাকে পুলিশ বেষ্টনীতে রাখা হবে। আবারো একটি আপেক্ষিক কথা বললেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। ‘যতদিন প্রয়োজন হবে’ কথাটির মানে কী? খালেদা জিয়া নিজে বুঝতে পারছেন না যে, তার নিরাপত্তা প্রয়োজন। কিন্তু জন্মান্ধ এই সরকার বুঝে গেছে, খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা অত্যন্ত জরুরি।
যেখানে দেশের শত শত মানুষ প্রতিদিন থানায় নিজেদের নিরাপত্তার জন্য শ’য়ে শ’য়ে জিডি করেন এবং এক্ষেত্রে পুলিশ নির্বিকার থাকে, সন্ত্রস্ত জিডিকারী মানুষের আশঙ্কা অনুযায়ী খুনও হয়ে যান। তখনও পুলিশকে নির্বিকারই দেখি। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া নিজেও চকবাজারে তার আদালতে হাজিরার দিন যে ঘটনা ঘটেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে চকবাজার থানায় একটি জিডি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু থানা সে জিডি গ্রহণ করেনি। হঠাৎ তার নিরাপত্তা বিষয়ে সরকারের মাসীর মতো দরদ যে কেন উথলে উঠল- বোঝা যাচ্ছে না।
বেগম খালেদা জিয়ার গত ৫ জানুয়ারি ঠিকই তার কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার বাসভবনের প্রতিটি গেটেই তালা লাগিয়ে দেয় পুলিশ। পুলিশ, র‌্যাব প্রভৃতি বাহিনী দিয়ে ৯ স্তরের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। খালেদা জিয়ার অফিসের প্রবেশপথে ঢুকতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সে এক ভয়াবহ পরিবেশ। সে পথে যারাই গিয়েছেন তারা বুঝেছেন, এ যেন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি। এ যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে সেটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু ক্রমেই স্পষ্ট হলো, এ যুদ্ধ সরকারের ছায়ার বিরুদ্ধে। সরকার নিজের বিরুদ্ধে যেন নিজেই যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছে।
এটা কোনো সভ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা হতে পারে না যে একজন মানুষকে সরকার বাইরে থেকে তালা মেরে হাজার হাজার পুলিশ নিয়োগ করে পিপার স্প্রে ছড়িয়ে তার অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখবে। সেভাবেই চার রাত ধরে নিজের রাজনৈতিক অফিসে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এভাবে আটকে রেখে সরকার অট্টহাসি হাসছে।
সরকার হয়তো ভেবেছিল, এর প্রতিক্রিয়ায় কোথায়ও বোধ করি কুটোটিও নড়বে না। কিন্তু সে দুরাশা বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা দেখেছি, ৫ জানুয়ারি (২০১৫) সারা দেশের মানুষই প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। আওয়ামী লীগের ঘোষণা সত্ত্বেও রাজধানীর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিশ দলের সমর্থক নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। কোথায়ও কোথায়ও সরকারি ষন্ডারা সেসব বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এই ষন্ডাদের চরিত্র অদ্ভুত। পুলিশের সহায়তা ছাড়া তারা এক পা-ও সামনে এগোতে সাহস পাচ্ছে না। এ চিত্র শুধু ঢাকা শহরের নয় সারা দেশেরই।
৫ জানুয়ারিতে (২০১৫) বিশদলীয় জোট ঢাকায় গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালনে ডাক দিয়েছিল। সরকার গণতন্ত্র রক্ষা উৎসব পালনের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ ডেকেছিল। বিশ দলের সমাবেশ ছিল নয়াপল্টন এলাকায়। সরকার নিজেও নিঃসংশয় ছিল না যে, তাদের এই গণতন্ত্র রক্ষা উৎসবে কতটা সাড়া মিলবে। এই সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নে  মানুষ দিশেহারা। ফলে ভাড়া করে ক’জন লোকই বা আনা যাবে। বিশদলীয় জোটের অনুষ্ঠানে যাতে সারা দেশ থেকে মানুষ এসে যোগদান করতে না পারে সে কারণে সরকার ৩ তারিখ রাত থেকেই ঢাকামুখী সকল বাস-লঞ্চ বন্ধ করে দেয়। ঢাকামুখী বাস-লঞ্চ যদি বন্ধ থাকে তাহলে সরকারের গণতন্ত্র উৎসবেও তো কেউ যোগদান করতে পারবে না। সরকার সেটা উপলব্ধি করেনি এমনও নয়। তার অর্থ হলো এই যে, সরকার নিশ্চিত ছিল, তাদের গণতন্ত্র উৎসব কিছুতেই জমানো যাবে না। তা যদি না যায় তাহলে তারা বিরোধী দলকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করতে কেন দেবে? অতএব বন্ধ হলো ঢাকামুখী সকল যানবাহন। আর অবরুদ্ধ হলেন বিশদলীয় জোটের নেত্রী তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। অবরুদ্ধ হলো গোটা দেশ।
কীভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার অবরুদ্ধ করলো এবং একজন মানুষকে দিনের পর দিন তার অফিস কক্ষে আটকে রাখছে, তার কোনো জবাবদিহিতা নেই। বরং তারা জোর গলায় বলেই যাচ্ছে, খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হচ্ছে না, নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে।
একইভাবে এই লেখার সময় পর্যন্ত প্রায় ২০ ঘণ্টা ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৫ জানুয়ারি (২০১৫) বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের এক আলোচনা সভায় বক্তব্য দিতে গিয়েছিলেন জনাব আলমগীর। সেখানে আওয়ামী মাস্তানরা ভাংচুর চালায় এবং তার ওপর হামলার চেষ্টা করে। এদের আবার নেতৃত্ব দিতে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫ তারিখে তাকে আওয়ামী ষ-াবাহিনীর নেতৃত্বে দেখলাম। তার আচরণে মনে হলো, যেন তিনি এক তুখোড় লেঠেল। জাতীয় প্রেস ক্লাব সকল মত-পথের মানুষের এক সম্মিলন কেন্দ্র। প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটি সে ঐহিত্য ধারণ করে এসেছে। এবার তার ব্যতিক্রম হলো। জনাব ইকবালের কথা শুনে মনে হলো, প্রেস ক্লাবে আওয়ামীপন্থীরা ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। এভাবেই সরকার নিজেদের ক্রমশ সঙ্কুচিত করে ফেলছে।
এ অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বের হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার পরে সারা দেশে টানা অবরোধের ডাক দিয়েছেন। অবরোধ চলছে। ভীতসন্ত্রস্ত সুশীলসমাজও চুপচাপ। কোথাও যেন বিবেকের তাড়না নেই। সত্যের জাগরণ নেই। এক থমথমে অবস্থার ভেতরে পড়েছে দেশ। এটা বিস্ফোরণের পূর্বলক্ষণ মাত্র। আমরা সে বিস্ফোরণের কাল গুনছি।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads