মঙ্গলবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৫

সত্য কি অবিরাম সমাহিত হতে থাকবে?


গত ২৪ জানুয়ারি অত্যন্ত আকস্মিকভাবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো মাত্র ৪৫ বছর বয়সে বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে বারোটায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ায় ইন্তেকাল (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন) করেছেন। এ খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এক গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষক বীরউত্তম মুক্তিযোদ্ধা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশী-বিদেশী চক্রান্তে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে শহীদ হন। তারপর থেকেই বেগম খালেদা জিয়া তার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে আঁকড়ে জীবনযাপন করতে থাকেন। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্রের জাল পাকিয়ে তুলছিলেন জিয়াউর রহমানেরই মনোনীত পাকিস্তান-প্রত্যাগত অমুক্তিযোদ্ধা লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ ডিসেম্বর এরশাদ বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। তার এই সামরিক শাসন জারিতে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া ছিল,‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপী (আমি অখুশি নই।)’
শেখ ফজলুল করিম সেলিম সম্পাদিত দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকা অত্যুৎসাহে গণতন্ত্র হত্যার এই খবরের শিরোনাম করেছিল, ‘এক ফোঁটা রক্তও নয়, একটি গুলীও নয়।’ গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে সামরিক শাসন জারি হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের আনন্দের কোনো সীমা থাকলো না। কেন রইলো না? গণতন্ত্র থাক বা না থাক, বিএনপি তো গেছে। এতেই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের আনন্দের সীমা ছিল না।
সেই থেকে ঘৃণার শুরু। ঘৃণা কোনো সুকুমার অনুভূতি নয়। কিন্তু ঘৃণার রাজনীতিই আওয়ামী রাজনীতি একমাত্র ভরসা। কার বিরুদ্ধে কত কুৎসা রটনা করতে পারলাম, অপরের মুখ কতটা ম্লান করে দিতে পারলাম, সম্মানিত ব্যক্তির মুখ কতটা ছোট করতে পারলাম, সেটাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য। সম্মান-শ্রদ্ধা তারা অর্জন করতে চায় আইন করে। সম্মান কি আইন করে পাওয়া যায়? নাকি সম্মান পেতে হয় আচরণের মাধ্যমে? এই বোধ আওয়ামী নেতানেত্রীদের নেই। এদেশের মানুষ ষোলো কোটি। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ষাটোর্ধ্ব। যাদের বয়স ষাটের উপরে তাদের পক্ষে আওয়ামী নির্দেশ অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে দেবতা জ্ঞান করা সম্ভব নয়। আমরা সব সময় বলেছি, শেখ মুজিবুর রহমান দোষেগুণে মানুষ ছিলেন। তিনি দেবতাও ছিলেন না, ফেরেশতাও ছিলেন না। তিনি মানুষ ছিলেন। মানুষের ভুলত্রুটি থাকবে। শেখ মুজিবুর রহমান ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। কিংবা তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডও প্রশ্নাতীত ছিল না। তিনি যা বলেননি বা বলতে চাননি, সেটি এখনকার সরকার দেশবাসীকে বলতে বাধ্য করতে চাইছে।
অতীত ইতিহাসের দিকে গেলে অনেক তিক্ত কথা উঠে আসবে। সেদিকে আমরা একেবারে না গিয়ে পারবো না। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সা¤্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির সম্মিলিত চক্রান্তে জেনারেল মইন উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ফখরুদ্দিন আহমদের মতো এক সা¤্রাজ্যবাদীর সেবাদাসের নেতৃত্বে যে সরকার এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা ছিল বাংলাদেশের ৪৫ বছরের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম সরকার। এরা ছিল আসলে এক লুটেরা দল। বিএনপির দুর্ভাগ্য এই যে, বিএনপির যারা এই অনুগ্রহ গ্রহণ করেছে তারা সবাই বিএনপির বুকে-পিঠে ছুরি মেরেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এরশাদকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। সে এরশাদ জিয়াউর রহমানকে হত্যার যাবতীয় ষড়যন্ত্র করেন। এবং ক্ষমতা দখল করেন। বিশ্বাসঘাতক জেনারেল মইন উদ্দিনকে বেগম খালেদা জিয়া কয়েকজনকে ডিঙিয়ে সেনাপ্রধান করেছিলেন। আহ্! মুহাম্মদী বেগের মতো বিএনপির পৃষ্ঠদেশে এই বেঈমান আমূল ছুরি চালিয়ে দিয়েছে।
মীর জাফররূপী এই জেনারেল বেগম খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করেছে। তারেক রহমানকে কারারুদ্ধ করে তার মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে। আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেফতার করে ড্রাগ দিয়ে তার হৃদপিন্ড দুর্বল করে দিয়েছে। এইখানে হয়তো মইন-প্রেমিকরা বলতে পারেন যে, এগুলো সত্য নয়। তাহলে আমরাও প্রশ্ন করতে পারি যে, শেখ হাসিনা যখন কারারুদ্ধ ছিলেন তখন তিনি বললেন, তাকে হত্যার জন্য মইন-ফখরের সরকার আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করেছিল। উনার এক লাফাঙ্গা চিকিৎসক ডা. সৈয়দ মোদাছছের হোসেন বললেন যে, আর্সেনিক বিষপ্রয়োগের ফলে শেখ হাসিনা কানে শুনতে পাচ্ছেন না। এই খবরের পাশাপাশি ঢাকার সংবাদপত্রে একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। শেখ হাসিনা দুই কানে দুই টেলিফোন নিয়ে কথা বলছেন। যদি কানেই শুনতে না পান, তাহলে দুই কানে দুই টেলিফোন নিয়ে তিনি কী করছিলেন?
অপরদিকে তারা যাকে হত্যার চেষ্টা করলো বলে তিনি অভিযোগ করলেন, আর্সেনিক প্রয়োগ করলো বলে তিনি জানালেন, কানে শুনতে পাচ্ছেন না বলে তিনি অভিযোগ করলেন, ডাক্তারদের দিয়ে বলালেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ, বিদেশের চিকিৎসা না করতে পারলে এক্কেবারে শেষ। সেভাবেই সবকিছু চলল। মইনের বর্ণচোরা সরকার পরে শেখ হাসিনাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবার অনুমতি দিল। সেখানে গিয়ে তিনি রাজনীতি শুরু করলেন। পরে এইসব স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে চেপে গেলেন। এখন আর উনাদের নাম শোনা যায় না।
কিন্তু বেগম খলেদা জিয়া রয়ে গেলেন বাংলাদেশেই। ঐ সরকার তাকে জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দেবার হেন কোনো চেষ্টা নেই, যা করেনি। কিন্তু রাজি হননি বেগম খালেদা জিয়া। ঐ সরকারের মূল উদ্দেশ্যই যেন ছিল জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া। তার বড় ছেলে তারেক রহমানকে আটক করে তার ওপর করা হয় অমানুষিক নির্যাতন । ভেঙে দেয়া হয় তার মেরুদন্ড। তিনি এখনও লন্ডনে চিকিৎসাধীন আছেন। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর কোনো রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা ছিল না। খেলাধূলা আর ছোটখাটো ব্যবসা নিয়েই ছিলেন তিনি। ঐ সামরিক সরকার তাকেও আটক করে তার ওপরও চালায় অমানুষিক নির্যাতন। তাতে তিনিও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্যারোলে মুক্তি লাভ করে তিনি চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যান। সেখান  থেকে যান মালয়েশিয়ায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।
দীর্ঘ সাত বছর তিনি স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ বিদেশে। এর মধ্যে মাত্র একবার বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। ঐ সময় খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। বড় ছেলে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী-কন্যার সঙ্গেও এই সাত বছরে বেগম খালেদা জিয়ার দেখা হয়েছে একবারই।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুসংবাদ তার জন্য যে কতটা শোক ও বেদনার ছিল, সেটা যেকোনো সুস্থ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই উপলব্ধি করতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই এ সংবাদে তার ভেঙে পড়ারই কথা। তার মধ্যেই ও বাড়ির গেইটে এক দারুণ নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেল। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবিলম্বে একটি নির্বাচনের দাবিতে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি চলছে। এরসঙ্গে মাঝেমধ্যে যুক্ত হচ্ছে হরতালের কর্মসূচি। ২০ দলীয় জোট নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। হাজারে হাজারে নেতাকর্মীকে প্রতিদিন আটক করা হচ্ছে। ক্রসফায়ারের নামে প্রতিদিন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। তাদের গুম করা হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার নানা কোশেশ করা হচ্ছে। তার ছেলেদের বিরুদ্ধে নাহক মামলা চালানো হচ্ছে। এখন ছোট ছোট মুখে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলা হচ্ছে।
এমন এক সময়ে গত ২৪ জানুয়ারী ছোট ছেলের মৃত্যু সংবাদে একেবারেই মুষড়ে পড়েন বেগম খালেদা জিয়া। শান্ত রাখতে চিকিৎসকরা তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন। নাটকের শুরু এখান থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সন্ধ্যায় জানানো হয় যে, বেগম খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে তার কার্যালয়ে আসতে চান শেখ হাসিনা। বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস রাত ৭টা ১০-এ প্রধানমন্ত্রীর এপিএসকে জানান, চিকিৎসকরা ইনজেকশন দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। ঘুম ভাঙলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের কথা জানানো হবে। তখনও যদি প্রধানমন্ত্রী আসতে চান, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী রাত সাড়ে আটটায় বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে এসে হাজির হন, যে কার্যালয়ে শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে অত্যন্ত বেআইনীভাবে দু’ সপ্তাহ ধরে তালা মেরে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী কোথায়ও গেলে সাধারণত দু’ একদিন আগে থেকে সে পুরো এলাকাটি এসএসএফের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং এক ধরনের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। শেখ হাসিনা যখন বেগম খলেদা জিয়ার কার্যালয়ে যান, তখন তার ভেতরে গিজগিজ করছিল শত শত নেতাকর্মীতে, যা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার অনুকূল ছিল না। সে রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে কেন তিনি গেলেন। নাকি তিনি যেতে চেয়েছিলেন ঐ গেট পর্যন্তই। এখন অভিযোগ করা হচ্ছে যে, বেগম খালেদা জিয়ার অফিসের তালা খুলে কেউ তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন না কেন। বেগম খালেদা জিয়ার অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। এখন বাইরের তালা তারা খুলে দিলেও, ভেতরের তালা ঝুলানোই আছে। ছোট গেট দিয়ে আসা যাওয়া করছেন অফিসের কর্মীরা ও নেতানেত্রীরা। সেই পথে মাথা নিচু করে চরম অনিরাপত্তায় শেখ হাসিনার ঐ বাসভবনে যাওয়ার কথা কোনো সুস্থ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।
আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বহর এলো। তিনি নামলেন। মিনিট খানেক দাঁড়ালেন। তারপর আবার গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। হায় হায় রব তুললেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ, দলকানা মিডিয়া এবং আরও অনেকে। অনেককেই বলতে শুনলাম, সঙ্কট সমাধানের একটা বিরাট সুযোগ হাতছাড়া করল বিএনপি। এর চেয়ে হাস্যকর বিষয় আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রীর গুলশান ভ্রমণ কতটা আন্তরিক ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ঘণ্টা দুয়েক পরেই। দু’ ঘণ্টা পর যাত্রাবাড়িতে বাসে বোমা হামলার ঘটনায় সরকার শোকে মুহ্যমান খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামী করে মামলা দায়ের করে দিল। সমবেদনার আওয়ামী ভাষা এটাই। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানানো না জানানো নিয়ে যারা সমালোচনামুখর,  তারা আশা করি বুঝবেন, সরকারের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads