শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫

গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও জাতীয়তাবাদ


বাংলাদেশের বর্তমান সংঘাত এর কারণ ও স্বরূপ নিরূপণে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদের আলোচনা পাঠকের ভাবনার খোরাক যোগাবে। এ আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্রে বসবাসকারী জাতি। প্রশ্ন হল  জাতি কি ? জাতি হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনসমষ্টি, যারা ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত সুনির্দিষ্ট আবাসভূমির বাসিন্দা। জাতি রাষ্ট্রের  অধিবাসী সেই লোকসমষ্টির সামগ্রিক বা সমষ্টিগত জীবন সুনিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ সেই জনসমষ্টি এরূপ একটি নিজস্ব সরকার দ্বারা শাসিত, যে সরকার সর্বক্ষেত্রে সত্যিকারার্থে স্বাধীন এবং কোন ক্ষেত্রেই অন্য কোন শক্তির লেজুর বা তাঁবেদার নয়। জাতীয়তা কি? জাতি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান জাতীয়তা। জাতীয়তা হচ্ছে- একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিশাল জনসমষ্টির চিন্তার, আবেগের, অনুভূতির, আশার, আকাক্সক্ষার, সংস্কৃতির, সংস্কারের, দেশাত্ববোধের, আনুগত্যের বিরাট সম্পর্ক ও অবিচ্ছেদ্য আত্মীয়তা। এই আত্মীয়তা যেখানে অনুপস্থিত সেখানে জাতীয়তা অবর্তমান। আবার একই রাষ্ট্রে একাধিক এথনিক গ্রুপ, কালচারাল গ্রুপ, রিলিজিয়াস গ্রুপ থাকতে পারে। কিন্তু জাতি ভাবাদর্শের মেইনস্ট্রিম থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালনার একটি বহুল পরিচিত পন্থা হলো গণতন্ত্র। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্র হলো কোন জাতিরাষ্ট্রের এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমান ভোট বা অধিকার আছে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরীর ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশ গ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসী শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ থেকে, যার অর্থ “জনগণের শাসন” শব্দটির উৎপত্তি (ডেমোস) “জনগণ” ও (ক্রাটোস) “ক্ষমতা” থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে এথেন্স ও অন্যান্য নগর রাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। এই শহর-রাষ্ট্রটি ছিলো এথেন্স শহর এবং তার আশপাশের গ্রামাঞ্চল নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে নেতাদের বেছে নেয়ার যে সনাতনী রীতি চালু ছিলো, ক্লিসথেনিস তার অবসান ঘটান। তার বদলে তিনি মানুষের নতুন জোট তৈরি করেন এবং প্রতিটি জোটকে ডিময়  অথবা প্যারিশ- এ বিভক্ত করেন। প্রতিটি মুক্ত নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে শহর-রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেয়া হয়। সাধারণভাবে এই ঘটনাকেই গণতন্ত্রের প্রথম উন্মেষরূপে গণ্য করা হয় যার পরে নাম হয় ডেমোক্রেশিয়া  যার অর্থ হচ্ছে জনগণের  শক্তি ।
ফ্যাসিবাদ হচ্ছে র‌্যাডিক্যাল কর্তৃত্বমূলক জাতীয়তাবাদের একটি রূপ যা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপে খ্যাতি লাভ করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ইটালিতে ফ্যাসিবাদ উৎপত্তি লাভ করে জাতীয় সিন্ডিক্যালবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। এটি বিশেষভাবে বামপন্থী রাজনীতির উপাদান গ্রহণের মাধ্যমে ডানপন্থী রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণ করে; এবং এটি ছিল সমাজতন্ত্র, উদারতাবাদ, সাম্যবাদ, ডানপন্থী রক্ষণশীল, গণতান্ত্রিকের বিরোধী। যদিও ফ্যাসিবাদকে বাম-ডান রাজনীতিতে সাধারণভাবে দূর ডানে জায়গা দেয়া হয়, কতিপয় স্ব-ব্যাখ্যাত ফ্যাসিবাদী এবং কিছু মন্তব্যকারীরা বলেছেন যে এই বিবরণ যথার্থ নয় এটি মুলত রাষ্ট্রের সকল মানুষকে একাত্ম করে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই কাজে তারা নির্ভর করে একটি বিশেষ বাহিনী বা গোষ্ঠীর উপর যারা পূর্বে রাজনৈতিক অঙ্গনে ততটা প্রভাবশালী ছিল না। যাদের এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা থাকে তারাই পরবর্তীতে রাষ্ট্র নেতৃতে অগ্রণী দায়িত্ব নেয়। সেই রাষ্ট্র তখন প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা, যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদকে অনুমোদন দেয় এবং রাষ্ট্রের মতে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের জন্য এগুলো মৌলিক বিষয়। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ অনুযায়ী উচ্চবিত্ত বা প্রভাবশালী রাষ্ট্রের (তারা নিজেদেরকেও এই শ্রেণীতে রাখে) উচিৎ অন্য দুর্বল বা যাদের অর্থনীতি তেমনটা মজবুত নয় এমন রাষ্ট্র বা জাতিকে দখল করে স্থানচ্যুত করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফ্যাসিবাদীরা অন্য সংস্কৃতির প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকে এবং জাতি ও সংস্কৃতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে। দেশের সকল শ্রেণীর মানুষকে একাত্ম করাই অর্থাৎ শ্রেণীবিভাজন দূর করে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই ফ্যাসিবাদের লক্ষ্য। অনেক বিশ্লেষকের মতে ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মাঝখানে অবস্থিত বা তৃতীয় “অবস্থান’’ বলেও উল্লেখ করেছেন। ফ্যাসিবাদী অর্থনীতি স্বনির্ভরতার উপর গুরুত্ব দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফ্যাসিবাদী সরকার সামরিক বাহিনীর ওপর অতিনির্ভর ও আস্থাশীল হয়। ইতালির জাতীয় শ্রমিক আন্দোলন জাতীয়তাবাদ থেকে ফ্যাসিবাদ উত্থান হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কোন রাজনৈতিক দলই খোলাখুলিভাবে নিজেদের ফ্যাসিবাদী বলে দাবি করতে চায় না। এখন সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলের প্রতি ঘৃণা বা রাগ প্রকাশের জন্য এই শব্দ ব্যবহার করে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার এবং ইতালির বেনিতো মুসোলিনি উল্লেখযোগ্য।
জাতীয়তাবাদ কি? জাতীয়তাবাদ বিবেচনা করা দরকার ব্যাপক অর্থে সাংস্কৃতিক স্মারকের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় হিসাবে। নিরাপত্তাহীন পৃথিবীতে এই স্মারকের একটি প্রকৃত অর্থ আছে ব্যক্তির কাছে। এদিক থেকে যদি দেখি তাহলে জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন অর্থ আছে, অবশ্য এই অর্থ শেষ বিশ্লেষণে, ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। সেজন্য কোন নির্বস্তুক সংজ্ঞা নয়, কংক্রীট সংজ্ঞা কেবল ব্যবহার করা যায় সাংস্কৃতিক স্মারক এবং সাংস্কৃতিক যুক্ততার ক্ষেত্রে। কারণ উপাদানগুলো ব্যক্তির সাথে জড়িত একাত্মভাবে।
(তথ্যসূত্র বাংলাদেশ রাজনীতির ২৫ বছর, সম্পাদনায়- তারেক শামসুর রহমান)। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধানতঃ দুটি ধারা রয়েছে। একটি হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারা। তত্ত্বগতভাবে এধরনের জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর নানা স্থানের বাংলাভাষীদের ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বললেও কার্যত এটি আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের বাঙালীদের ওপরই জোর দেয়। এ কারণে এ জাতীয়তাবাদ কার্যত ভূখন্ডকেন্দ্রিক জাতীয়তা হয়ে পড়ে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে সেই ভূখন্ডের অন্যান্য ক্ষুদ্র ভাষাভাষীরা এ জাতীয়তাবাদের স্রোতধারায় অন্তর্ভুক্ত হয়না। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের অপর ধারাটি হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন ভূখন্ডকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারা।
বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি নানা ধর্মের লোক বাস করেন। বসবাস করেন বাংলাত, চাকমা, মারমা, উর্দুসহ অনেকগুলো ভাষা ও নানা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ। এরা সবাই অর্থাৎ বাংলাদেশ ভূখন্ডে যারা বাস করেন তারা সবাই মিলে আমরা বাংলাদেশী। এটিই হচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল বক্তব্য ও মূল সুর। এই বাংলাদেশীদের জাতীয় স্বার্থের সুরক্ষা ও উন্নয়নই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূলবাণী ও মর্মকথা। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এতদঞ্চলের ইতিহাসেরই বাস্তব ফলশ্রুতি। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (২৯/০১/১৯৩৬- ৩০/০৫/১৯৮১) বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন উর্ধ্বে তুলে ধরে জিয়াউর রহমান আমাদেরকে সঠিক জাতীয় পরিচয়ের সন্ধান দিতে সক্ষম হন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি বিকাশ ও গুরুত্ব সম্পর্কে জিয়াউর রহমান লিখেছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন শ’শ’ বছর ধরে এদেশের আপামর জনগণের অন্তরে চির জাগরূক রয়েছে। যুগ-যুগান্তরের দেশপ্রেমিক হৃদয়ের মর্মমূলে নিহিত তাদের সব উৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রেরণার উৎস এই দর্শন। এই দর্শনে নিহিত রয়েছে বাস্তব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি যা দেশের ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপযোগী বাস্তবমুখী ও সময়োচিত শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংবদ্ধ করবে, জাতিকে সুনিশ্চিতভাবে অগ্রগতি, সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে এবং বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।
বাক স্বাধীনতা হরণ। গণ মাধ্যমের কন্ঠরোধ ফ্যাসিবাদের অস্ত্র। ফ্যাসিবাদের পরিণাম রক্তপাত। হিটলার তার প্রমাণ। পক্ষান্তরে ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতা গণতন্ত্রের অলঙ্কার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দফতরের ভেতরে মারণাস্ত্র দিয়ে আঘাত অমার্জনীয়।
আখতার মাহমুদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads