সোমবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৫

আসুন দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করি


দেশে স্বৈরতন্ত্রের অবসান, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের কারামুক্তি ও তাদের ওপর জেল-জুুলুম এবং নির্যাতন বন্ধকরণ, মৌলিক মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২০ দলীয় ঐক্যজোটের আহ্বানে সারাদেশে গত ১৬ দিন ধরে অবরোধ চলছে। অবরোধের পাশাপাশি পালাক্রমে বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় হরতালও পালিত হচ্ছে। ফলে সারাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। সরকার পুলিশী নিরাপত্তা দিয়ে আন্তঃজেলা বাস ও ট্রাক চলাচলের মাত্রা বৃদ্ধির চেষ্টা করলেও পরিবহন চালক ও মালিকরা এতে নিরাপত্তাবোধ করছেন না এবং রাষ্ট্রীয় সকল শক্তি ব্যবহৃত হবার পরও আঞ্চলিক ও আন্তঃজেলা মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের মাত্রা বাড়ছে না। দৈনিক প্রথম আলো ১৮ জানুয়ারি দেশের কর্মমুখর ১২টি জেলার ওপর নিবিড় তদন্ত করে রিপোর্ট করেছে যে, এইসব জেলায় সড়ক মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের হার শতকরা ৩৮ ভাগে নেমে এসেছে। পত্রিকাটির এই রিপোর্টটিতে দেশের দৈনন্দিন অবস্থার প্রতিফলন হয়নি বলে আমার ধারণা। ১৭-১৮ তারিখ তাবলিগ জামায়াতের আখেরী মুনাজাতের কারণে দেশে অবরোধ অবস্থা কিছুটা শিথিল ছিল। অন্যান্য দিনের অবস্থা ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে সীমিত বলে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে। এই অবরোধ-হরতালের পাশপাশি বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও ভাঙচুরের বহু মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে এর জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করা হচ্ছে। আবার বিরোধী দলগুলোর তরফ থেকে সরকারি দল ও গোয়েন্দা সংস্থার কিছু সংখ্যক সদস্যকে দোষারোপ করে বলা হচ্ছে যে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি এবং তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাসের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তারাই এই কাজগুলো করে তার দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগের অতীত চরিত্রকে এখানে তুলে ধরছেন এবং বলছেন যে, হরতাল-অবরোধে ধ্বংসাত্মক কাজে তারা নিজেরাই সিদ্ধহস্ত এবং তাদের যুক্তির সমর্থনে তারা বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল এবং ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্র্যন্ত পালিত যথাক্রমে ১৭৩ ও ১৩০ দিনের হরতাল-অবরোধের প্রাক্কালে সহিংসতা এবং ধ্বংসযজ্ঞের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তারা যাত্রাবাড়ী ও শেরাটন হোটেলের সামনে যাত্রীবাহী বাসে গান পাউডার ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে এবং প্রকাশ্যে রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনাও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন। অন্যান্য ধ্বংসযজ্ঞ তো ছিলই। আমি মনে করি যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মাধ্যমে অপরাধমূলক কাজ অব্যাহত থাকতে পারে না। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে তার নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে রাজনীতিতে শিষ্টাচারের প্রতিষ্ঠা এবং অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সৌজন্য ও সহনশীল সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে এখন তাদের আচার-আচরণ সকল শিষ্টাচার, সহনশীলতা, সভ্যতা ভব্যতার নীতি বৈশিষ্ট্যকে পদাঘাত করছে বলে মনে হয়। দেশে এখন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও জনগণের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত কোনও সরকার নেই। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে ২০০৮ সালের নির্বাচিত পার্লামেন্টকে বহাল রেখে নানা ছলছুতায় বিরোধী জোটকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে এবং জনগণের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে যে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাকে বাতিল করে আওয়ামী লীগ তার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে ক্ষমতা দখল করে। তারা জনগণকে ভোট দিতে দেয়নি। ২০ দলীয় জোট এখন মানুষের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই আন্দোলন করছে।
এই আন্দোলনের পূর্বে তারা সরকারের কাছে তাদের দাবি দাওয়াও পেশ করেছে এবং একটি জনসভার অনুমতি চেয়েছে। সরকার তাদের দাবি মেনে নেয়নি। সম্মেলনের অনুমতিও দেয়নি। বরং বিএনপি-জামায়াত ও তাদের নেতৃত্বাধীন দলগুলোর নেতা-কর্মীদের জঙ্গি দেশদ্রোহী এবং স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে শুধু রাজনীতি নয় তাদের দেশ থেকে নির্মূলেরও অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। সারা দুনিয়া বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে একটি কার্যকর সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে সরকার তাদের জুলুম নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। সারাদেশে বেপরোয়া গ্রেফতার চলছে। দলীয় ক্যাডার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্মিলিতভাবে এতে অংশ নিচ্ছে। ফলে সারাদেশ হানাহানি, মারামারির বিশাল প্লাটফরমে পরিণত হয়েছে। জেনারেল ইয়াহিয়া ও জেনারেল টিক্কাখান ১৯৭১ সালে যেমনি অস্ত্রবলে এ দেশে মানুষ নয়, মাটি চেয়েছিলেন তেমনি আওয়ামী লীগও দেশকে বিভক্ত করে তাদের সাথে দ্বিমত পোষণকারী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সকল মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে মাটি পাবার প্রত্যাশা করছেন বলে মনে হয়।
বিরোধী দলকে দমনের জন্য সরকার পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী দিয়ে অপারেশন শুরু করেছেন। এই অপারেশনের রাহবার হিসাবে ১৪ দলের নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। তারা অনেক স্থানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের সনাক্ত করছেন এবং যৌথবাহিনী তাদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের এক অপারেশনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রসূলপুর গ্রামের ৩০টি বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এই বাড়িগুলোর হাজার হাজার বাসিন্দা অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন, সর্বস্ব হারিয়ে এখন আশ্রয়হীন অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে। কেউ তাদের সাহায্যও করতে যেতে পারছে না। পত্র-পত্রিকায় বাড়িঘর ছেড়ে পলায়নপর শিশু-নারী ও পুরুষদের চিত্র প্রায় দিনই প্রকাশিত হচ্ছে। বহু জেলা থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, ‘আসামী’ ধরতে অপারেশনে গিয়ে আসামী না পেয়ে অথবা তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার সময় যৌথবাহিনীর সহযোগী সরকার দলীয় ক্যাডাররা বাড়ির রান্নার চুলা ভেঙে দিচ্ছে, খাবার সামগ্রী ফেলে দিচ্ছে এবং লেপ-তোষক, কাঁথা-বালিশ প্রভৃতি পুকুরে ফেলে দিচ্ছে। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের বই-পুস্তকও তারা নষ্ট করে দিচ্ছে। তাদের এই নির্মমতা ফেরাউনী অত্যাচারকেও হার মানায়। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, বাংলাদেশের মানুষ, সে যে দলেরই হোক না কেন, মানবিক মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে এতো নিচে নেমে গেছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার এখন বিরোধীদল নিধনে ব্যস্ত। আবার চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাদের কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগ স্বয়ং মারণাস্ত্র নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর হামলা করছে। পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো তার সচিত্র ছবি প্রকাশ করছে। কিন্তু সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ হোস্টেলগুলোতে ছাত্রলীগ অস্ত্রাগার গড়ে তুলেছে; পুলিশ তা উদ্ঘাটন করছে। কিন্তু কোনও বিচার নেই। একইভাবে নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যা, নারায়ণগঞ্জের এইট মার্ডার, ফেনীর একরাম হত্যা, নাটোরের সানাউল্লাহ হত্যা প্রভৃতিরও বিচার হীমাগারে চলে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
জনগণের জানমাল, ইজ্জত রক্ষার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তাদের নিরপেক্ষতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত। কিন্তু সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানদের প্রদত্ত এ সংক্রান্ত বিবৃতি দেশবাসীকে হতাশ করেছে। বিজিবি সদস্যদের প্রধান কাজ হচ্ছে সীমান্ত পাহারা দেয়া। সীমান্তে আমাদের নাগরিকরা প্রতিনিয়ত নিহত হচ্ছেন। বিজিবি তাদের কোনও নিরাপত্তা দিতে পারছে না। পক্ষান্তরে বিজিবি প্রধান যখন বলেন যে, তার বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আন্দোলনরত বিরোধীদলীয় কর্মীদের উপর গুলীবর্ষণ করবেন তখন মাথায় হাত দেয়া ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না। নবনিযুক্ত আইজিপি’র বেগম খালেদা জিয়ার সমাবেশ অনুষ্ঠানের দাবিকে আইনের অবমাননা এবং টকশোতে অংশগ্রহণকারী ও সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মন্তব্যকারী সুধীদের দেশপ্রেমে কটাক্ষ অবাক করে দেয়ার মতো বিষয়। র‌্যাব প্রধানের মন্তব্যকেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অহমিকাপূর্ণ, দলীয় পক্ষপাতপুষ্ট এবং দায়িত্বহীন রাজনৈতিক বক্তব্য বলে মনে করেন যা তাদের জন্য শোভনীয় নয়।
আমি একান্তভাবে বিশ্বাস করি, অনেক কষ্টে আমরা দেশটি অর্জন করেছি। ষোল কোটি মানুষের কল্যাণ আমাদের কাম্য। আসুন, এক্সটিমিজম ও হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে দেশটাকে আমরা রক্ষা করি। এর জন্য সংলাপের বিকল্প নেই। আমাদের প্রধান সমস্যা নির্বাচনকালীন একটি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় ঐকমত্য এবং তার মাধ্যমে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। নিজেকে আমরা একমাত্র দেশপ্রেমিক ও অন্যদের দেশের শত্রু গণ্য করতে পারি না। আমাদের সকলের খাজনায় দেশ চলে। এই দেশ ধ্বংস হলে আমরাও নিরাপদ থাকতে পারবো না।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads