কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার দুটি চরণ এ রকম : ‘থাকিতে চরণ মরণে কি ভয়, নিমিষে যোজন ফরসা/জয় শ্রীচরণ ভরসা।’ বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের জনবিচ্ছিন্নতায় তাদের অবস্থাও প্রায় এমনই দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সাধারণত ভরসা থাকে বা ভরসা করতে হয় জনগণের ওপর। এই জনগণের ওপর যখন ভরসা করা যায় না, জনগণ যখন সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন সেই সরকার সর্বশক্তি দিয়ে ঐ জনগণকেই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এবং তারা জানে জনগণের শক্তি দুর্বার। আবার এই প্রক্রিয়ায় তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে এবং দলীয় মাস্তানদের ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সেও জনগণকে দমন করার জন্যই, যেন তারা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে।
বর্তমান সরকারও তেমনি এক উৎপীড়নের ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে গেছে। আর সে কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই এই সরকার জননিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। লক্ষ্য, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। এই সঙ্গে সরকার-বিরোধী সকল কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া, যাতে ভবিষ্যতেও কেউ কোনোদিন এই সরকারের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও না করতে পারে। আমরা প্রথম থেকেই এর বিপজ্জনক দিক নিয়ে আলোচনা করে এসেছি। আমরা বলেছি, গণনির্যাতনের জন্য এসব বাহিনী ব্যবহার করা হলে তারা একসময় নিজেরাই অপরাধ সংঘটন করতে শুরু করবে। যেহেতু সরকার তাদের ব্যবহার করছে, সে কারণে এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে এরা জনরোষের মুখেও পড়তে পারে।
আমাদের অনুমান এতদিনে সত্যে পরিণত হতে শুরু করেছে। সরকার এই বাহিনীগুলোকে এতটাই দলীয়করণ ও অপব্যবহার করেছে যে, এখন তারা যেন নিজেরাই নিজেদের সরকার তথা দন্ডমুন্ডের কর্তা ভাবতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ প্রধান জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধংদেহী ঘোষণা দিয়ে বসেছেন, প্রজাতন্ত্রে কর্মকর্তা হিসেবে তা তাদের এখতিয়ারের সম্পূর্ণ বহির্ভূত। একটি অংশগ্রহণমূলক নতুন নির্বাচনের লক্ষ্যে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচির পর এখন লাগাতার অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি পালন করছে।
এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে সরকারের স্বৈরাচারী ও অদূরদর্শী মানসিকতার কারণে। তার আগে থেকেই সরকারের মন্ত্রী, নেতা, পাতি নেতারা বিরোধীদলগুলোকে এমনভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল যে, দেশে বোধ করি বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্বই নেই। তারা এই বলে হুঙ্কার দিচ্ছিল যে, বিরোধী দল যদি আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়, তবে তাদের মাঠে নামতে দেয়া হবে না। কেউ কেউ বলছিল, সরকার এমন ব্যবস্থা নেবে যে, তারা মাটির নিচে লুকিয়েও পার পাবে না। কেউ আবার বলছিলেন যে, বিরোধী দলের আন্দোলনের কোনো মুরোদই নেই। কেউ বলছিলেন, বিরোধী দল যদি আন্দোলন শুরু করে, তাহলে তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ‘নেড়ি-কুত্তা’র মতো রাস্তায় পেটানো হবে। এমনও বলতে শুনেছি যে, খালেদা জিয়াকে কেনো যুদ্ধে নামতে হলো? জেনারেল কখন নিজে যুদ্ধে নামে? তখনই নামে যখন তার সৈন্য-সামন্ত সবই যুদ্ধে মারা যায়। খালেদা জিয়ার সব সৈন্য মরে গেছে। এ কথা ঠিক যে, অত্যন্ত নিম্নমানের পদ্ধতিতে বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতাকে কারাগারে আটক করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে হুলিয়া। শুধু শীর্ষস্থানীয় নেতাই বা বলি কেন, মধ্যস্তরের সকল নেতাও কারারুদ্ধ কিংবা হুলিয়া নিয়ে পলাতক।
এরকম একটা পরিস্থিতিতেই এসেছিল ৫ জানুয়ারি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি প্রহসনের নির্বাচন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেখানে ভোটার উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। কারণ সকল বিরোধী দল সে নির্বাচন বর্জন করেছিল। তাদের দাবি ছিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে একটি নিদর্লীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সারা বিশ্বই উপলব্ধি করছিল যে, সরকার জনমতের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে। তারা এ ধরনের একটি নির্বাচন না করারও অনুরোধ জানিয়েছিল। উভয়পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতা আনার জন্য জাতিসংঘ দূত পাঠিয়েছিল। সে আলোচনা ব্যর্থ হয়। সরকার একতরফা নির্বাচন করে। এবং জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে কিছু লোকের নাম ঘোষণা করে তাদের সংসদ সদস্য বলে অভিহিত করে।
তারই বর্ষপূর্তি ছিল ৫ জানুয়ারি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দিনটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে অভিহিত করে সারাদেশে কালো পতাকা দিবস ও ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল। একইভাবে আওয়ামী লীগও দিনটিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আর বিএনপি নয়া পল্টনে সমাবেশ করার পরিকল্পনা করে। ৩ তারিখ বিকেলে পুলিশ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আর সরকার ঢাকামুখী সকল যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সারাদেশে অবরোধ অবস্থা জারি করে। কারণ সরকার নিশ্চিত ছিল যে, তারা সোহরাওয়ার্দীতে জনসভা ডাকলেও সেখানে তেমন কোনো লোকসমাগম হবে না। তাদের কাছে অজানা নেই যে, সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন, নির্যাতন, নিপীড়নে অতিষ্ঠ সারাদেশের মানুষ তাদের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। আর এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সাধারণ মানুষ লাখে লাখে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের জনসভায় যোগ দেবে। আর তাই সরকার সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হলো না, ৩ তারিখ রাত থেকেই বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলল। তালা লাগিয়ে দেয়া হলো বিএনপি অফিসে।
৫ তারিখে বেগম খালেদা জিয়া যখন তার পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী নয়া পল্টনের দিকে রওনা হতে গেলেন, তার প্রায় ৩৬ ঘণ্টা আগে থেকেই তার দফতরের বাইরে ইট-বালুর ট্রাক, পুলিশে ট্রাক, জলকামান, প্রিজনভ্যান আর শত শত পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে ফেলা হয়। কেড়ে নেয়া হয় ২০ দলীয় জোট নেত্রীর অবাধে চলাফেরার সকল অধিকার। তাকে তো বের হতে দেয়া হলোই না, উপরন্তু নিষিদ্ধ ঘোষিত বিষাক্ত পিপার স্প্রে ছিটানো হলো বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির অন্যান্য নেতাকর্মীর ওপর। ফলে তারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এটা যেন ছিল অনেকটাই বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র।
নয়া পল্টনে যেতে ব্যর্থ হয়ে বেগম খালেদা জিয়া পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দিলো। সে অবরোধ এখন চলছে। সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে রাজধানী। প্রতিদিন শত শত বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। যথেচ্ছ গুলী চালানো হচ্ছে। অবরোধ থামানো যাচ্ছে না। অথচ সরকার ভেবেছিল দুই চার দিনের মধ্যেই তারা ডা-া মেরে ষোল কোটি মানুষকে ঠান্ডা করে দেবে। তারপর যা ঘটল তা অভাবনীয়। মনে হলো, বিজিবি-র্যাব-পুলিশ যেন রাষ্ট্র ক্ষমতাই দখল করে বসেছে। গত ১৫ জানুয়ারি বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমদ পিলখানায় সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘বিজিবি মানুষ হত্যা করতে চায় না। সে ধরনের নির্দেশও বিজিবির ওপর নেই। তবে মানুষ হত্যা করতে দেখলে এবং নিজে আক্রান্ত হলে জীবন বাঁচানোর জন্য যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করবে।’ তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি যদি পেট্রোল বোমা ফাটায়। তাহলে পাঁচজন লোক নিহত হতে পারে। এ দৃশ্য কোনো বিজিবি সদস্যের নজরে এলে ঐ বোমা বহনকারীকে ক্যাজুয়ালিটি করা তার দায়িত্ব। সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে কোনো বোমাবাজকে গুলী করতে বিজিবি কুণ্ঠিত হবে না।’ তিনি বলেন, সীমান্ত রক্ষা আমাদের প্রাইম কাজ। কিন্তু জনগণের জানমাল রক্ষা করা, সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা দেয়া, এসব আমাদের সেকেন্ডারি কাজ। সুতরাং এ কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে বিজিবি মহাপরিচালকের কথা থেকে স্পষ্ট হলো যে, সেকেন্ডারি কাজ নিয়েই বিজিবির আগ্রহ অনেক বেশি।
এরপর গত ১৬ জানুয়ারি র্যাবের মহাপরিচালক একেবারে ইনু-কামরুলের মতো বক্তৃতা দিয়ে বসলেন যে, ‘নির্ধারিত সময়ের পরেই নির্বাচন হবে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এর বাইরে আমরা কোনো কিছুই চাই না।’ বিএনপি জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে র্যাব ডিজি বললেন, ‘গত দুই সপ্তাহে মিঠাপুকুরের পাঁচজনসহ সারাদেশে ২৪ জনকে খুন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের মতো একটি গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা দেশের গণতন্ত্র-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেছে। তারা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ খুনিদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’
একইদিন পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক বলেছেন, ‘বিএনপির ভুলের খেসারত জনগণ দেবে না। যারা টকশো করেন, তারা বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ তারা কি বলছেন, তারা নিজেরাই জানেন না। ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করতে দিলে যদি হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হতো, তখন টকশো-ওয়ালারা কী করতেন? এর দায় পড়তো সরকারের ওপর। ...। একটা দলের প্রধান যদি বেআইনি কাজ করেন, তার কাছ থেকে জনগণ কী চাইবে? আপনার ভোট প্রতিরোধ করলেন। ভোট কেন্দ্রে লোক আসতে দিলেন না। ভোটের কেন্দ্রগুলো যেখানে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ছিল সেগুলো পুড়িয়ে দিলেন। মানুষ মারলেন। প্রিজাইডিং অফিসার, জনগণকে ভোটের অধিকার দিলেন না। কেন? ভুল আপনারা করছেন। জনগণ খেসারত দেবে? তা এই দেশে আমরা করতে দেবো না ইনশাআল্লাহ। আমরা গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে, আমরা নির্বাচিত সরকারের পক্ষে, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে কাজ করে যাবো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। কোনো অপশক্তি কোনো সন্ত্রাসী বাংলার মাটিতে কখনও তাদের অশুভ উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ, সেটা আমরা নির্মূল করে ছাড়বো।’
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও নাশকতা নির্মূলে কাজ করে যাবো। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করা হবে। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিগুলোর দুর্লবতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অবরোধ আর হরতাল সংবিধান পরিপন্থী। হরতাল আর অবরোধের নামের যারা দেশের সম্পদ নষ্ট করছে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। শুধু মিথ্যাচার করছে। এই অপশক্তিকে নির্মূল করতে হলে পুলিশের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এই পুলিশ প্রধান আরও বলেন, ‘সংবিধানের কোথাও লেখা নেই গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে, হরতাল ও অবরোধ দিয়ে মানুষ মারা ও জনগণের সম্পদ নষ্ট করতে হবে। হরতাল অবরোধের মতো সংবিধান পরিপন্থী কাজ করে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সংবিধানে রয়েছে, প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সমাবেশ করার অনুমতি।’
এই তিন বাহিনীর প্রধানকে সাবাসি দিতে হয়। একেবারে যেন বাকশাল কায়েম হয়ে গেছে। বাকশালের সরকারি কর্মকর্তাদের যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। রাজনৈতিক কর্মী হলে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে আর বাধা কি? আর এই ঘটনার পর এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন তিন ব্যক্তি। তারাই এখন প্রকাশ্যে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে গুলী চালানো হুকুম ও ভয়ভীতি দেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। এসব বাহিনী প্রধানের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার অর্থ সত্যিই বিপজ্জনক। অর্থাৎ সরকার রাষ্ট্রের ওপর নিজের সকল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। অতএব তাদের জন্য, ‘জয় বিজিবি-পুলিশ-র্যাব ভরসা।’
বর্তমান সরকারও তেমনি এক উৎপীড়নের ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে গেছে। আর সে কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই এই সরকার জননিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। লক্ষ্য, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা। এই সঙ্গে সরকার-বিরোধী সকল কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া, যাতে ভবিষ্যতেও কেউ কোনোদিন এই সরকারের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও না করতে পারে। আমরা প্রথম থেকেই এর বিপজ্জনক দিক নিয়ে আলোচনা করে এসেছি। আমরা বলেছি, গণনির্যাতনের জন্য এসব বাহিনী ব্যবহার করা হলে তারা একসময় নিজেরাই অপরাধ সংঘটন করতে শুরু করবে। যেহেতু সরকার তাদের ব্যবহার করছে, সে কারণে এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে এরা জনরোষের মুখেও পড়তে পারে।
আমাদের অনুমান এতদিনে সত্যে পরিণত হতে শুরু করেছে। সরকার এই বাহিনীগুলোকে এতটাই দলীয়করণ ও অপব্যবহার করেছে যে, এখন তারা যেন নিজেরাই নিজেদের সরকার তথা দন্ডমুন্ডের কর্তা ভাবতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ প্রধান জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধংদেহী ঘোষণা দিয়ে বসেছেন, প্রজাতন্ত্রে কর্মকর্তা হিসেবে তা তাদের এখতিয়ারের সম্পূর্ণ বহির্ভূত। একটি অংশগ্রহণমূলক নতুন নির্বাচনের লক্ষ্যে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচির পর এখন লাগাতার অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি পালন করছে।
এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে সরকারের স্বৈরাচারী ও অদূরদর্শী মানসিকতার কারণে। তার আগে থেকেই সরকারের মন্ত্রী, নেতা, পাতি নেতারা বিরোধীদলগুলোকে এমনভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল যে, দেশে বোধ করি বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্বই নেই। তারা এই বলে হুঙ্কার দিচ্ছিল যে, বিরোধী দল যদি আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়, তবে তাদের মাঠে নামতে দেয়া হবে না। কেউ কেউ বলছিল, সরকার এমন ব্যবস্থা নেবে যে, তারা মাটির নিচে লুকিয়েও পার পাবে না। কেউ আবার বলছিলেন যে, বিরোধী দলের আন্দোলনের কোনো মুরোদই নেই। কেউ বলছিলেন, বিরোধী দল যদি আন্দোলন শুরু করে, তাহলে তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ‘নেড়ি-কুত্তা’র মতো রাস্তায় পেটানো হবে। এমনও বলতে শুনেছি যে, খালেদা জিয়াকে কেনো যুদ্ধে নামতে হলো? জেনারেল কখন নিজে যুদ্ধে নামে? তখনই নামে যখন তার সৈন্য-সামন্ত সবই যুদ্ধে মারা যায়। খালেদা জিয়ার সব সৈন্য মরে গেছে। এ কথা ঠিক যে, অত্যন্ত নিম্নমানের পদ্ধতিতে বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতাকে কারাগারে আটক করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে হুলিয়া। শুধু শীর্ষস্থানীয় নেতাই বা বলি কেন, মধ্যস্তরের সকল নেতাও কারারুদ্ধ কিংবা হুলিয়া নিয়ে পলাতক।
এরকম একটা পরিস্থিতিতেই এসেছিল ৫ জানুয়ারি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি প্রহসনের নির্বাচন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেখানে ভোটার উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। কারণ সকল বিরোধী দল সে নির্বাচন বর্জন করেছিল। তাদের দাবি ছিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে একটি নিদর্লীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সারা বিশ্বই উপলব্ধি করছিল যে, সরকার জনমতের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে। তারা এ ধরনের একটি নির্বাচন না করারও অনুরোধ জানিয়েছিল। উভয়পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতা আনার জন্য জাতিসংঘ দূত পাঠিয়েছিল। সে আলোচনা ব্যর্থ হয়। সরকার একতরফা নির্বাচন করে। এবং জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে কিছু লোকের নাম ঘোষণা করে তাদের সংসদ সদস্য বলে অভিহিত করে।
তারই বর্ষপূর্তি ছিল ৫ জানুয়ারি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দিনটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে অভিহিত করে সারাদেশে কালো পতাকা দিবস ও ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল। একইভাবে আওয়ামী লীগও দিনটিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আর বিএনপি নয়া পল্টনে সমাবেশ করার পরিকল্পনা করে। ৩ তারিখ বিকেলে পুলিশ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আর সরকার ঢাকামুখী সকল যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সারাদেশে অবরোধ অবস্থা জারি করে। কারণ সরকার নিশ্চিত ছিল যে, তারা সোহরাওয়ার্দীতে জনসভা ডাকলেও সেখানে তেমন কোনো লোকসমাগম হবে না। তাদের কাছে অজানা নেই যে, সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন, নির্যাতন, নিপীড়নে অতিষ্ঠ সারাদেশের মানুষ তাদের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। আর এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সাধারণ মানুষ লাখে লাখে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের জনসভায় যোগ দেবে। আর তাই সরকার সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হলো না, ৩ তারিখ রাত থেকেই বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলল। তালা লাগিয়ে দেয়া হলো বিএনপি অফিসে।
৫ তারিখে বেগম খালেদা জিয়া যখন তার পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী নয়া পল্টনের দিকে রওনা হতে গেলেন, তার প্রায় ৩৬ ঘণ্টা আগে থেকেই তার দফতরের বাইরে ইট-বালুর ট্রাক, পুলিশে ট্রাক, জলকামান, প্রিজনভ্যান আর শত শত পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে ফেলা হয়। কেড়ে নেয়া হয় ২০ দলীয় জোট নেত্রীর অবাধে চলাফেরার সকল অধিকার। তাকে তো বের হতে দেয়া হলোই না, উপরন্তু নিষিদ্ধ ঘোষিত বিষাক্ত পিপার স্প্রে ছিটানো হলো বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির অন্যান্য নেতাকর্মীর ওপর। ফলে তারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এটা যেন ছিল অনেকটাই বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র।
নয়া পল্টনে যেতে ব্যর্থ হয়ে বেগম খালেদা জিয়া পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দিলো। সে অবরোধ এখন চলছে। সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে রাজধানী। প্রতিদিন শত শত বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। যথেচ্ছ গুলী চালানো হচ্ছে। অবরোধ থামানো যাচ্ছে না। অথচ সরকার ভেবেছিল দুই চার দিনের মধ্যেই তারা ডা-া মেরে ষোল কোটি মানুষকে ঠান্ডা করে দেবে। তারপর যা ঘটল তা অভাবনীয়। মনে হলো, বিজিবি-র্যাব-পুলিশ যেন রাষ্ট্র ক্ষমতাই দখল করে বসেছে। গত ১৫ জানুয়ারি বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমদ পিলখানায় সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘বিজিবি মানুষ হত্যা করতে চায় না। সে ধরনের নির্দেশও বিজিবির ওপর নেই। তবে মানুষ হত্যা করতে দেখলে এবং নিজে আক্রান্ত হলে জীবন বাঁচানোর জন্য যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করবে।’ তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি যদি পেট্রোল বোমা ফাটায়। তাহলে পাঁচজন লোক নিহত হতে পারে। এ দৃশ্য কোনো বিজিবি সদস্যের নজরে এলে ঐ বোমা বহনকারীকে ক্যাজুয়ালিটি করা তার দায়িত্ব। সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে কোনো বোমাবাজকে গুলী করতে বিজিবি কুণ্ঠিত হবে না।’ তিনি বলেন, সীমান্ত রক্ষা আমাদের প্রাইম কাজ। কিন্তু জনগণের জানমাল রক্ষা করা, সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা দেয়া, এসব আমাদের সেকেন্ডারি কাজ। সুতরাং এ কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে বিজিবি মহাপরিচালকের কথা থেকে স্পষ্ট হলো যে, সেকেন্ডারি কাজ নিয়েই বিজিবির আগ্রহ অনেক বেশি।
এরপর গত ১৬ জানুয়ারি র্যাবের মহাপরিচালক একেবারে ইনু-কামরুলের মতো বক্তৃতা দিয়ে বসলেন যে, ‘নির্ধারিত সময়ের পরেই নির্বাচন হবে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এর বাইরে আমরা কোনো কিছুই চাই না।’ বিএনপি জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে র্যাব ডিজি বললেন, ‘গত দুই সপ্তাহে মিঠাপুকুরের পাঁচজনসহ সারাদেশে ২৪ জনকে খুন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের মতো একটি গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা দেশের গণতন্ত্র-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেছে। তারা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ খুনিদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’
একইদিন পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক বলেছেন, ‘বিএনপির ভুলের খেসারত জনগণ দেবে না। যারা টকশো করেন, তারা বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ তারা কি বলছেন, তারা নিজেরাই জানেন না। ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করতে দিলে যদি হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হতো, তখন টকশো-ওয়ালারা কী করতেন? এর দায় পড়তো সরকারের ওপর। ...। একটা দলের প্রধান যদি বেআইনি কাজ করেন, তার কাছ থেকে জনগণ কী চাইবে? আপনার ভোট প্রতিরোধ করলেন। ভোট কেন্দ্রে লোক আসতে দিলেন না। ভোটের কেন্দ্রগুলো যেখানে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ছিল সেগুলো পুড়িয়ে দিলেন। মানুষ মারলেন। প্রিজাইডিং অফিসার, জনগণকে ভোটের অধিকার দিলেন না। কেন? ভুল আপনারা করছেন। জনগণ খেসারত দেবে? তা এই দেশে আমরা করতে দেবো না ইনশাআল্লাহ। আমরা গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে, আমরা নির্বাচিত সরকারের পক্ষে, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে কাজ করে যাবো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। কোনো অপশক্তি কোনো সন্ত্রাসী বাংলার মাটিতে কখনও তাদের অশুভ উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ, সেটা আমরা নির্মূল করে ছাড়বো।’
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও নাশকতা নির্মূলে কাজ করে যাবো। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করা হবে। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিগুলোর দুর্লবতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অবরোধ আর হরতাল সংবিধান পরিপন্থী। হরতাল আর অবরোধের নামের যারা দেশের সম্পদ নষ্ট করছে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। শুধু মিথ্যাচার করছে। এই অপশক্তিকে নির্মূল করতে হলে পুলিশের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এই পুলিশ প্রধান আরও বলেন, ‘সংবিধানের কোথাও লেখা নেই গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে, হরতাল ও অবরোধ দিয়ে মানুষ মারা ও জনগণের সম্পদ নষ্ট করতে হবে। হরতাল অবরোধের মতো সংবিধান পরিপন্থী কাজ করে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সংবিধানে রয়েছে, প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সমাবেশ করার অনুমতি।’
এই তিন বাহিনীর প্রধানকে সাবাসি দিতে হয়। একেবারে যেন বাকশাল কায়েম হয়ে গেছে। বাকশালের সরকারি কর্মকর্তাদের যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। রাজনৈতিক কর্মী হলে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে আর বাধা কি? আর এই ঘটনার পর এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন তিন ব্যক্তি। তারাই এখন প্রকাশ্যে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে গুলী চালানো হুকুম ও ভয়ভীতি দেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। এসব বাহিনী প্রধানের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার অর্থ সত্যিই বিপজ্জনক। অর্থাৎ সরকার রাষ্ট্রের ওপর নিজের সকল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। অতএব তাদের জন্য, ‘জয় বিজিবি-পুলিশ-র্যাব ভরসা।’
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন