রবিবার, ১১ মে, ২০১৪

বিপর্যয়ের মুখে জাতীয় অর্থনীতি


জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করার মাস জুন যখন আসি আসি করছে তখন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দৌড়ঝাঁপও বেড়ে চলেছে। যথারীতি তিনি বৈঠক করছেন ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, নামে মতবিনিময় সভা হলেও এসব সংগঠনের কোনো পরামর্শকেই আমলে নিচ্ছেন না অর্থমন্ত্রী। তিনি বরং নিজের পরিকল্পিত লক্ষ-হাজার কোটি টাকার বাজেটের পক্ষে ওকালতি করে বেড়াচ্ছেন। চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন নিজেদের সিদ্ধান্ত। এই প্রক্রিয়ায় কৌতূহলের কারণও কম সৃষ্টি করছেন না তিনি। যেমন গত বৃহস্পতিবার এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এরকম এক মতবিনিময় সভায় খুবই আক্ষেপ করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশে কোনো বিনিয়োগই হচ্ছে না। বিনিয়োগ উপযোগী অর্থ বরং বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কথাটার জবাব অবশ্য সে অনুষ্ঠানেই পেয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মূলত আওয়ামী ঘরানার লোক হলেও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেছেন, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে জিডিপির অন্তত ৩০ শতাংশ বিনিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য কম সুদে ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে গেছেন। এদিকে গত শনিবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার প্রবল আগ্রহ নিয়ে আগত অনেক নাম করা বিদেশী কোম্পানি নিরাশ হয়ে ফিরে গেছে। এখনো ফিরেই যাচ্ছে। ফিরে যাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে টয়োটা, নকিয়া, স্যামসাং, সনি, কোকাকোলা ও নেসলের মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানিও রয়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে খবরে বলা হয়েছে,  এসব কোম্পারি মধ্যে স্যামসাং একাই অন্তত ৫০ হাজার লোকের চাকরির ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু তাদের চাহিদা অনুযায়ী কারখানার জায়গা এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি বলেই স্যামসাং কোনো অঞ্চলে করতে পারে।
বলা বাহুল্য, এমন অবস্থায় আর যা-ই হোক, অর্থমন্ত্রীর বিনিয়োগ বিষয়ক হা-হুতাশকে গ্রহণ বা সমর্থন করা যায় না। পর্যালোচনায় বরং এ অভিযোগই প্রতিষ্ঠিত হবে যে, বিশেষ করে বন্ধু রাষ্ট্রের স্বার্থে সরকার নিজেই সুকৌশলে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে চলেছে। প্রসঙ্গক্রমে শেয়ার বাজারের কেলেঙ্কারি ও মহালুণ্ঠনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সেবার শেয়ারবাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে একই অর্থমন্ত্রী বিনিয়োগকারীদের ‘ধান্দাবাজ’ বলে আখ্যা দিয়ে জাতীয় অর্থনীতির সর্বনাশকেই ত্বরান্বিত করে ছেড়েছিলেন। এর ফলে ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। ওদিকে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে একদিকে জটিলতা ও দলবাজি এবং অন্যদিকে উচ্চ হারের সুদের কারণে দেশী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এত কিছুর মধ্যেও মাঝে-মধ্যে বিদেশীরা যে একেবারে বিনিয়োগ করতে আসেননি তা নয়। অনেকে এমনকি কারখানা স্থাপনও করেছেন। কিন্তু উৎপাদনে যেতে পারেননি গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে। দেশী-বিদেশী মালিকানাধীন যেসব কারখানা এখনো চালু রয়েছে সেখানেও গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ জ্বালানির সংকটে পণ্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে যে শিল্পপতিরা ফার্নেস অয়েল নির্ভর বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন তারাও লোকসান সামাল দেয়ার জন্য পণ্যের দাম না বাড়িয়ে পারছেন না। কথা শুধু এটুকুই নয়। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারলেও সরকার দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল ও সিএনজিসহ জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয়ের পাশাপাশি  পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে গেছে। সব কিছুর জন্যই শেষ পর্যন্ত বাড়তি দাম গুণতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনাতেও সরকার ব্যর্থতা দেখিয়ে এসেছে। পরিণতিতে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বেড়ে চলেছে বাস, রিকশা ও সিএনজিসহ যানবাহনের ভাড়া। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া। গ্যাস পানি ও বিদ্যুতের দামও বাড়িয়ে চলেছে সরকার। অন্যদিকে এসবের তুলনায় আয় তো বাড়ছেই না বরং অনেকের রোজগার কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির দাপটে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়েই মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। কোনো একটি প্রসঙ্গেই এখন আর শতকরা হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। বলা যাচ্ছে না, অমুক পণ্যের দাম এত শতাংশ বেড়েছে। সর্বশেষ কয়েকটি পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। কিন্তু এ পরিসংখ্যানকেও একশ ভাগ সঠিক বলার উপায় নেই। কারণ, মূল্য ও ব্যয় বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে। মূল্য ও ব্যয় শুধু খাদ্যের বাড়ছে না। এসবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যানবাহনের ভাড়া যেমন বাড়ানো হচ্ছে তেমনি বাড়ানো হচ্ছে বাড়ি ভাড়াও। অর্থাৎ বিক্রেতা থেকে বাস, রিকশা ও সিএনজিসহ যানবাহনের মালিকরা তো বটেই, বাড়িওয়ালারাও যার যার ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য দাম বাড়িয়ে চলেছেন। মাঝখান দিয়ে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অর্থমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের কথা অবশ্য আলাদা। কারণ, মানুষের যখন জিহবা বেরিয়ে পড়ছে তখনও কল্পিত সফলতার ঢেঁকুর তুলে বেড়াচ্ছেন তারা।
আমরা মনে করি, এমন অবস্থা চলতে পারে না। দলীয় টাউট ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় ও সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত কঠোরতার সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা ও পণ্যের মূল্য কমিয়ে আনা। আর্থিক খাতে দুর্নীতিও কমিয়ে আনতে হবে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এমন হওয়া দরকার দেশ যাতে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। এসব বিষয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শুধু নয়, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও সরকারের পরামর্শ করা উচিত। আগামী মাসেই পবিত্র রমযান শুরু হবে। সুতরাং সতর্ক ও সচেষ্ট হওয়া উচিত এখনই।  দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া মানুষের যে উপায় থাকে না সে কথাটা আমরা অবশ্য স্মরণ করিয়ে দিতে চাই না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads