মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০১৪

এত সব রহস্যের প্রয়োজন কী


নারায়ণগঞ্জের ‘সেভেন মার্ডার’ তথা ১১ হত্যাকা- নিয়ে এখনও সারা দেশে তোলপাড়। এই হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে গত ২৭ এপ্রিল দিনেদুপুরে। হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ ব্যক্তি। তাদের ৪ জন ছিলেন নজরুল ইসলামের সহযোগী। বেশ আগে থেকেই নজরুল ইসলাম আশঙ্কা করছিলেন যে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী অপর কাউন্সিলর অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ী নূর হোসেন, যিনি প্রধানমন্ত্রীর অতি প্রিয় নারায়ণগঞ্জের গডফাদার হিসেবে কুখ্যাত শামীম ওসমানের ডান হাত। এই নূর হোসেন নজরুল ইসলামকে হত্যা করতে পারেন, এমন আশঙ্কা নজরুলের ছিল। এবং তা এতই প্রবল ছিল যে, তিনি নারায়ণগঞ্জের আবাস ছেড়ে ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সেদিন এক মামলায় তার নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজির হওয়ার কথা। এই হাজিরার তারিখ সামনে রেখে তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঐদিন তার জীবনের নিরাপত্তা দাবি করেছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার অতি প্রিয়ভাজন, বিনা ভোটে মনোনীত এমপি শামীম ওসমানের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ভাই, নূর হোসেন আমাকে খুন করতে পারে, একটু দেইখেন।’ শামীম ওসমান তাকে অভয় দিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগ। তার প্রতিদ্বন্দ্বী নূর হোসেন আওয়ামী লীগ। শামীম ওসমান আওয়ামী লীগ। সবই আওয়ামী খেলা। অর্থাৎ আওয়ামী অন্তর্দ্বন্দ্ব।
ঢাকা থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম যখন নারায়ণগঞ্জের আদালতে যান, তখন তাকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করছিল এক লোক। দাড়িওয়ালা। কাবুলি-জোব্বা পরা, মাথায় পাগড়ি। নজরুল ইসলামও একা চলতেন না। নারায়ণগঞ্জের বধ্যভূমিতে কোনো রাজনৈতিক নেতাই নিরস্ত্র একা চলাফেরা করেন না। বিধান নেই। যারা সরকারী চাকরি করেছেন, তারা আশা করি বুঝেছেন ‘বিধান নেই’ কাকে বলে। সে প্রসঙ্গে ভিন্ন একদিন আলোচনা করবো। কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের লোকেরা ঐ জোব্বাধারী অনুসরণকারীকে আটক করে। এবং তার কাছে একটি অস্ত্র পায়। পরে তারা জোব্বাধারীকে কোর্ট পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। সে নিজেকে র‌্যাব-এর লোক বলে পরিচয় দেয়। তার কাছে কোনো পরিচয়পত্র ছিল না। কিন্তু সে মোবাইলে ছবি দেখায় যে, সে র‌্যাব-এর পোশাক পরিহিত অবস্থায় আছে। কিন্তু কোর্ট পুলিশ এতে সন্তুষ্ট না হলে র‌্যাব’র কালো পোশাক, মাথায় কালো পট্টি পরিহিত এক লোক এসে বলে যে, সে প্রকৃতই র‌্যাব’র লোক। অতএব তাকে ছেড়ে দেওয়া হোক।
র‌্যাব তো এলিট ফোর্স। পুলিশের আর কি করার আছে? তারা ঐ লোককে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ নজরুল ইসলামকে আদালত চত্বর থেকেই অনুসরণ করতে শুরু করেছিল র‌্যাব-এর সদস্যরা। সেটা নিশ্চয় ঐ জোব্বাধারী নিজের ইচ্ছায় করেনি। কমিশনার নজরুল ইসলামকে আদালত থেকেই অনুসরণ করার জন্য তাকে মোতায়েন করা হয়েছিল। আমি তাকে কোনো দোষ দেই না। সে হুকুমের চাকর মাত্র। হুকুম দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন অনেক খুনের নায়ক হিসেবে সন্দেহভাজন র‌্যাব ১১-এর কমান্ডিং অফিসার তারেক সাইদ মাহমুদ। তিনি আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়ার জামাতা। ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের আগে তাকে নারায়ণগঞ্জে পোস্টিং দেওয়া হয়। এখানেও আমি মায়ার কোনো দোষ দেখি না। হয়তো তার আত্মীয় হিসেবেই তিনি এই পোস্টিং পান। হয়তো মায়া নিজেও প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন যে, তাকে ঐ এলাকায় র‌্যাব ১১-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিলে সরকারের কী কী লাভ হবে। কিংবা কিছুই নয়। সরকারের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী লে. ক. তারেক সাঈদ র‌্যাব-১১ কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ ১১ জনের হত্যাকা- সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানে সামনে চলে আসেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মায়ার জামাতা। তিনি এই হত্যাকা-ের প্রধান আসামী নন। প্রধান আসামী অপর কাউন্সিলর নূর হোসেন। কিন্তু অভিযোগ হলো এই যে, নূর হোসেন এই তারেক সাঈদকে ছয় কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে কাউন্সিলর নজরুল ও তার সহযোগীদের খুন করিয়েছে। নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান একেবারে হিসাব করে বলে দিয়েছেন যে, কীভাবে এই টাকাগুলো লেনদেন হয়েছে। তিনি দাবি করেছিলেন, নূর হোসেন এবং লে. ক. তারেক সাঈদ ও তার সহযোগীদের ব্যাংক হিসাব তদন্ত করলেই এ তথ্য বেরিয়ে আসবে। শহীদ চেয়ারম্যান কীভাবে টাকা লেনদেনের খবর জানলেন? সেটিও তিনি অস্পষ্ট রাখেননি। বলে দিয়েছেন, একজন ডাবল এজেন্টের মাধ্যমে তিনি এ সকল তথ্য পেয়েছেন। গত সোমবার বাংলা নিউজডটকম-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দল ৭ খুনের অভিযুক্তদের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে। ওই খুনের আগে ও পরে অভিযুক্ত ও তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক টাকা জমা দেওয়া ও উঠানোর ঘটনা ঘটেছে। অথচ গত ছয় মাসেও ওসব হিসাবে এ ধরনের কোনো লেনদেন হয়নি।
এছাড়া দৈনিক যুগান্তর, প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ঐ সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব-১১ এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নজরুল ইসলামসহ অন্যদের একই কায়দায় একইভাবে আঘাত করে খুন করা হয়েছে। খুনীরা যে অত্যন্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। খুনের ঘটনাও ছিল সুপরিকল্পিত। খুন শেষে ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রত্যেকটি লাশের তলপেট ফুটো করে দেওয়া হয়েছিল যাতে লাশগুলোর পেটে গ্যাস জমে ভেসে উঠতে না পারে। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে প্রত্যেকটি লাশের পায়ে দু’টি করে ইটের বস্তা বেঁধে দেয়া হয়। যে বস্তায় ইট বাঁধা হয়, সে বস্তাগুলো ছিল একই রকম। নাটোরের বিস্মিল্লাহ ডাল মিলের ডালের বস্তা। এই প্রতিষ্ঠানের ফোন নম্বরও বস্তার গায়ে লেখা ছিল। সে ফোন নম্বর নিয়ে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ঐ ডাল কারখানায় ফোন করে জানতে পারে যে, তারা সরকারি লোকদের জন্য ডাল সরবরাহ করে থাকে। এই ডালের বস্তাগুলো বাঁধা হয় বিশেষ ধরনের রশি দিয়ে। এই রশি বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। সাধারণত সামরিক বাহিনীর লোকেরা বা প্যারাট্রুপাররা এই রশি ব্যবহার করে। প্রত্যেকটি লাশের দু’পায়ে বেঁধে দেওয়া হয়, সে বস্তাগুলো বাঁধা হয়েছিল সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কায়দায়। সাধারণত সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা এভাবে তাদের বেডিং বাঁধে। তারপর লাশগুলো র‌্যাব-এর নৌকায় করে শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীর সঙ্গমস্থলে স্রোতহীন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়।
লাশগুলো ভেসে ওঠার পর পরই ঐ এলাকার জনগণের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক নৌকা দু’টি র‌্যাব-এর ঘাট থেকে উধাও হয়ে যায়। এ বিষয়ে দৈনিক প্রথম আলো র‌্যাব-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন যে, হয়তো মেরামতের জন্য এগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘মেরামত কাজ’ সম্ভবত এখনও শেষ হয়নি। নৌকা দু’টিও আর ফেরত আসেনি।
পরদিন আরও একটি ভয়াবহ রিপোর্ট করে দৈনিক ইত্তেফাক। সেখানে প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায় যে, ঐ এলাকায় হামেশাই লাশ ভেসে ওঠে। গত কয়েক বছরে তা কয়েকশ’ হবে। পুলিশকে খবর দিলে তারা এসে লাশগুলোর কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই নদীর তীরে পুঁতে রেখে চলে যায়, যাতে মামলা-মোকদ্দমা, তদন্ত, লাশের পরিচয় সনাক্তকরণ কোনো কিছুই করতে না হয়। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ঐ প্রত্যক্ষদর্শীরা ৩০ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুলসহ অন্যদের লাশ ভেসে ওঠার ও উদ্ধার করার বিস্তারিত বর্ণনাও দেন।
রশি, ইটের বস্তা বাঁধার কৌশল, ইট ও ইটের স্তূপ, র‌্যাব-এর অফিস, উধাও নৌকা, সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন এসব কিছু থেকেই প্রমাণিত হয় যে, এই খুনের সঙ্গে র‌্যাব জড়িত থাকতে পারে। সরকারও যে বিষয়টি নিয়ে অবহিত, সেটিও বলার অপেক্ষা রাখে না। তা না হলে নারায়ণগঞ্জের ডিসি-এসপিসহ ৭৯ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে অত্যন্ত দ্রুততায় বদলি করা হতো না। র‌্যাব-এর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ সরকারের কাছে না থাকলে ঝটপট র‌্যাব-১১ কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদসহ তিন কর্মকর্তাকে সরিয়ে এনে অকালীন ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হতো না। এটি শাস্তি। যদি তারা অপরাধীই না হয়ে থাকে তবে তাদের এই শাস্তি কেন দেওয়া হবে?
এখন মূল মুশকিলটা যা দাঁড়িয়েছে সেটি একেবারেই পারিবারিক এবং সরকারের ভিত নাড়ানো। দেশজুড়ে বহু অপকর্মের হোতা লে. ক. তারেক সাঈদ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। তার ছেলে দীপু চৌধুরীও সন্ত্রাসী হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। মায়াকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বললেন যে, ৭ খুনের ঘটনায় তার পরিবারের কেউ জড়িত নেই। অথচ নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান দীপু চৌধুরীর মাধ্যমেও যে টাকা লেনদেন হয়েছে সে কথা স্পষ্টই বলেছেন। না হয় সাত বা ১১টি খুন নারায়ণগঞ্জে করেছেই, তাই বলে তার জামাতাকে চাকরিচ্যুত করতে হবে? এটা কেমন কথা! আর সেই অভিমানে মন্ত্রিসভার দু’টি বৈঠকে তিনি যোগদান করেননি। সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নেরও জবাব দিতে চাননি। বরং বলেছেন, তার জন্য সাংবাদিকরা যেন দোয়া করেন। কারণ ‘হাতি গর্তে পড়লে চামচিকায়ও লাথি মারে।’ এখন ‘মায়া হাতি’ গর্তে পড়েছেন। কে লাথি মারছে আমরা বলতে পারি না। 
এত কিছু সত্ত্বেও সরকারের ভাবচক্কর ভাল না। আদালত র‌্যাব-এর সাবেক তিন সেনা কর্মকর্তাকে আটক করার নির্দেশ দিয়েছেন। সে নির্দেশে বলেছেন, যদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নাও থেকে থাকে তাহলেও যেন ৫৪ ধারায়, অর্থাৎ সন্দেহভাজন হিসেবে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এই লেখা লিখছি ১৩ মে দুপুরে। আদালত আদেশ দিয়েছেন ১১ মে। এর মধ্যেও তারেক সাঈদসহ ঐ তিন সামরিক কর্মকর্তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি বা করতে পারেনি কিংবা সরকার তাদের গ্রেফতারের অনুমতি দেয়নি। এখন গোটা দেশবাসী অপেক্ষায় আছে এই সাত বা ১১ খুনের বিচার আদৌ হবে কিনা, অপরাধীরা গ্রেফতার হবে কিনা সেটি দেখার জন্য।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads