বুধবার, ৭ মে, ২০১৪

হা করে দাঁড়িয়ে আছে ভীতির এক পরিবেশ


কি চেয়েছিল আর কি পেল দেশের জনগণ। শান্তির পরিবেশ পেল না, পেল না আলোকিত সমাজও। বরং সামনে হা করে দাঁড়িয়ে আছে এক আতঙ্কের পরিবেশ, ভীতির পরিবেশ। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে এ কেমন সমাজ উপহার দিল আমাদের সরকার এবং গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়নরা! ৭ হত্যাকা-ের পর সারাদেশ যখন বিক্ষুব্ধ তখনও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে নজরুলসহ নারায়ণগঞ্জের নিহত ৭ জনের পরিবারের সদস্যদের। পরিবারগুলোকে হত্যাকা- নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। পরিবারের আরো সদস্য হারাতে হবে বলে হুমকিদাতারা জানিয়ে দিয়েছে। তবে কোত্থেকে তারা এই হুমকি দিচ্ছে সে বিষয়টি রহস্যঘেরা। নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে র‌্যাব’র বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কাছে। উল্লেখ্য যে, গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হন নজরুল, তার তিন বন্ধু, গাড়ির ড্রাইভার এবং সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার ড্রাইভার। অপহরণ ঘটনার পরই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেন, থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন, হাসমত আলী হাসু, ইকবাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ফতুল্লা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। তবে এই আসামীদের কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। এই ব্যর্থতার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছে নানা অভিযোগ। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জের ডিসি, এসপি, র‌্যাব ১১-এর কমান্ডিং অফিসার এবং ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর এখন তো পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে, মন্ত্রীর ছেলের মধ্যস্থতায় নজরুল খুনের চুক্তি হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা র‌্যাব ১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদসহ তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে নারায়ণগঞ্জের ৭ ব্যক্তি অপহরণ ও খুনের ঘটনায় বরখাস্ত  করা হয়েছে। বরখাস্তকৃত বাকি দু’জন হলেন মেজর আরিফ ও লে. রানা। গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের নিচতলায় নামায ঘরে নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের জানান, ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে ৭ খুনের চুক্তি হয়। র‌্যাব’র সঙ্গে এ চুক্তি করেন নূর হোসেন। আর এ কাজে মধ্যস্থতা করে দেন এক মন্ত্রীর ছেলে। অভিযুক্ত নূর হোসেনের সঙ্গে সড়ক ও জনপথের ঠিকাদারি কাজ করতেন মন্ত্রীপুত্র। তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের একটি অংশের উপকরণ সরবরাহের কাজ করছিলেন যৌথভাবে। কী অপূর্ব সম্মিলন- ঠিকাদারি, ব্যবসা, রাজনীতি, খুন সবই চলছিল একসাথে!
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের লোকজন দায়িত্বে অবহেলা বা অপরাধ করলে সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এই সব ব্যবস্থায় আন্তরিকতা কিংবা ন্যায় নিষ্ঠার অভাব থাকলে জনমনে হতাশার মাত্রা বাড়ে। যেমন নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় জনগণ এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যরা এখন বলছেন, যেসব অভিযান ও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা সবই লোক দেখানো। অভিযোগ জানানোর পরপরই দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলে এতগুলো মানুষকে প্রাণ হারাতে হতো না। প্রসঙ্গত নারায়ণগঞ্জের ডিসি ও এসপিকে প্রত্যাহারের প্রসঙ্গটি এখানে উল্লেখ করা যায়। এ ব্যাপারে পত্রিকায় শিরোনাম করা হয়েছে, ‘নরায়ণগঞ্জে সেই ডিসি-এসপিকে প্রাইজ পোস্টিং।’ খবরটিতে বলা হয়, নরায়ণগঞ্জের আলোচিত জেলা প্রশাসক মনোজকান্তি বড়াল ও পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম প্রাইজ পোস্টিং পেয়েছেন। চাঞ্চল্যকর ৭ অপহরণ ও হত্যাকা-ের ক্ষত শুকানোর আগেই তারা পদায়ন পেয়েছেন যথাক্রমে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি)। ব্যর্থতার অভিযোগে প্রত্যাহারের দিনই একই আদেশে তাদের নতুন কর্মস্থলে পদায়ন করা হয়। বিভাগীয় ব্যবস্থা বা অনুসন্ধান না করেই এই দুই কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করায় প্রশাসনে চলছে কানাঘুষা। অনেকেই বলছেন, এত বড় ব্যর্থতার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। খতিয়ে দেখা উচিত ছিল তাদের ভূমিকা। কিন্তু তা না করে এদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। তাছাড়া অপহরণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন এই ডিসি ও এসপি’র মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত বহু ‘রাজনৈতিক অপরাধী’ও অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। ফলে যাচাই-বাছাই না করে যাকে- তাকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। এমন চিত্র বিবেচনায় এনে এখন অনেকেই বলছেন, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেও আছে রকমফের। এজন্যেই বলা হচ্ছে সব ব্যবস্থাই ব্যবস্থা নয়, লোক দেখানো ব্যবস্থাও লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই হয়তো ৭ হত্যাকা-ের পরও দেশে গুম ও অপহরণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। গত রোববার সুনামগঞ্জ থেকে গাড়িচালকসহ বিএনপি’র এক প্রবাসী নেতা ও সিলেট নগরী থেকে ব্যাংকের এক প্রহরী অপহৃত হয়েছেন। অপহরণের এইসব ঘটনায় সিলেটে ও সুনামগঞ্জে তোলপাড় চলছে। সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সাবেক সহ-সভাপতি ও যুক্তরাজ্য যুবদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুজিবুর রহমান মুজিব রোববার বিকেলে সুনামগঞ্জ থেকে ছাতকে ফেরার পথে গাড়িচালকসহ নিখোঁজ হন।
আমরা জানি, বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে বেশ শক্ত কথা বলেছিলেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তারা অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু তারা কথা রাখেননি। বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নের ব্যাপারে তাদের অতি উৎসাহ লক্ষ্য করা গেলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং র‌্যাব ও পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের কারণে এখন তারা নিজেদের স্বার্থে নিজেদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এখন বলছেন, কর্তাব্যক্তিরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে একটি অন্যায় কাজ করালে, তারা নিজেরা আরো দশটি অন্যায় কাজ করার উৎসাহ পায়। এ কারণেই এখন হয়তো পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হচ্ছে, ‘র‌্যাব-পুলিশই আইন মানে না।’ আমরা জানি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয় আইনের রক্ষক। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন তাদের দায়িত্ব। এই লক্ষ্যে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আইন লঙ্ঘনকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দায়িত্ব পালন করতে হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, গত কয়েক বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় মহামারীতে রূপ নিয়েছে গুম, অপহরণ ও খুন। এর জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহারকে দায়ী করছেন সমাজ বিশ্লেষকরা। লক্ষণীয় বিষয় হলো- কাউকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার বা আটক রেখেই নয়; ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুন-খারাবির মত বেআইনী কর্মকা-েও জড়িয়ে পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য। সম্প্রতি দেশে সংঘটিত অপহরণ-গুমের মত অপরাধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিশেষ করে র‌্যাব’র সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন অপহৃতদের আপনজনরা। এ কারণে রাষ্ট্র জননিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এই প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আইনবিদরা বলছেন-আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক কাজে অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে তাদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছে। একই সাথে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির অভাবে এসব বাহিনীর অনেক সদস্য অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো বিপর্যয় ঘটবে।
আমরা জানি, হতাশার মধ্যে কোনো মুক্তি নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতেও আমরা আশাবাদী হতে চাই। তবে আশাবাদের বাস্তব ভিত্তি রচনায় সরকারের প্রতিশ্রুত দায়িত্ব পালন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের রাজনৈতিক কিংবা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহারের পরিবর্তে জনস্বার্থে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বিধিবদ্ধ স্বাধীনতা দেয়া প্রয়োজন। আর বর্তমান সময়ে জনমনে আতঙ্ক ও ভীতির যে অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে তা দূর করতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃশ্যমান কিছু শাস্তিরও ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে সময়ের এইসব দাবি পূরণে কাক্সিক্ষত চেতনা জাগ্রত হয় কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads