সোমবার, ৫ মে, ২০১৪

আসামে মুসলিম হত্যা


ভারতের বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্য আসামে আবারও মুসলমানদের হত্যার অভিযান শুরু হয়েছে। খোদ ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের খবরেই জানা গেছে, গত শুক্রবার দুপুর থেকে মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৩১ জন মুসলিম নারী-শিশু ও বৃদ্ধকে হত্যা করেছে সশস্ত্র ‘বোড়ো’ ঘাতকরা। হত্যাকা-গুলো ঘটেছে আসামের কোঁকড়াঝাড়, বক্সা ও চিরাং জেলায়। আশপাশের জেলাগুলোতেও তৎপর দেখা গেছে সশস্ত্র ‘বোড়ো’ ঘাতকদের। এসব জেলা থেকে মুসলিম যুবক ও পুরুষরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গেছেন। ওদিকে প্রথম দু’দিন পর্যন্ত সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পর আসামের রাজ্য সরকার তখনই পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীকে জেলাগুলোকে পাঠিয়েছে, যখন মুসলিম হত্যাকা-ের খবর বিশ্বের মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও হত্যাকা-ের অনেক পরে তৎপর হয়েছে। উল্লেখিত তিন জেলার পাশাপাশি ধুবড়ি, বড়পেটা, বনগাইগাঁও, নলবাড়িসহ বেশকিছু এলাকায় সরকার কার্ফিউ জারি করেছে। প্রকৃত ঘাতকরা তাই বলে গ্রেফতার হয়নি। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অব বোড়োল্যান্ডের (এনডিএফবি) পক্ষ থেকে বরং সর্বশেষ উপলক্ষেও মুসলিমবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হত্যাকা-ের আশু কারণ জানাতে গিয়ে ভারতীয় মিডিয়া বলেছে, গত ২৪ এপ্রিল উল্লেখিত তিন জেলাসহ লোকসভার নির্ধারিত আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুসলিম ভোটাররা বোড়োদের সংগঠন এনডিএফবির প্রার্থীকে ভোট দেননি। এজন্যই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে ‘বোড়ো’ ঘাতকরা। তারা গ্রামাঞ্চলে মুসলমানদের বাড়িতে গিয়ে একে-৪৭ ধরনের সর্বাধুনিক অস্ত্র দিয়ে গুলী চালিয়েছে। বোড়োদের প্রতিহিংসার ভয়ে আগে থেকে মুসলিম যুবক ও পুরুষরা পালিয়ে যাওয়ায় গুলীর শিকার হয়েছেন নারী-শিশু ও বৃদ্ধরা। পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নামানো এবং কার্ফিউ জারি করা হলেও, ওই এলাকায় রোববার পর্যন্তও মানুষ প্রচ- আতঙ্কের মধ্য দিন কাটিয়েছে। মুসলমান কোনো যুবক ও পুরুষকেই প্রকাশ্যে কোথাও দেখা যায়নি।
আমরা আসামে মুসলিম হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। বলা দরকার এবারই প্রথম নয়, এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ভারতের এই রাজ্যটিতে মুসলমানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোড়ো ঘাতকরাই হত্যার অভিযান চালিয়েছে। মাত্র দুই বছর আগে, ২০১২ সালেও মুসলিম হত্যার ভয়াবহ অভিযান চালিয়েছিল বোড়োরা। সেবারের অভিযান এতটাই মারাত্মক ছিল যে, কয়েক হাজার মুসলিম পরিবার নিজেদের বাসাবাড়ি শুধু নয়, আসাম রাজ্য ছেড়েও পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ভারতের অন্য কোনো রাজ্যেও তাদের আশ্রয় দেয়া হয়নি। তাদের বরং ধাওয়ার মুখে রাখা হয়েছিল। সেবার মুম্বাইকেন্দ্রিক রাজ্য মহারাষ্ট্রের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনা শুধু আসামের মুসলমানদের বিতাড়নের জন্যই আন্দোলন গড়ে তোলেনিÑ এ অভিযোগও তুলেছিল যে, ওই মুসলমানরা নাকি বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে গিয়ে ভারতে বসবাস করার চেষ্টা চালাচ্ছেন! মৃত জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী নেতা বাল ঠাকরের দল শিবসেনার সশস্ত্র ক্যাডাররা একই সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধেও অভিযান শুরু করেছিল। তথ্যগুলো উল্লেখের কারণ হলো, ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে যা কিছুই লেখা থাকুক না কেন, বাস্তবে ভারত এখনো সম্পূর্ণ হিন্দুত্ববাদী একটি রাষ্ট্রই রয়ে গেছে। দেশটিতে বিশেষ করে মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। বর্তমান পর্যায়েও সে সত্যেরই প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে। দেশটিতে এখন লোকসভার নির্বাচন চলছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র রেখেও প্রধান বিরোধী দল বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদী দলগুলো নতুন করে মুসলমানবিরোধী ধোঁয়া তুলেছে। বিজেপি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং ২০০২ সালে গোধরায় হাজার হাজার মুসলমান হত্যার দায়ে ‘কসাই’ নামে কুখ্যাত হয়ে উঠা নরেন্দ্রনাথ মোদিকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করেছে। তিনিও কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ কথিত বাংলাদেশীদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, ভারতে অবৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশীদের ‘গাঁট্টি-বোচকা’ বেঁধে তৈরি থাকতে বলেছেন। অর্থাৎ তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেই ঘাড়ে ধরে বের করে দেবেন বাংলাদেশীদের! কারণ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘রিফিউজি’ ভোটারদের কারণেই বিজেপি নাকি নির্বাচনে জিততে পারে না।
উদ্বেগের কারণ হলো, বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্য আসামের রাজনীতিতেও একইভাবে মুসলমানদের টার্গেট বানানো হয়েছে। সেখানে পৃথক রাজ্যের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত বোড়োরা ক্ষমতাসীন কংগ্রেস বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার পরিবর্তে এমনভাবেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগে আছে, যা দেখে মনে হবে যেন মুসলমানরাই বোড়োদের সকল বঞ্চনার জন্য দায়ী! উল্লেখ্য, বোড়োদের প্রশমিত করার কৌশল হিসেবে ভারত সরকার বছর দুই আগে কোঁকড়াঝাড়, বক্সা, চিরাংসহ কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে পৃথক একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এতেও বন্ধ হয়নি বোড়োদের সশস্ত্র কর্মকা-। তাদের দাবি, ওই অঞ্চলে কেবল বোড়োরাই বসবাস করবে। অন্য কেউ, বিশেষ করে মুসলমানরা বসবাস করতে পারবেন না। অথচ সরকারি হিসাবে ৩৭.৫ শতাংশ এবং বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৪৫ শতাংশ আসামের নাগরিকই মুসলমান। তাছাড়া বোড়োদের দাবি মানার অর্থ তাদের এলাকাকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়া। এজন্যই ভারত সরকার স্বাধীন বোড়োল্যান্ডের দাবি প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে বোড়োরা। তারা সব রাগ মেটাচ্ছে মুসলমানদের ওপর। আমরা মনে করি, কেবল মুসলমান হওয়ার কারণে একটি রাজ্যের প্রায় অর্ধেক নাগরিক বোড়োদের হাতে নির্যাতিত হবেন এবং তাদের হত্যা করা হবেÑ এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে পারে না। ভারত সরকারের উচিত সশস্ত্র বোড়ো ঘাতকদের খুঁজে বের করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিজেপির মতো দল এবং নরেন্দ্রনাথ মোদির মতো রাজনীতিকদেরও উচিত মুসলমানদের ব্যাপারে নীতি ও কর্মকা-ে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো। ভারত সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কিনাÑ সে কথাটা এবার ভারতীয় রাজনীকিদেরই প্রমাণ করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads