বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০১৪

অর্থমন্ত্রীর বয়স, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাকে সাক্ষী মানলাম


আজ মে দিবস। এই দিবসের তাৎপর্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ নিয়ে কী ধরনের নোংরা রাজনীতি হয় তার প্রমাণ রানা প্লাজা। ক্ষমতার রাজনীতির স্ফীত মেদ কত ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তা দেখার জন্য আমাদের শ্রমঘন পোশাক শিল্পের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। এত বড় ঘটনায় কোনো মন্ত্রী দায় নিয়ে পদত্যাগ করেনি। ফেরিঘাটের দুর্ঘটনায় আমাদের দূরপ্রতিবেশী দেশে দায় নিয়ে মন্ত্রী পদত্যাগ করলেন। অথচ আমাদের নেতানেত্রীরা দায়বোধের ডুগডুগি বাজান, কান্নার ভান করে আবেগ ঝরিয়ে করুনা ভিক্ষা করেন। হলমার্ক, ব্যাংক, ডেসটিনি ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি তো অর্থমন্ত্রীকে আঁচড়ও কাটল না।

আমরা নিজেদের দিকে তাকাতে অভ্যস্ত নই। আত্মসমালোচনার বোধ নষ্ট হয়ে গেছে। নিজেদের ভুলত্রুটি নীতি-নৈতিকতা, সীমাহীন ঔদ্ধত্য, ক্ষমতার দম্ভ-অহমিকা কিছুই চোখে পড়ে না। অন্যরা আমাদের দিকে কিভাবে তাকাল সেটা দেখতেই আমরা ব্যস্ত। কেউ আমাদের সমালোচনা করুক, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিক, ভালো-মন্দ বলে দিক, এটা অসহ্য মনে হয়। ভিন্নমত, দ্বিমত পোষণ যেন পাপ। সব ব্যাপারে একমত না হলেই শত্রু জ্ঞান করা, গুম অপহরণের ঝুঁকিতে পড়া একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তা ছাড়া এই সমাজে এখন কেউই নিরাপদ নন। তাই বলে আমাদের লজ্জা-শরম কমেছে বৈ বাড়েনি। আমরা প্রতিনিয়ত দুই কানকাটা নির্লজ্জ মানুষের মতো আচরণ করছি। কথায় আছে এক কানকাটা মানুষ রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাটে। উদ্দেশ্য কাটা কানটা আড়াল করা। দুই কানকাটা মানুষ রাস্তার মধ্য দিয়ে হাটে। কারণ কাটা দুটা কান আড়াল করার সুযোগ থাকে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এই সরকারের আচরণ ছিল এক কানকাটা মানুষের মতো। বাড়াবাড়ি করেছে কিন্তু লজ্জা পেয়েছে এমন ভাব দেখিয়েছে। ৫ জানুয়ারির পর দুই কানকাটা মানুষের মতো এতটা নির্লজ্জের মতো আচরণ করছে তার কোনো সংজ্ঞা নিরূপণ করা কঠিন। উপজেলায় নির্বাচনের নামে মাতলামির পর তা আরো বেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আমাদের অতি উৎসাহ নেই। আমরাও মনে করি কোনো রাষ্ট্রদূতই ভাইসরয় নন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বলে কোনো কথা নেই। আমাদের জাত তুলে আঁতে ঘা দিলে নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ আছে বলেও মনে করি না। আমাদের অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনে হলো তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে শুধুই গ্রামীণ ব্যাংক, ডক্টর ইউনূস ও পোশাক শিল্পের স্বার্থ নিয়েই ভাবতে চান। আমরা অর্থমন্ত্রীর বয়স, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সাক্ষী মানলাম- ঘটনা কি অতটুকুনই! কদিন আগেও একজন মন্ত্রী বললেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বোঝাপড়া ভালো। তাহলে হঠাৎ করে অস্বস্তির কারণ ঘটল কেন, সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নেয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তো আর বিরোধীদলের মতো নয় যে, মানিনা, মানব না বলে রাজপথে নামবে। তারা কূটনৈতিক আচরণ দিয়েই তাদের মনের ভাব প্রকাশ করবে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার মানতে গিয়ে তারা সরকারকে কিছু বিষয়ে সহযোগিতা দিচ্ছে, কিছু বিষয়ে আপত্তি জানাচ্ছে। প্রকাশ্যে জানান দিচ্ছে, তারা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক তা চায়। বিশেষত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও একটি বৈধ সরকার গঠনের তাগিদ অব্যাহত রেখেছে। এটাতো ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১৪ কোটির দাবি। আমাদের জানা মতে ভারত ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্র, দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, আন্তর্জাতিক ফোরাম ও সংগঠন বর্তমান সরকারকে গণতন্ত্রের মানদণ্ডে বৈধ বলতে চাচ্ছে না। তাই রাখ-ঢাক করে কথাগুলো ঘুরিয়ে বলছে। 

এটা ঠিক অনেকেই শব্দ চয়নে অবৈধ বলছে না, কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একদলীয় সরকার ও অনুগত বিরোধী দলের উপস্থিতিকে মেনেও নিচ্ছে না। এই সংসদীয় সরকারের নামে যে তামাশা সেটাও অনুমোদন করছে না। কেউ কেউ ঘুরিয়ে বলছেন- বর্তমান সংসদ পূর্ণ মেয়াদ থাকুক-সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। একটা স্বাধীন দেশের সরকারের সাথে এর চেয়ে আর কী ধরনের ভাষা ও ভাব প্রকাশ করলে আমাদের সরকারের কানে পানি যাবে জানি না।

অর্থমন্ত্রী যদি তার অভিজ্ঞতা ও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারকে সাক্ষী মানতেন, তাহলে নির্বাচনের আগে তার মন্তব্য স্মরণ করে আজকের ভূমিকার জন্য লজ্জিত হতেন। তার মতো লোকও যখন নীতিনৈতিকতার ভাষা বুঝতে চান না, তখন মনের কষ্ট বাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের স্বার্থের বোঝাপড়ায় কতটা বন্ধুপ্রতিম, কতটা নয়, সেটা সামনে রেখে পরিচিতিবোধ নিয়ে মন্তব্য করলে অর্থমন্ত্রী ভালো করতেন। সব কিছু জুুটা হ্যায়পাগলা মেহের আলীর সংলাপে মানায়। বোগাস, রাবিশ শব্দও অর্থমন্ত্রীর সাথে যায়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বর্জিত মন্তব্য কোনোভাবেই দেশের জন্য এবং খোদ অর্থমন্ত্রীর জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। শিষ্টাচারের মধ্যে তো পড়েই না। আমলা চরিত্রের অর্থমন্ত্রীকে খল স্বভাবের রাজনীতিবিদ ও পতিত বামদের মতো রোমান্টিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিলাসী মানুষ মনে না করতে পারলে আমাদেরও ভালো লাগত।

দেশের ভেতর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উৎসব চলছে। খুনের অবস্থা নুন এবং চুনের চেয়েও সস্তা। অপহরণ তো রুটিন ওয়ার্ক। আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। মানবাধিকার অধরা এক সোনার হরিণ। দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারতের সাবেক বিচারপতিও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, তাহলে বিচার বিভাগ আইন-আদালত থাকল কই। ঢাকার উত্তরায় অপহৃত যুবদল নেতার লাশ মিলল নোয়াখালীতে। একজন নির্বোধ বালকও বুঝতে পারে এমন অপহরণ কারা করে। কারা গুলি করে হত্যা করে, আবার লাশ উদ্ধারের নাটক করে। সাতক্ষীরা ও নরায়ণগঞ্জে কিসের আলামত সেটাও জনগণ বোঝে।

অর্থমন্ত্রীর চোখে কি এত সব মৌলিক বিষয় আদৌও পড়ে না। যুক্তরাষ্ট্রকে কেন যত শক্তিধর দেশই হোক বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে সুযোগ না দেয়ার ব্যাপারে আমাদেরও সহমত রয়েছে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য দোষত্রুটিগুলো সম্পর্কে যারা মন্তব্য করছে তাদের সাথে সুর না মিলালেও জনগণ তাদের ত্রাণকর্তা ভাবতে চাইবে। কারণ রাষ্ট্রের সন্তানতুল্য নাগরিকদের গুম, অপহরণ ও হত্যা করে সরকার লুকাতে চায়, তারা সেটা দেখছে, বলছে। এটাকে জনগণ অপরাধ ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ মনে করবে না।

আবার অর্থমন্ত্রীর বয়স ও অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়, একটি প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হওয়ার সুখানুভূতি লালন করবেন আর দায় নেবেন না তাও কি হয়। আপনাদের দুর্বলতার জন্য, বাড়াবাড়িমূলক তৎপরতার জন্য বিশ্বের কাছে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। জাতি হিসেবে আমরা বিশ্ববাসীর কাছে হাসির পাত্র হচ্ছি। তা দেখার দায়িত্ব কি বয়সে প্রবীণ, অতিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ অর্থমন্ত্রীরও থাকতে নেই কিংবা তার মত মানুষেরও বিবেক স্পর্শ করবে না! এই বয়সেও কি তিনি সাদাকে সাদা বলবেন না!

আমাদের দারিদ্র্য নিয়ে কেউ কটাক্ষ করলে আমরা হজম করি। আমাদের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুললে নিজেদের খাছলত ও নৈতিক অবস্থার কথা স্মরণ করে লজ্জিত হই। শোষণ, বঞ্চনা ও নানামুখী অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও মানতে কষ্ট হয় না। কষ্ট হয় আমাদের সরকার, সংসদ, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুদক, সেবা খাতসহ প্রাতিষ্ঠানিক সরকার কাঠামোর ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে। সরকার একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও রাখল না যেটিকে নিয়ে বলা যাবে এটি দলান্ধ নয়। যে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দেশের তাবৎ মানুষ লজ্জিত, শুধু লজ্জিত নয় সরকার ও নির্বাচন কমিশন নামে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানটি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে যখন বিদেশীরা বলেন- এটা নির্বাচন নয় প্রহসন, এই সংসদ নির্বাচিত নয় অর্থহীন একটি ফোরাম, এই সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ, এই আইন অকার্যকর, এই গণতন্ত্র গণতন্ত্র নয়, তখন জনগণের দেখা অভিজ্ঞতার সাথে বিদেশীদের পর্যবেক্ষণ মিলে যায়। অর্থমন্ত্রী নিজেও জনগণের নির্বাচিত ও আক্ষরিক অর্থে বৈধ প্রতিনিধি নন। এই সরকার তো নয়ই। তাহলে জনগণের কাছে কাদের বিরুদ্ধে মিডিয়াকে সাক্ষী মেনে নালিশ করছেন যাদের পর্যবেক্ষণের সাথে জনগণের পর্যবেক্ষণের কোনো গরমিল নেই। বিরোধী জোট তো বটেই অনেকেই বলছেন, দেশের জনগণ আপনাদের চায় না। চায় কি চায় না সেটা খতিয়ে দেখার ঝুঁকিও আপনারা নিতে নারাজ। এর ওপর বিদেশীরা আপনাদের অস্বস্তিতে রেখেছে। নানামুখী চাপ দিচ্ছে। ন্যায়সঙ্গত দাবিও বিবেচনায় নিচ্ছে না। তারপরও ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন কেন, কোন নৈতিক শক্তিতে। কিংবা কোন ধরনের দেশপ্রেমের দোহাইতে। বিশ্ববাসীর কাছে কেনই বা নিজেদের মান-ইজ্জত খোয়ানোর পর দেশের ও জনগণের মান-ইজ্জত নিয়েও ছিনিমিনি খেলছেন। দোহাই আল্লাহর, দেশের ও জনগণের স্বার্থে নিজেরা মুক্তির পথ খুঁজুন। জাতিকেও জবরদস্তিমূলক শাসন-শোষণ, গুম, হত্যা ও অপহরণ থেকে মুক্তি দিন। জনগণকে বিশ্বাস করলে হয়তো হারবেন, ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়বেন, নিশ্চিহ্ন তো হবেন না। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা পরিবর্তনের সব পাটাতন সরে গেলে কারো শেষ রক্ষা হয় না। 


 মাসুদ মজুমদার

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads