বুধবার, ২১ মে, ২০১৪

গুম অপহরণের এই দেশ কি চেয়েছিলাম?


দেশ এখন এক কঠিন ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষকে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরোতে হচ্ছে। বিশেষ করে সারা দেশের দৃষ্টি যখন নারায়ণগঞ্জের দিকে,তখন নারায়ণগঞ্জের মানুষেরা তাকিয়ে আছেন সারা দেশের দিকে। নারায়ণগঞ্জের শিশু কিশোর থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধরাও আতংকে দিনপাত করছেন।  দেশের সীমানা একটু বাড়েনি,তবে বেড়েছে হত্যা গুম আর তথাকথিত ক্রসফায়ার। এ লেখাটি যখন লিখছি তখনও হয়তবা  ক্রসফায়ার আর গুম হাতছানি দিয়ে কাউকে না কাউকে ডাকছে, টাকা দিতে চাপ দিচ্ছে। আর লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন হয়তবা অর্ধ গলিত লাশ শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র, তুরাগ, পদ্মা, মেঘনার তীরে ভেসে ওঠবে। নিহত স্বজনেরা নজরুল ইসলামের স্ত্রী সন্তানের মতো চোখের অশ্রু ফেলবে,আর নুর হোসেনের মতো বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসীরা আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভিনদেশে চলে যাবে। নুর হোসেনকে কারা বিদেশে যেতে সাহায্য করল তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। কোন অদৃশ্য শক্তির  জোরে নুর হোসেন ট্রাকের হেলপার থেকে সন্ত্রাসীদের গডফাদার হয়েছেন তাও বিবেচনায় আনতে হবে। সরকার বলবে খুনিদের বিচার করা হবে, মিডিয়ার সাংবাদিকরা রিপোর্ট করবে,বিরোধী দল দুঃখপ্রকাশ করবে, সুশীলসমাজ একটু মাথা নাড়িয়ে ধিক্কার দিবে, ওই পর্যন্তই। কিন্তু খুনের বিচার শেষ পর্যন্ত হবে না। নিহত স্বজনদের সান্তনা দেয়ার ভাষা আমাদের জানা নেই,কারণ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, দেশে কোনো গুম, হত্যা, ক্রসফায়ার হচ্ছে না। গুম, হত্যার কথা আমার সামনে বলবেন না। তখন নিভৃতে সাধারণ মানুষের চোখের পানি ফেলা বৈ কি আর করার থাকে?
দেশে সর্বত্র রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আর দুর্নীতির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠছে হাজারো নুর হোসেন। তারা ক্ষমতার লাঠি হিসেবে প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করে খুন, গুম নদীর দখল আর অবৈধ ব্যবসা দিনের পর দিন করে যাচ্ছে। তা দেখার যেন কেউ নেই। নুর হোসেনের আস্তানা থেকে পুলিশ বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল ওদ্ধার করেছে,যা মিডিয়ার বদলৌতে গোটা দেশবাসী দেখেছে,কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নুর হোসেনের অবৈধ ব্যবসার খোঁজ কি পুলিশ প্রশাসন আগ থেকে জানতেন না। নাকি তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছিলো, যার ফলে নুর হোসেন অন্যায় করেও পার পেয়ে যেতো। নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ নুরহোসেনদের গডফাদারদের কারা তাদেরকে দেখতে চায়। ত্বকী হত্যা থেকে শুরু করে সকল গুম অপহরণকারী খুনীদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দেখার প্রহর গুণছে নারায়ণগঞ্জবাসী। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য সরকারকে আগে গণতন্ত্রের সুপথে ফিরে আসতে হবে। মাঝি বিহীন নৌকা যেমন গন্তব্যে যেতে পারে না, ঠিক তেমনি গৃহপালিত বিরোধীদল সরকারকে সঠিক পথের দিশা দেখাতে পারে না। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধীদল যে গণতন্ত্রের অপরিহার্য পূর্বশত তা সরকার মানতে নারাজ। ক্ষমতার মোহে যখন সরকার গণতন্ত্রকে গলাটিপে ধরে দেশ পরিচালনা করেন তখনই তারা বিরোধীজোটকে গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু বলেই গণ্য করে থাকেন। যার ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে হয় বঞ্চিত।
৫ই জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ জিতেছে এ কথা সত্যি কিন্তু ১৬ কোটি মানুষ হেরেছে।  ভোটের অধিকার হরণের মধ্য দিয়েই দেশে নেমে এসেছে এক জগদ্দল পাথর । সেই পাথরের চাপে পিষ্ট হচ্ছে দেশের মানুষ। নির্বাচনকে ঘিরে পুলিশের গুলিতে যে প্রাণগুলো অকালে ঝরে গেল তার দায়ভার কে নেবে সরকার না রাষ্ট্র? জামাত শিবিরের অসংখ্য নেতা কর্মীদেরকে তথাকথিত বন্দুক যুদ্ধের নামে গুলি করে নিহত করেছে রাষ্ট্রীয়শক্তি। তখন সুশীল সমাজ আর মিডিয়া একটুও উচ্চবাচ্য করেনি, কারণ যারা র‌্যাব বা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন তারা সবাই ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত। একজন সুনাগরিক হিসেবে সমাজের প্রতিটি মানুষের উচিত ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করা। কিন্তু আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্র তা করেননি। কথায় বলে মাঘ মাস কারও জন্য চিরদিন থাকে না চৈত্র বৈশাখ ও আসে। সাপ দেখলেই যে কোন সুস্থ মানুষ একটু বিচলিত হয়ে যান, তবে যারা সাপের খেলা দেখিয়ে টাকা রোজগার করেন তারা কিন্তু একটওু বিচলিত হয় না। তারপরেও মানুষজন বলে, যে ওঝা সাপের খেলা দেখায় সে ওঝাও নাকি সাপের কামড়েই মরে। এক কথায় গত জানুয়ারি থেকে ক্ষমতাসীন দলটির নেতা-কমীদের হত্যা লুণ্ঠনের তৃষ্ণা এতো বেড়ে গেছে যা রাষ্ট্র লাগাম দিয়েও টেনে ধরতে পারছেন না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা সায়াদকে যখন একই সংগঠনের একদল কর্মী পিটিয়ে হত্যা করেন,তখন কেউ অনুমান করতে পারেননি যে, সেই হত্যার রেশ না কাটতেই নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মতো ঘটনা ঘটবে। যিনি হত্যার শিকার হলেন, তিনিও খোদ সরকার দলীয় নেতা।  কোন মানুষের অকাল মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারি না। তারপরও অকাল মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে  দীর্ঘতর হচ্ছে। একটি অপরাধের সঠিক বিচার না হওয়ার প্রেক্ষিতে আরেকটি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। সাগর-রুনির হত্যার ২৭ মাস অতিবাহিত হলেও মেঘ তার বাবা মার খুনি কারা তা জানতে পারেনি। একটি দেশের সরকার যখন বিরোধীজোটের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়,তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচীকে পুলিশবাহিনী দিয়ে প্রতিহত করে অট্টহাসিতে হাসে তখনই দেশের আইনশৃঙ্খলা চরম বিপর্যয়ের দিকে যায়। র‌্যাব বাহিনীকে দোষ দিয়ে কি লাভ? যাদের হাতের রিমোট কন্ট্রোলে র‌্যাবের বেতন হয়, বিলাস বহুল গাড়ি হয় তারা যদি একটু কঠোর হন তাহলে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। র‌্যাব বাহিনীর সুনামের চেয়ে অপরাধের পাল্লাই আজ ভারি হয়ে ওঠছে। যে বাহিনী জীবন দিতে জানে না,নিতে জানে সেই বাহিনীর কার্যক্রম চালু রাখার প্রয়োজন কতটুকু আছে তা বিবেচনা করবে এদেশের ১৬ কোটি মানুষ। 
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব। সরকার সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে লঙ্ঘিত হচ্ছে সংবিধান। তিনি আরো বলেছেন,ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধ করতে হবে। কার্যত নাগরিক নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচিত গুম-খুন-অপহরণ এখন আর কেবলমাত্র সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের আলোচনায় সীমাবদ্ধ নেই বরং সহিংস রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।সরকারের সোনার ছেলেরাও জড়িয়ে পড়ছে গুম আর অপহরণের মতো জঘন্যতম ঘটনার সাথে। গত শুক্রবার অপহরণের মুক্তিপণ আদায় করতে গিয়ে ছাত্রলীগের পাঁচ নেতাসহ সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ। এঁদের গ্রেফতার দেখানো হবে কি না তা নিয়ে পুলিশও ছিল বিভ্রান্ত। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এদের ছেড়ে দিতে চাপ দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
গুম অপহরণ নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে। গুম অপহরণ বন্ধ করার চেয়ে ব্লেইম গেইমের রাজনীতি চলছে। যারা গণতন্ত্রের মানসকন্যার উপাধি বহন করেন তাদেরই শাসনামলে আমরা কেউ আজ নিরাপদ নয়। যারা লেখালেখি করেন তাদের কলমের কালি না ফুরিয়ে গেলেও মনের ভাষা গুম আতংকে নিস্তেজ করে দেয়ার চেষ্টা চলছে । দেশ ও জাতির জন্য এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। সুতরাং আজ দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করার। সমাজের সবারই মনে একটিই প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে- কবে থামবে, এই গুম খুন অপহরণ। কিন্তু উত্তর দিতে পারছেন না কেউ-ই। তবে এর উত্তর অবশ্যই সরকারকে দিতে হবে। আমরা মনে করি সরকার বিরোধীদল রাজনীতিবিদ সুশীল সমাজ সবাই দেশকে ভালোবাসে। কিন্তু কেন কোন কারণে সবাই প্রতিহিংসার পথকে পরিহার করে সমঝোতার রাজনীতি করতে পারছে না। তা আজ আমাদেরকে ভাবতে হবে। প্রহসন আর কাকে বলে! যারা সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যার পথকে বাতলে দিচ্ছে তাদেরকে আজ ধরা ছোয়ার বাইরে রাখা হচ্ছে। যারা নববধূদের বিধবা করেছে,মায়ের কোল শূন্য করেছে, মাসুম শিশুদের এতিম করেছে,ঘরে ঘরে কান্নার রোল সৃষ্টি করেছে আজ হোক কাল হোক তাদের পরিবার পরিজনকে ও তার দায় নিতে হবে।
পৃথিবীর স্বৈরাচারী শাসকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যে কয়েক জন তাদেরই একজন ছিলেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ড এডরালিম মার্কোস। তার শাসনকাল ছিল দীর্ঘ ২০ বছর । কিন্তু সময় ও সুযোগ পেয়ে তিনিও ভুলে গিয়েছিলেন ইতিহাসের শিক্ষা। এই স্বৈরাচারী শাসকের ব্যক্তি ইচ্ছা অনুযায়ীই পরিচালিত হতো দেশের আইন-কানুন সরকার ও প্রশাসন। তিনি ১৯৭২ সালে সামরিক আইন জারির মাধ্যমে তার নিজের এবং তার পরিবারের হাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। তার চরম প্রতিদ্বন্দী নেতা বেনিগনো একুইনোকে হত্যার আদেশ দিতেও কুন্ঠাবোধ করেননি। দুর্নীতি,স্বজনপ্রীতি ক্ষমতার অপব্যবহার,জুলুম আর নির্যাতনের অনিবার্য পরিণতির ফলে অবশেষে একদিন তাকেও ক্ষমতার মসনদ ছাড়তে হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণঅভ্যুত্থানে সশস্ত্র বাহিনী শামিল হয়ে ত্বরান্বিত করে স্বৈরাচারের পতন। অবশেষে এই স্বৈরাচার ১৯৮৬ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ক্লার্ক বিমান ঘাঁটি থেকে একটি মার্কিন বিমানে করে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছিল।
ইরানের আরেক স্বৈরাচারের নাম আজো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে, কে না শুনেছে  বাদশা রেজাশাহ্ পাহলভির নাম। কী ছিল না তার, অর্থ বিত্ত সম্পদ সবই ছিল তার অফুরন্ত। কিন্তু ইতিহাস বলে, বিদায় বেলায় কোনো কিছুই তার কাজে আসেনি। তাকেও  প্রাণ রক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে হয়েছিল। এই ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি। ইতিহাস বলে,অন্যায় করে জুলুম করে নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে কেউ বেশি দিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি, যেমনটি পারেননি গাদ্দাফি ও হোসনে মোবারক। তাদের অহংকার ভেস্তে গেছে। তাদের শক্তি ক্ষমতা দম্ভ মিসমার করে দেয়া হয়েছে। তাদের নাম নিশানা ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। নমরুদ ফিরাউন সাদ্দাদ কারুন আবুজেহেল কেউ রক্ষা পায়নি। সময় তারা পেয়েছিল যথেষ্ট। তুবু সে সময় তাদের কোন কল্যাণে আসেনি,রোধ করতে পারেনি পতন। তবু যুগে  যুগে সাদ্দাদ, নমরুদ, ফিরাউন, আবু জাহেলরা আসে। ধরাকে সরা জ্ঞান করে। আমরা আশা করছি সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সকল গুম খুন অপহরণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদেরকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবে। ভয় আতংকের হাত থেকে রক্ষা পাবে এদেশের ১৬ কোটি মানুষ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads