শুক্রবার, ৩০ মে, ২০১৪

শাসকগোষ্ঠীর হিংস্র চেহারা


বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় আসীন হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এক আঁতাতের নির্বাচনের মাধ্যমে। সে নির্বাচনের কৌশল যারা সমর্থন করেছিলেন, তারা অবশ্য এখনও শিবের গীত গেয়েই যাচ্ছেন। সে সময় দেশে ছিল বর্তমানে পলাতক জেনারেল মঈনের কার্যত সামরিক শাসন। মঈন ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতা ছেড়ে দেয় ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষে। তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল সে সময়কার সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কাছে। আওয়ামী লীগ তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে রাজপথে অবস্থান নেয় এবং প্রকাশ্যে টিভি ক্যামেরার সামনে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হন কিংবা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের ব্যর্থ করা হয়। এরপর মঈন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। যদিও সামনে তিনি রেখেছিলেন মার্কিন শিখ-ি ফখরুদ্দিন আহমদকে। তারা সংবিধানবহির্ভূত একটি তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন এবং সংবিধান লঙ্ঘন করে দুবছর ধরে দেশ শাসন করেন।
জেনারেল মঈন যদিও প্রথম দিকে বলেছিলেন, তিনি একটি নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা থেকে চলে যাবেন। কিন্তু ক্রমেই তিনি ক্ষমতা তার অনুকূলে স্থায়ী করার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকেন। তার মধ্যে প্রধান পদক্ষেপ ছিল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করা। ইন্দো-মার্কিন ষড়যন্ত্রের রূপরেখাও তাই ছিল। তখন আওয়ামী লীগ জোর প্রচারণা চালাচ্ছিল যে, বিএনপি ইসলামী মৌলবাদীদের মদদ দিয়ে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করছে। ভারতীয় মদদে চালানো সেই প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্রও যে বিভ্রান্ত হয়েছিল তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ফলে প্রধানত, ঐ ভারতীয় প্রচারণার ফাঁদে যুক্তরাষ্ট্র পা দেয়। সে সময় বিএনপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল যে, তারা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, এর সবই ছিল ভারত ও আওয়ামী লীগের মিলিত প্রোপাগান্ডার ফসল। আর ইসলামী মৌলবাদ ছিল কেবলই প্রচারণার ডঙ্কা। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগই। দায়টা চাপানোর চেষ্টা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের ওপর।
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে যে প্রহসন হচ্ছে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন, ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রহসন ও উপজেলা নির্বাচনের ভোট ডাকাতিÑ সবকিছুই কার্যত একই সূত্রে গাঁথা। আমরা এমন এক শ্রেণীর লোক লক্ষ্য করি, যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনের সমালোচনা করতে গিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনের স্তুতি করতে কসুর করেন না। তারা বলতে চান ২০০৮ সালের নির্বাচন খুবই সুষ্ঠু হয়েছিল। কারণ তাতে রক্তক্ষয় হয়নি। কিন্তু সেখানে নির্বাচন কমিশন ও সামরিক প্রশাসন মনে হয়েছিল যে, একেবারে লিস্ট করে এগিয়ে গেছেন কোন আসনে কাকে জেতাবেন। সেই জন্য দেখা গেছে, ঐ নির্বাচনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোটারের চেয়ে ভোট পড়েছে বেশি। তা নিয়ে যখন প্রশ্ন উত্থাপন হতে থাকে, তখন তৎকালীন নির্বাচন কমিশনও ঘটনার তদন্ত না করে, প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন। সেভাবেই ৩০/৩২টি আসন ছাড়া বাকি সব আসন থেকে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে আনা হয়। আঁতাতটা ছিল তাই। জেনারেল মঈনের লুটেরা সরকার যখন দেশের পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিল না, তখন এরকম একটি নির্বাচনের আয়োজন করেছিল।
আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে ছবছর ইন্দিরা-প্রণবের পোষ্য হিসেবে সেদেশে আশ্রিত ছিলেন। সেই হিসেবে তাদের সম্পর্ক ব্যক্তি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ইন্দিরা-প্রণব রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশ হিসেবে শেখ হাসিনাকে মনে করতেন। আর সেই কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ করতে শেখ হাসিনা যেন কংগ্রেস সরকারকে বাংলাদেশটাকেই দিয়ে ফেলতে চাচ্ছিলেন। সেটা আরও কত বেশি নেয়া যায়, সেই জন্য যে কোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে মরিয়া ছিল কংগ্রেস। কিন্তু কংগ্রেসের আত্মবিমোহিত নেতৃবৃন্দ এ কথাও উপলব্ধি করতে পারেনি যে, তাদের যারা বধিবে সেই ভারতবাসী গোকুলে বেড়ে উঠছে এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভারতীয়রা কংগ্রেসকে শ্মশানে নিয়ে ফেলেছে। লোকসভার ৫৪৩ আসনে মধ্যে সারা ভারতে কংগ্রেস মাত্র ৪৪টি আসনে জয়লাভ করেছে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গে এক তৃণমূলই পেয়েছে ৩৪ আসন। এমনকি এই কুচক্রি কংগ্রেস দল বিরোধী দলের আসনে বসার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছে। সে মর্যাদা পেতে হলেও তাদের কমপক্ষে ৫৪টি আসনে এককভাবে জয়লাভ করা দরকার ছিল।
ভারতে কংগ্রেস যেমন, তেমনি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগও কল্পনা করেনি যে, তাদের পেয়ারের এই দলটি এমন ভরাডুবির শিকার হবে। ফলে হিসাব অনেকখানি উল্টে গেছে বৈকি। শুধুমাত্র ভারতীয় কংগ্রেসনির্ভর শেখ হাসিনা সরকার এখন চোখে-মুখে সরষে ফুল দেখতে শুরু করেছে। ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এখনও ক্ষমতায় আসীন তারও মূল কারিগর ছিল ভারতের কংগ্রেস সরকার। সারাবিশ্বে ধিক্কার উঠলেও শেখ হাসিনাকে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় রাখার জন্য কংগ্রেস মরিয়া ছিল। আর সে করাণেই শুধুমাত্র ভারতের স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে শেখ হাসিনাও আত্মবিমোহিত হয়ে উঠছিলেন।
আর ২০০৮ সালের আঁতাতের নির্বাচনের পর থেকে বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার এক আত্মবিনাশী খেলায় মেতে উঠেছিল সরকার। আর সে কাজে ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করে এসেছে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগকে। লীগ ক্যাডাররা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে পুলিশের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাদের সহযোগী বাহিনী হিসেবে নরহত্যায় মেতে উঠেছে। আমরা তখনই সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলাম যে, এটি না থামাতে পারলে এক সময় তা আওয়ামী লীগের জন্য ও একই সাথে দেশবাসীর জন্য বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে। এ অঙ্ক খুব স্বাভাবিক যে, আজ যে সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন-গুম করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, একসময় তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজেরাই গুম-খুন-অপহরণ-মুক্তিপণ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়বে। ঘটনা ঘটছেও তাই। নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা অভিযোগ অনুযায়ী ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে প্যানেল মেয়র কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের খুন করেছে। এ খুন ঢাকতে গিয়ে সেখানে খুন করা হয়েছে ১১ জনকে। যারা খুন হয়েছে তারা সরকারি দলের সমর্থক। যারা খুন করিয়েছে তারাও সরকারি দলের সমর্থক। আর যারা খুন করেছে বলে ধারণা করা হয় তারা সরকারের বাহিনী। অর্থাৎ খুনোখুনিটা এখন বিরোধী দল ছাপিয়ে সরকার ও সরকারি দলের ভেতরে বিস্তৃত হয়েছে।
উপরন্তু পুলিশ-র‌্যাবের বিরুদ্ধে প্রতিদিন খুন-গুম-অপহরণের অভিযোগ আসছে। প্রতিদিনই দু-চারটি পরিবারে কান্নার রোল উঠছে। স্বজন হারাদের আর্তনাদ আর দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারি হচ্ছে জনপদে। প্রতিবাদের শক্তিও তাদের নেই। প্রতিবাদ জানানোর কোনো ফোরাম নেই। সরকার সে আর্তধ্বনি উঠতে দিতেও চায় না। যেখানেই সেরকম সম্ভাবনা দেখা দেয়, সেখানেই তাদের পেটোয়া বাহিনী দিয়ে তা ভ-ুল করে দেয়ার চেষ্টা করে। কয়েকদিন আগে বিএনপির তরফ থেকে তেমন আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। কিন্তু সকালেই পুলিশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ভবনে তালা লাগিয়ে দেয়। সন্ধ্যায় পুত্রহারা, স্বামীহারা, ভাইহারা, পিতৃহারাÑ সেইসব মানুষ সমবেত হয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসে। শোকবিহ্বল লোকেরা চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন। বলেছেন, প্রতিবেলা ভাত ভিজে যায় মায়েদের অশ্রুতে।
তারপরও থেমে নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুম-খুন-অপহরণ বাণিজ্য। তাদের পাশাপাশি এসব অপকর্মের জন্য সশস্ত্র দলও গঠিত হয়েছে। বাজারে কিনতে পাওয়া যায় র‌্যাব, পুলিশের পোশাক, জুতা, বেল্ট, টুপি। সেগুলো বিক্রি হয় পুলিশের সামনেই। অর্থাৎ যে যেমন করে পারো চালাও গ্রেফতার বাণিজ্য। পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠুক অপরাধের জগত। অপরাধ বিস্তৃত হোক সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু এসব পাপ তো কখনও বাপকেও ছাড়ে না। সেটা নারায়ণগঞ্জে যেমন প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি প্রমাণিত হলো ফেনীতেও। জেল-জালিয়াতি করে একজন এমপি হয়েছেন আওয়ামী লীগ থেকে। সেটিও বিনা ভোটেই। তার নাম নিজাম হাজারী। সেখানে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান খুন হয়েছেন কয়েকদিন আগে। সন্দেহের আঙুল ঐ নিজাম হাজারীর দিকেই। তার ধারণা, উপজেলা চেয়ারম্যানই স্বার্থের দ্বন্দ্বে তার জেল-জালিয়াতির খবর ফাঁস করে দিয়েছেন। সে কারণেই ফিল্মি স্টাইলে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে ফেনী শহরে প্রকাশ্যে তার গাড়ির ভেতরে গুলী করে, কুপিয়ে হত্যা করে গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করা হয়েছে। জেল-জালিয়াতির কারণেই তো ইতোমধ্যে নিজাম হাজারীর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে গ্রেফতার করা উচিত ছিল। কিন্তু একরাম হত্যার পর তাকে বরং পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এরা উভয়ই আওয়ামী লীগের নেতা। এর সবকিছুর জন্য সরকারকে এক সময় চড়া মূল্য দিতে হবে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে জনগণকেও কম মাশুল গুণতে হবে না।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads