জীবন চলার পথে কিছু কিছু স্মৃতি আছে যা সারা জীবন সঙ্গী হয়ে জীবনের সাথে চলে। এমন তিনটি স্মৃতি যা আমার জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে। দুটি পরিচয়ের আর অপরটি বিদায়ের। ১৯৮০ এর জানুয়ারি মাস। তারিখটা মনে নেই। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী ও মালিবাগ এলাকায় সাজ সাজ রব। সবাই যেনো উৎসবমুখর। দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আসছেন দুটি স্কুল পরিদর্শনে। আমাদেরকে নিয়ে বড়দের কি না দৌড়ঝাপ। কারা কারা রাষ্ট্রপতিকে ফুল দেবেন আর কে কি ধরনের পোশাক পরবে ইত্যাদি। যদিও আমি তখন শান্তিবাগ স্কুলের ছাত্র। বড় ভাই সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের ছাত্র হওয়াতে ভাইয়ের কারণে রাষ্ট্রপতিকে ফুল দেবার দলে চান্স পেয়ে গেলাম। সকাল থেকেই নতুন পোশাকে ফুলের তোরা হাতে রাষ্ট্রপতির আগমনের অপেক্ষায়। বড়রা এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছেন। যতটা মনে পড়ে তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে ১১টা। হঠাৎ সাইরেন- রাষ্ট্রপতি আসছে। রাষ্ট্রীয় গার্ডসজ্জিত একটি সাদা রংয়ের গাড়ি থেকে ধূসর বর্ণের সাফারী পোশাক আর চোখে সোনালী সানগ্লাসে মহামান্য রাষ্ট্রপতি নেমে এলেন অপেক্ষমান জনতার ভিড়ে। কোন নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে হাসিমাখা মুখে একের পর এক সবার সাথে হাত মিলাতে মিলাতে সরাসরি চলে গেলেন মঞ্চের দিকে। আমরাও ছুটলাম তার পিছ পিছু- যে করেই হোক ফুলের তোরা রাষ্ট্রপতিকে দিতেই হবে। এরই মধ্যে মাইকে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে মঞ্চে আসন গ্রহণের জন্য আহ্বান করা হলো। এরপরই ঘোষণা আসলো ফুল দিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বরণ করে নেয়ার। মুক্তিযুদ্ধের ১১ সেক্টর এর পক্ষ থেকে আমরা ১১ জন শিশু রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলাম। রাষ্ট্রপতি আমাদের সবাইকে মাথায় হাত দিয়ে আদর করেছিলেন। এরপর রাষ্ট্রপতি বক্তব্য রাখলেন। ভরাট কণ্ঠে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দিয়ে বক্তব্য শুরু করলেন। সেদিনের সেই ভরাট কণ্ঠের ভাষণ আজও কানে বাজে।
১৯৮০ শেষের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক আয়োজিত নতুন কুঁড়ি শিশু-কিশোর জাতীয় প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্বে আমি আবৃতিতে ২য় স্থান লাভ করি ঢাকা বিভাগের প্রতিযোগী হিসেবে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সকল প্রতিযোগীর সাথে একমঞ্চে এসে জীবন বাংলাদেশ গানটি গাইলেন। গান শেষে রাষ্ট্রপতি জিয়া সকলের সাথে করমর্দন করলেন। শিশুদের প্রতি শহীদ জিয়ার ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা। যে কারণে তিনি শিশু মন্ত্রণালয়, শিশুপার্ক এবং শিশু একাডেমীসহ নানা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯৮১-এর ৩০ মে। যথারীতি ঘুম থেকে জেগে বাসার সবার স্কুলে যাবার প্রস্তুতির ধুম। মা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। বাবা সাধারণত ফজরের নামায পরে বাড়ির মধ্যেই রেডিও হাতে নিয়ে পায়চারি করেন। হঠাৎ বাবা-মাকে চিৎকার দিয়ে ডেকে বলেন, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়া কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্য দ্বারা নিহত হয়েছেন। আমার যতটা মনে পরছে, আমার মায়ের হাতে থাকা রুটি বানানোর বেলুনটা হাত থেকে পরে গেলো। বাবার চোখ ছলছল। যেনো মুহূর্তের মধ্যে গোটা বাড়িটা বিস্বাদে পরিণত হলো। বাবা বললেন, স্কুলে যেতে হবে না। বাবা-মার সাথে আমরা সকল ভাই-বোন রেডিওর ঘোষণা শুনছিলাম। ঘোষণার মাঝে মাঝে কুরআন তেলাওয়াত আর হামদ-নাত চলছে। ইতোমধ্যে রেডিওতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা হলো। সকাল ৯টার সময় বাবার সাথে মালিবাগ মোড়ে গেলাম। চারদিকে সুনসান নীরবতা। বাবার সাথে যারই দেখা হচ্ছে সবার চোখেই কান্না দেখেছি। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে দেশ সম্পর্কে ধীরে ধীরে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাহাদাতে মানুষ যেভাবে শোকে কেঁদেছে তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। তাঁর জানাযা ও দাফনের দিন বাবার সাথে আমি ও আমার বড় ভাই গিয়েছিলাম। মালিবাগ থেকে পায়ে হেঁটে জাতীয় সংসদের দিকে জনস্রোত ঠেলে সেখানে পৌঁছাতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। অগনিত মানুষের ভিড়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পবিত্র কফিন অনেকের দেখার সুযোগ না হলেও সবাই এই জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ককে হƒদয় দিয়ে অনুভব করেছিল বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। জানাযা চলাকালীন সময় সবার কান্নার ধ্বনি আকাশ-বাতাসকে ভাড়ি করে তুলেছিল। আমার পাশে একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়েছিল। জানাযা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম সে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পরলো। সবাই যেনো শোক আর কষ্টে সেদিন উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গিয়েছিল। জানাযা শেষে ২৭ বার তোপোধ্বনির মধ্যদিয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সামরিক মর্যাদায় একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ককে দেশের ঐতিহাসিক স্থানে সমাহিত করা হয়। রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানকে শেষ বিদায়ের সেদিনের জনসমাগম তৎকালীন বিশ্ব ইতিহাসে রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। যেনো মনে হয়েছিল বাংলাদেশ শহীদ জিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাইতো যথার্থ লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদ ‘একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ’।
১৯৭৫ এর ৭ই নবেম্বর সিপাহী-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেনানিবাসের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে এই দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাস্টষ্টীয় ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে যখন তিনি দেশকে স্বনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরেয়ে এনে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যৈষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে ১৭ মে ১৯৮১ ভারত থেকে দেশে এনে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরছিলেন সেই সময়কার প্রেক্ষাপট নিয়ে আমার সাংবাদিকতা জীবন ও সামাজিক আন্দোলনের শিক্ষক সাবেক মন্ত্রী সাংবাদিক জগতের কিংবদন্তী মরহুম আনোয়ার জাহিদ জাতীয় যুব কমান্ডের এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, সেই সময় ঢাকার দেয়ালগুলোতে লিখা হয়েছিল ‘শেখ হাসিনা আসছে জিয়ার গদি কাঁপছে’। তিনি আরও বলেছেন, সেদিন শুধু জিয়ার গদিই কাঁপেনি, শেখ হাসিনা আসার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় জিয়া নিহত হয়েছিলেন। জিয়া হত্যা আর ঐ সময়ের দেয়াল লিখনী একই সূত্রে গাঁথা বলেও তিনি মন্তব্য করে জিয়া হত্যার পিছনে শেখ হাসিনার হাত রয়েছে মর্মে অভিযোগ করেন।
’৯০-এর পর বিএনপি ৩ বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকেও এ বিষয় কোন প্রকার পদক্ষেপ নেইনি। যদি বিএনপি সেদিন এ বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে শহীদ জিয়া হত্যা বিষয়ে নতুন করে তদন্ত করতো তাহলে দেশের ইতিহাসটা ভিন্নভাবে লিখা হতো। এছাড়া আরও একটি বিষয় বিএনপি করতে পারেনি তাহলো জাতীয় দাবি থাকা সত্ত্বেও দেশের জন্য জীবনদানকারী স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক এই জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়কের শাহাদাতের দিনটিকে জাতীয় শোক এবং রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করতে।
আরও একটি বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়। ১৯৯৬ সালে ঐকমত্যের সরকারের নামে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ফ্যাসিবাদী কায়দায় ৭ নবেম্বর এর রাষ্ট্রীয় ছুটি বাতিল করে দেয়। যে ব্যাপারে বিভিন্ন সংগঠনসহ অনেকেই প্রতিবাদ করেছিলেন। সে সময় আমি এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম যা দৈনিক দিনকাল ও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এই প্রবন্ধের এক জায়গায় আমি মন্তব্য করেছিলাম, পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, যদি ৭ নবেম্বর এর ছুটি বাতিল করা হয় তাহলে দেশে ভয়াবহ পরিস্থতি সৃষ্টি হবে। এই লেখার অপরাধে ১২ আগস্ট ১৯৯৬ আমাকে আমার মতিঝিলের অফিস থেকে সিটিএসবির একটি বিশেষ দল সাদা পোশাকে গ্রেফতার করে। দীর্ঘ ৩ মাস বিনা বিচারে হাসিনার কারাগারে বন্দী থেকে হাইকোর্টের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তিলাভ করি। ঐ সময়ে দেশের হাইকোর্ট অনেকটা নিরপেক্ষ ছিল।
আজ শহীদ জিয়ার লড়াইয়ে অর্জিত বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদী অপশক্তির দখলে। দেশপ্রেমিক জনতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। কারাগারগুলো পরিপূর্ণ জাতীয়তাবদী ও আদর্শিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের দ্বারা।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৫তম শাহাদাত দিবসে আমাদের শপথ হোক জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সকল বাধা উপেক্ষা করে ফ্যাসিবাদী অপশক্তির পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের স্বকীয়তা ফিরিয়ে এনে জনগণের শাসন ব্যবস্থা চালু করা।
১৯৮০ শেষের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক আয়োজিত নতুন কুঁড়ি শিশু-কিশোর জাতীয় প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্বে আমি আবৃতিতে ২য় স্থান লাভ করি ঢাকা বিভাগের প্রতিযোগী হিসেবে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সকল প্রতিযোগীর সাথে একমঞ্চে এসে জীবন বাংলাদেশ গানটি গাইলেন। গান শেষে রাষ্ট্রপতি জিয়া সকলের সাথে করমর্দন করলেন। শিশুদের প্রতি শহীদ জিয়ার ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা। যে কারণে তিনি শিশু মন্ত্রণালয়, শিশুপার্ক এবং শিশু একাডেমীসহ নানা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯৮১-এর ৩০ মে। যথারীতি ঘুম থেকে জেগে বাসার সবার স্কুলে যাবার প্রস্তুতির ধুম। মা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। বাবা সাধারণত ফজরের নামায পরে বাড়ির মধ্যেই রেডিও হাতে নিয়ে পায়চারি করেন। হঠাৎ বাবা-মাকে চিৎকার দিয়ে ডেকে বলেন, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়া কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্য দ্বারা নিহত হয়েছেন। আমার যতটা মনে পরছে, আমার মায়ের হাতে থাকা রুটি বানানোর বেলুনটা হাত থেকে পরে গেলো। বাবার চোখ ছলছল। যেনো মুহূর্তের মধ্যে গোটা বাড়িটা বিস্বাদে পরিণত হলো। বাবা বললেন, স্কুলে যেতে হবে না। বাবা-মার সাথে আমরা সকল ভাই-বোন রেডিওর ঘোষণা শুনছিলাম। ঘোষণার মাঝে মাঝে কুরআন তেলাওয়াত আর হামদ-নাত চলছে। ইতোমধ্যে রেডিওতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা হলো। সকাল ৯টার সময় বাবার সাথে মালিবাগ মোড়ে গেলাম। চারদিকে সুনসান নীরবতা। বাবার সাথে যারই দেখা হচ্ছে সবার চোখেই কান্না দেখেছি। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে দেশ সম্পর্কে ধীরে ধীরে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাহাদাতে মানুষ যেভাবে শোকে কেঁদেছে তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। তাঁর জানাযা ও দাফনের দিন বাবার সাথে আমি ও আমার বড় ভাই গিয়েছিলাম। মালিবাগ থেকে পায়ে হেঁটে জাতীয় সংসদের দিকে জনস্রোত ঠেলে সেখানে পৌঁছাতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। অগনিত মানুষের ভিড়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পবিত্র কফিন অনেকের দেখার সুযোগ না হলেও সবাই এই জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ককে হƒদয় দিয়ে অনুভব করেছিল বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। জানাযা চলাকালীন সময় সবার কান্নার ধ্বনি আকাশ-বাতাসকে ভাড়ি করে তুলেছিল। আমার পাশে একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়েছিল। জানাযা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম সে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পরলো। সবাই যেনো শোক আর কষ্টে সেদিন উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গিয়েছিল। জানাযা শেষে ২৭ বার তোপোধ্বনির মধ্যদিয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সামরিক মর্যাদায় একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ককে দেশের ঐতিহাসিক স্থানে সমাহিত করা হয়। রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানকে শেষ বিদায়ের সেদিনের জনসমাগম তৎকালীন বিশ্ব ইতিহাসে রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। যেনো মনে হয়েছিল বাংলাদেশ শহীদ জিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাইতো যথার্থ লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদ ‘একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ’।
১৯৭৫ এর ৭ই নবেম্বর সিপাহী-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেনানিবাসের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে এই দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাস্টষ্টীয় ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে যখন তিনি দেশকে স্বনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরেয়ে এনে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যৈষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে ১৭ মে ১৯৮১ ভারত থেকে দেশে এনে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরছিলেন সেই সময়কার প্রেক্ষাপট নিয়ে আমার সাংবাদিকতা জীবন ও সামাজিক আন্দোলনের শিক্ষক সাবেক মন্ত্রী সাংবাদিক জগতের কিংবদন্তী মরহুম আনোয়ার জাহিদ জাতীয় যুব কমান্ডের এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, সেই সময় ঢাকার দেয়ালগুলোতে লিখা হয়েছিল ‘শেখ হাসিনা আসছে জিয়ার গদি কাঁপছে’। তিনি আরও বলেছেন, সেদিন শুধু জিয়ার গদিই কাঁপেনি, শেখ হাসিনা আসার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় জিয়া নিহত হয়েছিলেন। জিয়া হত্যা আর ঐ সময়ের দেয়াল লিখনী একই সূত্রে গাঁথা বলেও তিনি মন্তব্য করে জিয়া হত্যার পিছনে শেখ হাসিনার হাত রয়েছে মর্মে অভিযোগ করেন।
’৯০-এর পর বিএনপি ৩ বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকেও এ বিষয় কোন প্রকার পদক্ষেপ নেইনি। যদি বিএনপি সেদিন এ বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে শহীদ জিয়া হত্যা বিষয়ে নতুন করে তদন্ত করতো তাহলে দেশের ইতিহাসটা ভিন্নভাবে লিখা হতো। এছাড়া আরও একটি বিষয় বিএনপি করতে পারেনি তাহলো জাতীয় দাবি থাকা সত্ত্বেও দেশের জন্য জীবনদানকারী স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক এই জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়কের শাহাদাতের দিনটিকে জাতীয় শোক এবং রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করতে।
আরও একটি বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়। ১৯৯৬ সালে ঐকমত্যের সরকারের নামে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ফ্যাসিবাদী কায়দায় ৭ নবেম্বর এর রাষ্ট্রীয় ছুটি বাতিল করে দেয়। যে ব্যাপারে বিভিন্ন সংগঠনসহ অনেকেই প্রতিবাদ করেছিলেন। সে সময় আমি এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম যা দৈনিক দিনকাল ও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এই প্রবন্ধের এক জায়গায় আমি মন্তব্য করেছিলাম, পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, যদি ৭ নবেম্বর এর ছুটি বাতিল করা হয় তাহলে দেশে ভয়াবহ পরিস্থতি সৃষ্টি হবে। এই লেখার অপরাধে ১২ আগস্ট ১৯৯৬ আমাকে আমার মতিঝিলের অফিস থেকে সিটিএসবির একটি বিশেষ দল সাদা পোশাকে গ্রেফতার করে। দীর্ঘ ৩ মাস বিনা বিচারে হাসিনার কারাগারে বন্দী থেকে হাইকোর্টের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তিলাভ করি। ঐ সময়ে দেশের হাইকোর্ট অনেকটা নিরপেক্ষ ছিল।
আজ শহীদ জিয়ার লড়াইয়ে অর্জিত বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদী অপশক্তির দখলে। দেশপ্রেমিক জনতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। কারাগারগুলো পরিপূর্ণ জাতীয়তাবদী ও আদর্শিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের দ্বারা।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৫তম শাহাদাত দিবসে আমাদের শপথ হোক জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সকল বাধা উপেক্ষা করে ফ্যাসিবাদী অপশক্তির পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের স্বকীয়তা ফিরিয়ে এনে জনগণের শাসন ব্যবস্থা চালু করা।
মোহাম্মদ মাহবুব হোসাইন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন