মজলুম মুসলমানরা এখন নানাভাবে অভিযুক্ত, তাদের দুঃখের যেন শেষ নেই। মিয়ানমারে নিপীড়িত সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা বলায় রেঙ্গুনে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন উগ্রপন্থীরা। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও যোগ দেন তাদের সাথে। গত ২৮ এপ্রিল ওই বিক্ষোভকারীরা দাবি করেন, মুসলিমরা রোহিঙ্গা নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙ্গালি। যদিও মুসলিমরা মিয়ানমারে কয়েক শতাব্দী ধরে বাস করছেন। মিয়ানমার এখন রোহিঙ্গাদের দেশটির আদিবাসী বলে স্বীকার করে না। তাদের নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। পশ্চিমাঞ্চলে রাখাইন রাজ্যে প্রায় ১০ লাখ মুসলিম বাস করেন। এদের ভূমি ও সম্পদ দখল করার জন্য বৌদ্ধ মৌলবাদীরা ভয়াবহ সহিংসতা চালিয়েছে। এর ফলে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গা ঘর-বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় শিবিরে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
ইয়াঙ্গুন থেকে এপি পরিবেশিত খবরে আরো বলা হয়, একটি নৌকাডুবিতে বহু রোহিঙ্গা মারা গেলে এপ্রিল মাসে এক বিবৃতিতে মার্কিন দূতাবাস রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর জের ধরে গত ২৮ এপ্রিল উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা বিক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তার কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেন- ‘রোহিঙ্গা শব্দের ব্যবহার আর নয়।’ ‘আবারও বললে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করে দেয়া হবে।’ ‘যারা এসব ভুয়া শব্দ আবিষ্কার এবং ভুয়া আদিবাসী জনগোষ্ঠী বলে তারা আমাদের শত্রু, আমাদের শত্রু।’ উল্লেখ্য যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের এবং সাধারণভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন দেশটির বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা। অথচ এই ধর্মগুরুদের দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই কাজ করার কথা ছিল।
আন্তর্জাতিক মহল উদ্বেগ জানালেও গত কয়েক দশক ধরেই রোহিঙ্গাদের দুর্দশা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে মিয়ানমারের শাসক সামরিক বাহিনী। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অংসান সু চির নতুন সরকারও রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবে এখনও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে বিশ্বের মানবাধিকার কর্মীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের বিবেকবান মানুষের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, নিপীড়িত ও বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘসহ বর্তমান সভ্যতার শাসক-প্রশাসকদের কি কোনই দায়িত্ব নেই? কার্যকর ভূমিকা পালনে তারা কি অক্ষম? মুসলিম বিশ্বই বা কী করছে?
তুরস্কের ইস্তান্বুলে ১৪ এপ্রিল শুরু হয়েছে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) দু’দিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ঐক্য ও সংহতি’। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় ওআইসি’র প্রতিপাদ্য বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে তো শান্তি ও ন্যায়ের আকাল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ দু’টি বিষয়ের অভাবে এই বিশ্ব ক্রমেই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, এই গ্রহে ন্যায় আর কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আর পরিতাপের বিষয় হলো, যারা বিশ্বে ন্যায়ের দামামা বাজিয়ে চলেছেন তাদের কারণেই বিশ্বে আজ এত অশান্তি এবং অন্যায়ের দৌরাত্ম্য। বিশ্ব-নেতাদের সংকীর্ণ ও স্বার্থান্ধ দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিক ও মানবিক চেতনার অভাবে বর্তমান সভ্যতা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বর্তমান সভ্যতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলিম-উম্মাহ্। নিজেদের এই দুর্দশা দূর করার জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর এক্ষেত্রে সাফল্য পেতে হলে ঐক্য ও সংহতির কোনো বিকল্প নেই।
ওআইসি’র শীর্ষ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান এবং সৌদি আরবের বাদশাহ্ সালমান বিন আব্দুল আজিজ। প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, সমস্ত মুসলমান ও সমগ্র মানব জাতির জন্য আমরা একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ তৈরি করতে চাই। আমি সব সময় বলে আসছি, আমার ধর্ম সুন্নি কিংবা শিয়া নয়, আমি একজন মুসলিম। আমরা ১৭০ কোটি মুসলমান ভাইবোনের মতো। আমি কেবল আমি নই, আমি একজন মুসলিম। অন্যসব মতপার্থক্য ও বিশ্বাস মুসলিম পরিচয়ের পরে। আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (সা:) বলেছেন, “এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। এক মুসলিমের রক্ত অন্য মুসলিম ভাইয়ের জন্য হালাল নয়।” এছাড়া এরদোগান বিভিন্ন উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠনের সমালোচনা করেন এবং বলেন- এইসব সন্ত্রাসী সংগঠন মুসলমান ও মানবতার শত্রু। তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার প্রসঙ্গে বলেন, ধর্ম ও অঞ্চল ভিত্তিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ বণ্টন হওয়া উচিত। এরদোগান মজলুম ফিলিস্তিনী ভাইবোনদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে বলেন, প্রতিনিয়ত তাদের রক্ত ঝরছে, তারা নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন। আমাদের শাসকদের আরো চেষ্টা করা উচিত, যাতে পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে একটি পূর্ণাঙ্গ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। আল-আকসাকেও আমাদের দখলমুক্ত করতে হবে।
ওআইসি’র শীর্ষ সম্মেলনে সৌদি আরবের বাদশাহ্ সালমান বিন আব্দুল আজিজ বলেন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও ইয়েমেন সমস্যার আশু সমাধানে ওআইসিকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদবিরোধী উদ্যোগ আরো জোরালো করার আহ্বান জানান তিনি। এদিকে ওআইসি’র মহাসচিব আইয়াদ মাদানী বলেছেন, ফিলিস্তিনীদের সহযোগিতা প্রদান, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব নিরসনে মুসলিম বিশ্বকে অবশ্যই একসাথে কাজ করতে হবে। তিনি ২০১২ সালের জেনেভা সম্মেলনের ইশতেহারের আলোকে সিরিয়া সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানান। সম্মেলনে বিশ্বশান্তি এবং মজলুম মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় যেসব বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে তা বেশ যৌক্তিক ও ইতিবাচক। এইসব বক্তব্য বাস্তবে প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব মুসলিম শাসকদের ওপরই বর্তায়। এক্ষেত্রে তাঁদের সফলতা আমরা কামনা করি। তবে প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেনের বাইরেও মুসলিম উম্মাহ্র আরো বহু সমস্যা আছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া বিপর্যস্ত কেন? কাশ্মীর ও মিয়ানমারের মুসলমানদের চোখের পানির কি কোনো মূল্য নেই? অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সমস্যা তো দূর হচ্ছে না, বরং সংকট বাড়ছে। তাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার পালক একে একে খসে পড়ছে। মুসলিম বিশ্বের নেতাদের এখন ১৭০ কোটি মুসলমানের সুখ-দুঃখ ও মর্যাদা নিয়ে ভাবতে হবে। ওআইসিকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। পৃথিবীতে সম্মানের সাথে বসবাস করতে হলে, বিশ্বসভ্যতায় অবদান রাখতে হলে, মুসলিম বিশ্বের এখন একটি বাতিঘর প্রয়োজন। ওআইসি কি হতে পারে না সেই বাতিঘর?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন