রবিবার, ২২ মে, ২০১৬

এবারের নির্বাচন : পশ্চিম বঙ্গের অবিসংবাদিত নেত্রীরূপে মমতার উত্থান


আজ লেখার শুরুতেই দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত পশ্চিম বঙ্গের নেতা মমতা ব্যানার্জীকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। যেখানে কলকাতা এবং ঢাকা উভয় স্থানের বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক মহল নির্বাচনের পূর্বে মমতা তথা তার দলের ভরাডুবি হবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, নির্বাচনের পর প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা কত বড় ভুল ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। ভরাডুবি তো দূরের কথা, মমতা ব্যানার্জী তার বিধান সভায় (আমরা এগুলিকে বলতাম প্রাদেশিক পরিষদ) দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন নিয়ে জয়লাভ করেছেন। ২৯৪ টি আসন বিশিষ্ট পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য বিধান সভায় দুই তৃতীয়াংশ আসনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৯৬টি আসন। সেখানে মমতা পেয়েছেন ২১১টি আসন। অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশের চেয়েও তিনি ১৫ টি আসন বেশি পেয়েছেন। আমরা বাংলাদেশের মানুষরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অথবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কোন প্রদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা অন্য কোন বিষয়ে পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখি। তাই কোন একটি দল ইলেকশনে মেজরিটি পেলে আমরা যেমন অকারণে উল্লসিত হইনা, তেমনি কোন একটি দল হেরে গেলে আমরা অকারণে বিমর্ষ হই না। তবে যেটি বাস্তব ঘটনা এবং যেটি কঠোর সত্য সেটিকে আমরা সত্য বলবই।
মমতা ব্যানার্জী এই নির্বাচনের মাধ্যমে পশ্চিম বঙ্গের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। এটি আরও একারণে বলছি যে, তার বিরুদ্ধে লড়েছে এমন তিনটি দল যে তিনটি দলের মধ্যে দুইটি সর্ব ভারতীয় বৃহত্তম দল। একটি হল কংগ্রেস, আরেকটি হল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। এই দুটি দল পালা করে ভারতের ইতিহাসে প্রায় ৫৯ বছর রাজত্ব করেছে। এখন ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতায় আছে বিজেপি। তাদের আগে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল দুইটি টার্মে, অর্থাৎ একটানা ১০ বছর। ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জী পশ্চিম বঙ্গের ক্ষমতায় এসেছেন। তার আগে পশ্চিম বঙ্গে একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বাম ফ্রন্ট। মমতাকে হারাবার জন্য সেই বাম ফ্রন্ট আর কংগ্রেস এবার জোট বেঁধেছিল। অন্যদিকে আরেকটি সর্ব ভারতীয় দল, যে দলটি বর্তমানে দিল্লীর ক্ষমতায় আছে, সেই বিজেপিও এবার মমতা ব্যানার্জীকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য পশ্চিম বঙ্গে ইলেকশন করেছে। সোজা কথায় মমতা ব্যানার্জীকে লড়তে হয়েছে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে। এগুলো হলো সর্ব ভারতীয় ভিত্তিতে কংগ্রেস ও বিজেপি এবং প্রাদেশিক ভিত্তিতে সিপিএম। প্রচন্ড শক্তিশালী এই তিন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করা চাট্টিখানি কথা ছিল না। এই লড়াইয়ে প্রথমেই যেটি দরকার ছিল সেটি হলো ইস্পাত কঠিন মনোবল। মমতা ব্যানার্জীর সেটি ছিল। তাই এই ত্রি-শক্তির বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে মমতা ব্যানার্জী শুধু জয়লাভই করেননি, বরং ২০১১ সালে যতগুলি আসন পেয়ে জয়লাভ করেছিলেন, এবার তার চেয়ে ২৭ টি আসন বেশি পেয়ে জয়লাভ করেছেন।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১১ সালের বিধান সভার নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জী পেয়েছিলেন ১৮৪ টি আসন। এবার পেয়েছেন ২১১ টি আসন। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে তার জনপ্রিয়তা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, একটি দুটি নয়, ২৭ টি আসন বেশী পেয়ে তার জয় জয়কার হয়েছে। অন্যদিকে সিপিএম আরো ডুবে গেছে। গতবারে তারা পেয়েছিল ৪০টি আসন। এবার ৮টি আসন হারিয়ে তারা পেয়েছে ৩২টি আসন। কংগ্রেসের বেড়েছে ২ টি আসন। গতবার তারা পেয়েছিল ৪০টি আসন, এবার তারা পেয়েছে ৪২টি আসন। সুতরাং এখন নির্দিধায় বলা যায় যে, মমতা ব্যানার্জী সন্দেহাতীতভাবে এখন পশ্চিম বঙ্গের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। তবে বিজেপির জন্য অত্যন্ত ক্ষুদ্র হলেও একটি সুসংবাদ আছে। সেটি হলো, গতবারে তারা পশ্চিম বঙ্গ বিধান সভায় একটি আসনও পায়নি। কিন্তু এবার পেয়েছে ৩টি আসন। অর্থাৎ তারা পশ্চিম বঙ্গে পা রাখার একটি জায়গা পেল। তাই বলা যায় যে, এবারের নির্বাচনে এক প্রান্তে যেমন চরম উত্থান ঘটেছে মমতা ব্যানার্জীর, অন্য প্রান্তে তেমনি পা রাখার জায়গা পেয়েছে বিজেপি। মাঝখানে দিনে দিনে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে কংগ্রেস।
॥দুই॥
এখানে আমি কয়েকটি তথ্য এবং উপাত্ত দিচ্ছি। এই তথ্য এবং উপাত্ত থেকে প্রমাণিত হবে যে, কতখানি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন মমতা ব্যানার্জী। আসলে তিনি পাহাড় ডিঙ্গিয়েছেন। একটু পেছনে তাকালে দেখা যায় যে, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাষ্ট ভারত স্বাধীন হলে (পাকিস্তান স্বাধীন হয় ১৪ অগাষ্ট, আর ভারত স্বাধীন হয় ১৫ অগাষ্ট) পশ্চিম বঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ। তিনি ছিলেন কংগ্রেস নেতা। প্রফুল্ল ঘোষের পরে মুখ্য মন্ত্রী হন ড. বিধান চন্দ্র রায়। তারপর প্রফুল্ল চন্দ্র সেন। এরা সকলেই ছিলেন কংগ্রেস নেতা। এই তিনজন একটানা রাজ্য শাসন করেন ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ ভারত বিভক্তির পর কংগ্রেস পশ্চিম বঙ্গে একটানা শাসন করে ২০ বছর। এরপর অজয় কুমার মুখার্জী কংগ্রেসের হয়ে ৮৪ দিন রাজ্য শাসন করেন। সেটি ১৯৭১ সালের ২রা এপ্রিল থেকে একই বছরের ২৫ জুন পর্যন্ত। এরপর ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন কংগ্রেসের সিদ্ধার্থ শংকর রায়। তিনি শাসন করেন ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। অর্থাৎ তিনি শাসন করেন ৫ বছর। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, কংগ্রেস প্রথমে টানা ২০ বছর এবং পরে কিছুটা বিরতি দিয়ে ৫ বছর - মোট ২৫ বছর পশ্চিম বঙ্গের ক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৭ সালের পর এখন ২০১৬ সাল। এই ৩৯ বছর কংগ্রেস আর ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি। আগামী ৫ বছরও তারা ফিরতে পারবে না। সুতরাং সাধারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, কংগ্রেস কম করে হলেও ৪৪ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকবে। পরবর্তী নির্বাচন হবে ২০২১ সালে। তখন জনগণ কংগ্রেসের দিকে ফিরে তাকাবে কিনা সেটা নিহিত রয়েছে ভবিষ্যতের গর্ভে।
সিদ্ধার্থ শংকর রায় ক্ষমতা থেকে আউট হওয়ার পর ৫১ দিনের জন্য পশ্চিম বঙ্গে রাষ্ট্র প্রধানের শাসন জারি হয়। এরপর নির্বাচনের মাধ্যমে কমিউনিষ্ট পার্টি (মার্কস বাদী) বা সিপিএম ক্ষমতায় আসে। মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু। ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ২৩ বছর তিনি পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন সিপিএম নেতা বুদ্ধ দেব ভট্টাচার্য্য। তিনি ক্ষমতায় থাকেন ২০১১ সালের ১৩ মে। অর্থাৎ মোট ১১ বছর। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সিপিএম একটানা ৩৪ বছর পশ্চিম বঙ্গের ক্ষমতায় থাকেন। ২০১১ সালের নির্বাচনে সিপিএম পরাজিত হয় এবং তাদের একটানা ৩৪ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটে। ক্ষমতায় আসেন মমতা ব্যানার্জী। এবারও তিনি বিপুল বিজয়ে ক্ষমতায় এসেছেন।
দেখা যাচ্ছে যে, শুধুমাত্র কংগ্রেস এবং সিপিএম পশ্চিম বঙ্গের ক্ষমতায় ছিল ৫৯ বছর। এই দুই প্রবল পরাক্রান্ত শক্তিকে ধরাশায়ী করে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা ব্যানার্জী। সেজন্যই বলেছি যে কংগ্রেস, সিপিএম এবং বিজেপিকে কুপোকাৎ করে যিনি ক্ষমতায় এসেছেন তাকে যদি পশ্চিম বঙ্গের অবিসংবাদিত নেতা বলা হয় তাহলে কোন ভুল বলা হয় না।
॥তিন॥
মমতা ব্যানার্জী এমন এক মহিলা যিনি তার ৬১ বছর বয়স পর্যন্ত সারা জীবন কুমারী রয়েছেন। অতীতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, রাজনীতিকেই তিনি বিয়ে করেছেন। তিনি রাজনীতির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, এই কথাটির সত্যতা মেলে যখন আমরা দেখি যে, তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ২৭ বছর কংগ্রেসে ছিলেন। ১৯৯৭ সালে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে সর্ব ভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন। আরেকটি খবর অনেকে জানতেও পারেন, নাও জানতে পারেন। সেটি হলো, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে মাষ্টার্স করেছেন। এরপর তিনি শ্রী শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষায় ডিগ্রী লাভ করেন। এছাড়া কলকাতার যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী ল’ কলেজ থেকে তিনি আইন বিষয়ে ডিগ্রী লাভ করেন। মমতার একটি দিককে অবশ্যই প্রশংসা করতে হবে। তিনি লম্বা সময় ধরে দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিমন্ত্রী ও পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী ছিলেন। তিনি রেল মন্ত্রণালয়, কয়লা ও খনি মন্ত্রণালয়, ক্রীড়া, যুব কল্যাণ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই নেত্রী অত্যন্ত সাদা সিধে জীবন যাপন করেন। তিনি সব সময় তাঁতের শাড়ী পরেন। তিনি কখনও প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করেন না। অথবা গয়না গাটি পরেন না। সব সময়ই তার কাঁধে সুতি কাপড়ের একটি ঝোলার ব্যাগ দেখা যায়। তার হাতে হাল ফ্যাশনের ভ্যানিটি ব্যাগ কদাচিৎ দেখা যায়।
॥চার॥
কেন মমতার এই বিশাল জনপ্রিয়তা? এই নিয়ে নানান জন নানান রকম বিশ্লেষণ দেন। কোনটাই মিথ্যা বা ভিত্তিহীন বলব না। আমার মতে সেই গুলো অর্ধ সত্য, পূর্ণ সত্য নয়। তবে পশ্চিম বঙ্গে ভোটের আগে এবং ভোটের সময় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক বলে যারা নিজেদেরকে দাবী করেন তাদের দাবী বা পর্যবেক্ষণ সঠিক হয় না। এর একটি কারণ আছে। সেটি হলো, এদের প্রায় সকলেই নিজ নিজ দলীয় মতাদর্শ বা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মমতার রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করেন। মমতা ব্যানার্জী বড় বড় কর্পোরেট হাউজের সাথে সরাসরি জড়িত নন। ভারতের ধনাঢ্য পরিবারগুলো কংগ্রেস বা বিজেপির সাথে জড়িত, সেটি প্রত্যক্ষ ভাবে হোক আর পরোক্ষ ভাবে হোক। সে জন্য বড় বড় টেলিভিশন এবং পত্রিকায় মমতার শুধুমাত্র খুঁত ধরা হয়। তার ব্যক্তি জীবনের বা রাজনীতির ইতিবাচক বা পজিটিভ সাইড কোন সময় হাইলাইট করা হয় না।
মমতা ব্যানার্জীকে বিচার করতে হলে মমতা ব্যানার্জীর অবস্থান থেকে তাকে বিচার করতে হবে, কংগ্রেস বা বিজেপি অথবা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বা ভারত পন্থী কোন দলের চোখ দিয়ে তাকে বিবেচনা করা যাবে না। মমতা ব্যানার্জী যতদিন কংগ্রেসের সাথে ছিলেন ততদিন তিনি এক ধরণের কথা বলেছেন। কিন্তু যখন তিনি আঞ্চলিক অর্থাৎ বাংলার রাজনীতিতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন তখন তার চিন্তাধারা এবং বক্তব্য সম্পূর্ণ বদলে যায়। তার বক্তব্য বিবৃতি পড়ে স্পষ্ট মনে হয় যে, তার বর্তমান রাজনীতি হলো বাংলার অর্থাৎ পশ্চিম বঙ্গের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। তার স্ট্র্যাটেজি হলো, পশ্চিম বাংলার অর্থনৈতিক স্বার্থ সহ সব ধরণের সুযোগ সুবিধা আদায় করার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাওয়া। পশ্চিম বঙ্গের ন্যায্য দাবী দাওয়া দিল্লীর নিকট থেকে কড়ায় গন্ডায় আদায় করাই তার বর্তমান রাজনীতির সেন্ট্রাল পয়েন্ট বলে মনে হয়। সেজন্য আগামী ৫ বছর তিনি কোন ভূমিকা গ্রহণ করেন সেটি দেখার জন্য বাংলাদেশ সহ ভারতের অনেক মানুষ প্রতীক্ষায় থাকবে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads