গণতন্ত্রবিহীন একটি দেশের অবস্থা কেমন হতে পারে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেন তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধমে ক্ষমতা দখল করে রাখা অবৈধ আওয়ামী সরকার জনগণের বাকস্বাধীনতা হরণ, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড এবং গুম-খুনের মধ্যে দিয়ে দেশে কায়েম করেছে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। বিরোধীদল ও ভিন্নমতের মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে খালে-বিলে, নদী-নালায়, ডাস্টবিনে যত্রতত্র। রাষ্ট্রীয় মদদে ক্রসফায়ারের নামে টার্গেট কিলিং দিন দিন বেড়েই চলছে। কখনো সাতক্ষীরা, জয়পুরহাট, লক্ষ্মীপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী আবার কখনো বা ঝিনাইদহ, একের পর এক জনপদ রক্তাক্ত হচ্ছে। কোন কোন স্থানে এটি পরিণত হয়েছে গণহত্যার মিছিলে।
দেশে এখন বিরোধী মতের মানুষ অনিরাপদ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খোদ আইন ভঙ্গ করছে, এমনকি সরকারের নির্দেশও অনেক সময় মানছে না এমন অভিযোগ অহরহ। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কোন অভিযোগ সরকার বাহাদুর(!) আমলে আনছে না, বরং দেশে যথেষ্ট শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রয়েছে, গণতন্ত্র আরো সুসংহত হয়েছে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন উপচে পড়ছে বলে দাবি করছে। প্রধানমন্ত্রী পুত্র ও তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে গত ১৫ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে সকল সমালোচনাকে নাকচ করে দিয়ে লিখেছেন “যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুলনা করলে আমাদের পুলিশ কম হত্যা করেছে এবং আমরা অপহরণ বা নির্যাতনকে কোনভাবেই অনুমোদন করি না।”
একই সুরে সুর মিলিয়ে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গত ২৫ এপ্রিল সোমবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার কার্যালয়ে সাম্প্রতিক বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়েন। এরমধ্যে ব্লগার হত্যা, গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের মূল ফটকের কাছে অবসরপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান কারারক্ষীকে গুলী করে হত্যা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের পর ‘পরিস্থিতির কি অবনতি হচ্ছে না?’ প্রশ্ন করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “অবনতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। সবকিছু দমন করা হচ্ছে। কেউ বাদ যাচ্ছে না। সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেজন্য আমি মনে করি আমাদের দেশ, আমরা অনেক নিরাপদ আছি।” (দৈনিক ইত্তেফাক- ২৫/০৪/১৬)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী এমপি-মন্ত্রীরা যে যাই বলুক, প্রকৃত অর্থে দেশের অবস্থা কতটা ভয়াবহ তা কেবল ভুক্তভোগী ও সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন ও বুঝেন।
সরকারের নানামুখী আশ্বাস ও চটকদার বক্তব্যে এখন কেউ আশ্বস্ত হতে পারছে না। কে তাদের নিরাপত্তা দেবে? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে প্রতিনিয়ত কাউকে না কাউকে বাসা-বাড়ি, হাট-বাজার থেকে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাদের সন্ধানের জন্য ধরণা দিলেও তারা তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে অহরহ। নেয়া হচ্ছে না কোন উদ্ধার তৎপরতা। ২৪ ঘণ্টা বা একটা সময় পরে কোথাও না কোথাও তাদের লাশ মিলছে। এরপর সংবাদে বন্দুকযুদ্ধ নাটকের স্ক্রিপ্ট উপস্থাপন করা হচ্ছে। অথচ প্রায় প্রতিটি ঘটনায় গ্রেফতারের বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পূর্ণ অস্বীকার করে থাকে। গুম হওয়ার পর বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চেীধুরী আলম, ইবি ছাত্রশিবির নেতা আল-মুকাদ্দাস, ওয়ালী উল্লাহ, হাফেজ জাকির হোসেন বা সিলেট ছাত্রদল নেতা দীনারের মত কত নাম না জানা বিরোধী মতাদর্শের নেতা-কর্মীর ভাগ্যে কি ঘটেছে তার খবর কে বা রাখে? কবে শেষ হবে তাদের স্বজনদের অপেক্ষার পালা ?
এমন হত্যাকাণ্ডের শেষ কোথায়?
প্রথমে সাদা পোশাকের পুলিশ পরিচয়ে গ্রেফতার, তার কয়েকদিন পর মিলছে লাশ। এটি এখন বাংলাদেশের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ক্ষমতার আসনকে পাকাপোক্ত করতে প্রতিদিনই খালি হচ্ছে কোন না কোন মায়ের বুক। জালিম সরকারের রক্ত পিপাসা দিন দিন যেন বেড়েই চলছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, আলেম ও সাধারণ মানুষ সহ তাদের গুম-খুনের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ। জামায়াতের দলীয় সূত্র মতে, জনগণের রাজপথের প্রতিবাদ দমন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যয় করে পুলিশ-র্যাবের গুলী-ক্রসফায়ারে এ পর্যন্ত (আওয়ামী লীগ সরকারে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সময়কাল) ৬৬৮ জন নিহত হয়েছেন, এছাড়াও ৭০ হাজার ৩’শ এর অধিক হয়েছেন আহত, ১ লক্ষ ৫১ হাজারের অধিক নাগরিককে আটক করা হয়েছে, ২ লক্ষ ৩’শ এর অধিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় ১০ লক্ষ ২ হাজারের অধিক নেতা-কর্মীকে আসামী করা হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১৯৩ জন বা তারও বেশি। যার মধ্যে ১৪৩ জনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রসফায়ারে হত্যা করে। এদের বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম দেশে কেন এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড? আর কত মায়ের বুক খালি হলে বন্ধ হবে এই জঘন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ? এমন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শেষ কোথায়?
গ্রেফতারের পর পুলিশের ধারাবাহিক অস্বীকার ও মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা : সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা প্রবাহের নজির আরো ভয়াবহ। ইতঃপূর্বের ঘটনাগুলোতে গুমের পর অন্তত ক্রসফায়ারের কথা মিডিয়ায় স্বীকার করলেও বর্তমান সময়ে তাও স্বীকার করছে না, কারো লাশ খালে বিলে মিলছে আর কারো হদিস নেই দিনের পর দিন। ধারাবাহিক গুম-খুনের ঘটনার সর্বশেষ কয়েকটি ঘটেছে ঝিনাইদহে- গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে হাফেজ জসিমকে ডিবি পরিচয়ে গুম করার ২১ দিন পর ৩ মার্চ গভীর রাতে গুলী চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে ঝিনাইদহ জেলার কুঠিদুর্গাপুর মাদরাসার শিক্ষক আবু হুরায়রাকে তার কর্মস্থল থেকে গ্রেফতার করে গুম করে ডিবি পুলিশ, ৩৬ দিন পর তার লাশ যশোরের চৌগাছা সড়কের পাশে থেকে উদ্ধার করা হয়। গত ১৮ই মার্চ ২০১৬ তারিখে শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে ৪ জন ব্যক্তি পুলিশ পরিচয়ে মায়ের সামনে থেকে আবুযর গিফারীকে তুলে নিয়ে গুম করার ২৬ দিন পরে ১২ এপ্রিল গভীর রাতে গুলী চালিয়ে তাকে হত্যা করে। একই কায়দায় গত ২৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে শামীম হোসেনকে পুলিশ পরিচয়ে গুম করার ২৬ দিন পরে ১২ এপ্রিল গভীর রাতে গুলী চালিয়ে তাকে হত্যা করে। দুই ছাত্রের রক্তের দাগ না শুকাতেই গত ২০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে ঘাতকের নির্মমতার শিকার হয় আরেক মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিন সোহান, যাকে একইভাবে ১০ এপ্রিল পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করার ৯ দিন পরে গুলী চালিয়ে হত্যা করা হয়।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ভিকটিমদের প্রত্যেকের পরিবার নিখোঁজের পরে তাদের অবস্থান জানতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করলে তারা তাদের গ্রেফতারের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। এমনকি অধিকাংশ ভিকটিমের জন্য থানায় কোন জিডি পর্যন্ত নেয়নি, নেয়া হয়নি কোন উদ্ধার তৎপরতা। প্রকাশ্যে দিবালোকে গ্রেফতারের পর পুলিশের সরাসরি অস্বীকার ও আদালতে হাজির না করা নিয়ে নানা আশঙ্কার জন্ম দেয়। পরিবারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ এবং তাদের সন্ধানের দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করা হয়, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ছেলেদের সন্ধানের দাবিতে প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের কাছে ধর্ণা দিয়েও পরিবারের কোন লাভ হয়নি। প্রত্যেকের গুম হওয়ার ঘটনা, পুলিশের অস্বীকার, গুলীবিদ্ধ লাশ পাওয়ার ঘটনা একই রকম।
কারা চালাচ্ছে এই গণহত্যা?
প্রতিটি হত্যার ধরন একই। কলেজ ছাত্র সোহানকে অপহরণের সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা কালীগঞ্জ থানার এস আই নীরব ও এ এস আই নাসিরকে চিনতে পারে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এটি একটি পরিকল্পিত সংঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ড এবং এতে পুলিশ সরাসরি জড়িত। কিন্তু সরকারের নির্দেশ ছাড়া শুধু পুলিশের পক্ষে এত বড় গণহত্যা চালানো কি সম্ভব? এটি এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট সরকারের নির্দেশেই পুলিশ ঝিনাইদহসহ সারাদেশে একের পর এক গণহত্যা চালাচ্ছে। হয়ত এহেন ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে ভবিষ্যতে প্রতিফোঁটা রক্তের হিসাব আজকের ক্ষমতাসীনদের দিতে হবে।
স্বজন হারাদের সাথে আলাপ কালে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরজন্য প্রশাসনকে দায়ী করেন এবং সন্তান হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। সম্প্রতি কালে ঝিনাইদহে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার কয়েকজনের বক্তব্য...
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হাফেজ জসিম উদ্দিনের পিতাকে তার ছেলেকে কে বা কারা হত্যা করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন পুলিশ ছাড়া কেউ আমার ছেলেকে মারেনি।” আপনার ছেলেকে উদ্ধারে পুলিশের ভূমিকা কেমন ছিল এমন উত্তরে তিনি বলেন “আমার ছেলের উদ্ধারের জন্য পুলিশ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, তারা আমার বাড়ি আসেনি।” আপনি কি এই হত্যার বিচার চান, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন “বিনা কারণে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে, আমি আমার ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। তার কারণ আমার ছেলে ভাল মানুষ, তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছেলে ৩০ পারা কুরআনে হাফেজ, তাকে বিনা কারণে হত্যা করা হয়েছে।”
ঝিনাইদহে আরেক হত্যাকাণ্ডের শিকার শিবির নেতা আবুযর গিফারীর বাবা বলেন, “আমার ছেলেকে প্রশাসনিক লোক, পুলিশ পরিচয়ে ধরে নিয়ে গেছে। জুমার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে দুইটা মোটর সাইকেল ৪টা লোক, অস্ত্রধারী লোক, পিস্তল আছে, হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে মোটর সাইকেলে করে পুলিশ পরিচয় দিয়ে নিয়ে গেছে। থানায় গিয়েছিলাম জিডি করার জন্য, তারা দুই কপিই রেখে দিয়েছিল, এন্ট্রি করেনি”। আপনার ছেলেকে কারা হত্যা করেছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন “যেহেতু প্রশাসনের লোকেরা নিয়ে গিয়েছে সেহেতু তারাই মেরেছে, আমার মনে হয়।” হত্যার বিচার চান কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন “অবশ্যই দোষীদের বিচার চাই। আমার ছেলে খুব ভাল ছিল, চরিত্রবান, আমাদের চোখে তার কোন দোষ নাই, তবে একটাই মাত্র কারণ দেখতেছি শিবির সংগঠন করার কারণেই তাকে মারা হয়েছে। সে এম এম কলেজে পড়ত, অনার্স ৩য় বর্ষে বাংলাতে। আমার ১ ছেলে মেয়ের মধ্যে সে বড়।”
আরেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার শামীম হোসেনের পিতার সাথে আলাপকালে তিনি বলেন “আমার ছেলেকে প্রশাসনের লোক পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায়। মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রী কলেজ গেটের পূর্বপার্শের ফার্নিচারে দোনাকে বসে সে পত্রিকা পড়ছিল। ঐ সময় চারজন মোটর সাইকেলে করে এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল, স্থানীয়রা বাধা দিলে তখন তারা বলে আমরা প্রশাসনের লোক। এ কথা বলে হাতে হ্যান্ডক্যাপ দিয়ে তাকে নিয়ে যায়। পুলিশের কাছে বারবার আমরা গিয়েছি, ওসি সাহেবের সাথে কথা হয়েছে, তিনি বলেন, এটাতো আমরা জানিনা, আমরা খুঁজছি। আমরা জিডি করতে গেলাম ওনারা জিডি এন্ট্রি না করে বল্লেন যে, কপি আমাদের কাছে আছে, অসুবিধা কি? ওনারা জিডি গ্রহণ করেননি।” আপনার ছেলেকে কারা হত্যা করেছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে শামীমের বাবা বলেন “প্রশাসনের কথা ওরা যেহেতু বলেছে প্রশাসনের লোকেরাই তাকে হত্যা করেছে। এখন এ প্রশাসনের লোক কারা এখন এটাইতো আমরা এখনো খুঁজে পেলাম না। প্রশাসন বলতে কি বুঝাইল ওনারা?” আপনি কি আপনার ছেলে হত্যার বিচার চান, এমন প্রশ্নের উত্তরে কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন অবশ্যই বিচার চাই। একটা ছেলেকে দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে মানুষ করার পরে, সে ছেলে যখন স্বাবলম্বী হওয়ার পথে তখন তারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, যার কোন অপরাধ নাই, আমি এই পর্যন্ত অনেক তথ্য অনুসন্ধান করেছি যার অপরাধটা কি? আমি তার জানাযায়ও বলেছি তাকে কোন অপরাধে হত্যা করা হয়েছে? আমি এর জবাব এখনো পাইনি। আমি এর বিচার চাই। যদি নাও পাই, আল্লাহর আদালতে বিচারটা দিয়ে রেখেছি।”
অপর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার মহিউদ্দীন সোহানের পিতার বলেন- “আমি ঢাকায় ছিলাম, তার মাকে বাড়িতে (ঝিনাইদহে) পাঠাই। তার মা বাস থেকে নামার ১০ মিনিট আগে সাদা পোশাকধারী ৪ জন পুলিশ ইজিবাইকে করে তাকে কালীগঞ্জে নিয়ে যায়। থানায় আমার পরিবারের লোকজন গেলে তারা গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করে। ১০ এপ্রিল তাকে নিয়ে যায় ১১ তারিখ জিডি করেছিলাম তারা জিডি ইস্যু করেছিল ১২ তারিখ। ওনাদের কাছে ধরণা দিলে ওনারা বলেন তারা আপনার কাছে আসবেন, আসলে হয়ত কিছু চাইবেন, আর আপনি খোঁজাখুজি করেন। আমি বল্লাম আপনারা খোঁজেন তারা বল্লেন আমরাও খুঁজছি। আমি খোঁজাখুঁজির ভিতর ছিলাম। ২১ এপ্রিল সকাল বেলা ঝিনাইদহ এসপি সাহেবের কাছে তার মা সহ যাব, এমন সময় একজন ফোন করে বল্ল আপনার ছেলের লাশ অমুক জায়গায় পাওয়া গিয়েছে।” আপনার ছেলেকে কারা হত্যা করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে সোহানের বাবা বলেন “এখন পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে কারা যে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে আমি সঠিক বলতে পারব না। পুলিশ নিয়ে গেছে এটাই আমি জানি। কান্না জড়িতভাবে বলেন, তিনি বলেন আমি অবশ্যই আমার শিশু হত্যার বিচার চাই। তার বয়স ১৬ বছর। তার নামে কেইস নাই, কিছু নাই, কোন দল করত না। সে কোন দলের সাথে ছিল কিনা তাও জানিনা। তার পরেও আমি সবার কাছে ধরণা দিয়েছি অন্তত আমার ছেলের জীবন ভিক্ষা দিতে। ২ ছেলে ১ মেয়ে, সে সবার বড় ছেলে। সে আমার বড় আদরের ছেলে”।
এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। যেখানে কারো জানমালের নিরাপত্তা নেই। সরকারের নেই জনগণের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা। রাষ্ট্রীয় মদদে খুন বা গুম হওয়ার পরে জনগণ কার কাছে নিরাপত্তা চাইবে ? এমন অপ্রত্যাশিত অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রেেয়াজন জনগণের সরকার। আর সেই প্রত্যাশিত সরকারের প্রয়োজনে অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সরকারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া মুক্তির কোন বিকল্প নেই।
দেশে এখন বিরোধী মতের মানুষ অনিরাপদ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খোদ আইন ভঙ্গ করছে, এমনকি সরকারের নির্দেশও অনেক সময় মানছে না এমন অভিযোগ অহরহ। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কোন অভিযোগ সরকার বাহাদুর(!) আমলে আনছে না, বরং দেশে যথেষ্ট শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রয়েছে, গণতন্ত্র আরো সুসংহত হয়েছে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন উপচে পড়ছে বলে দাবি করছে। প্রধানমন্ত্রী পুত্র ও তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে গত ১৫ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে সকল সমালোচনাকে নাকচ করে দিয়ে লিখেছেন “যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুলনা করলে আমাদের পুলিশ কম হত্যা করেছে এবং আমরা অপহরণ বা নির্যাতনকে কোনভাবেই অনুমোদন করি না।”
একই সুরে সুর মিলিয়ে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গত ২৫ এপ্রিল সোমবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার কার্যালয়ে সাম্প্রতিক বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়েন। এরমধ্যে ব্লগার হত্যা, গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের মূল ফটকের কাছে অবসরপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান কারারক্ষীকে গুলী করে হত্যা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের পর ‘পরিস্থিতির কি অবনতি হচ্ছে না?’ প্রশ্ন করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “অবনতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। সবকিছু দমন করা হচ্ছে। কেউ বাদ যাচ্ছে না। সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেজন্য আমি মনে করি আমাদের দেশ, আমরা অনেক নিরাপদ আছি।” (দৈনিক ইত্তেফাক- ২৫/০৪/১৬)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী এমপি-মন্ত্রীরা যে যাই বলুক, প্রকৃত অর্থে দেশের অবস্থা কতটা ভয়াবহ তা কেবল ভুক্তভোগী ও সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন ও বুঝেন।
সরকারের নানামুখী আশ্বাস ও চটকদার বক্তব্যে এখন কেউ আশ্বস্ত হতে পারছে না। কে তাদের নিরাপত্তা দেবে? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে প্রতিনিয়ত কাউকে না কাউকে বাসা-বাড়ি, হাট-বাজার থেকে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাদের সন্ধানের জন্য ধরণা দিলেও তারা তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে অহরহ। নেয়া হচ্ছে না কোন উদ্ধার তৎপরতা। ২৪ ঘণ্টা বা একটা সময় পরে কোথাও না কোথাও তাদের লাশ মিলছে। এরপর সংবাদে বন্দুকযুদ্ধ নাটকের স্ক্রিপ্ট উপস্থাপন করা হচ্ছে। অথচ প্রায় প্রতিটি ঘটনায় গ্রেফতারের বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পূর্ণ অস্বীকার করে থাকে। গুম হওয়ার পর বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চেীধুরী আলম, ইবি ছাত্রশিবির নেতা আল-মুকাদ্দাস, ওয়ালী উল্লাহ, হাফেজ জাকির হোসেন বা সিলেট ছাত্রদল নেতা দীনারের মত কত নাম না জানা বিরোধী মতাদর্শের নেতা-কর্মীর ভাগ্যে কি ঘটেছে তার খবর কে বা রাখে? কবে শেষ হবে তাদের স্বজনদের অপেক্ষার পালা ?
এমন হত্যাকাণ্ডের শেষ কোথায়?
প্রথমে সাদা পোশাকের পুলিশ পরিচয়ে গ্রেফতার, তার কয়েকদিন পর মিলছে লাশ। এটি এখন বাংলাদেশের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ক্ষমতার আসনকে পাকাপোক্ত করতে প্রতিদিনই খালি হচ্ছে কোন না কোন মায়ের বুক। জালিম সরকারের রক্ত পিপাসা দিন দিন যেন বেড়েই চলছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, আলেম ও সাধারণ মানুষ সহ তাদের গুম-খুনের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ। জামায়াতের দলীয় সূত্র মতে, জনগণের রাজপথের প্রতিবাদ দমন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যয় করে পুলিশ-র্যাবের গুলী-ক্রসফায়ারে এ পর্যন্ত (আওয়ামী লীগ সরকারে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সময়কাল) ৬৬৮ জন নিহত হয়েছেন, এছাড়াও ৭০ হাজার ৩’শ এর অধিক হয়েছেন আহত, ১ লক্ষ ৫১ হাজারের অধিক নাগরিককে আটক করা হয়েছে, ২ লক্ষ ৩’শ এর অধিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় ১০ লক্ষ ২ হাজারের অধিক নেতা-কর্মীকে আসামী করা হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১৯৩ জন বা তারও বেশি। যার মধ্যে ১৪৩ জনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রসফায়ারে হত্যা করে। এদের বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম দেশে কেন এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড? আর কত মায়ের বুক খালি হলে বন্ধ হবে এই জঘন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ? এমন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শেষ কোথায়?
গ্রেফতারের পর পুলিশের ধারাবাহিক অস্বীকার ও মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা : সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা প্রবাহের নজির আরো ভয়াবহ। ইতঃপূর্বের ঘটনাগুলোতে গুমের পর অন্তত ক্রসফায়ারের কথা মিডিয়ায় স্বীকার করলেও বর্তমান সময়ে তাও স্বীকার করছে না, কারো লাশ খালে বিলে মিলছে আর কারো হদিস নেই দিনের পর দিন। ধারাবাহিক গুম-খুনের ঘটনার সর্বশেষ কয়েকটি ঘটেছে ঝিনাইদহে- গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে হাফেজ জসিমকে ডিবি পরিচয়ে গুম করার ২১ দিন পর ৩ মার্চ গভীর রাতে গুলী চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে ঝিনাইদহ জেলার কুঠিদুর্গাপুর মাদরাসার শিক্ষক আবু হুরায়রাকে তার কর্মস্থল থেকে গ্রেফতার করে গুম করে ডিবি পুলিশ, ৩৬ দিন পর তার লাশ যশোরের চৌগাছা সড়কের পাশে থেকে উদ্ধার করা হয়। গত ১৮ই মার্চ ২০১৬ তারিখে শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে ৪ জন ব্যক্তি পুলিশ পরিচয়ে মায়ের সামনে থেকে আবুযর গিফারীকে তুলে নিয়ে গুম করার ২৬ দিন পরে ১২ এপ্রিল গভীর রাতে গুলী চালিয়ে তাকে হত্যা করে। একই কায়দায় গত ২৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে শামীম হোসেনকে পুলিশ পরিচয়ে গুম করার ২৬ দিন পরে ১২ এপ্রিল গভীর রাতে গুলী চালিয়ে তাকে হত্যা করে। দুই ছাত্রের রক্তের দাগ না শুকাতেই গত ২০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে ঘাতকের নির্মমতার শিকার হয় আরেক মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিন সোহান, যাকে একইভাবে ১০ এপ্রিল পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করার ৯ দিন পরে গুলী চালিয়ে হত্যা করা হয়।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ভিকটিমদের প্রত্যেকের পরিবার নিখোঁজের পরে তাদের অবস্থান জানতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করলে তারা তাদের গ্রেফতারের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। এমনকি অধিকাংশ ভিকটিমের জন্য থানায় কোন জিডি পর্যন্ত নেয়নি, নেয়া হয়নি কোন উদ্ধার তৎপরতা। প্রকাশ্যে দিবালোকে গ্রেফতারের পর পুলিশের সরাসরি অস্বীকার ও আদালতে হাজির না করা নিয়ে নানা আশঙ্কার জন্ম দেয়। পরিবারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ এবং তাদের সন্ধানের দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করা হয়, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ছেলেদের সন্ধানের দাবিতে প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের কাছে ধর্ণা দিয়েও পরিবারের কোন লাভ হয়নি। প্রত্যেকের গুম হওয়ার ঘটনা, পুলিশের অস্বীকার, গুলীবিদ্ধ লাশ পাওয়ার ঘটনা একই রকম।
কারা চালাচ্ছে এই গণহত্যা?
প্রতিটি হত্যার ধরন একই। কলেজ ছাত্র সোহানকে অপহরণের সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা কালীগঞ্জ থানার এস আই নীরব ও এ এস আই নাসিরকে চিনতে পারে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এটি একটি পরিকল্পিত সংঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ড এবং এতে পুলিশ সরাসরি জড়িত। কিন্তু সরকারের নির্দেশ ছাড়া শুধু পুলিশের পক্ষে এত বড় গণহত্যা চালানো কি সম্ভব? এটি এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট সরকারের নির্দেশেই পুলিশ ঝিনাইদহসহ সারাদেশে একের পর এক গণহত্যা চালাচ্ছে। হয়ত এহেন ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে ভবিষ্যতে প্রতিফোঁটা রক্তের হিসাব আজকের ক্ষমতাসীনদের দিতে হবে।
স্বজন হারাদের সাথে আলাপ কালে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরজন্য প্রশাসনকে দায়ী করেন এবং সন্তান হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। সম্প্রতি কালে ঝিনাইদহে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার কয়েকজনের বক্তব্য...
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হাফেজ জসিম উদ্দিনের পিতাকে তার ছেলেকে কে বা কারা হত্যা করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন পুলিশ ছাড়া কেউ আমার ছেলেকে মারেনি।” আপনার ছেলেকে উদ্ধারে পুলিশের ভূমিকা কেমন ছিল এমন উত্তরে তিনি বলেন “আমার ছেলের উদ্ধারের জন্য পুলিশ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, তারা আমার বাড়ি আসেনি।” আপনি কি এই হত্যার বিচার চান, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন “বিনা কারণে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে, আমি আমার ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। তার কারণ আমার ছেলে ভাল মানুষ, তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছেলে ৩০ পারা কুরআনে হাফেজ, তাকে বিনা কারণে হত্যা করা হয়েছে।”
ঝিনাইদহে আরেক হত্যাকাণ্ডের শিকার শিবির নেতা আবুযর গিফারীর বাবা বলেন, “আমার ছেলেকে প্রশাসনিক লোক, পুলিশ পরিচয়ে ধরে নিয়ে গেছে। জুমার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে দুইটা মোটর সাইকেল ৪টা লোক, অস্ত্রধারী লোক, পিস্তল আছে, হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে মোটর সাইকেলে করে পুলিশ পরিচয় দিয়ে নিয়ে গেছে। থানায় গিয়েছিলাম জিডি করার জন্য, তারা দুই কপিই রেখে দিয়েছিল, এন্ট্রি করেনি”। আপনার ছেলেকে কারা হত্যা করেছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন “যেহেতু প্রশাসনের লোকেরা নিয়ে গিয়েছে সেহেতু তারাই মেরেছে, আমার মনে হয়।” হত্যার বিচার চান কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন “অবশ্যই দোষীদের বিচার চাই। আমার ছেলে খুব ভাল ছিল, চরিত্রবান, আমাদের চোখে তার কোন দোষ নাই, তবে একটাই মাত্র কারণ দেখতেছি শিবির সংগঠন করার কারণেই তাকে মারা হয়েছে। সে এম এম কলেজে পড়ত, অনার্স ৩য় বর্ষে বাংলাতে। আমার ১ ছেলে মেয়ের মধ্যে সে বড়।”
আরেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার শামীম হোসেনের পিতার সাথে আলাপকালে তিনি বলেন “আমার ছেলেকে প্রশাসনের লোক পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায়। মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রী কলেজ গেটের পূর্বপার্শের ফার্নিচারে দোনাকে বসে সে পত্রিকা পড়ছিল। ঐ সময় চারজন মোটর সাইকেলে করে এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল, স্থানীয়রা বাধা দিলে তখন তারা বলে আমরা প্রশাসনের লোক। এ কথা বলে হাতে হ্যান্ডক্যাপ দিয়ে তাকে নিয়ে যায়। পুলিশের কাছে বারবার আমরা গিয়েছি, ওসি সাহেবের সাথে কথা হয়েছে, তিনি বলেন, এটাতো আমরা জানিনা, আমরা খুঁজছি। আমরা জিডি করতে গেলাম ওনারা জিডি এন্ট্রি না করে বল্লেন যে, কপি আমাদের কাছে আছে, অসুবিধা কি? ওনারা জিডি গ্রহণ করেননি।” আপনার ছেলেকে কারা হত্যা করেছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে শামীমের বাবা বলেন “প্রশাসনের কথা ওরা যেহেতু বলেছে প্রশাসনের লোকেরাই তাকে হত্যা করেছে। এখন এ প্রশাসনের লোক কারা এখন এটাইতো আমরা এখনো খুঁজে পেলাম না। প্রশাসন বলতে কি বুঝাইল ওনারা?” আপনি কি আপনার ছেলে হত্যার বিচার চান, এমন প্রশ্নের উত্তরে কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন অবশ্যই বিচার চাই। একটা ছেলেকে দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে মানুষ করার পরে, সে ছেলে যখন স্বাবলম্বী হওয়ার পথে তখন তারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, যার কোন অপরাধ নাই, আমি এই পর্যন্ত অনেক তথ্য অনুসন্ধান করেছি যার অপরাধটা কি? আমি তার জানাযায়ও বলেছি তাকে কোন অপরাধে হত্যা করা হয়েছে? আমি এর জবাব এখনো পাইনি। আমি এর বিচার চাই। যদি নাও পাই, আল্লাহর আদালতে বিচারটা দিয়ে রেখেছি।”
অপর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার মহিউদ্দীন সোহানের পিতার বলেন- “আমি ঢাকায় ছিলাম, তার মাকে বাড়িতে (ঝিনাইদহে) পাঠাই। তার মা বাস থেকে নামার ১০ মিনিট আগে সাদা পোশাকধারী ৪ জন পুলিশ ইজিবাইকে করে তাকে কালীগঞ্জে নিয়ে যায়। থানায় আমার পরিবারের লোকজন গেলে তারা গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করে। ১০ এপ্রিল তাকে নিয়ে যায় ১১ তারিখ জিডি করেছিলাম তারা জিডি ইস্যু করেছিল ১২ তারিখ। ওনাদের কাছে ধরণা দিলে ওনারা বলেন তারা আপনার কাছে আসবেন, আসলে হয়ত কিছু চাইবেন, আর আপনি খোঁজাখুজি করেন। আমি বল্লাম আপনারা খোঁজেন তারা বল্লেন আমরাও খুঁজছি। আমি খোঁজাখুঁজির ভিতর ছিলাম। ২১ এপ্রিল সকাল বেলা ঝিনাইদহ এসপি সাহেবের কাছে তার মা সহ যাব, এমন সময় একজন ফোন করে বল্ল আপনার ছেলের লাশ অমুক জায়গায় পাওয়া গিয়েছে।” আপনার ছেলেকে কারা হত্যা করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে সোহানের বাবা বলেন “এখন পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে কারা যে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে আমি সঠিক বলতে পারব না। পুলিশ নিয়ে গেছে এটাই আমি জানি। কান্না জড়িতভাবে বলেন, তিনি বলেন আমি অবশ্যই আমার শিশু হত্যার বিচার চাই। তার বয়স ১৬ বছর। তার নামে কেইস নাই, কিছু নাই, কোন দল করত না। সে কোন দলের সাথে ছিল কিনা তাও জানিনা। তার পরেও আমি সবার কাছে ধরণা দিয়েছি অন্তত আমার ছেলের জীবন ভিক্ষা দিতে। ২ ছেলে ১ মেয়ে, সে সবার বড় ছেলে। সে আমার বড় আদরের ছেলে”।
এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। যেখানে কারো জানমালের নিরাপত্তা নেই। সরকারের নেই জনগণের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা। রাষ্ট্রীয় মদদে খুন বা গুম হওয়ার পরে জনগণ কার কাছে নিরাপত্তা চাইবে ? এমন অপ্রত্যাশিত অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রেেয়াজন জনগণের সরকার। আর সেই প্রত্যাশিত সরকারের প্রয়োজনে অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সরকারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া মুক্তির কোন বিকল্প নেই।
মুহাম্মদ আবদুল জব্বার
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন