বৃহস্পতিবার, ২৬ মে, ২০১৬

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ


ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বক্তব্য রাখার সময় ক্ষমতাসীন কনজার্ভেটিভ পার্টি ও বিরোধী দল লেবার পার্টির বেশ কয়েকজন এমপি বাংলাদেশের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ ও আশংকা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, মৃত্যুদণ্ড ও গুপ্তহত্যার পাশাপাশি যেভাবে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে তার ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। কেউ কেউ একথা পর্যন্ত বলেছেন যে, বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। একদলীয় রাজনীতির উত্থান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাতজন এমপি। তারা বলেছেন, সাহায্যদানকারী রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের উচিত এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা- বাংলাদেশে যাতে শাসনক্ষমতা একটি দলের হাতে কুক্ষিগত না হয়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। সাইমন ড্যানজ্যাক-এর মতো কোনো কোনো এমপি পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সময়ের জন্য বাংলাদেশের ওপর অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা জারি করার দাবি জানিয়েছেন। 
উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দফতরের প্রতিমন্ত্রী হুগো সয়্যারও স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ ‘ঠিক পথে এগোচ্ছে না’। প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্য রাষ্ট্র এবং সে কারণে ব্রিটেন চায়, কমনওয়েলথ দেশটির বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। প্রতিমন্ত্রীর অন্য কিছু বক্তব্যও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রাধান্যে এসেছে। যেমন তিনি বলেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোই হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন ব্রিটিশ সরকার তার সঙ্গে একমত নয়। ব্রিটেন বরং মনে করে, সমস্যা আরো অনেক গভীরে। সমস্যার সমাধানও বাংলাদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেই করতে হবে। প্রতিমন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানমুখী উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক এবং গৃহযদ্ধের আশংকা ব্যক্ত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এমন এক সময়ে হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ প্রাধান্যে উঠে এসেছে যখন একের পর এক জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে, অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মতো অতি সাধারণ উপলক্ষেও মৃত্যু ঘটছে মানুষের। সব মিলিয়েই দেশ এক ভয়ংকর অবস্থায় পরিণত হয়েছে বলেই ‘গণতন্ত্রের সূতিকাগার’ নামে পরিচিত দেশ ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্যরা সোচ্চার না হয়ে পারেননি। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের এমপিদের পাশাপাশি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই প্রায় একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে প্রতিমন্ত্রী হুগো সয়্যারের একটি বক্তব্য বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, যেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোই চলমান হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এ প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে, বর্তমান সরকার ব্রিটেনের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আদৌ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এমপিদের মূল কথাগুলোও লক্ষ্য করা দরকার। তারা শুধু একদলীয় রাজনীতির উত্থান, আক্রান্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েই কথা বলেননি, বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের আশংকাও ব্যক্ত করেছেন। কোনো কোনো এমপি এমনকি অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে কমনওয়েলথই ব্যবস্থা নেবে বলে আশা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও অনেকাংশে একই মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। 
আমরা মনে করি, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যে সুরে ও ভাষায় বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে তা থেকে সরকারের উচিত বিবেচনায় নেয়া। উল্লেখ্য, পার্লামেন্টে প্রথমবারের মতো উঠে এলেও এর আগে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ‘গণতান্ত্রিক স্পেস সংকুচিত হয়ে গেছে ও যাচ্ছে’ ধরনের বক্তব্য রেখেছেন ব্রিটেন এবং ইইউভুক্ত দেশগুলোর মিশন প্রধানরা। এমন অবস্থায় এসব দেশ যে শংকিত সে সম্পর্কেও জানান দিয়েছেন তারা। এবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ওই আশংকারই প্রকাশ ঘটেছে। একযোগে এসেছে সংলাপে বসার সুনির্দিষ্ট পরামর্শও। বলা দরকার, সবই এসেছে অতীতের ধারাবাহিকতায়।  ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত একতরফা সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইইউ এবং কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার পাশাপাশি ব্রিটেনের পক্ষ থেকেও ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়েছিল। তখনও সকলে সংলাপের মাধ্যমে সংকট কাটিয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়েছিল। এই আহ্বানে সাড়া দেয়ার সময় এখনো রয়েছে এবং ইতিবাচকভাবে সাড়া দিলেই কেবল সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। গণতন্ত্রসম্মত ও সম্ভাবনাময় সে পথটিতে পা বাড়ানোর জন্য আমরা ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানাই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads