বিএনপির নবনিযুক্ত যুগ্ম-মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে নিয়ে সরকার এক নতুন নাটক মঞ্চস্থ করার কোশেশ করছে। আসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন ব্যবসায়ী। আর ব্যবসার প্রয়োজনে তার ভারতে যাতায়াত আছে। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির যুব সংগঠনের আমন্ত্রণে তিনি একটি সেমিনারে যোগ দিতে দিল্লী গিয়েছিলেন। তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের আর এক হিন্দু স্বার্থ রক্ষার কর্মী শিপন চৌধুরী। তার বাড়িও চট্টগ্রামে। সেই সেমিনারে আরও অনেকের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ইসরাইলের নাগরিক গবেষক ও রাজনীতিক মেন্দি এন সাফাদি। তাতে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়।
এ কথা অস্বীকার উপায় নেই যে, বর্তমান সরকারের আমলে এদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বহু গুণে বেড়ে গেছে। তাদের জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এর মধ্যে মন্ত্রীও আছেন। এর বিরুদ্ধে তারা যথাসম্ভব সোচ্চার প্রতিবাদও করছেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির ঊনিশ-বিশ কিছুই হয়নি। তারা মানববন্ধন করেছেন, বিভিন্ন স্থানে স্মারকলিপি দিয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। কোনো ফল হয়নি। তারা এমনও বলেছেন যে, বর্তমান সরকারের আমলে তাদের ওপর পাক বাহিনীর চেয়েও বেশি নির্যাতন হচ্ছে। সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী আবুল বারাকাত তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঙ্গে সরকার সমর্থক লোকেরাই বেশি জড়িত।
সরকার বিদেশী হত্যা, ব্লগার হত্যা, প্রকাশক হত্যা, অভিজিৎ হত্যা, তনু হত্যা, নাজিম হত্যা, কোনো ঘটনারই কোনো কিনারা করতে পারেনি। কিনারা করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনারও। বরং একটি ঘটনা দিয়ে আর একটি ঘটনা ধামাচাপা দেয়া চেষ্টা করেছে। তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের উদ্বেগ হয়েছে যে, এসব ঘটনার সঙ্গে কি তবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারও কারও যোগসাজস রয়েছে? আর যা কিছু ঘটুক না কেন, কোনারূপ তদন্ত ছাড়াই গৎবাঁধা বুলির মতো সরকার আওয়াজ দিচ্ছে, এই ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াত জড়িত। ফলে এর কোনো কিনারা করার তাগিদ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কখনও অনুভব করেনি। অঘটনের পর অঘটন ঘটেই চলেছে।
দিল্লীর সেমিনারে যারা যোগ দিতে এসেছিলেন, সেখানকার রীতি অনুযায়ী তাদের সকলকে ফুলের মালা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। মেন্দি সাফাদি ও উদ্যোক্তারা সে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ঐ দলের সঙ্গে আসলাম চৌধুরী আগ্রার মেয়রের আতিথেয়তায় আগ্রাও ভ্রমণ করেছেন। সে ছবিও সাফাদি তার ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। সেখান থেকে ছবি নিয়ে ঢাকায় সরকারের কিছু ধামাধরা পত্রিকা লিখে দিয়েছে যে, বর্তমান সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য আসলাম চৌধুরী তথা বিএনপি মোসাদের সঙ্গে বৈঠক করে ষড়যন্ত্র করেছে। তারপর থেকেই চলছে নানা তুলকালাম কা-। পত্রিকার পাতায় ঝড়, টিভির টক-শোতে ঝড় : বিএনপি ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বসে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে।
যে-কোনো ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্র দেখা আওয়ামী লীগের পুরানা অভ্যাস। কত রকম ঘড়যন্ত্রের দুঃস্বপ্ন যে তারা দেখে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মোসাদ ষড়যন্ত্রও তার একটি। পত্রিকাগুলোও না জেনে, না শুনে, না ঘেঁটে বলে দিল যে, সাফাদি বলেন মোসাদের একজন উচ্চ পর্যায়ের এজেন্ট এবং তিনি ইসরাইলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির নির্বাহী কমিটির সদস্য। অনুষ্ঠানের আয়োজকরা এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান। সাফাদিও বলেছেন, তিনি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার ফেসবুক পোস্ট আপডেট করেন। তার সব কিছুই খোলা। কোনো রাখঢাক নেই। আর তাই তাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোক বলা অসমীচীন। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘গুপ্তচর বৃত্তি নয়, আমি আন্তর্জাতিক কূটনীতির সঙ্গে জড়িত। মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার লক্ষ্য হচ্ছে বিরোধী দলকে স্তব্ধ করা। আর যাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আনার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবাধিকার কর্মীদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে তাদেরকেও গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের এটা স্বৈরশাসকীয় প্রক্রিয়া।’ আবার আসলাম চৌধুরীও তার সঙ্গে সাফাদির দেখা হওয়ার কথা অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, তবে সাফাদি গোয়েন্দা সংস্থার এজন্ট কিনা, সেটি তার জানা নেই। সেটি সম্ভবও নয়। কারণ কেউ যখন কোনো সেমিনারে যোগ দিতে যায়, তখন সেখানে অংশগ্রহণকারীদের বিস্তারিত বিবরণ অনুসন্ধান করে না। আসলাম চৌধুরীও তা করেননি।
তবে দেশের প্রধান ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ গত ২০ মে ভিন্ন খবর দিয়েছে। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, আসলাম চৌধুরীর ভারত সফরের বহু আগে থেকেই বর্তমান সরকার ইসরাইলের সঙ্গে ঘুরপথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। আসলাম চৌধুরীর যে সফরকে ষড়যন্ত্র বলে দেখানো হয়েছে, তার পোজ-দেয়া ছবিও আছে। কোনো ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপ ছবি তুলে একেবারে জানান দিয়ে কখনও ষড়যন্ত্র করে না। যেমন ভারত সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা দুবেল গোয়েন্দা বৃত্তির জন্য দাড়ি রেখে টুপি পরে মুসলমান সেজে ছয় বছর পাকিস্তানের করাচীতে অবস্থান করেছিলেন। ধরা পড়েননি। সাফাদির রাজনৈতিক পরিচয় বড় কিছু নয়। তিনি ইসরাইলের একজন উপমন্ত্রী আইয়ুব কারা’র সহকারী ছিলেন মাত্র। তিনি কখনও লিকুদ পার্টির সদস্য ছিলেন না
আসলাম চৌধুরীকে দিল্লীতে ডেকে নেয়াটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। আর ভারতে ইহুদীদের আনাগোনা ও কার্যক্রম কোনো গোপন ব্যাপারও নয়। নীলনকশা অনুযায়ী আসলাম চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে ছবিটবি তুলে তা প্রচার করে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, যাতে এটা প্রচার করা যায় যে, বাংলাদেশের বর্তমান জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকারকে উৎখাতের জন্য বিএনপি ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। তবে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে কি নেই, তাতে ইসরাইলের কোনো আগ্রহ নেই। এসব অপপ্রচারের মূল লক্ষ্য প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, আওয়ামী লীগ সরকার যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ইসরাইলী প্রতিষ্ঠান ভেরিন্টের কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলার মূল্যের তথ্য প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি কিনতে যাচ্ছে।
বিষয়টি পৃথিবীর অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পারে ২০১৫ সালে। জিমি জনসন গ্লোবাল রিসার্চ.সিএ জানিয়েছে, ‘ইসরাইলী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে, ইউনিট ৮২০০ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকার তথ্য আদান-প্রদান ধরতে পারবে। ইসরাইলী সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে।’ ইউনিট ৮২০০-এর একজন সাবেক সদস্য ইদান টেন্ডলার জানিয়েছেন, ‘বাইরের গবেষণা ও অগ্রগতির ওপর নির্ভর না করে ৮২০০’র প্রযুক্তিবিদগণ তাদের গ্রাহকদের (গোয়েন্দা কর্মকর্তা) সঙ্গে সরাসরি কাজ করেন। তথ্য বিশ্লেষণ, ডাটা সংরক্ষণ, তথ্য আটকে দেয়া ও গোয়েন্দা ব্যবস্থাপনাসহ সকল প্রযুক্তি ব্যবস্থা ঘরের মধ্যেই করা সম্ভব। দু’পক্ষের প্রযুক্তিবিদরা প্রতিদিন পাশাপাশি বসে সুনির্দিষ্ট চাহিদা মোতাবেক সব ব্যবস্থা করতে পারবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তার গোপনীয়তা একটি ইসরাইলী প্রতিষ্ঠানের কাছে যেমন প্রকাশিত হয়ে পড়বে, সেই সঙ্গে উভয় দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সমঝোতাও তৈরি হতে হবে। পত্রিকা একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে যে, ২০১০ সালে গঠিত জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (এনটিএমসি) পক্ষে এই চুক্তির মধ্যস্থতা করেছেন সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা। অন্য একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে যে, ২০১০ সালে সরকার যেখানে ৫০০০ কল পর্যবেক্ষণ করতে পারত, তা ২০১৩ সালে সে ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হাজারে। ভেরিন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি দেড় লাখ করতে চাইছে সরকার। ভেরিন্ট এই প্রযুক্তি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর কাছেও বিক্রি করেছে। অপর একটি সূত্র বলেছে, ‘আওয়ামী লীগ ও ইসরাইলের মধ্যকার এই বাণিজ্যিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতার বিষয়টি থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর ভারত সফরের ব্যবস্থা করে এবং তার সঙ্গে সাফাদির বৈঠকের ব্যবস্থা করে তার ছবি তুলে সেগুলো বাংলাদেশ ও ইসরাইলে প্রচারের ব্যবস্থা করে।
আওয়ামী লীগের এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আরও দৃঢ় ভিত্তি পায় আওয়ামী লীগের এক এমপি আবদুল মান্নানের লেখা থেকে। আসলাম চৌধুরীর গ্রেফতারের আগের দিন ১৪ মে তিনি ডেইলি সান-এ এক নিবন্ধ লিখে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চায়। এই লক্ষ্যে মোসাদের গোপন চর মেন্দি এন সাফাদির (তিনি ইসরাইলের লিকুদ পার্টির সিনিয়র সদস্য ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও জনসংযোগ নামের একটি সংস্থার সিইও) সঙ্গে বিএনপির অন্যতম যুগ্ম-মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর কলকাতা, দিল্লী ও লন্ডনে বৈঠক হয়। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।’ মান্নান লিখেছেন, তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন বাংলাদেশে মোসাদের দুই এজেন্ট শিপন বসু ও সঞ্জীব চৌধুরী। সে বৈঠকে তারা একমত হন যে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারকে সরিয়ে পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারলে ইসরাইল ও মোসাদের জন্য দরজা খুলে যাবে।
এভাবেই পাকিয়ে তোলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এখন পাঠকই বিবেচনা করতে পারবেন, আসল ঘটনা কী।
এ কথা অস্বীকার উপায় নেই যে, বর্তমান সরকারের আমলে এদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বহু গুণে বেড়ে গেছে। তাদের জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এর মধ্যে মন্ত্রীও আছেন। এর বিরুদ্ধে তারা যথাসম্ভব সোচ্চার প্রতিবাদও করছেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির ঊনিশ-বিশ কিছুই হয়নি। তারা মানববন্ধন করেছেন, বিভিন্ন স্থানে স্মারকলিপি দিয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। কোনো ফল হয়নি। তারা এমনও বলেছেন যে, বর্তমান সরকারের আমলে তাদের ওপর পাক বাহিনীর চেয়েও বেশি নির্যাতন হচ্ছে। সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী আবুল বারাকাত তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঙ্গে সরকার সমর্থক লোকেরাই বেশি জড়িত।
সরকার বিদেশী হত্যা, ব্লগার হত্যা, প্রকাশক হত্যা, অভিজিৎ হত্যা, তনু হত্যা, নাজিম হত্যা, কোনো ঘটনারই কোনো কিনারা করতে পারেনি। কিনারা করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনারও। বরং একটি ঘটনা দিয়ে আর একটি ঘটনা ধামাচাপা দেয়া চেষ্টা করেছে। তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের উদ্বেগ হয়েছে যে, এসব ঘটনার সঙ্গে কি তবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারও কারও যোগসাজস রয়েছে? আর যা কিছু ঘটুক না কেন, কোনারূপ তদন্ত ছাড়াই গৎবাঁধা বুলির মতো সরকার আওয়াজ দিচ্ছে, এই ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াত জড়িত। ফলে এর কোনো কিনারা করার তাগিদ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কখনও অনুভব করেনি। অঘটনের পর অঘটন ঘটেই চলেছে।
দিল্লীর সেমিনারে যারা যোগ দিতে এসেছিলেন, সেখানকার রীতি অনুযায়ী তাদের সকলকে ফুলের মালা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। মেন্দি সাফাদি ও উদ্যোক্তারা সে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ঐ দলের সঙ্গে আসলাম চৌধুরী আগ্রার মেয়রের আতিথেয়তায় আগ্রাও ভ্রমণ করেছেন। সে ছবিও সাফাদি তার ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। সেখান থেকে ছবি নিয়ে ঢাকায় সরকারের কিছু ধামাধরা পত্রিকা লিখে দিয়েছে যে, বর্তমান সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য আসলাম চৌধুরী তথা বিএনপি মোসাদের সঙ্গে বৈঠক করে ষড়যন্ত্র করেছে। তারপর থেকেই চলছে নানা তুলকালাম কা-। পত্রিকার পাতায় ঝড়, টিভির টক-শোতে ঝড় : বিএনপি ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বসে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে।
যে-কোনো ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্র দেখা আওয়ামী লীগের পুরানা অভ্যাস। কত রকম ঘড়যন্ত্রের দুঃস্বপ্ন যে তারা দেখে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মোসাদ ষড়যন্ত্রও তার একটি। পত্রিকাগুলোও না জেনে, না শুনে, না ঘেঁটে বলে দিল যে, সাফাদি বলেন মোসাদের একজন উচ্চ পর্যায়ের এজেন্ট এবং তিনি ইসরাইলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির নির্বাহী কমিটির সদস্য। অনুষ্ঠানের আয়োজকরা এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান। সাফাদিও বলেছেন, তিনি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার ফেসবুক পোস্ট আপডেট করেন। তার সব কিছুই খোলা। কোনো রাখঢাক নেই। আর তাই তাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোক বলা অসমীচীন। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘গুপ্তচর বৃত্তি নয়, আমি আন্তর্জাতিক কূটনীতির সঙ্গে জড়িত। মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার লক্ষ্য হচ্ছে বিরোধী দলকে স্তব্ধ করা। আর যাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আনার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবাধিকার কর্মীদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে তাদেরকেও গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের এটা স্বৈরশাসকীয় প্রক্রিয়া।’ আবার আসলাম চৌধুরীও তার সঙ্গে সাফাদির দেখা হওয়ার কথা অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, তবে সাফাদি গোয়েন্দা সংস্থার এজন্ট কিনা, সেটি তার জানা নেই। সেটি সম্ভবও নয়। কারণ কেউ যখন কোনো সেমিনারে যোগ দিতে যায়, তখন সেখানে অংশগ্রহণকারীদের বিস্তারিত বিবরণ অনুসন্ধান করে না। আসলাম চৌধুরীও তা করেননি।
তবে দেশের প্রধান ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ গত ২০ মে ভিন্ন খবর দিয়েছে। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, আসলাম চৌধুরীর ভারত সফরের বহু আগে থেকেই বর্তমান সরকার ইসরাইলের সঙ্গে ঘুরপথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। আসলাম চৌধুরীর যে সফরকে ষড়যন্ত্র বলে দেখানো হয়েছে, তার পোজ-দেয়া ছবিও আছে। কোনো ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপ ছবি তুলে একেবারে জানান দিয়ে কখনও ষড়যন্ত্র করে না। যেমন ভারত সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা দুবেল গোয়েন্দা বৃত্তির জন্য দাড়ি রেখে টুপি পরে মুসলমান সেজে ছয় বছর পাকিস্তানের করাচীতে অবস্থান করেছিলেন। ধরা পড়েননি। সাফাদির রাজনৈতিক পরিচয় বড় কিছু নয়। তিনি ইসরাইলের একজন উপমন্ত্রী আইয়ুব কারা’র সহকারী ছিলেন মাত্র। তিনি কখনও লিকুদ পার্টির সদস্য ছিলেন না
আসলাম চৌধুরীকে দিল্লীতে ডেকে নেয়াটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। আর ভারতে ইহুদীদের আনাগোনা ও কার্যক্রম কোনো গোপন ব্যাপারও নয়। নীলনকশা অনুযায়ী আসলাম চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে ছবিটবি তুলে তা প্রচার করে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, যাতে এটা প্রচার করা যায় যে, বাংলাদেশের বর্তমান জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকারকে উৎখাতের জন্য বিএনপি ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। তবে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে কি নেই, তাতে ইসরাইলের কোনো আগ্রহ নেই। এসব অপপ্রচারের মূল লক্ষ্য প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, আওয়ামী লীগ সরকার যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ইসরাইলী প্রতিষ্ঠান ভেরিন্টের কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলার মূল্যের তথ্য প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি কিনতে যাচ্ছে।
বিষয়টি পৃথিবীর অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পারে ২০১৫ সালে। জিমি জনসন গ্লোবাল রিসার্চ.সিএ জানিয়েছে, ‘ইসরাইলী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে, ইউনিট ৮২০০ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকার তথ্য আদান-প্রদান ধরতে পারবে। ইসরাইলী সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে।’ ইউনিট ৮২০০-এর একজন সাবেক সদস্য ইদান টেন্ডলার জানিয়েছেন, ‘বাইরের গবেষণা ও অগ্রগতির ওপর নির্ভর না করে ৮২০০’র প্রযুক্তিবিদগণ তাদের গ্রাহকদের (গোয়েন্দা কর্মকর্তা) সঙ্গে সরাসরি কাজ করেন। তথ্য বিশ্লেষণ, ডাটা সংরক্ষণ, তথ্য আটকে দেয়া ও গোয়েন্দা ব্যবস্থাপনাসহ সকল প্রযুক্তি ব্যবস্থা ঘরের মধ্যেই করা সম্ভব। দু’পক্ষের প্রযুক্তিবিদরা প্রতিদিন পাশাপাশি বসে সুনির্দিষ্ট চাহিদা মোতাবেক সব ব্যবস্থা করতে পারবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তার গোপনীয়তা একটি ইসরাইলী প্রতিষ্ঠানের কাছে যেমন প্রকাশিত হয়ে পড়বে, সেই সঙ্গে উভয় দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সমঝোতাও তৈরি হতে হবে। পত্রিকা একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে যে, ২০১০ সালে গঠিত জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (এনটিএমসি) পক্ষে এই চুক্তির মধ্যস্থতা করেছেন সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা। অন্য একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে যে, ২০১০ সালে সরকার যেখানে ৫০০০ কল পর্যবেক্ষণ করতে পারত, তা ২০১৩ সালে সে ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হাজারে। ভেরিন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি দেড় লাখ করতে চাইছে সরকার। ভেরিন্ট এই প্রযুক্তি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর কাছেও বিক্রি করেছে। অপর একটি সূত্র বলেছে, ‘আওয়ামী লীগ ও ইসরাইলের মধ্যকার এই বাণিজ্যিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতার বিষয়টি থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর ভারত সফরের ব্যবস্থা করে এবং তার সঙ্গে সাফাদির বৈঠকের ব্যবস্থা করে তার ছবি তুলে সেগুলো বাংলাদেশ ও ইসরাইলে প্রচারের ব্যবস্থা করে।
আওয়ামী লীগের এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আরও দৃঢ় ভিত্তি পায় আওয়ামী লীগের এক এমপি আবদুল মান্নানের লেখা থেকে। আসলাম চৌধুরীর গ্রেফতারের আগের দিন ১৪ মে তিনি ডেইলি সান-এ এক নিবন্ধ লিখে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চায়। এই লক্ষ্যে মোসাদের গোপন চর মেন্দি এন সাফাদির (তিনি ইসরাইলের লিকুদ পার্টির সিনিয়র সদস্য ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও জনসংযোগ নামের একটি সংস্থার সিইও) সঙ্গে বিএনপির অন্যতম যুগ্ম-মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর কলকাতা, দিল্লী ও লন্ডনে বৈঠক হয়। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।’ মান্নান লিখেছেন, তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন বাংলাদেশে মোসাদের দুই এজেন্ট শিপন বসু ও সঞ্জীব চৌধুরী। সে বৈঠকে তারা একমত হন যে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারকে সরিয়ে পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারলে ইসরাইল ও মোসাদের জন্য দরজা খুলে যাবে।
এভাবেই পাকিয়ে তোলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এখন পাঠকই বিবেচনা করতে পারবেন, আসল ঘটনা কী।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন