আওয়ামী লীগের ‘উদ্ধারকারী’ ও ‘পরীক্ষিত বন্ধু’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাশাপাশি অন্য দু’জন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে নিয়েও মাঝে-মধ্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা জমে ওঠে। দু’জনই বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান। একজন, মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ পদটিতে ছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত। তিনিই দেশের প্রথম সেনাপ্রধান। দ্বিতীয়জন, জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ, মরহুম জেনারেল এম এ জি ওসমানীর পর বাংলাদেশের সেনাবাহিনী যাকে প্রথম পূর্ণাঙ্গ জেনারেলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল। দু’জনকে নিয়ে আলোচনা জমে ওঠার কারণ হলো, প্রথমজন ১৯৭৫ সালের আগস্ট হত্যাকান্ডের সময় তার প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকার জন্য নিন্দিত হয়ে এসেছেন। তাকে এমনকি সর্বোচ্চ অদালতের তিরষ্কারও শুনতে হয়েছে। অন্যদিকে দ্বিতীয়জন সম্পর্কে কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না। বাহারী নামের ‘ওয়ান ইলেভেন’-এর প্রধান খলনায়ক তিনি। বর্তমান নিবন্ধে এই দু’জনকে এক সঙ্গে টেনে আনার কারণ হলো, দুটি পৃথক সময়ে সেনাপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও একটি বিষয়ে দু’জনের চমৎকার ‘মিল’ রয়েছে। দু’জনই অধীনস্থদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, পরাজিত হয়েছিলেন বলেই তাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল।
প্রথমে জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহর কথা। ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ আদালত শুধু তিরষ্কার করেননি, তার সম্পর্কে অত্যন্ত কঠিন মন্তব্যও করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে সে সময় কয়েকদিন ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও জোর আলোচনা হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর মুজিব হত্যা মামলার শুনানিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনাবলী সম্পর্কে জানাতে গিয়ে আসামী পক্ষের আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান বলেছিলেন, তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ তার সাক্ষ্যতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। বলেছেন, ওইদিন সকাল ছয়টা বাজার তিন-চার মিনিট আগে তিনি নাকি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। অথচ অন্য সাক্ষীরা জানিয়েছেন, সেদিন ভোর চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই সব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। তাছাড়া সফিউল্লাহর সাক্ষ্যতেই জানা গেছে, আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাকে টেলিফোনে ফোর্স পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান হলেও রাষ্ট্রপতির প্রাণ বাঁচানোর জন্য সফিউল্লাহ সেনা পাঠাননি। ঠিক এ পর্যায়ে এসেই মাননীয় আদালত মন্তব্য করেছিলেন, সফিউল্লাহ ‘একজন কাপুরুষ, ভিতু এবং মিথ্যাবাদী সেনাপতি’।
কথার পিঠে স্বাভাবিকভাবেই কথা উঠেছিল। এখনো কথা ওঠে। কারণ, মাননীয় আদালতই প্রথম নন, তারও আগে খোদ আওয়ামী লীগ থেকেও সফিউল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে। মুজিব-উত্তর সকল সরকারের আমলে সুবিধাভোগকারী এই জেনারেলের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হয়েছেন তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৯ সালের ১৯ ও ২২ আগস্ট আয়োজিত দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডে সেনা প্রধান সফিউল্লাহ ‘নেপথ্য ভূমিকায়’ ছিলেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেখ সেলিম জানিয়েছিলেন, সেদিন আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান একাধিকবার সফিউল্লাহকে টেলিফোন করে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু জবাবে সফিউল্লাহ দেশের রাষ্ট্রপতিকে তার বাসভবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন! উল্লেখ্য, ২২ আগস্টের দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। সফিউল্লাহ নিজেও ছিলেন সামনের সারিতে। ওই অনুষ্ঠানে শেখ সেলিম বলেছিলেন, সেনা প্রধান হিসেবে সফিউল্লাহ কেন রাষ্ট্রপতির টেলিফোন পাওয়ার পরও ব্যবস্থা নেননি তা ‘রহস্যজনক’। তাছাড়া হত্যাকান্ডের পর ‘খুনিরা’ সেনানিবাসে গিয়েছিল। সেখানে রেড অ্যালার্ট জারি করেও ‘খুনিদের’ গ্রেফতার করা যেতো। কিন্তু সফিউল্লাহ উল্টো তাদের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন। রেডিওতে গিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এভাবে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে পুরোপুরি ডিফেন্সিভে চলে গিয়েছিলেন সফিউল্লাহ। পরদিন, ২০০৯ সালের ২৩ আগস্ট একটি দৈনিকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে শেখ সেলিমের অভিযোগকে তার বিরুদ্ধে ‘নতুন ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘তখনকার’ বাস্তবতা ‘এখনকার’ মতো ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে হত্যার বিষয়ে তিনি নাকি কোনো তথ্যই জানতেন না! কারণ, ১৯৭৪ সালে ডিজিএফআইকে তার হাত থেকে সরিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে নেয়া হয়েছিল এবং এর ফলে তিনি নাকি একেবারে ‘অন্ধ ও বধির’ হয়ে পড়েছিলেন! রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার কাছ থেকে ছিনিয়ে অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। সুতরাং মুজিব হত্যাকান্ডে তার কোনো ‘ব্যর্থতা’ ছিল না! রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার কাছে টেলিফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন- এই প্রচারণাকে ‘অসত্য’ দাবি করে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি নন, তিনিই রাষ্ট্রপতিকে টেলিফোন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছিলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স বোধহয় আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। ওরা সম্ভবত কামালকে মেরে ফেলেছে। তুমি দ্রুত ফোর্স পাঠাও।’ উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। আপনি কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন?’ রাষ্ট্রপতি কোনো উত্তর দেননি, টেবিলের ওপর টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিলে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ শুনেছিলেন সফিউল্লাহ। তারপর (দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে) ‘বেশ কয়েক মিনিট’ তিনি ‘হ্যালো, হ্যালো’ করেছেন। কিন্তু জবাব পাননি। কিছুক্ষণ পর বেশ কিছু গুলির শব্দ শুনেছিলেন। শুনে তার ‘মনে হয়েছিল’, রাষ্ট্রপতি হয়তো আর বেঁচে নেই। সফিউল্লাহ দাবি করেছেন, ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক কর্নেল সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে তিনি হামলার প্রথম খবর পেয়েছিলেন। তার মাধ্যমেই তিনি ঢাকা ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ধানমন্ডি যাওয়ার নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শাফায়াত জামিলের সেনারা নাকি ‘মুভ’ করেনি! এর মধ্যেই সফিউল্লাহ নাকি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল আহমদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি যেন রাষ্ট্রপতিকে তার বাসভবন থেকে বের করে নিয়ে যান (অথচ সফিউল্লাহ নিজেই আবার বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্ব অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল! এটা সত্য হলে তিনি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কোন অধিকারে?)।
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ব্যাপারে সফিউল্লাহ ‘নিশ্চিত খবর’ পেয়েছিলেন সকাল আটটার দিকে। তিনি তখন তার অফিসে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন (এই দু’জনও নাকি তার টেলিফোনে দেয়া নির্দেশ পালন করেননি!)। ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য’ সফিউল্লাহ নাকি এরপর ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে সেখানকার সৈন্যদের মধ্যে ‘আনন্দের আভা’ দেখতে পেয়েছিলেন! ততক্ষণে ওই সৈন্যরাও নাকি ‘খুনিদের’ সঙ্গে যোগ দিয়েছিল! সেখান থেকেই তাকে নাকি ‘চাপাচাপি’ করে রেডিও অফিসে নেয়া হয়েছিল! সেখানে আগে থেকে উপস্থিত খন্দকার মোশতাক আহমদ তাকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন এবং ‘কাজ শেষ হওয়ায় বিশ্রাম নিতে’ বলেছিলেন (জড়িত না থাকলে ‘অভিনন্দন’ জানানোর, ‘কাজ শেষ’ হওয়ার এবং ‘বিশ্রাম’ নেয়ার প্রশ্ন এসেছিল কিভাবে?)। সফিউল্লাহ তখন নাকি ‘বিরক্ত’ হয়ে রেডিও অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেজর ডালিম তার ‘পথরোধ’ করে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘বাধ্য হয়ে’ তাকে নাকি প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরের লিখে দেয়া বক্তব্য ‘পাঠ’ করতে হয়েছিল! মেজর ডালিমকে কেন গ্রেফতার করেননি- এ প্রশ্নের উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছেন, পরিস্থিতি ‘কখনোই’ সে রকম ছিল না। তারা আমার সঙ্গে ‘অস্ত্র উঁচিয়ে’ কথা বলেছে! মেজর ডালিম নাকি সফিউল্লাহর অফিসের দরোজায় লাথি পর্যন্ত মেরেছিলেন! এরপর ২৪ আগস্ট তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় এবং ‘বাধ্য হয়ে’ তিনি রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে যান।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অনেক চেষ্টা করেও জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। জনগণ বরং তার কাছ থেকেই জেনেছে, তিনি এত বেশি ‘যোগ্য’ সেনাপ্রধানই ছিলেন যে, ‘খুনি’ মেজররা তার সঙ্গে ‘অস্ত্র উঁচিয়ে’ কথা বলার সাহস পেয়েছেন, তাকে ‘ধরে’ নিয়ে গেছেন রেডিও অফিসে এবং তাকে দিয়ে আনুগত্যের শপথ ‘পাঠ’ করিয়ে ছেড়েছেন! সফিউল্লাহ লক্ষ্য করেননি, এসবের প্রতিটিই তার জন্য ভারি লজ্জার কথা! তাছাড়া রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর সফিউল্লাহর জীবনে ‘শনৈ শনৈ’ উন্নতি হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত তিনি চুটিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। এজন্যই চেষ্টায় ত্রুটি না থাকলেও সাবেক এই সেনাপ্রধান দায়দায়িত্ব এড়ানোর মতো যুৎসই বক্তব্য হাজির করতে পারেননি। তার বক্তব্যে বরং প্রমাণিত হয়েছে, হয় তিনি হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন; না হলে নিজের অধীনস্থদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এতদিন মুজিব হত্যার দায় অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে সাবেক এই জেনারেল নিজে ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে দিব্যি বহাল তবিয়তে ছিলেন। শেখ হাসিনা তাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য পর্যন্ত বানিয়েছেন। কিন্তু শেখ সেলিমের মতো শীর্ষ একজন নেতা হঠাৎ হাটে হাড়ি ভেঙে দেয়ায় এবং সর্বোচ্চ আদালত তার সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করায় বিপদ শুরু হয়েছিল তার। অনেকে এ কথা পর্যন্ত বলেছিলেন, তাকে এমনকি মুজিব হত্যা মামলায় আসামীর কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হতে পারে। কিন্তু প্রশ্নসাপেক্ষ কারণে সেটা হয়নি। সফিউল্লাহ বরং এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। আফটার অল, আওয়ামী শিবিরের লোক তিনি!
এবার দেখা যাক, ১/১১-এর খলনায়ক জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ কিভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, সফিউল্লাহর মতো এই জেনারেলও নিজের অজান্তে নিজেই সে কাহিনী শুনিয়ে ফেলেছেন। এটা ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ঘটনা। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু ঘটেছিল। শেখ মুজিবেরই সহকর্মি খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। পরিস্থিতিতিতে পরিবর্তন ঘটেছিল ৩ নভেম্বর। সেদিন সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনা প্রধানের পদ দখল করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। খন্দকার মোশতাককে বঙ্গভবনে বন্দি করেছিল নতুন জান্তা। ‘শান্তির স্বপ্নে সময়ের স্মৃতিচারণ’ নামে প্রকাশিত গ্রন্থের ‘বঙ্গভবন : নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি’ অধ্যায়ে ওই ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে মইন উ আহমেদ জানিয়েছেন (পৃ: ৯০-১০০), তিনিই খন্দকার মোশতাককে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মইন উ তখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, সবে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। ৬ নবেম্বর রাতে গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর তাকেই নাকি বঙ্গভবনের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে কেটে পড়েছিলেন জান্তার নেতারা। বঙ্গভবনের মেইন গেইটে গিয়ে মইন উ ছয়-সাতটি গাড়ি ভর্তি লোকজনকে বঙ্গভবনের দিকে আসতে দেখেছিলেন। তারা ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই’ স্লোগানে এলাকা ‘প্রকম্পিত’ করে তুলেছিল। মইন উ নাকি ‘লোকজনকে’ মেশিনগানের গুলি চালানোর ভয় দেখিয়েছিলেন এবং ওতে নাকি ‘কাজও’ হয়েছিল! কিন্তু এর পর পরই এসেছিল হাজার হাজার মানুষ। সঙ্গে ছিল ট্যাঙ্ক। মইন উ লিখেছেন, ‘বন্যা যেমন ধেয়ে আসে, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি মানুষের ঢল ধেয়ে এলো বঙ্গভবনের দিকে।...আমি কয়েকজন সৈনিকসহ যেন খড়কুটো, এক নিমিষে উড়ে যাবো। ...’ এর পরের ঘটনা সম্পর্কে মইন উ লিখেছেন, ‘স্লুইস গেইট খুলে দিতেই পানির স্রোতে যেমন সবকিছু খড়কুটোর মতো ভেসে যায়, তেমনি ভেসে গেলো সব। আমি কোথায়, কে কোথায় বলতে পারলাম না। ...এক ধাক্কায় অসংখ্য লোক বঙ্গভবনে ঢুকে গেলো। মুহূর্তের ভেতর আমি নিজেকে বঙ্গভবনের মূল ফটকে আবিষ্কার করলাম।...’ এ পর্যন্ত এসেই মইন উ তার ভীরুতা ও আত্মসমর্পণের কাহিনী শুনিয়েছেন। লিখেছেন, ‘জনতা মারমুখী হয়ে উঠতে লাগলো। ওই ভিড়ের মধ্য থেকে দু’জন সৈনিক আমাকে ভবনের পেছন দিকে নিয়ে গেলো। সেখানে একটি পুকুর ছিল।...যে দু’জন আমাকে নিয়ে গেলো সে দু’জন এসেছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। তাদের হাতে অস্ত্র। তাদের চোখের দিকে তাকালাম, ঘোলা চোখ, খুনে দৃষ্টি। ... বুঝলাম আমার সময় শেষ। তারা আমাকে গুলি করে মারার জন্যই ভবনের পেছনের দিকে নিয়ে এসেছে। সত্যি সত্যি ওরা রাইফেল তাক করলো। আমি রাইফেলের ক্ষুধার্ত কালো নল দেখলাম। ট্রিগারে আঙুল দেখলাম। ...এক মুহূর্তের জন্য শুধু মায়ের মমতাময়ী মুখটা চোখে ভেসে উঠলো। চোখ বন্ধ করলাম। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত হলাম। মনে মনে শেষবারের মতো কলেমা পড়া শুরু করেছি। ...এমন সময়ে একটা চিৎকারে আমার হুঁশ ফিরে এলো।’ এরপর ‘চোখ খুলে’ মইন উ দেখলেন, মিলিটারি পুলিশের একজন সার্জেন্ট এসে রাইফেলের নল দুটি তার দিক থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। ‘সে আমাকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিজের কাছে নিয়ে এলো।’- লিখেছেন মইন উ। এরপর তাকে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে গালগল্প জুড়েছেন মইন উ, খন্দকার মোশতাককে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও করেছেন। তারপর লিখেছেন, ‘...কিন্তু ঐদিনটা ছিল আসলেই অন্য রকম।...তাই আমি সবার সাথে গাড়ির পেছনে বসেই রওয়ানা দিলাম।’
ইতিহাসের আলোকে পর্যালোচনায় কিন্তু দেখা যাবে, মইন উ’র এই বর্ণনা প্রকৃতপক্ষে তার ভীরুতা ও কাপুরুষতাকেই প্রাধান্যে এনেছে। ‘মারমুখী’ জনতার মধ্য থেকে যে দু’জন তাকে বঙ্গভবনের পেছনে ‘নিয়ে’ গিয়েছিল তারা কি ‘আদর-সোহাগ’ করতে করতে ‘নিয়ে’ গিয়েছিল নাকি ঘাড়ে ধাক্কা দিতে দিতে ‘নিয়ে’ গিয়েছিল সে কথা জানাননি মইন উ। এতে অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কারণ, এর পরের অংশটুকুই যথেষ্ট। ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’ দাঁড়িয়ে পড়া থেকে অস্ত্রধারীদের ‘ঘোলা চোখ, খুনে দৃষ্টি’ এবং ‘বুঝলাম আমার সময় শেষ’ পর্যন্ত শুধু নয়, ‘রাইফেল তাক’ করা এবং অন্ধকারেও ‘রাইফেলের ক্ষুধার্ত কালো নল’ ও ‘ট্রিগারে আঙুল’ দেখা পর্যন্ত বর্ণনাও বুঝিয়ে দেয়, পরাজিত মইন উ অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তার আগে প্রতিরোধের কোনো চেষ্টার কথাও নেই তার বর্ণনায়। ‘চোখ বন্ধ’ করা এবং ‘মনে মনে শেষবারের মতো কলেমা পড়া’র যে বর্ণনা দিয়েছেন তারও নিশ্চয়ই অন্য কোনো অর্থ হতে পারে না। মইন উ’র অবশ্য ‘দোষ’ নেই। কারণ, একটি সত্য কথাও রয়েছে তার বর্ণনায়- ‘ঐদিনটা ছিল আসলেই অন্য রকম।’ এজন্যই তাকে সিপাহীদের সঙ্গে ট্রাকের পেছনে বসে (নাকি শুয়ে?) বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। এই বর্ণনায় একটি বিষয় কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- সেনা অফিসার হিসেবে জীবনের শুরুতেই মইন উ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিছুটা এদিক-সেদিক করে তিনি নিজেই সে স্বীকারোক্তিটুকু দিয়ে ফেলেছেন!
দুই জেনারেলকে বিষয়বস্তু বানানোর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে। দু’জনই আসলে ইতিহাসের ‘সোর্স’ হিসেবে ঘটনাক্রমে এসে গেছেন। অধীনস্থদের কাছে পরাজিত হওয়ার এবং আত্মসমর্পণ করার দিক থেকে দুই জেনারেলের অসাধারণ ‘মিল’ দেখে যে কাউকেই বিস্মিত ও স্তম্ভিত হতে হবে। পার্থক্য হলো, প্রথমজন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আত্মসমর্পন করেছিলেন। অন্যদিকে দ্বিতীয়জনের কর্মজীবনের শুরুটাই হয়েছিল আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। জাতির দুর্ভাগ্য হলো, অমন দু’জন জেনারেলই বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের পদ ‘অলংকৃত’ করে গেছেন!
প্রথমে জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহর কথা। ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ আদালত শুধু তিরষ্কার করেননি, তার সম্পর্কে অত্যন্ত কঠিন মন্তব্যও করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে সে সময় কয়েকদিন ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও জোর আলোচনা হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর মুজিব হত্যা মামলার শুনানিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনাবলী সম্পর্কে জানাতে গিয়ে আসামী পক্ষের আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান বলেছিলেন, তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ তার সাক্ষ্যতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। বলেছেন, ওইদিন সকাল ছয়টা বাজার তিন-চার মিনিট আগে তিনি নাকি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। অথচ অন্য সাক্ষীরা জানিয়েছেন, সেদিন ভোর চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই সব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। তাছাড়া সফিউল্লাহর সাক্ষ্যতেই জানা গেছে, আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাকে টেলিফোনে ফোর্স পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান হলেও রাষ্ট্রপতির প্রাণ বাঁচানোর জন্য সফিউল্লাহ সেনা পাঠাননি। ঠিক এ পর্যায়ে এসেই মাননীয় আদালত মন্তব্য করেছিলেন, সফিউল্লাহ ‘একজন কাপুরুষ, ভিতু এবং মিথ্যাবাদী সেনাপতি’।
কথার পিঠে স্বাভাবিকভাবেই কথা উঠেছিল। এখনো কথা ওঠে। কারণ, মাননীয় আদালতই প্রথম নন, তারও আগে খোদ আওয়ামী লীগ থেকেও সফিউল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে। মুজিব-উত্তর সকল সরকারের আমলে সুবিধাভোগকারী এই জেনারেলের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হয়েছেন তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৯ সালের ১৯ ও ২২ আগস্ট আয়োজিত দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডে সেনা প্রধান সফিউল্লাহ ‘নেপথ্য ভূমিকায়’ ছিলেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেখ সেলিম জানিয়েছিলেন, সেদিন আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান একাধিকবার সফিউল্লাহকে টেলিফোন করে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু জবাবে সফিউল্লাহ দেশের রাষ্ট্রপতিকে তার বাসভবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন! উল্লেখ্য, ২২ আগস্টের দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। সফিউল্লাহ নিজেও ছিলেন সামনের সারিতে। ওই অনুষ্ঠানে শেখ সেলিম বলেছিলেন, সেনা প্রধান হিসেবে সফিউল্লাহ কেন রাষ্ট্রপতির টেলিফোন পাওয়ার পরও ব্যবস্থা নেননি তা ‘রহস্যজনক’। তাছাড়া হত্যাকান্ডের পর ‘খুনিরা’ সেনানিবাসে গিয়েছিল। সেখানে রেড অ্যালার্ট জারি করেও ‘খুনিদের’ গ্রেফতার করা যেতো। কিন্তু সফিউল্লাহ উল্টো তাদের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন। রেডিওতে গিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এভাবে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে পুরোপুরি ডিফেন্সিভে চলে গিয়েছিলেন সফিউল্লাহ। পরদিন, ২০০৯ সালের ২৩ আগস্ট একটি দৈনিকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে শেখ সেলিমের অভিযোগকে তার বিরুদ্ধে ‘নতুন ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘তখনকার’ বাস্তবতা ‘এখনকার’ মতো ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে হত্যার বিষয়ে তিনি নাকি কোনো তথ্যই জানতেন না! কারণ, ১৯৭৪ সালে ডিজিএফআইকে তার হাত থেকে সরিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে নেয়া হয়েছিল এবং এর ফলে তিনি নাকি একেবারে ‘অন্ধ ও বধির’ হয়ে পড়েছিলেন! রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার কাছ থেকে ছিনিয়ে অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। সুতরাং মুজিব হত্যাকান্ডে তার কোনো ‘ব্যর্থতা’ ছিল না! রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার কাছে টেলিফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন- এই প্রচারণাকে ‘অসত্য’ দাবি করে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি নন, তিনিই রাষ্ট্রপতিকে টেলিফোন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছিলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স বোধহয় আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। ওরা সম্ভবত কামালকে মেরে ফেলেছে। তুমি দ্রুত ফোর্স পাঠাও।’ উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। আপনি কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন?’ রাষ্ট্রপতি কোনো উত্তর দেননি, টেবিলের ওপর টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিলে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ শুনেছিলেন সফিউল্লাহ। তারপর (দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে) ‘বেশ কয়েক মিনিট’ তিনি ‘হ্যালো, হ্যালো’ করেছেন। কিন্তু জবাব পাননি। কিছুক্ষণ পর বেশ কিছু গুলির শব্দ শুনেছিলেন। শুনে তার ‘মনে হয়েছিল’, রাষ্ট্রপতি হয়তো আর বেঁচে নেই। সফিউল্লাহ দাবি করেছেন, ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক কর্নেল সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে তিনি হামলার প্রথম খবর পেয়েছিলেন। তার মাধ্যমেই তিনি ঢাকা ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ধানমন্ডি যাওয়ার নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শাফায়াত জামিলের সেনারা নাকি ‘মুভ’ করেনি! এর মধ্যেই সফিউল্লাহ নাকি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল আহমদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি যেন রাষ্ট্রপতিকে তার বাসভবন থেকে বের করে নিয়ে যান (অথচ সফিউল্লাহ নিজেই আবার বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্ব অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল! এটা সত্য হলে তিনি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কোন অধিকারে?)।
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ব্যাপারে সফিউল্লাহ ‘নিশ্চিত খবর’ পেয়েছিলেন সকাল আটটার দিকে। তিনি তখন তার অফিসে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন (এই দু’জনও নাকি তার টেলিফোনে দেয়া নির্দেশ পালন করেননি!)। ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য’ সফিউল্লাহ নাকি এরপর ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে সেখানকার সৈন্যদের মধ্যে ‘আনন্দের আভা’ দেখতে পেয়েছিলেন! ততক্ষণে ওই সৈন্যরাও নাকি ‘খুনিদের’ সঙ্গে যোগ দিয়েছিল! সেখান থেকেই তাকে নাকি ‘চাপাচাপি’ করে রেডিও অফিসে নেয়া হয়েছিল! সেখানে আগে থেকে উপস্থিত খন্দকার মোশতাক আহমদ তাকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন এবং ‘কাজ শেষ হওয়ায় বিশ্রাম নিতে’ বলেছিলেন (জড়িত না থাকলে ‘অভিনন্দন’ জানানোর, ‘কাজ শেষ’ হওয়ার এবং ‘বিশ্রাম’ নেয়ার প্রশ্ন এসেছিল কিভাবে?)। সফিউল্লাহ তখন নাকি ‘বিরক্ত’ হয়ে রেডিও অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেজর ডালিম তার ‘পথরোধ’ করে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘বাধ্য হয়ে’ তাকে নাকি প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরের লিখে দেয়া বক্তব্য ‘পাঠ’ করতে হয়েছিল! মেজর ডালিমকে কেন গ্রেফতার করেননি- এ প্রশ্নের উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছেন, পরিস্থিতি ‘কখনোই’ সে রকম ছিল না। তারা আমার সঙ্গে ‘অস্ত্র উঁচিয়ে’ কথা বলেছে! মেজর ডালিম নাকি সফিউল্লাহর অফিসের দরোজায় লাথি পর্যন্ত মেরেছিলেন! এরপর ২৪ আগস্ট তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় এবং ‘বাধ্য হয়ে’ তিনি রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে যান।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অনেক চেষ্টা করেও জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। জনগণ বরং তার কাছ থেকেই জেনেছে, তিনি এত বেশি ‘যোগ্য’ সেনাপ্রধানই ছিলেন যে, ‘খুনি’ মেজররা তার সঙ্গে ‘অস্ত্র উঁচিয়ে’ কথা বলার সাহস পেয়েছেন, তাকে ‘ধরে’ নিয়ে গেছেন রেডিও অফিসে এবং তাকে দিয়ে আনুগত্যের শপথ ‘পাঠ’ করিয়ে ছেড়েছেন! সফিউল্লাহ লক্ষ্য করেননি, এসবের প্রতিটিই তার জন্য ভারি লজ্জার কথা! তাছাড়া রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর সফিউল্লাহর জীবনে ‘শনৈ শনৈ’ উন্নতি হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত তিনি চুটিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। এজন্যই চেষ্টায় ত্রুটি না থাকলেও সাবেক এই সেনাপ্রধান দায়দায়িত্ব এড়ানোর মতো যুৎসই বক্তব্য হাজির করতে পারেননি। তার বক্তব্যে বরং প্রমাণিত হয়েছে, হয় তিনি হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন; না হলে নিজের অধীনস্থদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এতদিন মুজিব হত্যার দায় অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে সাবেক এই জেনারেল নিজে ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে দিব্যি বহাল তবিয়তে ছিলেন। শেখ হাসিনা তাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য পর্যন্ত বানিয়েছেন। কিন্তু শেখ সেলিমের মতো শীর্ষ একজন নেতা হঠাৎ হাটে হাড়ি ভেঙে দেয়ায় এবং সর্বোচ্চ আদালত তার সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করায় বিপদ শুরু হয়েছিল তার। অনেকে এ কথা পর্যন্ত বলেছিলেন, তাকে এমনকি মুজিব হত্যা মামলায় আসামীর কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হতে পারে। কিন্তু প্রশ্নসাপেক্ষ কারণে সেটা হয়নি। সফিউল্লাহ বরং এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। আফটার অল, আওয়ামী শিবিরের লোক তিনি!
এবার দেখা যাক, ১/১১-এর খলনায়ক জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ কিভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, সফিউল্লাহর মতো এই জেনারেলও নিজের অজান্তে নিজেই সে কাহিনী শুনিয়ে ফেলেছেন। এটা ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ঘটনা। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু ঘটেছিল। শেখ মুজিবেরই সহকর্মি খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। পরিস্থিতিতিতে পরিবর্তন ঘটেছিল ৩ নভেম্বর। সেদিন সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনা প্রধানের পদ দখল করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। খন্দকার মোশতাককে বঙ্গভবনে বন্দি করেছিল নতুন জান্তা। ‘শান্তির স্বপ্নে সময়ের স্মৃতিচারণ’ নামে প্রকাশিত গ্রন্থের ‘বঙ্গভবন : নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি’ অধ্যায়ে ওই ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে মইন উ আহমেদ জানিয়েছেন (পৃ: ৯০-১০০), তিনিই খন্দকার মোশতাককে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মইন উ তখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, সবে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। ৬ নবেম্বর রাতে গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর তাকেই নাকি বঙ্গভবনের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে কেটে পড়েছিলেন জান্তার নেতারা। বঙ্গভবনের মেইন গেইটে গিয়ে মইন উ ছয়-সাতটি গাড়ি ভর্তি লোকজনকে বঙ্গভবনের দিকে আসতে দেখেছিলেন। তারা ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই’ স্লোগানে এলাকা ‘প্রকম্পিত’ করে তুলেছিল। মইন উ নাকি ‘লোকজনকে’ মেশিনগানের গুলি চালানোর ভয় দেখিয়েছিলেন এবং ওতে নাকি ‘কাজও’ হয়েছিল! কিন্তু এর পর পরই এসেছিল হাজার হাজার মানুষ। সঙ্গে ছিল ট্যাঙ্ক। মইন উ লিখেছেন, ‘বন্যা যেমন ধেয়ে আসে, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি মানুষের ঢল ধেয়ে এলো বঙ্গভবনের দিকে।...আমি কয়েকজন সৈনিকসহ যেন খড়কুটো, এক নিমিষে উড়ে যাবো। ...’ এর পরের ঘটনা সম্পর্কে মইন উ লিখেছেন, ‘স্লুইস গেইট খুলে দিতেই পানির স্রোতে যেমন সবকিছু খড়কুটোর মতো ভেসে যায়, তেমনি ভেসে গেলো সব। আমি কোথায়, কে কোথায় বলতে পারলাম না। ...এক ধাক্কায় অসংখ্য লোক বঙ্গভবনে ঢুকে গেলো। মুহূর্তের ভেতর আমি নিজেকে বঙ্গভবনের মূল ফটকে আবিষ্কার করলাম।...’ এ পর্যন্ত এসেই মইন উ তার ভীরুতা ও আত্মসমর্পণের কাহিনী শুনিয়েছেন। লিখেছেন, ‘জনতা মারমুখী হয়ে উঠতে লাগলো। ওই ভিড়ের মধ্য থেকে দু’জন সৈনিক আমাকে ভবনের পেছন দিকে নিয়ে গেলো। সেখানে একটি পুকুর ছিল।...যে দু’জন আমাকে নিয়ে গেলো সে দু’জন এসেছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। তাদের হাতে অস্ত্র। তাদের চোখের দিকে তাকালাম, ঘোলা চোখ, খুনে দৃষ্টি। ... বুঝলাম আমার সময় শেষ। তারা আমাকে গুলি করে মারার জন্যই ভবনের পেছনের দিকে নিয়ে এসেছে। সত্যি সত্যি ওরা রাইফেল তাক করলো। আমি রাইফেলের ক্ষুধার্ত কালো নল দেখলাম। ট্রিগারে আঙুল দেখলাম। ...এক মুহূর্তের জন্য শুধু মায়ের মমতাময়ী মুখটা চোখে ভেসে উঠলো। চোখ বন্ধ করলাম। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত হলাম। মনে মনে শেষবারের মতো কলেমা পড়া শুরু করেছি। ...এমন সময়ে একটা চিৎকারে আমার হুঁশ ফিরে এলো।’ এরপর ‘চোখ খুলে’ মইন উ দেখলেন, মিলিটারি পুলিশের একজন সার্জেন্ট এসে রাইফেলের নল দুটি তার দিক থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। ‘সে আমাকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিজের কাছে নিয়ে এলো।’- লিখেছেন মইন উ। এরপর তাকে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে গালগল্প জুড়েছেন মইন উ, খন্দকার মোশতাককে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও করেছেন। তারপর লিখেছেন, ‘...কিন্তু ঐদিনটা ছিল আসলেই অন্য রকম।...তাই আমি সবার সাথে গাড়ির পেছনে বসেই রওয়ানা দিলাম।’
ইতিহাসের আলোকে পর্যালোচনায় কিন্তু দেখা যাবে, মইন উ’র এই বর্ণনা প্রকৃতপক্ষে তার ভীরুতা ও কাপুরুষতাকেই প্রাধান্যে এনেছে। ‘মারমুখী’ জনতার মধ্য থেকে যে দু’জন তাকে বঙ্গভবনের পেছনে ‘নিয়ে’ গিয়েছিল তারা কি ‘আদর-সোহাগ’ করতে করতে ‘নিয়ে’ গিয়েছিল নাকি ঘাড়ে ধাক্কা দিতে দিতে ‘নিয়ে’ গিয়েছিল সে কথা জানাননি মইন উ। এতে অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কারণ, এর পরের অংশটুকুই যথেষ্ট। ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’ দাঁড়িয়ে পড়া থেকে অস্ত্রধারীদের ‘ঘোলা চোখ, খুনে দৃষ্টি’ এবং ‘বুঝলাম আমার সময় শেষ’ পর্যন্ত শুধু নয়, ‘রাইফেল তাক’ করা এবং অন্ধকারেও ‘রাইফেলের ক্ষুধার্ত কালো নল’ ও ‘ট্রিগারে আঙুল’ দেখা পর্যন্ত বর্ণনাও বুঝিয়ে দেয়, পরাজিত মইন উ অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তার আগে প্রতিরোধের কোনো চেষ্টার কথাও নেই তার বর্ণনায়। ‘চোখ বন্ধ’ করা এবং ‘মনে মনে শেষবারের মতো কলেমা পড়া’র যে বর্ণনা দিয়েছেন তারও নিশ্চয়ই অন্য কোনো অর্থ হতে পারে না। মইন উ’র অবশ্য ‘দোষ’ নেই। কারণ, একটি সত্য কথাও রয়েছে তার বর্ণনায়- ‘ঐদিনটা ছিল আসলেই অন্য রকম।’ এজন্যই তাকে সিপাহীদের সঙ্গে ট্রাকের পেছনে বসে (নাকি শুয়ে?) বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। এই বর্ণনায় একটি বিষয় কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- সেনা অফিসার হিসেবে জীবনের শুরুতেই মইন উ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিছুটা এদিক-সেদিক করে তিনি নিজেই সে স্বীকারোক্তিটুকু দিয়ে ফেলেছেন!
দুই জেনারেলকে বিষয়বস্তু বানানোর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে। দু’জনই আসলে ইতিহাসের ‘সোর্স’ হিসেবে ঘটনাক্রমে এসে গেছেন। অধীনস্থদের কাছে পরাজিত হওয়ার এবং আত্মসমর্পণ করার দিক থেকে দুই জেনারেলের অসাধারণ ‘মিল’ দেখে যে কাউকেই বিস্মিত ও স্তম্ভিত হতে হবে। পার্থক্য হলো, প্রথমজন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আত্মসমর্পন করেছিলেন। অন্যদিকে দ্বিতীয়জনের কর্মজীবনের শুরুটাই হয়েছিল আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। জাতির দুর্ভাগ্য হলো, অমন দু’জন জেনারেলই বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের পদ ‘অলংকৃত’ করে গেছেন!
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন