শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৬

শফিক রেহমান এবং মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার পূর্বাপর


শফিক রেহমান কোনো গুরুত্বপূর্ণ জননেতা নন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও তিনি প্রথম কাতারের নন। তাকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জানে বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র প্রবক্তা হিসাবে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে কে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না। এর সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতির কোনো মিল নাই। বাংলাদেশের মানুষ বরং তাকে প্রেমের ব্যাপারী হিসাবেই জানে। তাও আবার বাংলাদেশের সব মানুষ না। কিছু উঠতি তরুণ-তরুণী, যারা তাদের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিস্মৃত অথবা তাদেরকে অতীত ইতিহাস ভুলানো হয়েছে, সেই মুষ্টিমেয় কতিপয় তথাকথিত ভালবাসার কাঙ্গালদের কাছেই বেশি পরিচিত। কিন্তু হঠাৎ করে অর্থাৎ এই মাসে বর্তমান সরকার তার মতো একজন নন পলিটিক্যাল এলিমেন্টের মাথায় রাজনীতির মুকুট পরিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ করে ‘যায়যায় দিনের’ মীলা মঈনের অবৈধ প্রেম লীলার স্রষ্টা শফিক রেহমান এই মাসে খুব বিখ্যাত হয়েছেন। তাকে এমন বিখ্যাত করার জন্য বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ। মানুষ অপহরণ এবং হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে এই ভালবাসার ফেরিওয়ালাকে গ্রেফতার করার সাথে সাথেই রাতারাতি তিনি একজন বড় রাজনৈতিক নেতার পর্যায়ে চলে গেছেন। ঠিক যেমন সজীব ওয়াজেদ জয় ইমরান সরকারের মতো তীব্র বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে নানান কথা বলে তাকে অকস্মাৎ সজীব ওয়াজেদ জয় প্রায় নিজের পর্যায়ে অর্থাৎ সমপর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। শফিক রেহমানের বয়স ৮২ বছর। রাজনীতিতে তার সরব পদচারণা নাই। যেটুকু আছে সেটি একটি বাংলা দৈনিকের কল্যাণে। কারণ ঐ ব্যক্তিকে দিনের বেলা সকলের সামনে তাকে যেভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং ৮২ বছর বয়স্ক একজন বৃদ্ধকে জেলে নিয়ে রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। তার ফলে মানুষের সহজাত সহানুভূতি তার ওপর পড়েছে এবং তার অতীতের প্রেমিক ইমেজ রাতারাতি একজন পলিটিক্যাল এলিমেন্টের ইমেজে রূপান্তরিত হয়েছে।
প্রিয় পাঠক, এখানে একটি বিষয় আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই। যেসব মামলায় শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং দুই দফায় ১০ দিনের রিমান্ড দেয়া হয়েছে সেই ঘটনার টেকনিক্যাল দিক অথবা আইনগত দিক অথবা তার রাজনৈতিক দিক নিয়ে আমরা কোনো রকম মন্তব্য করছি না। একজন সাচ্চা গণতন্ত্রী হিসাবে আমাদের বক্তব্য হলো এই, শুধু শফিক রেহমান নন, সকলের ক্ষেত্রেই আইন তার নিজস্ব পথে এগিয়ে যাবে। সে ব্যাপারে কোনোরূপ মন্তব্য করা বা কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা আমাদের মোটেই ইচ্ছা নাই। এজন্য আমরা এই কয়েকদিন এ ব্যাপারে নিজ থেকে কোনো মন্তব্য করি নাই। আজও করার কোনো ইচ্ছা নাই। কিন্তু আমরা দেখছি যে, বিষয়টি কেন যেন ক্রমান্বয়েই জট পাকিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি যেভাবে শুরু হয়েছিল এখন ঠিক সেই রকম নাই। মনে হচ্ছে মাঝখানে পথভ্রষ্ট হয়ে সেটি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। কারণ একই সময় দু’টো সাধারণ ঘটনা ঘটেছে। যেগুলো স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। তাছাড়াও এমন খাপছাড়াভাবে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে যে, অনেকেই মূল বিষয়টি ধরতেই পারেননি। সেই জন্য আজ আমরা কোনো নিজস্ব মন্তব্য না করে এসব ঘটনাকে ক্রম অনুসারে সাজিয়ে নিচে পরিবেশন করছি। এর ফলে আর কিছু হোক বা না হউক, সাধারণ মানুষ একটা ঘটনার সৃষ্টি এবং ডাল পালা বিস্তার সম্পর্কে জানতে পারবে।
এই ঘটনার সাথে জড়িত হয়েছে ৩টি স্থান। একটি হলো আমেরিকা, আরেকটি হলো আমেরিকার আইন ও আদালত এবং তৃতীয় হলো আমেরিকার ল’ এবং জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ এন্ডে প্রধান অকুস্থল হলো বিএনপি ও জাসাস অফিস এবং শফিক রেহমানের বাস ভবন। ঘটনাবলী ধারাবাহিকভাবে এবং একটির সাথে আরেকটি জোড়া দিয়ে পরিবেশন করলে নিম্নোক্ত রূপ ধারণ করে।
॥দুই॥
২০১৫ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। যিনি মামলা দায়ের করেন তার নাম ফজলুর রহমান। তিনি ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের একজন ইন্সপেক্টর। তিনি বিএনপির সাংস্কৃতিক অঙ্গ সংগঠন জাসাসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তিনি প্রধান মন্ত্রীর পুত্র এবং তার তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের পুত্র রিজভী আহমেদ সিজার আমেরিকায় একটি মামলায় জেল খাটছেন। পল্টন থানার ঐ মামলায় মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনকে এই অপহরণ এবং হত্যা প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করেছেন জনাব শফিক রেহমান এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং বেগম জিয়ার আমলের জ¦ালানি উপমন্ত্রী জনাব মাহমুদুর রহমান। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জনাব মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকার অসংখ্য মামলা দিয়েছে। ২০১৩ সালে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। সেই থেকে ৩ বছর তিনি জেলের ঘানি টানছেন। তিনি প্রতিটি মামলাই আইনগতভাবে লড়ে যাচ্ছেন। সরকারের নানান ভয় ভীতির কাছে তিনি নতি স্বীকার করেননি। চলতি মাসের গোড়ার দিকে মাহমুদুর রহমান তার বিরুদ্ধে জারিকৃত প্রতিটি মামলাতেই জামিন পান। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত এসব মামলায় তাকে জামিন দেন। সব মামলায় জামিন পেয়ে যেদিন মাহমুদুর রহমান কারাগার থেকে বের হওয়ার জন্য শারীরিক ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং যখন তাকে বরণ করার জন্য কারাগারের বাইরে তার আত্মীয়-স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা পুষ্প গুচ্ছ নিয়ে অপেক্ষমাণ ছিলেন তখন তারা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শুনলেন যে, মাহমুদুর রহমানকে আজ আর মুক্তি দেয়া হবে না। কারণ তাকে অপর একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেল খানাতেই রাখা হচ্ছে। প্রথমে মানুষজন বিস্মিত হন। কারণ এতোদিন পর তার বিরুদ্ধে আবার নতুন মামলা? তবে ধীরে ধীরে অস্পষ্টতার চাদর সরে যেতে থাকে। জানা যায় যে, ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে পল্টন থানায় ইন্সপেক্টর ফজলুর রহমান যে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দাখিল করেছেন সেই মামলায় শফিক রেহমানের সাথে চক্রান্তকারী হিসাবে মাহমুদুর রহমানের নামও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে যে, মামুন এবং বিএনপি ও তার জোটের কয়েক জন শীর্ষ নেতা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পূর্বেই আমেরিকা ইংল্যান্ড এবং বাংলাদেশী জাসাসের পল্টন অফিসে একাধিক বৈঠক করেন। এসব বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে অপহরণ ও হত্যা করা। এই গুরুতর অভিযোগের স্বপক্ষে পুলিশের হাতে কি প্রমাণ রয়েছে সেটি আজ পর্যন্ত পরিষ্কার নয়।
॥তিন॥
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মামলার বা অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা করা। এটি হলো মামলার বা অভিযোগের এই প্রান্ত। এই মামলা বা অভিযোগের অপর প্রান্ত হলো আমেরিকা। সেখানে কিন্তু অপহরণ বা হত্যা প্রচেষ্টার সত্যতা মেলেনি। মার্কিন কোর্টে একটি মামলা হয়েছে এবং সেই মামলায় ২ জন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী আমেরিকান এবং ১ জন এফবিআই এজেন্টের জেল হয়েছে। তারা যে অভিযোগে জেল খাটছেন সেখানেও কিন্তু অপহরণ বা হত্যা পরিকল্পনার অভিযোগ নাই। মার্কিন আদালতে যে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করা হয়েছিল এবং যে অভিযোগের ভিত্তিতে তারা জেল খাটছেন সেটা হলো, ঘুষ প্রদান এবং ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ। সেই মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামও নাই। তাকে বলা হয়েছে বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক। তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ১ নম্বর ব্যক্তি হিসাবে। তবে একথা ঠিক যে, মামলা এবং মার্কিন আদালতের রায়ের পুরোটা পড়লে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, এই ১ নম্বর ব্যক্তি হলেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।
২০১৪ সালের ১৭ অক্টোবর আমেরিকার বিচার বিভাগ (US Department of Justice) এই মামলার সংক্ষিপ্ত সার ব্যাখ্যা করেন। বলা হয়, ‘‘দক্ষিণ নিউ ইয়র্কের এটর্নি প্রীত ভারারা, বিচার বিভাগের অপরাধ শাখার এ্যাসিস্ট্যান্ট এটর্নি জেনারেল লেসলী ক্যাল্ড ওয়েল এবং বিচার বিভাগের মহাপরিদর্শক মাইকেল হরোউইটজ্ ঘোষণা করেন যে, জোনাথন থ্যালার এবং বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী রিজভী আহমেদ সিজার মার্কিন হোয়াইট ফেডারেল কোর্টে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছেন। অপরাধ বলতে তারা বুঝিয়েছেন ঘুষ দেওয়ার বিনিময়ে আদালতের নথিপত্র হস্তগত করা। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল সেই অভিযোগে বলা হয়েছে যে, প্রাক্তন এফবিআই এজেন্ট রবার্ট লাস্তিক নগদ অর্থের বিনিময়ে আলোচ্য ২ বাংলাদেশীর নিকট সরকারি গোপনীয় নথিপত্র বিক্রয় করেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত একদিকে লাস্তিক ও থেলার এবং অন্যদিকে বাংলাদেশী এই ২ ব্যক্তি টাকা পয়সার লেনদেন করেন। এসব মূল্যবান কাগজপত্র সংগ্রহের বিনিময়ে আলোচ্য ২ বাঙ্গালি মার্কিন এজেন্ট গণকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার ডলার ঘুষ দেয়ার প্রস্তাব করেন। কোর্ট রিপোর্টে বলা হয় যে, এফবিআই এজেন্ট লাস্তিক এবং থেলার ১ হাজার ডলার পান। বাকি লেনদেনের খবর বিচার বিভাগের রায়ে পাওয়া যায় না।
টরন্টোর সাংবাদিক শহীদ ইসলাম বলেন যে, তিনি বেশ কিছুদিন ধরে এই মামলার ব্যাপক তদন্ত করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণ ছাড়া অপহরণ বা হত্যাকাণ্ডের কোনো অভিযোগ বা ডকুমেন্টের হদিস তিনি পাননি।
‘দ্য ওয়ার’ মাগাজিনের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, জয়কে হত্যার কোনো ষড়যন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রে হয়নি, এমনকি তার শারীরিক কোনো ক্ষতি করার মোটিভেরও প্রমাণ পায়নি মার্কিন আদালত। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ডিক চেনি এই ম্যাগাজিনের মালিক। তিনি আমেরিকার প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং তেল ব্যবসার একজন দিকপাল। তার পত্রিকার খবরের সূত্র সাধারণত অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য হয়।
তবে জয় যুক্তরাষ্ট্রের এবং তার বাইরে কোথায় কোথায় কত পরিমাণ অর্থ সম্পদ জমা করেছেন সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়ার শর্তে প্রবাসী এক বিএনপি নেতার ছেলে একজন এফবিআই এজেন্টকে ঘুষ দিয়েছিলেন বলে আদালত প্রমাণ পেয়েছিল। এবং সেই ঘুষ দেয়ার প্রমাণের ভিত্তিতে ঘুষদাতাকে চার বছরের কারাদণ্ডও দিয়েছে আদালত।
কিন্তু এ ঘটনায় জয়কে হত্যার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না বলে আদালত তার লেখা রায়ে বলেছে। ‘দ্য ওয়ার’ এর পক্ষ থেকে ডেভিড বার্গম্যান অনুসন্ধান করে আদালতের ডকুমেন্টগুলো সংগ্রহ করেছেন। যদিও রায় সংক্রান্ত বেশ কিছু ডকুমেন্ট মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটেই রয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ডেভিড বার্গম্যান প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের জামাতা এবং তার মেয়ে ব্যারিস্টার সারাহ হোসেনের স্বামী। ডেভিড বার্গম্যান ইতোমধ্যেই অনুসন্ধানের রিপোর্টের জন্য বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads