আমাদের বিজ্ঞ মন্ত্রীদের মুখে মাঝে মাঝে এমনসব অমিয় বাণী বের হয়, যা কেবল ইসলামের অনুশাসনের সাথেই সাংঘর্ষিক নয়, বাস্তবতার সাথেও সঙ্গতিবিহীন। কিছুদিন আগে জনৈক মন্ত্রী ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজ্ব সম্পর্কে মুসলমানদের চিরদিনের লালিত আকিদা-বিশ্বাসের বিপরীত সম্পূর্ণ মনগড়া তথ্য দিয়ে তাওহীদবাদীদের অনুভূতিতে দারুণ আঘাত হেনেছেন। আরও প্রবীণ একজন মন্ত্রী সুদ এবং ঘুষকে হালাল হিসেবে মত প্রকাশ করেছেন। দেশে শর’য়ী আইন বলবৎ থাকলে ইসলামী শরীয়তের বিধানের বিরোধিতা করায় তিনি বিচারের সম্মুখীন হতেন।
উঁচু মর্যাদায় আসীন এসব ব্যক্তিদের মুখ দিয়ে এ ধরনের কথা বের হয়েই চলেছে। সম্প্রতি আমাদের মন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমরা যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করি, তাদের পহেলাবৈশাখ ও চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন করা উচিত। কিন্তু কিছু মূর্খ লোক এটার ওপর ধর্মের লেবাস লাগাতে চায়” (দৈনিক সংগ্রাম ২৬ মার্চ ২০১৬)। বিজ্ঞ মন্ত্রীর কথার মর্মার্থ (Implications) হচ্ছে : এক. মুসলমানদের পহেলা বৈশাখ ও চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন করা উচিত; দুই. এসব কাজকে ধর্মীয় বিষয় মনে করা যায় না এবং তিন. এসব কাজকে যারা ধর্মীয় বিষয় মনে করে তারা মূর্খ। এবার দেখা যাক, বিজ্ঞ মন্ত্রীর এসব ধারণা কতটুকু যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য। আমাদের এ আলোচনা চৈত্রসংক্রান্তির মধ্যেই সীমিত থাকবে।
মূলত হিন্দুদের অন্যতম প্রধান দেবতা শিবের পূজা হিসেবেই চৈত্রসংক্রান্তি চালু হয়েছে। কাজেই, চৈত্রসংক্রান্তি যে একটি ধর্মীয় বিষয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’ এ (দ্বিতীয় সংস্কারণ, পৃ. ২০৪) এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘‘চৈত্রসংক্রান্তি চৈত্র মাসের শেষ দিন- এই দিনে বাঙালি হিন্দুরা শিবের পূজা করে এবং বিভিন্ন ধরনের লোক-উৎসব ও মেলা হয়।” সাধারণভাবেও এটা জানার কথা যে চৈত্রসংক্রান্তি নামে বাংলা সালের শেষ দিনটিতে হিন্দুদের উৎসব উদযাপিত হয়। স্মরণাতীত কাল থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে তা চালু আছে। হিন্দুদের বিশ্বাস, চৈত্র মাসের শেষ দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপাসনা প্রভৃতি ক্রিয়াকর্ম পুণ্যজনক (বাংলাপিডিয়া)। এ কারণে দিনটিকে এসব কাজের ভেতর দিয়ে উদযাপন করার রেওয়াজ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চালু আছে।
চৈত্রসংক্রান্তির মূল অনুষঙ্গ, প্রধান আকর্ষণ ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চড়কপূজা। প্রাচীনকাল থেকেই শিবের ভক্ত হিন্দুরা নির্দিষ্ট নিয়মে চড়কপূজা করে থাকেন। এ নিয়ম অনুসারে পূজার সময় একটি উঁচু খুঁটি পোতা হতো। এ খুঁটির মাথায় এমনভাবে একটি বাঁশ আড়াআড়িভাবে স্থাপন করা হতো যাতে তাকে ইচ্ছে মতো ঘোরানো যেত খুঁটির মাথায়। এই বাঁশের দু’মাথায় বাঁধা থাকত দড়ি এবং দড়ির মাথায় থাকত লোহার হুক। হুককে শিবের ভক্ত বা সন্যাসীর পিঠে বিঁধিয়ে দ্রুতবেগে ঘুরপাক দেয়া হত। তার পিঠে, হাতে-পয়ে,জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে লোহার শলাকা বিদ্ধ করা হতো । কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হতো। বহু মানুষ হুক থেকে ছিঁড়ে পড়ে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করত। মৃত্যুর এসব ঘটনা দেখে খৃস্টান মিশনারীরা এ পূজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ফলে ইংরেজ সরকার ১৮৮৫ সালে এ পূজাকে নিষিদ্ধ করে। পূজার নামে নিষ্ঠুর এ প্রথাটি এভাবেই রহিত হয়।
বেআইনি হয়ে গেলেও চড়কপূজা ভারতের গ্রামের সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে। উপভোগ্য হওয়ার কারণে এর কিছু কিছু অংশ সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে সব সময়ই চালু রয়েছে। কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বিনোদনের অংশ হিসেবেও তারা এসব কাজকে দেখে। চড়কপূজাকে শিবের উৎসবও বলা হয়। এ পূজাকে কেন্দ্র করে আগে তিনদিন মেলা বসত। শিবের ভক্তরা নানারূপ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে এসব মেলায় নাচতেন, আর নাচতেন ভাঙখেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে। হিন্দুদের বিশ্বাস, তাদের দেবতা শিব নেশাজাতীয় জিনিস খুব পছন্দ করেন। এ কারণে, চড়কপূজার সময় শিবের গাজনের আয়োজন করা হয়। এ আয়োজন থাকায় পশ্চিমবঙ্গে এ উৎসবকে বলা হয় শিবের গাজন। উৎসব পালনকালে পানিভরা পাত্রে শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যাকে ভক্তরা বলেন, ‘বুড়ো শিব’ (বাংলাপিডিয়া)।
ওপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবার কথা যে, চৈত্রসংক্রান্তি হিন্দুদের একটি ধর্মীয় বিষয়, তাদের ঐতিহ্য। কিন্তু বিজ্ঞ মন্ত্রীর কথা “কিছু মূর্খ লোক এটার (পহেলা বৈশাখ ও চৈত্রসংক্রান্তি) ওপর ধর্মের লেবাস লাগাতে চায়” হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে, কারণ, ‘মূর্খ লোক’ হিন্দুও বোঝাতে পারে, যারা চৈত্রসংক্রান্তিকে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদযাপন করেন। ‘মূর্খ লোক’ বলতে বিজ্ঞ মন্ত্রী যদি ঐসব সচেতন মুসলমানকে বোঝান যারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানদের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেন, তবে এ অবস্থায়ও তাঁর মন্তব্যটি আপত্তিকর। তাঁর এ মন্তব্যটি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে অবশ্যই আঘাত দেবে। কারণ, হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানদের অংশগ্রহণের বিরোধিতার কারণ তাদের মূর্খতা নয়, বরং ধর্মীয় জ্ঞান। যারা তাঁদেরকে মূর্খ বলেন, তাদেরই রয়েছে সঠিক জ্ঞানের অভাব। নিজেদের অজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন না থাকার কারণেই তাঁরা এ ধরনের কথা বলেন। Alfred North Whitehead বলেছেন ‘‘Ignorance of ignorance is the death of knowledge”.
এবার দেখা যাক, চৈত্রসংক্রান্তিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণে আলেম-ওলামা ও সচেতন মুসলমানদের আপত্তির কারণ কি? এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলার সুযোগ এখানে নেই, সংক্ষেপে দু’একটা কথা বলছি। ইসলামের দৃষ্টিতে অবিশ্বাসীদের অনুকরণ করা বা ধর্মীয় আচার-আচরণ মেনে চলা যে একটি জঘন্য পাপ, পবিত্র কুআন ও হাদীসে এর বহু প্রমাণ আছে। ইসলামের মূল কথা হচ্ছে, ঈমান বা বিশ্বাস। বিধর্মীদের উৎসবে অংশগ্রহণ ঈমানকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। দেখুন, কুরআন কারীম, সূরা নিসা, আয়াত ১১৫)। এটা আমাদের ঈমান ও মৌলিক বিশ্বাসের অঙ্গ যে, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন-বিধান। এতে কোনো অসম্পূর্ণতা নেই যা অন্য ধর্ম থেকে ধার করে আনতে হবে। হাদীস থেকে এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। হিজরতের পর মদীনা মুনাওয়ারায় মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেলে পাঁচ ওয়াক্তের নামাযের জন্য বিশেষভাবে এলান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ ব্যাপারে একটি পরামর্শ সভায় সাহাবীদের মধ্যে কেউ বলেন, নামাযের সময় হলে উঁচু স্থানে আগুন জ্বালানো হোক, কেউ বলেন, ‘নাকুস’ বাজানো হোক আবার কেউ বলেন, শিঙা বাজানো হোক। দেখা গেল, আগুন জ্বালানো অগ্নিপূজকদের কাজ, শিঙা বাজানো ইহুদিদের কাজ এবং নাকুস বাজানো খৃস্টানদের কাজ। কাজেই সবগুলো প্রস্তাবই নাকচ করা হলো। আযানের নিয়মটি পরে স্বপ্নের মাধ্যমে পাওয়া গিয়েছিল।
যদি বলা হয়, চৈত্রসংক্রান্তি তো হুবহু আগের মতো হয় না, কালক্রমে এর উদযাপন কাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কাজেই এতে আপত্তির কী আছে? মনে রাখা দরকার, উৎসবটির পরিচিতি আগের নামেই রয়েছে। এতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তা ছাড়া চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবে এমন অনেক কিছু করা হয় যা ইসলামী ধ্যানধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। কাজেই কোনো মুসলমানই এতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। আর চৈত্রসংক্রান্তিকে জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেবার প্রশ্নই ওঠে না। এটা কি কল্পনা করা যেতে পারে যে, হিন্দুপ্রধান ভারতে মুসলমানদের ঈদ একটি জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে? আমাদের দেশের প্রায় বিরানব্বই শতাংশ নাগরিক মুসলমান। চৈত্রসংক্রান্তি এ দেশের জাতীয় উৎসব হবে, তা কোনো দিক থেকেই মেনে নেয়া যায় না। দুর্গাপূজাকে জাতীয় উৎসব বলা যা, এটাও হবে তা। এটা হবে ইসলামকে নিয়ে চরম তাচ্ছিল্য করারই নামান্তর।
আমাদের মিডিয়ার একটি বিরাট অংশ কয়েক বছর থেকে বাঙালিত্বের লেবাস পরিয়ে এবং সংস্কৃতির নামে মুসলমানদের আচার-আচরণ ও ধ্যান-ধারণায় পৌত্তলিকতা ঢুকানোর প্রয়াস পাচ্ছে। দুর্গাপূজা, যা বাঙালি হিন্দুদের উৎসব, তাকে আজকাল সার্বজনীন উৎসব বলা হচ্ছে। অনুরূপভাবে, চৈত্রসংক্রান্তিকে বাঙালির জাতীয় উৎসব হিসেবে পেশ করে এ জাতিকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এসব মিথ্যে প্রচার-প্রপাগাণ্ডা সরলমনা তরুণ সমাজ অবলীলায় গিলে ফেলছে। বর্তমান মুসলিম সমাজে সচেতনতার চরম অভাব দেখা দেয়ায় পৌত্তলিকতার প্রসার লাভের কাজটি অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। পৌত্তলিকতার অবাধ অনুপ্রবেশ জাতির জন্য এক সময় যে মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে, এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে। ভয়ের যথেষ্ট কারণ আছে, মুসলিম সমাজ অচিরেই জেগে না উঠলে আমাদের তাওহীদবাদী সংস্কৃতির অবলুপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। মহান আল্লাহ তায়ালা যেন ঘুমন্ত এ জাতিকে জাগিয়ে তোলেন, এ দেশ ও জাতিকে হেফাযত করেন।
উঁচু মর্যাদায় আসীন এসব ব্যক্তিদের মুখ দিয়ে এ ধরনের কথা বের হয়েই চলেছে। সম্প্রতি আমাদের মন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমরা যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করি, তাদের পহেলাবৈশাখ ও চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন করা উচিত। কিন্তু কিছু মূর্খ লোক এটার ওপর ধর্মের লেবাস লাগাতে চায়” (দৈনিক সংগ্রাম ২৬ মার্চ ২০১৬)। বিজ্ঞ মন্ত্রীর কথার মর্মার্থ (Implications) হচ্ছে : এক. মুসলমানদের পহেলা বৈশাখ ও চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন করা উচিত; দুই. এসব কাজকে ধর্মীয় বিষয় মনে করা যায় না এবং তিন. এসব কাজকে যারা ধর্মীয় বিষয় মনে করে তারা মূর্খ। এবার দেখা যাক, বিজ্ঞ মন্ত্রীর এসব ধারণা কতটুকু যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য। আমাদের এ আলোচনা চৈত্রসংক্রান্তির মধ্যেই সীমিত থাকবে।
মূলত হিন্দুদের অন্যতম প্রধান দেবতা শিবের পূজা হিসেবেই চৈত্রসংক্রান্তি চালু হয়েছে। কাজেই, চৈত্রসংক্রান্তি যে একটি ধর্মীয় বিষয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’ এ (দ্বিতীয় সংস্কারণ, পৃ. ২০৪) এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘‘চৈত্রসংক্রান্তি চৈত্র মাসের শেষ দিন- এই দিনে বাঙালি হিন্দুরা শিবের পূজা করে এবং বিভিন্ন ধরনের লোক-উৎসব ও মেলা হয়।” সাধারণভাবেও এটা জানার কথা যে চৈত্রসংক্রান্তি নামে বাংলা সালের শেষ দিনটিতে হিন্দুদের উৎসব উদযাপিত হয়। স্মরণাতীত কাল থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে তা চালু আছে। হিন্দুদের বিশ্বাস, চৈত্র মাসের শেষ দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপাসনা প্রভৃতি ক্রিয়াকর্ম পুণ্যজনক (বাংলাপিডিয়া)। এ কারণে দিনটিকে এসব কাজের ভেতর দিয়ে উদযাপন করার রেওয়াজ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চালু আছে।
চৈত্রসংক্রান্তির মূল অনুষঙ্গ, প্রধান আকর্ষণ ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চড়কপূজা। প্রাচীনকাল থেকেই শিবের ভক্ত হিন্দুরা নির্দিষ্ট নিয়মে চড়কপূজা করে থাকেন। এ নিয়ম অনুসারে পূজার সময় একটি উঁচু খুঁটি পোতা হতো। এ খুঁটির মাথায় এমনভাবে একটি বাঁশ আড়াআড়িভাবে স্থাপন করা হতো যাতে তাকে ইচ্ছে মতো ঘোরানো যেত খুঁটির মাথায়। এই বাঁশের দু’মাথায় বাঁধা থাকত দড়ি এবং দড়ির মাথায় থাকত লোহার হুক। হুককে শিবের ভক্ত বা সন্যাসীর পিঠে বিঁধিয়ে দ্রুতবেগে ঘুরপাক দেয়া হত। তার পিঠে, হাতে-পয়ে,জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে লোহার শলাকা বিদ্ধ করা হতো । কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হতো। বহু মানুষ হুক থেকে ছিঁড়ে পড়ে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করত। মৃত্যুর এসব ঘটনা দেখে খৃস্টান মিশনারীরা এ পূজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ফলে ইংরেজ সরকার ১৮৮৫ সালে এ পূজাকে নিষিদ্ধ করে। পূজার নামে নিষ্ঠুর এ প্রথাটি এভাবেই রহিত হয়।
বেআইনি হয়ে গেলেও চড়কপূজা ভারতের গ্রামের সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে। উপভোগ্য হওয়ার কারণে এর কিছু কিছু অংশ সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে সব সময়ই চালু রয়েছে। কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বিনোদনের অংশ হিসেবেও তারা এসব কাজকে দেখে। চড়কপূজাকে শিবের উৎসবও বলা হয়। এ পূজাকে কেন্দ্র করে আগে তিনদিন মেলা বসত। শিবের ভক্তরা নানারূপ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে এসব মেলায় নাচতেন, আর নাচতেন ভাঙখেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে। হিন্দুদের বিশ্বাস, তাদের দেবতা শিব নেশাজাতীয় জিনিস খুব পছন্দ করেন। এ কারণে, চড়কপূজার সময় শিবের গাজনের আয়োজন করা হয়। এ আয়োজন থাকায় পশ্চিমবঙ্গে এ উৎসবকে বলা হয় শিবের গাজন। উৎসব পালনকালে পানিভরা পাত্রে শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যাকে ভক্তরা বলেন, ‘বুড়ো শিব’ (বাংলাপিডিয়া)।
ওপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবার কথা যে, চৈত্রসংক্রান্তি হিন্দুদের একটি ধর্মীয় বিষয়, তাদের ঐতিহ্য। কিন্তু বিজ্ঞ মন্ত্রীর কথা “কিছু মূর্খ লোক এটার (পহেলা বৈশাখ ও চৈত্রসংক্রান্তি) ওপর ধর্মের লেবাস লাগাতে চায়” হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে, কারণ, ‘মূর্খ লোক’ হিন্দুও বোঝাতে পারে, যারা চৈত্রসংক্রান্তিকে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদযাপন করেন। ‘মূর্খ লোক’ বলতে বিজ্ঞ মন্ত্রী যদি ঐসব সচেতন মুসলমানকে বোঝান যারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানদের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেন, তবে এ অবস্থায়ও তাঁর মন্তব্যটি আপত্তিকর। তাঁর এ মন্তব্যটি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে অবশ্যই আঘাত দেবে। কারণ, হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানদের অংশগ্রহণের বিরোধিতার কারণ তাদের মূর্খতা নয়, বরং ধর্মীয় জ্ঞান। যারা তাঁদেরকে মূর্খ বলেন, তাদেরই রয়েছে সঠিক জ্ঞানের অভাব। নিজেদের অজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন না থাকার কারণেই তাঁরা এ ধরনের কথা বলেন। Alfred North Whitehead বলেছেন ‘‘Ignorance of ignorance is the death of knowledge”.
এবার দেখা যাক, চৈত্রসংক্রান্তিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণে আলেম-ওলামা ও সচেতন মুসলমানদের আপত্তির কারণ কি? এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলার সুযোগ এখানে নেই, সংক্ষেপে দু’একটা কথা বলছি। ইসলামের দৃষ্টিতে অবিশ্বাসীদের অনুকরণ করা বা ধর্মীয় আচার-আচরণ মেনে চলা যে একটি জঘন্য পাপ, পবিত্র কুআন ও হাদীসে এর বহু প্রমাণ আছে। ইসলামের মূল কথা হচ্ছে, ঈমান বা বিশ্বাস। বিধর্মীদের উৎসবে অংশগ্রহণ ঈমানকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। দেখুন, কুরআন কারীম, সূরা নিসা, আয়াত ১১৫)। এটা আমাদের ঈমান ও মৌলিক বিশ্বাসের অঙ্গ যে, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন-বিধান। এতে কোনো অসম্পূর্ণতা নেই যা অন্য ধর্ম থেকে ধার করে আনতে হবে। হাদীস থেকে এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। হিজরতের পর মদীনা মুনাওয়ারায় মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেলে পাঁচ ওয়াক্তের নামাযের জন্য বিশেষভাবে এলান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ ব্যাপারে একটি পরামর্শ সভায় সাহাবীদের মধ্যে কেউ বলেন, নামাযের সময় হলে উঁচু স্থানে আগুন জ্বালানো হোক, কেউ বলেন, ‘নাকুস’ বাজানো হোক আবার কেউ বলেন, শিঙা বাজানো হোক। দেখা গেল, আগুন জ্বালানো অগ্নিপূজকদের কাজ, শিঙা বাজানো ইহুদিদের কাজ এবং নাকুস বাজানো খৃস্টানদের কাজ। কাজেই সবগুলো প্রস্তাবই নাকচ করা হলো। আযানের নিয়মটি পরে স্বপ্নের মাধ্যমে পাওয়া গিয়েছিল।
যদি বলা হয়, চৈত্রসংক্রান্তি তো হুবহু আগের মতো হয় না, কালক্রমে এর উদযাপন কাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কাজেই এতে আপত্তির কী আছে? মনে রাখা দরকার, উৎসবটির পরিচিতি আগের নামেই রয়েছে। এতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তা ছাড়া চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবে এমন অনেক কিছু করা হয় যা ইসলামী ধ্যানধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। কাজেই কোনো মুসলমানই এতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। আর চৈত্রসংক্রান্তিকে জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেবার প্রশ্নই ওঠে না। এটা কি কল্পনা করা যেতে পারে যে, হিন্দুপ্রধান ভারতে মুসলমানদের ঈদ একটি জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে? আমাদের দেশের প্রায় বিরানব্বই শতাংশ নাগরিক মুসলমান। চৈত্রসংক্রান্তি এ দেশের জাতীয় উৎসব হবে, তা কোনো দিক থেকেই মেনে নেয়া যায় না। দুর্গাপূজাকে জাতীয় উৎসব বলা যা, এটাও হবে তা। এটা হবে ইসলামকে নিয়ে চরম তাচ্ছিল্য করারই নামান্তর।
আমাদের মিডিয়ার একটি বিরাট অংশ কয়েক বছর থেকে বাঙালিত্বের লেবাস পরিয়ে এবং সংস্কৃতির নামে মুসলমানদের আচার-আচরণ ও ধ্যান-ধারণায় পৌত্তলিকতা ঢুকানোর প্রয়াস পাচ্ছে। দুর্গাপূজা, যা বাঙালি হিন্দুদের উৎসব, তাকে আজকাল সার্বজনীন উৎসব বলা হচ্ছে। অনুরূপভাবে, চৈত্রসংক্রান্তিকে বাঙালির জাতীয় উৎসব হিসেবে পেশ করে এ জাতিকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এসব মিথ্যে প্রচার-প্রপাগাণ্ডা সরলমনা তরুণ সমাজ অবলীলায় গিলে ফেলছে। বর্তমান মুসলিম সমাজে সচেতনতার চরম অভাব দেখা দেয়ায় পৌত্তলিকতার প্রসার লাভের কাজটি অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। পৌত্তলিকতার অবাধ অনুপ্রবেশ জাতির জন্য এক সময় যে মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে, এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে। ভয়ের যথেষ্ট কারণ আছে, মুসলিম সমাজ অচিরেই জেগে না উঠলে আমাদের তাওহীদবাদী সংস্কৃতির অবলুপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। মহান আল্লাহ তায়ালা যেন ঘুমন্ত এ জাতিকে জাগিয়ে তোলেন, এ দেশ ও জাতিকে হেফাযত করেন।
মুরতাহিন বিল্লাহ জাসির
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন