‘আজকে বাংলা মাসের কত তারিখ’?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হলে শতকরা হিসাবে খুব সামান্য সংখ্যক বাঙালির কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যাবে।
‘আজকে ইংরেজি মাসের কত তারিখ’?
এই প্রশ্নটির জবাবে শতভাগ সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব।
অথচ বাংলা নববর্ষের মচ্ছবে আর বাঙালি সংস্কৃতির নামে এরাই প্রচ- হল্লা করে। ইলিশ আর পান্তা খেয়ে একদিনের বাঙালি সাজে। নানা রকম উপলক্ষের মোড়কে বাংলা নববর্ষ আর বাঙালি সংস্কৃতির মূল লক্ষ্যকে স্পর্শ করার বদলে হট্টগোল করে। এরা সংস্কৃতি যে জীবনের অংশ সেটা বিবেচনা না করে আচার সর্বস্ব একটি অনুষ্ঠানে পর্যবসিত করে। বাংলা বা বাঙালির কল্যাণ ও উপকার করার জন্য ঐতিহাসিক বিবেচনায় অগ্রসরের কোন পথ ও পন্থা তারা গ্রহণ করে না। করলে সারা বছর ভিন্ন সংস্কৃতির তাঁবেদারি করে একদিনের জন্য নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার প্রহসন করতে এই শ্রেণিটি কুণ্ঠিত হতো।
অথচ আশ্চর্যজনক বিষয় এটাই যে, ইংরেজি ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালাই নেই, রোমান হরফ ধার করে এ আন্তর্জাতিক ভাষাটি গড়ে উঠেছে। এমনকি ইংরেজির নিজস্ব কোন সালও নেই, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে নির্ভর করেই চলছে তাদের জীবন-যাপন। শুধু নিজেরাই চলছে না, বাকি বিশ্বকেও তাদের দিন-তারিখ মানতে বাধ্য করছে।
পক্ষান্তরে সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত প্রায় চার হাজারেরও অধিক ভাষার মধ্যে যে দেড় শতাধিক ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে, বাংলা তার মধ্যে অন্যতম প্রধান, প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। হালের বিশ্বে বাংলা ভাষার অবস্থান সপ্তম স্থানে। নিজস্ব ৫০ হরফের বর্ণমালা ছাড়াও সিলেটী নাগরী নামে ৩২ হরফের আরেকটি অগ্রসর বর্ণমালাসহ মোট দু’টি স্বতন্ত্র বর্ণমালার অধিকারী আমাদের বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার গৌরবের মতোই বাংলার সাংস্কৃতিক অহংকার হলো বাংলা সাল।
ইতিহাসের ভাষ্য মতে, বাংলার স্বাধীন সুলতানি শাসন (১৩৩৮-১৫৩৮) পরবর্তীকালের পাঠান, আফগান ও ঈসা খানের নেতত্বাধীন বারো ভূঁইয়া শাসনের অস্থির ধারাবাহিকতায় মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) বাংলার খাজনা আদায়ের বিষয়টিকে একটি বিশৃঙ্খল, জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে দেখতে পান। রাজনৈতিক সমস্যা ছাড়াও চান্দ্র মাসভিত্তিক সাল গণনায় দেখা যায় যে, বছরে ১০-১১ দিন করে কমে মাসগুলো ক্রমান্বয়ে সারা বছরে আবর্তিত হতে থাকে। অথচ খাজনাদাতা কৃষিজীবীর জমির ফসল কিন্তু মওসুম মতোই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়েই উৎপন্ন হয়। এতে খাজনা আদায়ের বার্ষিক সিডিউল প্রতি বছরই পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। একাদশ শতাব্দীতে একই সমস্যা দেখা দিয়েছিল পারস্যের মালিক শাহের রাজত্বে। মালিক শাহের সভাকবি ওমর খৈয়াম পণ্ডিত নিশাপুরীর মাধ্যমে চন্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষে রূপান্তরিত করে সমস্যাটির সমাধান করেন। সম্রাট আকবরও বাংলাসহ বেশ কয়েকটি প্রদেশ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে কতিপয় ‘ফসলি সাল’ প্রবর্তন করেন। বাংলা বর্ষ আকবর প্রবর্তিত সেইসব ফসলি সালের একটি।
সম্রাট আকবরের দরবারের বিখ্যাত ‘নবরত্ন সভা’র বাইরেও অনেক মেধাবী-পণ্ডিত ছিলেন, যাদের মধ্যে অন্যতম আমির ফতেহ উল্লাহ শিরাজী, তাকেই দায়িত্ব দেয়া হয় নতুন বর্ষ প্রণয়নের। শিরাজী সম্রাটের অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা টোডরমলের সহকারীরূপে কাজ করতেন। টোডরমলকে ভূমি রাজস্ব, খাজনা ও অর্থনীতি বিষয়ক গ্রন্থ রচনায় সহযোগিতা করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বীয় যোগ্যতায় সম্রাটের অর্থ বিভাগের প্রধান বা সদর পদে উন্নীত হন। শিরাজী আকবরের কাছ থেকে ‘আমিন-উল- মুলক’, ‘আসাফ-উদ- দৌলা’, ‘রোস্তম সানি’ ইত্যাদি উপাধি লাভ করেন।
সব দিক বিবেচনা এবং সমন্বয় সাধন করে শিরাজী আকবরের সিংহাসন আরোহনের বছর অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরীকে ভিত্তি বছর ধরে একটি সাল প্রবর্তনের প্রস্তাব দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হিজরী সালের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত শকাব্দ থেকে মাসের নামগুলো নেয়া হয় নতুন সালে। এতে চান্দ্রভিত্তিক ১ হিজরী থেকে ৯৬৩ হিজরী পর্যন্ত পুরো সময়কালকে অপরিবর্তনীয় ধরে ৯৬৩ পরবর্তী সময়কালকে সৌর গণনা পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই বাংলা বর্ষটি ১ সাল থেকে শুরু হয়নি। বরং যে বছর চালু হলো, সে বছরের হিজরী সাল অনুযায়ী বর্ষটির শুরু ৯৬৩ সাল থেকে। চান্দ্র ও সৌরবর্ষের সমন্বয়ে তৈরি এই ক্যালেন্ডার স্বভাবতই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে পিছিয়ে পড়তো। এই গরমিল ঘোচানোর জন্য ১৯৬৬ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে বাংলা একাডেমি একটি সংস্কার কমিটি গঠন করে। শহীদুল্লাহ-কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী সংস্কার সাধন করে এই বর্ষে ৩৬৫ দিন রাখা হয় এবং বছরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ থেকে ভাদ্র) ৩১ দিন করে এবং শেষ সাত মাস (আশ্বিন থেকে চৈত্র) ৩০ দিন করে ঠিক করা হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের অধিবর্ষে (লিপইয়ার) বাংলা ক্যালেন্ডারের ফাল্গুন মাসে এক দিন বাড়তি যোগ করা হয়। আধুনিক এই বাংলা ক্যালেন্ডার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা অন্যান্য প্রদেশে তা গ্রহণ করা হয়নি।
আকবরের বাংলা ক্যালেন্ডার চালু হওয়ার পরও এই বাংলাদেশেই অন্যতম প্রচলিত ক্যালেন্ডার ছিল শকাব্দ বা শালিবাহন বর্ষ। ঠিক কোন সময় থেকে এই বর্ষ চালু হয়, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন, শকরাজা শালিবাহনের মৃত্যুর দিন থেকে শকাব্দ গণনা শুরু। আল-বিরুনির মতে, এই বর্ষ চালু করেন রাজা বিক্রমাদিত্য। তিনি এক যুদ্ধে কোনো এক রাজাকে পরাজিত ও হত্যা করার প্রসঙ্গটি স্মরণীয় করে রাখতেই নাকি কাজটি করেছিলেন। আবার কেউ বলেন, শক-বংশজাত কুশান রাজা কনিষ্ক এই সাল প্রবর্তন করেন। বিচিত্র ব্যাপার হলো, একইসঙ্গে ভারতের দুই প্রান্তে দুই নিয়মে শকাব্দ প্রচলিত ছিল। পশ্চিম ভারতে শকাব্দ পরিচালিত হতো চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী।
আর পূর্ব ভারতে শকাব্দ চলে সৌরবর্ষ অনুযায়ী। বাংলা বর্ষটি চান্দ্র ও সৌরবর্ষের মধ্যে ভারসাম্য আর সমন্বয়ের প্রতিফল।
এইসব ঐতিহাসিক তথ্য এবং বাস্তবতা না জেনে গড্ডালিকা প্রবাহে কোনো আচার-অনুষ্ঠানে লিপ্ত হওয়া সচেতনতার লক্ষণ নয়। এইসব আচারিক অনুষ্ঠানের মর্মচিন্তা ও দার্শনিক ভাবাদর্শ সম্পর্কে জ্ঞাত-অবহিত ও সচেতন না হয়ে বানের জলের মতো ভেসে বেড়ালে সংস্কৃতির লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। যেমন, অতীতে এই ধরনের মহতী অনুষ্ঠানের মধ্যেই চরম নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি ও নিপীড়নের বহু ঘটনা ঘটেছে। বাংলা বা ইংরেজি বর্ষের শুরু বা শেষের দিন নগরের নানা স্থানে যে উন্মাতাল হুল্লোড় হয় সেটা অনেক সময়ই মাত্রা ছাড়ায়। ইংরেজি নববর্ষ বরণের সময় গুলশান-বনানী-বারিধারার পথঘাট পুরো রাত জনারণ্যে পরিণত হয়। তরুণ-তরুণীর মাত্রা-ছাড়া অপতৎপরতা থামাকে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়। অনুষ্ঠানের পর দিন উক্ত এলাকাসমূহের উন্মুক্ত রাস্তায় শত-সহস্র খালি মদের বোতল গড়াগড়ি দিতে দেখা যায়। এগুলো কখনোই সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ নয়। অপসংস্কৃতির দৌরাত্ম্য।
বাংলা নববর্ষ ও সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে এবং এর ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অপরিহার্য। অজ্ঞতার মাধ্যমে কোন উৎসব বা অনুষ্ঠান বা অংশগ্রহণ অর্থবহ হতে পারে না। লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন না হলে সেটা উপলক্ষ সর্বস্ব হৈচৈ বৈ আর কিছু হতে পারে না। এর মাধ্যমে মোক্ষ বলতে আসলেই কিছু পাওয়া সম্ভব হয় না। জাতীয় জীবনে সংস্কৃতি নিয়ে চর্চার সময় ইতিহাস সচেতনতার যেমন দরকার, তেমনি পুরো কার্যক্রমের লক্ষ্যও সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। উপলক্ষগুলোও যাতে কোনোভাবেই মূল আদর্শ বা লক্ষ্যকে অতিক্রম করতে না পারে, সে খেয়ালও রাখা দরকার। বিশেষত পুরো আয়োজনের মধ্য দিয়ে ইতিবাচক অর্জনের পথে যাওয়াই মূল মোক্ষ হওয়া বিধেয়। মহৎ উৎসবের সময় উদ্দেশ্যহীন বেলেল্লাপনা কিংবা সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপসংস্কৃতিভিত্তিক কার্যক্রম কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিশেষ করে, দুষ্ট, সমাজবিরোধী এবং তস্করগণ যেন জাতীয় অনুষ্ঠানাদির স্বচ্ছ ইমেজের মধ্যে কালো কলঙ্কের দাগ লেপন করতে না পারে এবং নারী নির্যাতনের কারণ না হয়, সেটা কঠোরভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। উপলক্ষে মেতে থেকে লক্ষ্য-বিচ্যুতিও কাম্য নয়। আসন্ন নববর্ষের প্রাক্কালে পূর্ণ সতর্কতা জরুরি এবং যে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা অগ্রহণযোগ্য। সবাইকে এ কথাটি অনুধাবন করতে হবে। তবেই উৎসব উদ্দেশ্যহীন হবে না। উৎসবের দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইতিহাসবোধের মাধ্যমে সজীব ও অটুট থাকবে।
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হলে শতকরা হিসাবে খুব সামান্য সংখ্যক বাঙালির কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যাবে।
‘আজকে ইংরেজি মাসের কত তারিখ’?
এই প্রশ্নটির জবাবে শতভাগ সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব।
অথচ বাংলা নববর্ষের মচ্ছবে আর বাঙালি সংস্কৃতির নামে এরাই প্রচ- হল্লা করে। ইলিশ আর পান্তা খেয়ে একদিনের বাঙালি সাজে। নানা রকম উপলক্ষের মোড়কে বাংলা নববর্ষ আর বাঙালি সংস্কৃতির মূল লক্ষ্যকে স্পর্শ করার বদলে হট্টগোল করে। এরা সংস্কৃতি যে জীবনের অংশ সেটা বিবেচনা না করে আচার সর্বস্ব একটি অনুষ্ঠানে পর্যবসিত করে। বাংলা বা বাঙালির কল্যাণ ও উপকার করার জন্য ঐতিহাসিক বিবেচনায় অগ্রসরের কোন পথ ও পন্থা তারা গ্রহণ করে না। করলে সারা বছর ভিন্ন সংস্কৃতির তাঁবেদারি করে একদিনের জন্য নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার প্রহসন করতে এই শ্রেণিটি কুণ্ঠিত হতো।
অথচ আশ্চর্যজনক বিষয় এটাই যে, ইংরেজি ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালাই নেই, রোমান হরফ ধার করে এ আন্তর্জাতিক ভাষাটি গড়ে উঠেছে। এমনকি ইংরেজির নিজস্ব কোন সালও নেই, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে নির্ভর করেই চলছে তাদের জীবন-যাপন। শুধু নিজেরাই চলছে না, বাকি বিশ্বকেও তাদের দিন-তারিখ মানতে বাধ্য করছে।
পক্ষান্তরে সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত প্রায় চার হাজারেরও অধিক ভাষার মধ্যে যে দেড় শতাধিক ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে, বাংলা তার মধ্যে অন্যতম প্রধান, প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। হালের বিশ্বে বাংলা ভাষার অবস্থান সপ্তম স্থানে। নিজস্ব ৫০ হরফের বর্ণমালা ছাড়াও সিলেটী নাগরী নামে ৩২ হরফের আরেকটি অগ্রসর বর্ণমালাসহ মোট দু’টি স্বতন্ত্র বর্ণমালার অধিকারী আমাদের বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার গৌরবের মতোই বাংলার সাংস্কৃতিক অহংকার হলো বাংলা সাল।
ইতিহাসের ভাষ্য মতে, বাংলার স্বাধীন সুলতানি শাসন (১৩৩৮-১৫৩৮) পরবর্তীকালের পাঠান, আফগান ও ঈসা খানের নেতত্বাধীন বারো ভূঁইয়া শাসনের অস্থির ধারাবাহিকতায় মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) বাংলার খাজনা আদায়ের বিষয়টিকে একটি বিশৃঙ্খল, জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে দেখতে পান। রাজনৈতিক সমস্যা ছাড়াও চান্দ্র মাসভিত্তিক সাল গণনায় দেখা যায় যে, বছরে ১০-১১ দিন করে কমে মাসগুলো ক্রমান্বয়ে সারা বছরে আবর্তিত হতে থাকে। অথচ খাজনাদাতা কৃষিজীবীর জমির ফসল কিন্তু মওসুম মতোই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়েই উৎপন্ন হয়। এতে খাজনা আদায়ের বার্ষিক সিডিউল প্রতি বছরই পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। একাদশ শতাব্দীতে একই সমস্যা দেখা দিয়েছিল পারস্যের মালিক শাহের রাজত্বে। মালিক শাহের সভাকবি ওমর খৈয়াম পণ্ডিত নিশাপুরীর মাধ্যমে চন্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষে রূপান্তরিত করে সমস্যাটির সমাধান করেন। সম্রাট আকবরও বাংলাসহ বেশ কয়েকটি প্রদেশ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে কতিপয় ‘ফসলি সাল’ প্রবর্তন করেন। বাংলা বর্ষ আকবর প্রবর্তিত সেইসব ফসলি সালের একটি।
সম্রাট আকবরের দরবারের বিখ্যাত ‘নবরত্ন সভা’র বাইরেও অনেক মেধাবী-পণ্ডিত ছিলেন, যাদের মধ্যে অন্যতম আমির ফতেহ উল্লাহ শিরাজী, তাকেই দায়িত্ব দেয়া হয় নতুন বর্ষ প্রণয়নের। শিরাজী সম্রাটের অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা টোডরমলের সহকারীরূপে কাজ করতেন। টোডরমলকে ভূমি রাজস্ব, খাজনা ও অর্থনীতি বিষয়ক গ্রন্থ রচনায় সহযোগিতা করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বীয় যোগ্যতায় সম্রাটের অর্থ বিভাগের প্রধান বা সদর পদে উন্নীত হন। শিরাজী আকবরের কাছ থেকে ‘আমিন-উল- মুলক’, ‘আসাফ-উদ- দৌলা’, ‘রোস্তম সানি’ ইত্যাদি উপাধি লাভ করেন।
সব দিক বিবেচনা এবং সমন্বয় সাধন করে শিরাজী আকবরের সিংহাসন আরোহনের বছর অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরীকে ভিত্তি বছর ধরে একটি সাল প্রবর্তনের প্রস্তাব দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হিজরী সালের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত শকাব্দ থেকে মাসের নামগুলো নেয়া হয় নতুন সালে। এতে চান্দ্রভিত্তিক ১ হিজরী থেকে ৯৬৩ হিজরী পর্যন্ত পুরো সময়কালকে অপরিবর্তনীয় ধরে ৯৬৩ পরবর্তী সময়কালকে সৌর গণনা পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই বাংলা বর্ষটি ১ সাল থেকে শুরু হয়নি। বরং যে বছর চালু হলো, সে বছরের হিজরী সাল অনুযায়ী বর্ষটির শুরু ৯৬৩ সাল থেকে। চান্দ্র ও সৌরবর্ষের সমন্বয়ে তৈরি এই ক্যালেন্ডার স্বভাবতই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে পিছিয়ে পড়তো। এই গরমিল ঘোচানোর জন্য ১৯৬৬ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে বাংলা একাডেমি একটি সংস্কার কমিটি গঠন করে। শহীদুল্লাহ-কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী সংস্কার সাধন করে এই বর্ষে ৩৬৫ দিন রাখা হয় এবং বছরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ থেকে ভাদ্র) ৩১ দিন করে এবং শেষ সাত মাস (আশ্বিন থেকে চৈত্র) ৩০ দিন করে ঠিক করা হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের অধিবর্ষে (লিপইয়ার) বাংলা ক্যালেন্ডারের ফাল্গুন মাসে এক দিন বাড়তি যোগ করা হয়। আধুনিক এই বাংলা ক্যালেন্ডার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা অন্যান্য প্রদেশে তা গ্রহণ করা হয়নি।
আকবরের বাংলা ক্যালেন্ডার চালু হওয়ার পরও এই বাংলাদেশেই অন্যতম প্রচলিত ক্যালেন্ডার ছিল শকাব্দ বা শালিবাহন বর্ষ। ঠিক কোন সময় থেকে এই বর্ষ চালু হয়, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন, শকরাজা শালিবাহনের মৃত্যুর দিন থেকে শকাব্দ গণনা শুরু। আল-বিরুনির মতে, এই বর্ষ চালু করেন রাজা বিক্রমাদিত্য। তিনি এক যুদ্ধে কোনো এক রাজাকে পরাজিত ও হত্যা করার প্রসঙ্গটি স্মরণীয় করে রাখতেই নাকি কাজটি করেছিলেন। আবার কেউ বলেন, শক-বংশজাত কুশান রাজা কনিষ্ক এই সাল প্রবর্তন করেন। বিচিত্র ব্যাপার হলো, একইসঙ্গে ভারতের দুই প্রান্তে দুই নিয়মে শকাব্দ প্রচলিত ছিল। পশ্চিম ভারতে শকাব্দ পরিচালিত হতো চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী।
আর পূর্ব ভারতে শকাব্দ চলে সৌরবর্ষ অনুযায়ী। বাংলা বর্ষটি চান্দ্র ও সৌরবর্ষের মধ্যে ভারসাম্য আর সমন্বয়ের প্রতিফল।
এইসব ঐতিহাসিক তথ্য এবং বাস্তবতা না জেনে গড্ডালিকা প্রবাহে কোনো আচার-অনুষ্ঠানে লিপ্ত হওয়া সচেতনতার লক্ষণ নয়। এইসব আচারিক অনুষ্ঠানের মর্মচিন্তা ও দার্শনিক ভাবাদর্শ সম্পর্কে জ্ঞাত-অবহিত ও সচেতন না হয়ে বানের জলের মতো ভেসে বেড়ালে সংস্কৃতির লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। যেমন, অতীতে এই ধরনের মহতী অনুষ্ঠানের মধ্যেই চরম নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি ও নিপীড়নের বহু ঘটনা ঘটেছে। বাংলা বা ইংরেজি বর্ষের শুরু বা শেষের দিন নগরের নানা স্থানে যে উন্মাতাল হুল্লোড় হয় সেটা অনেক সময়ই মাত্রা ছাড়ায়। ইংরেজি নববর্ষ বরণের সময় গুলশান-বনানী-বারিধারার পথঘাট পুরো রাত জনারণ্যে পরিণত হয়। তরুণ-তরুণীর মাত্রা-ছাড়া অপতৎপরতা থামাকে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়। অনুষ্ঠানের পর দিন উক্ত এলাকাসমূহের উন্মুক্ত রাস্তায় শত-সহস্র খালি মদের বোতল গড়াগড়ি দিতে দেখা যায়। এগুলো কখনোই সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ নয়। অপসংস্কৃতির দৌরাত্ম্য।
বাংলা নববর্ষ ও সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে এবং এর ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অপরিহার্য। অজ্ঞতার মাধ্যমে কোন উৎসব বা অনুষ্ঠান বা অংশগ্রহণ অর্থবহ হতে পারে না। লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন না হলে সেটা উপলক্ষ সর্বস্ব হৈচৈ বৈ আর কিছু হতে পারে না। এর মাধ্যমে মোক্ষ বলতে আসলেই কিছু পাওয়া সম্ভব হয় না। জাতীয় জীবনে সংস্কৃতি নিয়ে চর্চার সময় ইতিহাস সচেতনতার যেমন দরকার, তেমনি পুরো কার্যক্রমের লক্ষ্যও সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। উপলক্ষগুলোও যাতে কোনোভাবেই মূল আদর্শ বা লক্ষ্যকে অতিক্রম করতে না পারে, সে খেয়ালও রাখা দরকার। বিশেষত পুরো আয়োজনের মধ্য দিয়ে ইতিবাচক অর্জনের পথে যাওয়াই মূল মোক্ষ হওয়া বিধেয়। মহৎ উৎসবের সময় উদ্দেশ্যহীন বেলেল্লাপনা কিংবা সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপসংস্কৃতিভিত্তিক কার্যক্রম কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিশেষ করে, দুষ্ট, সমাজবিরোধী এবং তস্করগণ যেন জাতীয় অনুষ্ঠানাদির স্বচ্ছ ইমেজের মধ্যে কালো কলঙ্কের দাগ লেপন করতে না পারে এবং নারী নির্যাতনের কারণ না হয়, সেটা কঠোরভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। উপলক্ষে মেতে থেকে লক্ষ্য-বিচ্যুতিও কাম্য নয়। আসন্ন নববর্ষের প্রাক্কালে পূর্ণ সতর্কতা জরুরি এবং যে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা অগ্রহণযোগ্য। সবাইকে এ কথাটি অনুধাবন করতে হবে। তবেই উৎসব উদ্দেশ্যহীন হবে না। উৎসবের দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইতিহাসবোধের মাধ্যমে সজীব ও অটুট থাকবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন