আজকাল অনেকেরই সময় কাটে খুব টেনশনে। ছেলে বা মেয়ের চিন্তা করে ঘুম আসে না। রাত বাড়তে থাকে, সাথে সাথে বাবা মায়ের চিন্তার পরিধি, ব্যাপকতা এবং ভয়াবহতাও বাড়তে থাকে। ওদিকে যাদের জন্য বাবা মায়ের ঘুম হারাম তারা কিন্তু অপসংস্কৃতির ঘৃণ্য থাবা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। বেরিয়ে আসার পরিবেশটা পাচ্ছে কি না সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। দেশে অনেক কিছু হচ্ছে এবং ঘটছে। এত কিছুর ভীড়ে সবাই কেমন যেন আমাদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস যে উচ্ছনে চলেছে তা বেমালুম গোচর করছেন না। ফলে সাংস্কৃতিক লুটেরা এবং দুর্বৃত্তরা তাদের ফায়দাটুকু ঠিক ঠিক লুটে নিচ্ছে। আমাদের দেশের শাসক এবং অভিভাবকগণ যখন অবচেতন মনে সংস্কৃতির বিষয়টিকে এড়িয়ে চলেছেন ঠিক তখনি এ সুযোগটা কাজে লাগাতে কালক্ষেপণ করছেনা ভীনদেশী সংস্কৃতির তল্পীবাহকরা। অবশ্য বর্তমান সাংস্কৃতিক পরিবেশকে অনেক বাবা মা স্বাগতম জানিয়েছেন এবং ছেলে মেয়ের প্রগতিশীল আচরণ শেখার নাম করে বিপথে যাবার পথটাকে সুগম করছেন। এখন অনেক পরিবারে নিজস্ব সংস্কৃতির তালীম হয় না, হয় ধার করা বিজাতীয় সংস্কৃতির আল্ট্রামডার্ন তালীম যা কি না পরবর্তীতে ঐশীদের জন্ম দেয়। খ্যাতিমান ছড়াশিল্পী অজয় দাশ গুপ্ত তার এক ছড়ায় লিখেছিলেন সংস্কৃতি মানে যদি প্রিন্সেস নাচা/দেশ তবে দেশ নয়, বানরের খাঁচা। বহুদিন আগে লেখা তার এ ছড়ায় বাঙালি সংস্কৃতির যে দৈন্যদশা মাত্র দুটি লাইনে প্রকাশিত হয়েছে এক কথায় তা অপূর্ব। বর্তমান প্রজন্ম কবে এ বানরের খাঁচা থেকে মুক্ত হবে তা এ সময়ের বড় প্রশ্ন। আমাদের সংস্কৃতি প্রবলভাবে সা¤্রাজ্যবাদী আর সম্প্রসারণবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। এক সময় আমরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে থেকেছি বেখেয়াল। এখন নতুন করে মুখোমুখি আরেক সম্প্রসারণবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের। সময়ের সাথে এই আগ্রাসন ক্রমেই পরিব্যাপক হচ্ছে। এই আগ্রাসনের সহজ শিকার আমাদের তরুণ প্রজন্ম। কোনো ধরনের ভালো-মন্দ বিবেচনা না করেই এরা অন্ধভাবে অনুকরণ করছে এমন বিদেশী সংস্কৃতি, যার পরিণাম ভয়াবহ। এর অনিবার্য পরিণাম নিজস্ব সংস্কৃতিকে অস্থিত্বহীনতার দিকে ঠেলে দেয়া। সম্প্রসারণবাদীদের চাওয়াটা কিন্তু তাই। কারণ, এরা ভালো করে জানে একটি জাতিকে পদানত করতে সবার আগে প্রয়োজন এর শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেয়া। নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে তরুণ প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করা। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ‘আগ্রাসন’ শব্দটি যথাযথ কিনা তা তর্ক সাপেক্ষ। তবে যেটা বাস্তব তা হলো- ‘তোমার পছন্দের ওপরে আমার পছন্দকে কৌশলগতভাবে এমনভাবে চাপিয়ে দেবো যাতে তুমি পর্যায়ক্রমে তাতে প্রভাবিত হও এবং একসময় আমার পছন্দকে গ্রহণ করো। এটা একটা দিক।’ দ্বিতীয় বিষয় হলো যুব এবং তরুণ সম্প্রদায়ের শিক্ষা মাধ্যমে এমন কিছু বিষয় সংযুক্ত করবো এবং এমন কিছু বিষয় কৌশলে বাতিল করবো যাতে তাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন সাধিত হয় এবং আমার পছন্দকে নিজের পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করে। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, যিনি তার পছন্দকে অন্যের মধ্যে প্রভাবিত করেন সেই প্রভাবিত ব্যক্তিটি পছন্দ বিস্তারকারীর ফ্যান হয়ে যায়। ‘ফ্যান’ শব্দটি সাংস্কৃতিক বা ফিল্মী শব্দ। বাংলারূপ হচ্ছে ‘ভক্ত’ বা ‘অত্যুৎসাহী সমর্থক’। সোজা কথায় আমরা যাকে মানসিক গোলাম বা দাসশ্রেণি অথবা আরো স্থূলভাবে বলতে গেলে দালাল হিসেবে অভিহিত করি। যুগ যুগ ধরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই শ্রেণির দালাল তৈরি করছে পশ্চিমারা। বোধ করি, সকলেই সহমত হবেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও আমরা সংস্কৃতির পথ-নির্দেশ সাব্যস্ত করতে পারিনি। বরং দলীয় নীতি এসবের ওপর আছর করেছে। ঐকমত্য হওয়া ভালো কিন্তু রাষ্ট্র-নির্দেশিত ঐকমত্যের তিক্ত অভিজ্ঞতায় দইকে চুন বলে মনে করতে পারি না। গড়পরতা মতৈক্য এবং এর মধ্যে নানামুখী মিথস্ক্রিয়তাই বাঞ্ছনীয়। বিস্তারিত বিশ্লেষণের কাটাছেঁড়ায় না ঢুকে বলতে পারি, বিশ্বায়ন, জাতি, রাষ্ট্রীয় সাবেকী ধরন-ধারণের বিলুপ্তি, নগরায়ন এবং মিডিয়ার বেধড়ক ব্যাপ্তিতে জনজীবন ও সংস্কৃতিতে অপরিমেয় প্রভাব পড়ে গেছে। এর মধ্যে মিডিয়া বিশেষ করে বৈদ্যুতিক গণমাধ্যম বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া সংস্কৃতির একটা নবাবী স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর, নাটক, গান, যাত্রা, ব্যান্ড, রকমারি বিজ্ঞাপন প্রতি মুহূর্তে আমাদের চেতনাকে আঘাত হানছে। পেছনে স্পন্সরশিপের মূল নাটাইটা ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের হাতে। যেমন, বাংলাদেশের বহুজাতিক ও বড় পুঁজির কোম্পানিগুলোর মার্কেটিং কম্যুনিকেশন এবং দশাসই বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর ক্রিয়েটিভ হেডগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কলকাতার হিন্দি মগজধারী বাঙালি তরুণরা। মালিকদের মেয়ে-ছেলের সঙ্গে বিয়ে করে মোটামুটি তারা এখানে সেটেলড। বাংলা এবং বাঙ্গালী সংস্কৃতির মৃত্যু অবধি কাজ করে যেতে তারা বদ্ধপরিকর। একজন সমাজ বিজ্ঞানী যথার্থই বলেছেন ”Man dies when his heart fails and nation dies when its culture dies” মানুষ মৃত্যুবরণ করে যখন তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক তেমনি একটি জাতিরও মৃত্যু ঘটে, যখন তার সংস্কৃতিকে মেরে ফেলা হয়। আমাদের দেশের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা পশ্চিমা ভোগবাদী আগ্রাসনের শিকার। যারা নারী স্বাধীনতার কথা বলে, আবার এরাই নারীকে ‘বাণিজ্যিক পণ্য’ বানিয়ে ফায়দা লুটছে। একটা নূতন গাড়ির বিজ্ঞাপনে ‘অর্ধনগ্ন নারী শরীরের ভূমিকা কী? আমাদের সমাজও সে বাতাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছে, কিন্তু দুই বিপরীত মেরুর মূল্যবোধের দ্বন্দ্বে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে উঠতি প্রজন্ম। কেউ ইসলামী মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকতে চাইলে তাকে চরম ‘কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে। বাড়ির কাছে ভারতেই ‘লিভ টুগেদার’ বেশ তোড়েজোরে শুরু হয়েছে, বড় শহরগুলোতে, এমনকি ঢাকাতেও এমনটা এক্কেবারে চলছে না, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না।
আমাদের দেশে এখনও পুরুষ প্রধান সমাজব্যবস্থা প্রচলিত। পুরুষকে তার পরিবারের জন্য খাদ্য, বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়, না হলে সমাজে তার ইজ্জত থাকে না, মর্যাদা থাকে না। যার জন্য প্রতিটি সক্ষম পুরুষ সেই মাপের চেষ্টা করে। শুধু আবেগ দিয়ে সংসার চলে না। ভরণ পোষণের ‘সামর্থ্য না থাকলে বিয়ে করা যাবে না, বরং ‘রোজা থেকে ‘হরমোনের প্রাবল্য থেকে আত্মরক্ষা তথা ‘সংযম অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু চোখের সামনে এত ‘প্রলোভন, এর উপরে ‘ইন্টারনেট এর কল্যাণে যদি ‘আধুনিকা কারো সাথে সে ধরনের যোগাযোগ হয়ে যায় পা পিছলানোর এত ‘আড়ম্বর চারপাশে, পিছলে যেতে সময় লাগে না। পশ্চিমাদের অনুকরণে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সম্পর্ক এখন ‘গ্লোরিয়াস, মর্যাদাপূর্ণ, সমাজে গ্রহণযোগ্য। এক সময় এ ধরনের সম্পর্ককে ‘নোংরা হিসেবে, সমাজে অশ্রাব্য, দূষণীয় হিসেবে দেখা হত। প্রেমিক বা বয়ফ্রেন্ড নয়, বলা হত- নাগর! সমাজের নিম্ন স্তরে অবস্থানকারী মানুষ, যাদের বিয়ে করা বা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পর্বে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের মধ্যে এমনটা চালু ছিল। কোন সভ্য ঘরের ছেলে মেয়ে এমন কর্মে লিপ্ত হবে তা কল্পনাতেও আসত না। যখন দাস প্রথা চালু ছিল সেই যুগেও স্বাধীন নর নারী এমনটা ভাবতে পারত না। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধে নেই কোন পদক্ষেপ, নেই কোন আগ্রহ। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সম্পর্কে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের সামনে কোনো স্বচ্ছ সংজ্ঞা দেশের বুদ্ধিজীবী থেকে রাজনীতিবিদ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় শিক্ষকরা পর্যন্ত রাখতে পারছেন না। ঠিক এ কারণেই অমিত সম্ভাবনার দেশ হয়েও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্বের তিলক পড়তে বাধ্য হচ্ছে। অবাধ আকাশ সংস্কৃতির যুগে বর্তমান প্রজন্ম শুধু দেশীয় চ্যানেলে পড়ে থাকবে এমনটা ভাবাই এখন অশোভন বলে মনে হলেও ভীনদেশী সংস্কৃতি যে আমাদের কতটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা বর্তমার প্রজন্মের আচার আচরণ দেখলেই অনুমান করা যায়। যুবক তরুণ, বৃদ্ধ, নবীন, প্রবীণ সর্বোপরি বাংলাদেশের দর্শকরা এখন আর নিজেদের চ্যানেল দেখে না বললেও বেশি বলা হবে না। জি বাংলা আর স্টার জলসার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দৌরাত্ম্যে তারা একেবারে দিশেহারা। হেমিলনের বাঁশিওয়ালা বাঁশিতে ফুঁ দিতেই তারা জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে, বাঁশি থামার সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে সাগরে। ‘কিরণ মালা’ আমাদের মনে এমন এক প্রভাব বিস্তার করেছে তা দেখা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে যা থেকে ঘটে যাচ্ছে আত্মহননের মতো ঘটনা। ‘বোঝে না সে বোঝে না’ ধারাবাহিকের নায়িকা ‘পাখি’র নামের পোশাক কিনে না দেয়ায় কিশোরী অভিমানে বিষ পান করছে। কী শেখানো হচ্ছে এসব ধারাবাহিকে? একটি সাজানো যৌথ পরিবার কূটবুদ্ধির প্রয়োগে কীভাবে ছিন্নভিন্ন করা যায় তাই তো? এ ধারাবাহিকগুলোর প্রভাব এমন অপ্রতিরোধ্য বিশেষত আমাদের দেশের নারী দর্শকরা সেই পর্দার চরিত্রকেই মনে করছে আসল চরিত্র আর সেই জীবনকেই মনে করছে প্রকৃত জীবন। তাদের আদলে সংসার সাজাতে গিয়ে মুখোমুখি হচ্ছে দারুণ বিড়ম্বনার। আর এভাবেই কাঠপোকার মতো ভারতীয় সংস্কৃতি আমাদের ভেতরে ভেতরে খেয়ে একদম শেষ করে দিচ্ছে আর উপরে যা থাকছে তা একটি খোলস মাত্র। তাই বর্তমানে যা আছে তা হলো দেশীয় সংস্কৃতির মোড়কে বিজাতীয় সংস্কৃতির বেলাল্লাপনা। আস্তে আস্তে আমাদের লজ্জা ভাঙা হচ্ছে এরপর সুযোগ বুঝে দেশীয় সংস্কৃতি মূলোৎপাটনের কাজটা হচ্ছে। এখনই সময় এ অবস্থা থেকে উত্তরণের, নয় তো আমাদের সন্তানরা বেলাল্লাপনা করবে আর আমরা হব তার নীরব দর্শক। একজন নয়ন জুড়ানো সন্তান পাওয়ার আকাক্সক্ষা শুধু আকাক্সক্ষাই রবে, তা আর বাস্তবে রূপ নিবে না। আসুন আমরা যার যার অবস্থান থেকে একদম ব্যক্তি পর্যায়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখে দাড়াই। আপনার আমার আজকের একটু সাংস্কৃতিক সচেতনতা, একটা দৃঢ় পদক্ষেপই আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে নিশ্চিত অন্ধকার পিচ্ছিল পথ থেকে আলোর পথে যেতে সহায়তা করবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন