গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে মগবাজার চৌরাস্তা হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের একটি অংশের উদ্বোধন করেছেন। তার আগে ফলক উন্মোচন করে দেয়ায় অংশ নিয়েছেন এবং পরে বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন। সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের অর্থিক সহযোগিতায় নির্মিত ফ্লাইওভারের এ অংশটির দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ১১ কিলোমিটার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার কারণ এবং পথচারীসহ সাধারণ মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, শুধু চালককে দোষ দিলে চলবে না। দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিরও দোষ আছে কি না তাও খতিয়ে দেখতে হবে। সড়ক ব্যবহারের সময় পথচারীরা নিয়মকানুন মেনে চলছে কি না সেটাও দেখা দরকার। সেটা না করে কেবলই চালকদের দোষ দেয়ার এবং গাড়ি ভাঙচুর করার ও গাড়িতে আগুন দেয়াসহ চালককে মারধর করার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির। এ উদ্দেশ্যে স্কুল পর্যায় থেকেই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। ট্রাফিক পুলিশের প্রতিও সচেতন হওয়ার এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মূল কথাগুলোকে যথার্থ ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, দুর্ঘটনার জন্য সব সময় আসলেও চালকরাই কেবল দায়ী থাকে না, পথচারীদের ভুলের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকেই কোনো দিকে না দেখেই রাস্তা পারাপারের চেষ্টা করে, অন্যদিকে যান্ত্রিক যানবাহন বলে যখন তখন গাড়ি থামানো সম্ভব হয় না বলে পথচারীরা দুর্ঘটনার শিকার হয়। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা পারাপারের পরামর্শ দিয়েছেন। এ পরামর্শ সঠিক হলেও আমরা কিন্তু মনে করি, রাজধানীতে যথেষ্টসংখ্যক ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস এখনো তৈরি করা হয়নি। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শপিং মল ও মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকা ও সড়কের বেশিরভাগই রয়ে গেছে আগের অবস্থায়। বাস্তবে ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসের সংখ্যা বরং হাতে গুণে গুণেই বলা সম্ভব। সুতরাং কেবলই পথচারীদের দোষারোপ করার পরিবর্তে একদিকে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত এলাকাগুলোতে যথেষ্টসংখ্যক ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা দরকার, অন্যদিকে চালকদের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশকেও কঠোরতার সঙ্গে সতর্ক করতে হবে। কারণ, পথচারী ও সাধারণ মানুষের প্রতি ইঙ্গিত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য রেখেছেন, বেপরোয়া চালকরা তাকে দুর্ঘটনার জন্য ‘ওপেন লাইসেন্স’ হিসেবে ধরে নিতে ও ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যাই কেবল বাড়তে থাকবে না, সাধারণ মানুষের বিপদও বহুগুণে বেড়ে যাবে। ওদিকে ট্রাফিক পুলিশও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সুযোগ নিতে ছাড়বে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমনিতেই রাজধানীর নিত্যদিনের যানজটের পেছনে প্রধান একটি কারণ হিসেবে রয়েছে ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতি। তারা এমনকি নিজেদের আইন নিজেরাই ভঙ্গ করে থাকে। লাল বাতি জ্বললেও তারা গাড়ি যেতে দেয় আবার সবুজ বাতি জ্বলে থাকা অবস্থায় বন্ধ করে গাড়ির চলাচল। কথাটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জানেন, তিনি বলেছেনও। এজন্যই ব্যবস্থা নেয়া দরকার সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।
প্রসঙ্গক্রমে যানজট প্রসঙ্গেও না বলে পারা যায় না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করার অনেক আগে থেকেই বেইলি রোড, সিদ্ধেশ্বরী, মগবাজার, তেজগাঁও সাতরাস্তা, মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল প্রভৃতি এলাকায় মারাত্মক যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। যানজট ছিল বুধবার সারাদিনই। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ত্রুটিপূর্ণ এই ফ্লাইওভার রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এমনকি বাংলামোটরের দিক থেকে মৌচাক পর্যন্ত এবং মৌচাক থেকে মালিবাগ চৌধুরী পাড়া পর্যন্ত ফ্লাইওভারের বাকি দুটি অংশ চালু হওয়ার পরও যানজট আরো প্রকটই হতে থাকবে। কারণ, ফ্লাইওভার থেকে যে স্থান তিনটিতে গাড়িগুলো নামবে তার প্রতিটি স্থানেই নিচ দিয়ে আসা শত শত গাড়ির ভিড় জমবে। ফলে ফ্লাইওভারটুকু দিয়েই শুধু কিছুটা সহজে যাতায়াত করা যাবে, নিচের সড়ক দিয়ে নয়। বহুদিন ধরে এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে মহাখালি ফ্লাইওভারে। আজকাল সকাল-সন্ধ্যায় তো বটেই, গভীর রাত পর্যন্তও ফ্লাইওভারটিতে গাড়ি আটকে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ অভিজ্ঞতার আলোকেই বলা হচ্ছে, কেবলই ফ্লাইওভার তৈরি করে রাজধানীকে যাজটমুক্ত করা সম্ভব নয়। এজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। ট্রাফিক পুলিশ যাতে স্বয়ংক্রিয় সিগনাল মেনে সে অনুযায়ী গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে তা নিশ্চিত করতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। বেপরোয়া চালকদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিসহ ভিভিআইপিদের যাতায়াতের জন্য প্রতিদিন যে যানজটের সৃষ্টি হয় এবং যে যানজট সমগ্র রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে তার ব্যাপারেও বিশেষ নজর দেয়া দরকার। আমরা আশা করি, ফ্লাইওভার নির্মাণের কর্মকান্ডকে সাফল্য ও কৃতিত্ব জাহির করার বিষয়বস্তু বানানোর পরিবর্তে সরকার যানজট নিরসনের ব্যাপারে আন্তরিকতার সঙ্গে সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন