আরো একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট যোদ্ধারা। গত বুধবার মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে পাকিস্তানকে পাঁচ উইকেটে হারিয়ে দিয়েছেন তারা। টান টান উত্তেজনার এ খেলায় জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ। ফাইনালে প্রতিপক্ষ থাকবে ভারত। টি-২০ ফরম্যাটে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের খেলায় পাকিস্তানকে হারানো খুব সহজ ছিল না। কারণ, নির্ধারিত ২০ ওভারে পাকিস্তান সাত উইকেটে ১২৯ রান সংগ্রহ করেছিল। শুনতে খ্বু বেশি মনে না হলেও টি-২০’র ম্যাচে এই টার্গেটে পৌঁছানো কোনো দেশ বা ক্লাবের জন্যই সহজ নয়। বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি চ্যালেঞ্জের তো বটেই, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে পড়েছিল। পাশাপাশি ছিল দর্শকদের সমর্থন ও প্রত্যাশার কারণে প্রবল মানসিক চাপ। বড় কথা, ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের ফাইনালে এই পাকিস্তানের কাছেই বাংলাদেশ মাত্র দুই রানে হেরেছিল। সে তিক্ত অভিজ্ঞতা ক্রিকেট যোদ্ধাদের নিশ্চিতভাবেই দুর্ভাবনার মধ্যে রেখেছিল। ফলে সব মিলিয়েই ম্যাচটি বাংলাদেশের জন্য ছিল এক কঠিন পরীক্ষা।
ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি পাকিস্তানও অবশ্য ভালো করতে পারেনি। শুরু থেকেই বরং পিছিয়ে পড়েছে দেশটি। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ছয় ওভারের পাওয়ার প্লেতে পাকিস্তানীরা তিন-তিনটি উইকেট খুইয়ে সংগ্রহ করেছিল মাত্রই ২০ রান। দুর্দান্ত বোলিং-এর মুখে অপরাজিত সরফরাজের ৫৮ এবং শোয়েব মালিকের ৪১ রান ছাড়া আর কারো কথাই উল্লেখযোগ্য নয়। এদিকে তিনটি উইকেট নেয়া আল আমিনের বোলিং ছিল সকল অর্থেই বিধ্বংসী। তাছাড়া বাংলাদেশের বোলাররা কোনো নো বল করেননি, দেননি কোনো ওয়াইডও। এমন অবস্থায় শেষ সাত ওভারে প্রায় ১১ রান রেটে ৭৫ করে ১২৯ রান করলেও এটা ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সর্বনিম্ন সংগ্রহ। এর আগে পাকিস্তান করেছিল ১৩৫। ফলে পাকিস্তানীদের মনোবল ছিল না বললেই চলে।
এর বিপরীতে বাংলাদেশের সূচনাও কিন্তু দর্শকদের যথেষ্ট আশান্বিত করতে পারেনি। মাত্র ৭ রান করেই প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছেন তামিম ইকবাল। ৪৮ রান করে এমন এক সময়ে সৌম্য সরকার বোল্ড হয়েছিলেন দর্শকরা কেবলই যখন জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। এরপর একে একে আউট হয়েছেন সাব্বির ও মুশফিকুর রহিম। দুর্ভাগ্যজনক ছিল মুশফিকের এলবিডাব্লিউ হওয়ার ঘটনাটি। মাত্র ১২ রান করে ফিরে গেছেন তিনি। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানও সফলতা দেখাতে পারেননি। ১২ বল খেলে মাত্র ৮ রান করেই বোল্ড আউট হয়েছেন তিনি। সাকিবের এই ব্যর্থতা দর্শকদের দারুণভাবে নিরাশ করেছিল। উদ্বিগ্নও না হয়ে পারেননি তারা। কারণ, এ সময় দ্রুত রান রেটে পিছিয়ে পড়ছিল বাংলাদেশ দল। কখনো কখনো ১০/১২ বলেও পিছিয়ে থেকেছেন ক্রিকেট যোদ্ধারা।
সবশেষে হাল ধরেছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্তজা। ততক্ষণে বাংলাদেশের পাঁচটি উইকেট পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু যাকে বলে বাঘের বাচ্চা! ২২ বলেই দু’জনে করেছিলেন ৩৪ রান। এর মধ্যে মাশরাফি পর পর দুটি চার মেরেছিলেন। অন্যদিকে দুটি চারের পর একটি ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ । ছক্কাটি তিনি তখনই মেরেছিলেন, জয়ের জন্য বাংলাদেশের যখন মাত্র তিন রান দরকার ছিল। এর ফলে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল শহিদ আফ্রিদীদের, পাকিস্তানকে পাঁচ উইকেটে হার মানতে হয়েছিল। সেই সাথে বাংলাদেশ উঠে গেছে ফাইনালে। এতে বাংলাদেশকে ভারতের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
আমরা এই গৌরবোজ্জ্বল কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশের ক্রিকেট যোদ্ধাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই। তারা শুধু ম্যাচই জেতেননি, বাস্তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আসরে এমন বিজয় খুব কম দেশই পেয়েছে। ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিং-এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা সমান দাপটের সঙ্গে খেলেছেন, যার ফলে পরাজয় মেনে নেয়া ছাড়া পাকিস্তানীদের সামনে আর কোনো উপায় থাকেনি। আমরা আশা করতে চাই, ভারতের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠেয় ফাইনালেও বিজয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন তারা এবং দেশবাসীকে আবারও মুগ্ধ ও গর্বিত করার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি থাকবে না তাদের। এটা আসলে সম্ভবও। কারণ, গত বছরের জুন মাসে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি ও সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতকে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে এক ম্যাচ বাকি থাকতেই দাপটের সঙ্গে হারিয়ে দিয়েছিলেন তারা। শুধু তা-ই নয়, দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশ বিরাট ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল। প্রথম ম্যাচে ৭৯ রানে জেতার পর দ্বিতীয় ম্যাচে ৫৪ বল বাকি থাকতেই ভারতকে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন ক্রিকেট যোদ্ধারা। যাকে বলে হেসে খেলে জয়ী হওয়া- সেটাই হয়েছিলেন তারা। ওই সিরিজেই ১৯ বছর বয়সী নবাগত বাঁ-হাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান পরপর দুই ম্যাচে ১১টি উইকেট নেয়ার মাধ্যমে বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন। উল্লেখ্য, প্রথম ম্যাচের দিন বাংলাদেশের এ মুস্তাফিজকেই ধাক্কা মেরেছিলেন ভারতের অধিনায়ক এমএস ধোনি। সিরিজ বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট যোদ্ধারা ২০১৭ সালে অনুষ্ঠেয় চ্যাপিম্পয়নস ট্রফিতে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আসরে এমন বিজয় খুব কম দেশই পেয়েছে। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে আবারও সেই একই দেশ ভারতের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপ ফাইনালে তাই ক্রিকেট যোদ্ধাদের কাছে দর্শক-জনগণ আরো একটি বিজয়ের প্রত্যাশা করতেই পারেন। আমরাও সে বিজয়ের অপেক্ষায় রইলাম।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন