অবশেষে রাজকোষেও লুণ্ঠন। এমন দুঃসংবাদ দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে উঠে এসেছে। বর্তমানে দুর্নীতির মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশ। কোন প্রান্তে নাই দুর্নীতি। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, ঊর্ধ্ব-অধঃ এমনকি পাতালেও দুর্নীতির নিনাদ ধ্বনিত হয়। ব্যাংকের পর ব্যাংকের থলি ফোকলা করে ফেলছে দুর্নীতির ‘ইঁদুর’ সম্প্রদায়। দু’চার দিন হৈচৈ, যদি কোনোভাবে খবরটি বাইরে চলে আসে। এমতাবস্থায় শুরু হয় সলাপরামর্শ, কৌশল আবিষ্কার। দেশবাসীর মগজ থেঁতলা করা অন্য একটি কাণ্ড দিয়ে লুণ্ঠনের খবরটি কবরস্থ করা। এই সিলসিলাই যেন চলছে অহর্নিশ। বুুদ্ধি-বিবেচনার তারিফ করতেই হয়। বুদ্ধি না থাকলে এমনটা করাও অসম্ভব। ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা’ কবির নাম অজানা। তবে কবি যদি জীবিত থাকতেন বা থাকেন তিনি দেখতেন তার চিন্তা অনেকটাই অসার। ধরা পড়লেও কুচপরওয়া নেহি। বরং পুরস্কার তার পদপ্রান্তে এসে লুটোপুটি খায়। কেউ বিবেকবান আবার কেউ দেশপ্রেমী এমনসব উপাধিতে আচ্ছাদিত হয়।
ক. চমৎকার দেশ, কী চমৎকার সমাজ। রাজকোষ, লুণ্ঠনের ব্যাপারটাও যথাপূর্বং তথাপরংই যে হবে না তা হয়তো বলাই বাহুল্য। তাছাড়া ‘উদর পি-ি বুধোর ঘাড়ে’ এ রকমের একটি প্রবাদ তো আছেই। খবর মাধ্যমগুলোর বাক্যবিন্যাসে এমন আলামতই যেন উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। রাজকোষ বলে কথা। রাজা, রাজপরিবার এবং রাজ দরবারের উচ্চ পর্যায়ের অমাত্যবর্গ এ ব্যাপারে অধিক ওয়াকিফহাল থাকেন। তাছাড়া মুরগির খোয়াড়ে যদি শিয়াল পাহারাদার নিযুক্ত করা হয় তবে তো মুরগির ভবলীলা সম্পর্কে দুশ্চিন্তা বাড়বেই। চোর পালালে নাকি বুদ্ধি বাড়ে। এমন বাড়ন্ত বুদ্ধিতে কতটা সুফল আসে জানাটা মুশকিল হয় প্রায়শই। এখানে বুদ্ধির বিভাজনটাই লক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রয়োগটা সুবুদ্ধির না কুবুদ্ধির। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব, রাজকোষের যে কক্ষে অতি গোপনীয় তথ্য আদান-প্রদান হয় সেসব তথ্যও নাকি লোপাট। মাশাআল্লাহ। স্বীকার করতেই হবে অতি বুদ্ধিমান ‘চোরের’ কবলে পড়েছে রাজকোষ। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলেন, অপরাধীরা নাকি অপরাধের কিছু না কিছু আলামত ফেলে যায়। যা থেকে ধরা পাড়ে চোর বা অপরাধী। তবে যারা ধরবেন বা ধরার দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীল সমস্ত বিষয়টি। সুবিবেচনা এবং কুবিবেচনা দেশবাসী অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বিজয়ের পাল্লাটি কোন দিকে ঝুলে।
খ. দুর্নীতি দুর্ভাবনা দুঃস্বপ্ন আর দুঃসময় যেন দেশ এবং জনগণের ভবিতব্য। জীবন বিনাশের খবর তো বর্তমানে পান বিড়ি থেকেও সুলভ। লাশ মিলছে ক্ষেত খামারে, আবর্জনার ডিব্বায়। আইনের লোকদের বন্দুক যুদ্ধ তো একটি মশহুর শব্দ। প্রায় প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় দেখা মিলে। পাঠক এমন খবর পাঠ করে, সন্দেহের চোখে। গ্রামের একটি প্রবাদ আছে ‘কার গলা কে কাটে ধুলায় অন্ধকার। বাংলাদেশেরও এমনটাই অবস্থা। অন্ধকার যেন কাটতেই চাচ্ছে না। দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে নতুন উপসর্গ। শিশু নিপীড়ন এবং হত্যার মহাযজ্ঞ। মা হত্যা করছে প্রিয় সন্তান। মানুষের মন-মানসিকতা কতটা নি¤œগামী হলে সমাজে এমনটা ঘটতে পারে। অপসারিত হচ্ছে বিবেক-বিবেচনা। বলা যাবে না। শিক্ষার অভাবে এই দৃশ্য দেশের। তেমনটাতো নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিতজনরাই ঘটাচ্ছে অঘটন। দুর্নীতিবাজদের অধিকাংশই তো শিক্ষার উচ্চতর ডালটিতে বসে থাকে বা আছে। তাই শিক্ষা কোনো ফ্যাক্টর নয়। শিক্ষিত হলেই যে সাধু সজ্জন বনে যাবে তা নাও হতে পারে। হয়ও না বেশিরভাগ সময়। কারণ ইদানিং পাঠ্যসূচিতে যা থাকে তা একজন শিক্ষার্থীকে সুমানুষরূপে গড়ে তুলতে যথেষ্ট নয় বরং এর অন্তরায়। ভুল শিক্ষা অসত্য ইতিহাস আর অতিকথন চর্বন করতে করতে একটি শিশু বেড়ে উঠে। তাই পরবর্তী জীবনে যা হবার তাই হয়। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়। এই নিমজ্জন থেকে উদ্ধারে যা সহায়ক শক্তিরূপে কাজে আসতে পারে সেই নৈতিক শিক্ষা পাঠক্রমে রাখা হয় না। অসত্য থেকে সত্যকে কিভাবে বিভাজিত করতে হয় সেরকম শিক্ষা থাকে অনুপস্থিত। তাই জাগ্রত হয় না বিবেক-সুবিবেচনা। এছাড়া যারা শিক্ষা দেন তাদের বর্ণচোরা স্বভাবে শিক্ষার্থীগণ হয় বিভ্রান্ত। মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশের সমাজপতিদের মগজেও পচন ধরেছে। যার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে দেশময়। উড়ে যাচ্ছে মায়া-মমতা। কেবল খুনাখুনি নয় শিশুহত্যা চলছে অবলীলায়। চুরি ডাকাতি আর দুর্নীতি আছড়ে পড়ছে সমগ্র জাতির বিবেক বিবেচনায়। অপসারিত হচ্ছে সত্য, অধঃপতিত হচ্ছে নীতিনৈতিকতা। সুসম্পর্কের বিপরীতে উথলে উঠছে হিংসাবিদ্বেষ। যে স্বভাবগুলো একটি জাতির অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করে। ইতিহাস এমন পাঠই দেয়। আফসোসের খবর হলো সঠিক ইতিহাস পাঠ থেকেই দূরে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চলছে বর্তমানে। দেশ এবং সমাজের শীর্ষে যারা অবস্থান নেয় কি ক্ষমতাবান কি বুদ্ধিমান(?) তাদেরই অনাচার এবং কুবুদ্ধি একটি উজ্জীবিত দেশ এবং জাতির অধঃগতির জন্য যথেষ্ট। এমন কি ধ্বংসও অনিবার্য হয়ে উঠে আসে কোনো কোনো সময়। যা আলামত দৃষ্ট হচ্ছে চারপাশ ঘিরে তাতে তো বাড়িয়ে তুলছে বিবেকবানদের দুশ্চিন্তা। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক অতিক্রম করে এসেও কমলো না জাতির হা-হুতাশ, থামছে না আতংক। সুশাসন সুবিচার এবং সুবিবেচনার যেন খরা বইছে। যে কারণে স্নেহময়ী মা তার প্রিয় সন্তানকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। কাঁপছে না হৃদয়। পশুও সন্তানকে আগলে রাখে জীবন দিয়ে। পশুর কাছে মানুষের পরাজয়। ডানে বাঁয়ে নজর ঘুরালে এমন দৃশ্য দৃশ্যমান সমাজের কোণাকানছায়। সুবিবেক আর সুবিচার সমাজ থেকে যেন অপসারিত। যার প্রতিক্রিয়া ভয়াবহরূপে দেশ ও জাতিকে আলোড়িত করছে। লুণ্ঠিত হলো রাজকোষ যেখানে প্রধান পাহারাদারকে জবাবদিহিতায় আনা উচিত, পরিবর্তে মিলল বিবেকবান উপাধি, সাথে সাথে ফিরত পেল পুরনো চাকরিও। হায়রে বিচার বিবেচনা। এমনটাই তো নিয়ম বাসাবাড়ি বা অফিস আদালতে কোনো অঘটন ঘটলে প্রথম সন্দেহের আওতায় আনা হয় বাড়ির দারোয়ান এবং প্রধান দায়িত্ববানকে। এখানে ঘটলো ভিন্ন আয়োজন। সবখানে রাজনীতির প্রলেপ শুভ ফল বয়ে আনে না। অপরাজনীতি এবং অপবিবেচনা দেশ ও সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে। অপরাধী চিহ্নিত করতে গেলেও প্রয়োজন সততা এবং সত্যের প্রতি অনুগত মন। কিন্তু মুশকিলের বার্তা হলো সততা এবং সত্য নামক শব্দ দুটি বর্তমানে অন্ধকারে নিমজ্জমান। এমনটা না হলে দুর্নীতির হস্ত রাজকোষ পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারতো না। এই দুঃসাহসের কারণ ক্ষমতাবানদের রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতি। রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকতে পারলেই হলো, তখন সাতখুনও মাফ, রাজকোষ লুটতো কোনো ব্যাপারই নয়। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে ঠেকে।
গ. দুঃস্বপ্ন আর দুর্ভাবনা দেশ ও সমাজের সদর অন্দরে সদর্পে হাঁটছে। এই বলদর্প হাঁটা রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নাই, আয়োজনেও কেউ এগিয়ে আসছে না। সাহসী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বড় বেশি অভাব। দেশ, সমাজ এবং চরিত্র বিধ্বংসী এতো কিছু ঘটছে কিন্তু ঠোঁটে আঙ্গুল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের। যারা নিজেদেরকে জাহির করেন বুদ্ধিমান বলে। কবি সাহিত্যিকদের কোলাহলও হঠাৎ শব্দহীন। কোনো জাতি যখন সর্বদিক দিয়ে নিঃস্ব হবার পথে এগোতে থাকে তখন নাকি এ ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করে। এমনি পরিস্থিতির মুখোমুখি কি দেশ ও জাতি? সত্যের প্রতি অনুগত না থাকলে যে চিত্র অংকিত হয়, ক্ষমতা আর লোভ লালসার রাজনীতির কাছে নিঃশর্ত প্রণতি জানালে যেরকম দৃশ্য দৃশ্যমান হয় ঠিক তেমনটাই ঘটছে দেশে। এক শ্রেণীর কবি সাহিত্যিক এবং বুদ্ধি ব্যবসায়ীদের আচরণ সে রকমেরই ছবি তুলে আনছে নিরীহ জনগণের কাছে। ঘরে আগুন লেগেছে ওরা নির্বিকার। আনন্দ ফুর্তিতে মগ্ন। ওদের আচরণ দেখে লজ্জায় লজ্জারও যেন আনত মুখ।
সাজজাদ হোসাইন খান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন