শিরোনাম দেখে পাঠকদের কারো কারো মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হতেই পারে। কারণ, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিরা তো বটেই, তাদের সমর্থক ও সেবাদাস সকল গোষ্ঠীও কথায় কথায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্পর্কে জানিয়ে চলেছেন। রীতিমতো তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানাচ্ছেন, অর্থনীতির ঠিক কোন খাতে কত বেশি সমৃদ্ধি অর্জন করেছে সরকার। কেউ সংশয় প্রকাশ করলে অনেকাংশে বাঙ্গালকে হাই কোর্ট দেখানোর স্টাইলে তারা বিরাট বিরাট ফ্লাইওভারের দিকে আঙুল ওঠাচ্ছেন। মেট্রোরেল থেকে নানা বাহারী নামের আরো অনেক কিছুর কথাও তারা শোনাচ্ছেন। মাঝখানে পদ্মা সেতুর কথা তো বুক চিতিয়ে বলছেনই। অন্যদিকে আসলেও কি দেশে সমৃদ্ধির সুবাতাস বইছে? এ সম্পর্কে নিবন্ধের একেবারে শেষ অংশে সর্বশেষ একটি ঋণ চুক্তি সম্পর্কে জানানো হবে, যা সরকার ও তার সমর্থক-সেবাদাসদের দাবি ও বক্তব্যকে অন্তত সত্য প্রমাণ করে না।
সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে শুরুতে জাতীয় অর্থনীতির দু-একটি দিক নিয়ে সংক্ষেপে বলে নেয়া যাক। বলতে হচ্ছে এজন্য যে, এসবের মধ্যে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ রয়েছে। এরকম একটি বিষয় হলো, বাংলাদেশ থেকে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো তাদের অর্থ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অর্থের পরিমাণও চমকে ওঠার মতো। একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে জানা গেছে, বিগত মাত্র পাঁচ বছরেই ৪০৮ কোটি ৭৫ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যাহার করেছে দাতারাÑ বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। প্রত্যাহারকারীদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির পাশাপাশি বিশেষভাবে রয়েছে জাপানভিত্তিক সংস্থা জাইকা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, অর্থ প্রত্যাহারের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯-১০ অর্থ বছরে। সেবার পরিমাণ ছিল ৮০০ কোটি টাকা। এরপর প্রতি বছর প্রত্যাহারের পরিমাণ কেবল বেড়েছেই এবং সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে নয় হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ফেরৎ চলে গেছে বাংলাদেশ থেকে।
লজ্জিত হওয়ার মতো কথা আরো আছে। সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ১০টি প্রকল্প থেকে রীতিমতো ‘চাপ দিয়ে’ অর্থ ফেরৎ নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০১৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বেঁধে দেয়া সময়ে সরকার বিশ্বব্যাংকের অর্থ ফেরৎ দিতে বাধ্য হয়েছে। ডব্লিউএফপির মতো আরো কিছু সংস্থাও তাদের দেয়া অর্থ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর সব কিছুর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে এসেছে দুর্নীতির অভিযোগ। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে প্রমাণ পেয়েছে দাতারা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের অযোগ্যতা ও অদক্ষতারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর ফলে সরকারের পক্ষেও দাতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করার সুযোগ থাকেনি। পরিবর্তে বিনা বাক্যব্যয়ে এবং মাথা নিচু করে অর্থ ফেরৎ দিয়েছে সরকার। এভাবে মাত্র পাঁচ অর্থ বছরের মধ্যে দাতারা প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে সরকারকে বিপাকে পড়তে হয়েছে। দাতাদের অর্থে শুরু করা প্রকল্পগুলো মাঝ পথে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রকল্প এমনকি শেষ পর্যায়ে আসার পরও থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। অর্থ প্রত্যাহারের বিষয়টি যে জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর সে কথাটা স্বীকার করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী। এ ব্যাপারে লক্ষ হাজার কোটি টাকার পর্বত সমান বাজেট পেশ করার এবং যাকে তাকে ‘রাবিশ’ বলার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অবশ্য কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। তবে তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে দাতারা অর্থ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা যে দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত অশুভ সে কথাও স্বীকার না করে পারেননি তারা।
অর্থ প্রত্যাহার করে নেয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুতর। কারণ হিসেবে দুর্নীতির অভিযোগও নিশ্চয়ই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রসঙ্গক্রমে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি এবং সে কারণে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের পিছিয়ে যাওয়ার তথ্য স্মরণ করতেই হবে। আশাবাদী অনেকের ধারণা ছিল, পদ্মা সেতুর ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া হবে এবং দুর্নীতি যাতে আর না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবে সরকার। অন্যদিকে পরিস্থিতি যে ‘যাহা বাহান্ন তাহা তেপ্পান্নই’ রয়ে গেছেÑ তারই প্রমাণ হিসেবে এসেছে আলোচ্য রিপোর্টটি। লক্ষ্যণীয় যে, দুর্নীতির পাশাপাশি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অযোগ্যতা ও অদক্ষতার ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছে দাতারা। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, যোগ্যতা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা থাকুক আর না-ই থাকুক, নানা নামের প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সব ঠিকাদারিই দেয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনকে। দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়ার উদ্দেশ্যও গোপন করা যায়নি। ঠিকাদারি যারা পেয়েছেন তারা নিয়মনীতির মধ্যে এগোনোর পরিবর্তে শুধু টাকার পেছনেই ছুটেছেন। কাজের কাজ কিছুই করেননি। আর সে কারণে কোনো প্রকল্পেই নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী অগ্রগতি হয়নি। দাতারাও তাই টাকা প্রত্যাহার করে নেয়ার অজুহাত পেয়ে গেছে। অন্যদিকে সব জেনেও সহজবোধ্য কারণে সরকার নীরবতা অবলম্বন করেছে। পরিষ্কার হয়েছে, আর যা-ই হোক, এই সরকারের অধীনে অর্থনীতির কোনো খাতেই অন্তত দুর্নীতি বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এটা যে কেবলই কথার কথা নয় এবং দুর্নীতি যে আসলেও লাফিয়ে বেড়ে চলেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত সম্পর্কিত অন্য এক রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে, বিশেষ করে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অর্থমন্ত্রীর সংসদে উপস্থাপিত তথ্য-পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি ৫৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ রয়েছে বিদেশী ব্যাংকগুলোরও- যদিও এর পরিমাণ এক হাজার ৮৩৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আশংকার কারণ হলো, অর্থের পরিমাণের সঙ্গে ঋণখেলাপিদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এক লাখের বেশি ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছেন। যুক্তির অবশ্য শেষ নেই তাদের। সময়মতো ঋণ এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়া, রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতার কারণে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে পণ্য পৌঁছাতে না পারা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মঘটসহ শ্রমিক অসন্তোষের মতো অনেক যুক্তি ও অজুহাতের কথাই জানিয়ে থাকেন খেলাপিরা। অন্যদিকে তথ্যাভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের অভিমত, এসবের অধিকাংশই খোঁড়া যুক্তি। গলদ রয়েছে তাদের উদ্দেশের মধ্যে। বড় কথা, খেলাপি ঋণের প্রতিটি ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এই নেতারা প্রভাব খাটিয়ে ঋণের ব্যবস্থা যেমন করছেন তেমনি আবার বাঁচিয়ে দিচ্ছেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কবল থেকেও। ফলে ঋণের অর্থ না দিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন খেলাপিরা। মূলত সে কারণেই বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এভাবে বেড়ে যাওয়াকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক ‘বিরল’ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ‘হলমার্ক’ ধরনের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি সুপারিশের আড়ালে ক্ষমতাসীনদের চাপের কারণেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে বলে মনে করেন তথ্যাভিজ্ঞরা। ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি না থাকার সুযোগে ব্যাংকিং খাতের চরম অব্যবস্থাপনার কথাও বলেছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে দেশের ব্যাংকিং খাত তথা সমগ্র অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়বে বলেও তথ্যাভিজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার খবর অত্যন্ত আশংকাজনক হলেও এতে অবশ্য বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। কারণ, ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ রয়েছে অথচ বিভিন্ন অর্থখাতে দুর্নীতি-অনিয়ম ঘটবে না এমন অবস্থার কথা কল্পনা করা যায় না। প্রসঙ্গক্রমে শেয়ারবাজারের লক্ষ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা থেকে পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক ঘুষ-দুর্নীতির মহোৎসবের মতো অনেক ঘটনারই উল্লেখ করা যায়। কারণ, প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, প্রতিটি কেলেংকারিতে ক্ষমতাসীনদের রথি-মহারথিরাই জড়িত রয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদগুলোর দিকেও লক্ষ্য করা যেতে পারে। গা থেকে এখনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ধ যায়নি এমন কিছু যুবক-যুবতিকেই পরিচালনা পরিষদগুলোতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যারা ব্যাংকিং-এর অ, আ, ক, খ সম্পর্কে কিছু জানেন কি না তা নিয়ে পর্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন উঠেছে। তাদের প্রধান ‘যোগ্যতা’- সবাই ছাত্রলীগের নেতা বা নেত্রী ছিলেন। এসব পরিচালকও জবরই দেখিয়ে ছেড়েছেন, যার প্রমাণ দেয়ার জন্য ‘হলমার্ক’ কেলেংকারিই যথেষ্ট। এই একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক একাই চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ওদিকে রথি-মহারথিদের হুকুম তামিল করতে হয়েছে বলে ব্যাংকের কর্মকর্তারাও ‘উপোস’ করতে রাজি হননি। তারাও খেয়েছেন যেমন গিলেছেনও তেমনই। এভাবে সবার অংশগ্রহণেই সর্বনাশের পর্যায়ে এসে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত।
বলা দরকার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের যদি সততা ও সদিচ্ছা থাকতো এবং তারা যদি দূরপ্রসারী গঠনমূলক পরিকল্পনা নিয়ে পা বাড়াতেন তাহলে অবস্থা অবশ্যই এতটা ভয়াবহ হতো না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা শুধু ঘুষ-দুর্নীতির মহোৎসবেই মেতে থাকছেন না, এমন আরো কিছু পদক্ষেপও নিয়ে চলেছেন যেগুলোর কারণেও একদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে অন্যদিকে স্থবির হয়ে পড়ছে জাতীয় অর্থনীতি। যেমন প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঢালাওভাবে গ্যাসের সংযোগ দেয়া বন্ধ রাখার কারণে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানই উৎপাদনে যেতে পারেনি বলে এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে খেলাপি ঋণও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। তথ্যাভিজ্ঞরা মনে করেন, সরকারকে ঘুষ-দুর্নীতির পথ থেকে সরে তো আসতেই হবে, একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার দিকেও নজরদারি বাড়াতে হবে। গ্যাসের সংযোগ দেয়া এবং বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সব মিলিয়ে এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে টাউট লোকজন ব্যাংক ঋণ না পেতে পারে এবং যাতে প্রকৃত শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা ঋণের অভাবে বাধাগ্রস্ত না হন। তাহলেই শুধু খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসতে পারে। ওদিকে দাতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যও চেষ্টা করতে হবে। এজন্য কমানো শুধু নয়, দরকার আসলে দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা। এটা সম্ভব হতে পারে বিশেষ করে কারো কারো স্বজনসহ ক্ষমতাসীনরা যদি দুর্নীতিবাজদের চক্র থেকে বেরিয়ে আসেন। মধুখানেওয়ালাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো নিতেই হবে, একযোগে দরকার আইনের এমন কঠিন প্রয়োগ করাও, যাতে অযোগ্য, অদক্ষ এবং অভিজ্ঞতাহীন কারো পক্ষেই কোনো ঠিকাদারি বা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পাওয়া এবং যথেচ্ছভাবে দুর্নীতি ও অর্থ লুণ্ঠন করা সম্ভব না হয়। এমন অবস্থান নেয়া দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠা কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব কি না সেটা অবশ্য চিন্তার বিষয়!
এবার সেই ঋণ চুক্তি প্রসঙ্গ, যার কথা আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছে। ১০ মার্চ প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, আগেরদিন সরকার ভারতের সঙ্গে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কঠিন শর্তের অধীনে থাকতে হবে। যেমন, এই ঋণের অর্থে বাংলাদেশ যেসব প্রকল্প গ্রহণ করবে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ও সেবার অন্তত ৯০ শতাংশ ভারত থেকে এবং ভারতের নির্ধারিত মূল্যে আমদানি করতে হবে। চুক্তির মেয়াদও মাত্র ২০ বছর। অথচ এ ধরনের চুক্তির মেয়াদ সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ বছরের হয়ে থাকে। সুদের হারের ক্ষেত্রেও খুবই চাতুর্যপূর্ণ মারপ্যাঁচ খাটানো হয়েছে। সুদের হার যেখানে শূন্য দুই থেকে সর্বোচ্চ শূন্য পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত হওয়ার কথা সেখানে আলোচ্য চুক্তিতে সুদের হার ধরা হয়েছে এক শতাংশ হারে। শুধু তা-ই নয়, নির্ধারিত সময়ে ঋণের অর্থ ব্যয় না করতে পারলে সুদের হার সরাসরি দুই শতাংশে উন্নীত হয়ে যাবে। কথা আরো আছে। ভারতীয়দের সূত্রে জানা গেছে, এ চুক্তির অর্থ প্রধানত বিদ্যুৎ, রেলপথ, সড়ক ও নৌপরিবহনসহ এমন কয়েকটি খাতে ব্যবহার করতে হবে, যেগুলোর সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িত রয়েছে।
সুদের অত্যধিক উচ্চ হারের পাশাপাশি মাত্র ২০ বছর মেয়াদসহ কঠিন বিভিন্ন শর্তের কারণে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তিকে স্বাভাবিক মনে করা যাচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করতে পারলে সুদের হার লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ার শর্তটি আন্তর্জাতিক রীতি ও নিয়মের পরিপন্থী। বড় কথা, এই চুক্তির অর্থে নেয়া প্রতিটি প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ভারত থেকে আনতে তো হবেই, কিনতেও হবে ভারতীয়দের বেঁধে দেয়া দামে। চুক্তির শর্ত ধরে ধরে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, ঋণের আড়ালে বাংলাদেশকে গোলামীর জিজ্ঞিওে বেঁধে ফেলার ভয়ংকর পদক্ষেপ নেয়া হলেও আওয়ামী লীগ সরকার দুটি প্রধান কারণে সবকিছু মেনে নিয়েছে। প্রথম কারণটি ভারতের স্বার্থ উদ্ধার করে দেয়া। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা দরকার, ২০১০ সালে ভারত যে একশ কোটি ডলারের ঋণ দিয়েছিল তার মধ্যে ৭০ কোটি ডলারই খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণসহ রেলখাতের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশ নয়, ভারতই বেশি লাভবান হতে যাচ্ছে। এবারও যাতে ব্যতিক্রম না হতে পারে সে উদ্দেশ্যে ভারত প্রথমেই শর্তের মারপ্যাঁচ কষে রেখেছে। ওদিকে ভারতের শর্ত মেনে নেয়ার দ্বিতীয় কারণটিও সহজবোধ্য। বাগাড়ম্বর করা হলেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সরকার প্রকৃতপক্ষে শোচনীয় ব্যর্থতাই দেখিয়ে চলেছে। এজন্যই ধার করে ঘি খাওয়ার এত আয়োজন। ক্ষমতাসীনদের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ, তাদের পাশে রয়েছে এমন এক ‘বন্ধুরাষ্ট্র’- যে দেশটি যেতেও কাটছে, আসতেও কাটছে।
কিন্তু জনগণ কিছুই করতে পারছে না। জনগণ যাতে প্রতিবাদ জানানো বা আন্দোলন গড়ে তোলাসহ কিছু না করতে পারে সে ব্যাপারেও সরকারের জন্য যথার্থ বন্ধুরাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করে চলেছে দেশটি।
সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে শুরুতে জাতীয় অর্থনীতির দু-একটি দিক নিয়ে সংক্ষেপে বলে নেয়া যাক। বলতে হচ্ছে এজন্য যে, এসবের মধ্যে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ রয়েছে। এরকম একটি বিষয় হলো, বাংলাদেশ থেকে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো তাদের অর্থ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অর্থের পরিমাণও চমকে ওঠার মতো। একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে জানা গেছে, বিগত মাত্র পাঁচ বছরেই ৪০৮ কোটি ৭৫ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যাহার করেছে দাতারাÑ বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। প্রত্যাহারকারীদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির পাশাপাশি বিশেষভাবে রয়েছে জাপানভিত্তিক সংস্থা জাইকা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, অর্থ প্রত্যাহারের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯-১০ অর্থ বছরে। সেবার পরিমাণ ছিল ৮০০ কোটি টাকা। এরপর প্রতি বছর প্রত্যাহারের পরিমাণ কেবল বেড়েছেই এবং সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে নয় হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ফেরৎ চলে গেছে বাংলাদেশ থেকে।
লজ্জিত হওয়ার মতো কথা আরো আছে। সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ১০টি প্রকল্প থেকে রীতিমতো ‘চাপ দিয়ে’ অর্থ ফেরৎ নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০১৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বেঁধে দেয়া সময়ে সরকার বিশ্বব্যাংকের অর্থ ফেরৎ দিতে বাধ্য হয়েছে। ডব্লিউএফপির মতো আরো কিছু সংস্থাও তাদের দেয়া অর্থ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর সব কিছুর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে এসেছে দুর্নীতির অভিযোগ। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে প্রমাণ পেয়েছে দাতারা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের অযোগ্যতা ও অদক্ষতারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর ফলে সরকারের পক্ষেও দাতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করার সুযোগ থাকেনি। পরিবর্তে বিনা বাক্যব্যয়ে এবং মাথা নিচু করে অর্থ ফেরৎ দিয়েছে সরকার। এভাবে মাত্র পাঁচ অর্থ বছরের মধ্যে দাতারা প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে সরকারকে বিপাকে পড়তে হয়েছে। দাতাদের অর্থে শুরু করা প্রকল্পগুলো মাঝ পথে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রকল্প এমনকি শেষ পর্যায়ে আসার পরও থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। অর্থ প্রত্যাহারের বিষয়টি যে জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর সে কথাটা স্বীকার করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী। এ ব্যাপারে লক্ষ হাজার কোটি টাকার পর্বত সমান বাজেট পেশ করার এবং যাকে তাকে ‘রাবিশ’ বলার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অবশ্য কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। তবে তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে দাতারা অর্থ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা যে দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত অশুভ সে কথাও স্বীকার না করে পারেননি তারা।
অর্থ প্রত্যাহার করে নেয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুতর। কারণ হিসেবে দুর্নীতির অভিযোগও নিশ্চয়ই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রসঙ্গক্রমে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি এবং সে কারণে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের পিছিয়ে যাওয়ার তথ্য স্মরণ করতেই হবে। আশাবাদী অনেকের ধারণা ছিল, পদ্মা সেতুর ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া হবে এবং দুর্নীতি যাতে আর না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবে সরকার। অন্যদিকে পরিস্থিতি যে ‘যাহা বাহান্ন তাহা তেপ্পান্নই’ রয়ে গেছেÑ তারই প্রমাণ হিসেবে এসেছে আলোচ্য রিপোর্টটি। লক্ষ্যণীয় যে, দুর্নীতির পাশাপাশি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অযোগ্যতা ও অদক্ষতার ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছে দাতারা। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, যোগ্যতা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা থাকুক আর না-ই থাকুক, নানা নামের প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সব ঠিকাদারিই দেয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনকে। দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়ার উদ্দেশ্যও গোপন করা যায়নি। ঠিকাদারি যারা পেয়েছেন তারা নিয়মনীতির মধ্যে এগোনোর পরিবর্তে শুধু টাকার পেছনেই ছুটেছেন। কাজের কাজ কিছুই করেননি। আর সে কারণে কোনো প্রকল্পেই নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী অগ্রগতি হয়নি। দাতারাও তাই টাকা প্রত্যাহার করে নেয়ার অজুহাত পেয়ে গেছে। অন্যদিকে সব জেনেও সহজবোধ্য কারণে সরকার নীরবতা অবলম্বন করেছে। পরিষ্কার হয়েছে, আর যা-ই হোক, এই সরকারের অধীনে অর্থনীতির কোনো খাতেই অন্তত দুর্নীতি বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এটা যে কেবলই কথার কথা নয় এবং দুর্নীতি যে আসলেও লাফিয়ে বেড়ে চলেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত সম্পর্কিত অন্য এক রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে, বিশেষ করে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অর্থমন্ত্রীর সংসদে উপস্থাপিত তথ্য-পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি ৫৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ রয়েছে বিদেশী ব্যাংকগুলোরও- যদিও এর পরিমাণ এক হাজার ৮৩৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আশংকার কারণ হলো, অর্থের পরিমাণের সঙ্গে ঋণখেলাপিদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এক লাখের বেশি ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছেন। যুক্তির অবশ্য শেষ নেই তাদের। সময়মতো ঋণ এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়া, রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতার কারণে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে পণ্য পৌঁছাতে না পারা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মঘটসহ শ্রমিক অসন্তোষের মতো অনেক যুক্তি ও অজুহাতের কথাই জানিয়ে থাকেন খেলাপিরা। অন্যদিকে তথ্যাভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের অভিমত, এসবের অধিকাংশই খোঁড়া যুক্তি। গলদ রয়েছে তাদের উদ্দেশের মধ্যে। বড় কথা, খেলাপি ঋণের প্রতিটি ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এই নেতারা প্রভাব খাটিয়ে ঋণের ব্যবস্থা যেমন করছেন তেমনি আবার বাঁচিয়ে দিচ্ছেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কবল থেকেও। ফলে ঋণের অর্থ না দিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন খেলাপিরা। মূলত সে কারণেই বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এভাবে বেড়ে যাওয়াকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক ‘বিরল’ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ‘হলমার্ক’ ধরনের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি সুপারিশের আড়ালে ক্ষমতাসীনদের চাপের কারণেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে বলে মনে করেন তথ্যাভিজ্ঞরা। ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি না থাকার সুযোগে ব্যাংকিং খাতের চরম অব্যবস্থাপনার কথাও বলেছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে দেশের ব্যাংকিং খাত তথা সমগ্র অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়বে বলেও তথ্যাভিজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার খবর অত্যন্ত আশংকাজনক হলেও এতে অবশ্য বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। কারণ, ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ রয়েছে অথচ বিভিন্ন অর্থখাতে দুর্নীতি-অনিয়ম ঘটবে না এমন অবস্থার কথা কল্পনা করা যায় না। প্রসঙ্গক্রমে শেয়ারবাজারের লক্ষ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা থেকে পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক ঘুষ-দুর্নীতির মহোৎসবের মতো অনেক ঘটনারই উল্লেখ করা যায়। কারণ, প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, প্রতিটি কেলেংকারিতে ক্ষমতাসীনদের রথি-মহারথিরাই জড়িত রয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদগুলোর দিকেও লক্ষ্য করা যেতে পারে। গা থেকে এখনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ধ যায়নি এমন কিছু যুবক-যুবতিকেই পরিচালনা পরিষদগুলোতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যারা ব্যাংকিং-এর অ, আ, ক, খ সম্পর্কে কিছু জানেন কি না তা নিয়ে পর্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন উঠেছে। তাদের প্রধান ‘যোগ্যতা’- সবাই ছাত্রলীগের নেতা বা নেত্রী ছিলেন। এসব পরিচালকও জবরই দেখিয়ে ছেড়েছেন, যার প্রমাণ দেয়ার জন্য ‘হলমার্ক’ কেলেংকারিই যথেষ্ট। এই একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক একাই চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ওদিকে রথি-মহারথিদের হুকুম তামিল করতে হয়েছে বলে ব্যাংকের কর্মকর্তারাও ‘উপোস’ করতে রাজি হননি। তারাও খেয়েছেন যেমন গিলেছেনও তেমনই। এভাবে সবার অংশগ্রহণেই সর্বনাশের পর্যায়ে এসে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত।
বলা দরকার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের যদি সততা ও সদিচ্ছা থাকতো এবং তারা যদি দূরপ্রসারী গঠনমূলক পরিকল্পনা নিয়ে পা বাড়াতেন তাহলে অবস্থা অবশ্যই এতটা ভয়াবহ হতো না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা শুধু ঘুষ-দুর্নীতির মহোৎসবেই মেতে থাকছেন না, এমন আরো কিছু পদক্ষেপও নিয়ে চলেছেন যেগুলোর কারণেও একদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে অন্যদিকে স্থবির হয়ে পড়ছে জাতীয় অর্থনীতি। যেমন প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঢালাওভাবে গ্যাসের সংযোগ দেয়া বন্ধ রাখার কারণে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানই উৎপাদনে যেতে পারেনি বলে এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে খেলাপি ঋণও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। তথ্যাভিজ্ঞরা মনে করেন, সরকারকে ঘুষ-দুর্নীতির পথ থেকে সরে তো আসতেই হবে, একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার দিকেও নজরদারি বাড়াতে হবে। গ্যাসের সংযোগ দেয়া এবং বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সব মিলিয়ে এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে টাউট লোকজন ব্যাংক ঋণ না পেতে পারে এবং যাতে প্রকৃত শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা ঋণের অভাবে বাধাগ্রস্ত না হন। তাহলেই শুধু খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসতে পারে। ওদিকে দাতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যও চেষ্টা করতে হবে। এজন্য কমানো শুধু নয়, দরকার আসলে দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা। এটা সম্ভব হতে পারে বিশেষ করে কারো কারো স্বজনসহ ক্ষমতাসীনরা যদি দুর্নীতিবাজদের চক্র থেকে বেরিয়ে আসেন। মধুখানেওয়ালাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো নিতেই হবে, একযোগে দরকার আইনের এমন কঠিন প্রয়োগ করাও, যাতে অযোগ্য, অদক্ষ এবং অভিজ্ঞতাহীন কারো পক্ষেই কোনো ঠিকাদারি বা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পাওয়া এবং যথেচ্ছভাবে দুর্নীতি ও অর্থ লুণ্ঠন করা সম্ভব না হয়। এমন অবস্থান নেয়া দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠা কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব কি না সেটা অবশ্য চিন্তার বিষয়!
এবার সেই ঋণ চুক্তি প্রসঙ্গ, যার কথা আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছে। ১০ মার্চ প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, আগেরদিন সরকার ভারতের সঙ্গে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কঠিন শর্তের অধীনে থাকতে হবে। যেমন, এই ঋণের অর্থে বাংলাদেশ যেসব প্রকল্প গ্রহণ করবে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ও সেবার অন্তত ৯০ শতাংশ ভারত থেকে এবং ভারতের নির্ধারিত মূল্যে আমদানি করতে হবে। চুক্তির মেয়াদও মাত্র ২০ বছর। অথচ এ ধরনের চুক্তির মেয়াদ সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ বছরের হয়ে থাকে। সুদের হারের ক্ষেত্রেও খুবই চাতুর্যপূর্ণ মারপ্যাঁচ খাটানো হয়েছে। সুদের হার যেখানে শূন্য দুই থেকে সর্বোচ্চ শূন্য পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত হওয়ার কথা সেখানে আলোচ্য চুক্তিতে সুদের হার ধরা হয়েছে এক শতাংশ হারে। শুধু তা-ই নয়, নির্ধারিত সময়ে ঋণের অর্থ ব্যয় না করতে পারলে সুদের হার সরাসরি দুই শতাংশে উন্নীত হয়ে যাবে। কথা আরো আছে। ভারতীয়দের সূত্রে জানা গেছে, এ চুক্তির অর্থ প্রধানত বিদ্যুৎ, রেলপথ, সড়ক ও নৌপরিবহনসহ এমন কয়েকটি খাতে ব্যবহার করতে হবে, যেগুলোর সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িত রয়েছে।
সুদের অত্যধিক উচ্চ হারের পাশাপাশি মাত্র ২০ বছর মেয়াদসহ কঠিন বিভিন্ন শর্তের কারণে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তিকে স্বাভাবিক মনে করা যাচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করতে পারলে সুদের হার লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ার শর্তটি আন্তর্জাতিক রীতি ও নিয়মের পরিপন্থী। বড় কথা, এই চুক্তির অর্থে নেয়া প্রতিটি প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ভারত থেকে আনতে তো হবেই, কিনতেও হবে ভারতীয়দের বেঁধে দেয়া দামে। চুক্তির শর্ত ধরে ধরে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, ঋণের আড়ালে বাংলাদেশকে গোলামীর জিজ্ঞিওে বেঁধে ফেলার ভয়ংকর পদক্ষেপ নেয়া হলেও আওয়ামী লীগ সরকার দুটি প্রধান কারণে সবকিছু মেনে নিয়েছে। প্রথম কারণটি ভারতের স্বার্থ উদ্ধার করে দেয়া। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা দরকার, ২০১০ সালে ভারত যে একশ কোটি ডলারের ঋণ দিয়েছিল তার মধ্যে ৭০ কোটি ডলারই খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণসহ রেলখাতের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশ নয়, ভারতই বেশি লাভবান হতে যাচ্ছে। এবারও যাতে ব্যতিক্রম না হতে পারে সে উদ্দেশ্যে ভারত প্রথমেই শর্তের মারপ্যাঁচ কষে রেখেছে। ওদিকে ভারতের শর্ত মেনে নেয়ার দ্বিতীয় কারণটিও সহজবোধ্য। বাগাড়ম্বর করা হলেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সরকার প্রকৃতপক্ষে শোচনীয় ব্যর্থতাই দেখিয়ে চলেছে। এজন্যই ধার করে ঘি খাওয়ার এত আয়োজন। ক্ষমতাসীনদের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ, তাদের পাশে রয়েছে এমন এক ‘বন্ধুরাষ্ট্র’- যে দেশটি যেতেও কাটছে, আসতেও কাটছে।
কিন্তু জনগণ কিছুই করতে পারছে না। জনগণ যাতে প্রতিবাদ জানানো বা আন্দোলন গড়ে তোলাসহ কিছু না করতে পারে সে ব্যাপারেও সরকারের জন্য যথার্থ বন্ধুরাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করে চলেছে দেশটি।
আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন