বক্তৃতা তো ভাল বিষয়, বিবৃতিও কোনো মন্দ বিষয় নয়। তবে বক্তৃতা-বিবৃতির সারবত্তা তখনই প্রমাণিত হয়, যখন কথামালার সাথে কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে একটু থমকে যেতে হয়। ভাবতে গেলে হোঁচট খেতে হয়! বর্তমান সময়ে আমাদের যতসব দুঃখ তার মূল কারণ কিন্তু ওইখানেই সুপ্ত আছে। কথা ও কাজে গরমিলের কারণেই কিন্তু আমাদের দুঃখের মাত্রা বাড়ছে। এ দৈন্য ঘোচাতে পারলে আমাদের গণতন্ত্রের সংকট, সুশাসনের সংকট, দুর্নীতির সংকট দূর হতে পারে। বক্তৃতা-বিবৃতির উষ্ণতা লক্ষ্য করলে তো মনে হয় সবাই ওইসব সংকট সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল, কিন্তু বাস্তবে তো এর তেমন কোনো সুফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এর ফলে আমাদের জীবনে আনন্দের মাত্রাই যে শুধু হ্রাস পাচ্ছে তা নয়, ভেতর থেকেও আমরা দুর্বল হয়ে পড়ছি। আর বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আত্মমর্যাদা, ইমেজ ও জাতীয় ঐক্য-সংহতির বিষয়টিকেও আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে আন্তর্জাতিক মহল এমনকি প্রতিবেশী মহলও আমাদের তেমন সমীহ করবে না। সমীহ করলে কি প্রতিবেশী দেশের বিএসএফ এভাবে একের পর এক আমাদের নাগরিকদের গুলী করে হত্যা করতে পারে? সমীহ করলে কি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিকটতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ হুমকির সুরে বলতে পারেন, পাকিস্তানকে ঠাণ্ডা করে দেয়া হয়েছে, প্রয়োজনে বাংলাদেশকেও ঠাণ্ডা করে দেয়া হবে।
এ নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বরং কর্তব্যকর্মে মনোযোগী হয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করাই হবে আসল কাজ। অন্যের মন্দ তো আছেই, তবে আগে নিজেদেরটাই সংশোধন করতে হবে। গত কয়েকদিন ধরেই বাহুবলের ঘটনা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি মানবজমিন পত্রিকায় মুদ্রিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘অপরাধের ষোলকলা পূর্ণ রুবেল-জুয়েলের’। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, হামলা, ভাঙচুর, চুরি-ডাকাতির পর এবার খুনির খাতায় নাম লিখিয়ে ষোলকলা পূর্ণ করলো দুই ভাই রুবেল ও জুয়েল। তাদের ভয়ে কোনো কিশোরী শিক্ষার্থী একা স্কুলে যেতে ভয় পেত। ফলে দলবেঁধে তারা বিদ্যালয়ে যেত। তারপরেও রক্ষা হতো না তাদের। হঠাৎ কাউকে আগলে ধরে খাতা টেনে নিয়ে ফোন নম্বর লিখে বলতো- ফোন নম্বর লিখে দিলাম, রাতে ফোন না দিলে তোর খবর আছে, তোরে আমি ভালবাসি। কোনো কিশোরীকে প্রকাশ্যে জাপটে ধরে বলতো- আজ সন্ধ্যায় বাড়ির পশ্চিম পাশের মাঠে আসবি, তোরে আমি ভালবাসার কথা কইমু। এভাবেই চলতো তাদের দৌরাত্ম্য ও বখাটেপনা। এ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও ছাত্রীদের সংকটের সমাধান হয়নি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি ওদের ডেকে শাসন করতে চাইলে ওরা সন্ত্রাসের ভাষায় কথা বলতো। ছাত্রীদের অভিভাবকরা ওদের অপতৎপরতার প্রতিবাদ করলে ওরা দলবল নিয়ে তাদের ওপরও আক্রমণ করে। এমন এক ঘটনায় পুলিশ উপস্থিত হয়ে ওদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। পরে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। এ ব্যাপারে বাহুবল মডেল থানার ওসি মোশাররফ হোসেন বলেন, রুবেল ও জুয়েল বখাটে। তাদের নিয়ে এলাকাবাসী আতঙ্কে ছিল। এবার আর তারা ছাড় পাবে না।
বখাটে দুই ভাই প্রকাশ্যে যেভাবে ইভটিজিং, নারী-নির্যাতন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তাতে আমাদের প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের প্রশংসা করা যায় না। বরং তাঁরা অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন কেন সেই প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী বলেন, আমি ব্যর্থ। অনেকবার পুলিশকে পাঠিয়েছি ওদের ধরতে। শুনেছি তাদের ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু পথিমধ্যে অদৃশ্য ফোনে ওদের ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওইসব অদৃশ্য ব্যক্তিরাই অশান্তির মূল। তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আবদুল আলী বাগাল ও তার পুত্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সংসদ সদস্য তো অদৃশ্য ব্যক্তিদের কথা বললেন। অদৃশ্য ব্যক্তিদের ফোনের কারণেই বখাটে দুই ভাইকে পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এমন বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, অদৃশ্য ব্যক্তিরা খুবই ক্ষমতাধর, নইলে তাদের ফোনে অপরাধীদের পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে কেন? আর এমন ক্ষমতাধরদের তো স্থানীয় সংসদ সদস্যের না চেনার কথা নয়। বখাটেদের প্রশ্রয় দিয়ে যারা এলাকাবাসীর জীবন-যাপনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তাদের নাম গোপন করা তো কোনো সংসদ সদস্য কিংবা পুলিশের কাজ হতে পারে না। বরং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সংসদ সদস্য ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তব্য ছিল। কিন্তু তেমন কর্তব্য পালিত হতে দেখা যায়নি। ফলে বখাটে দুই ভাই ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের দৌরাত্ম্য ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। আর এই বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে যে, ক্ষমতাধরদের প্রশ্রয় ছাড়া বখাটেরা তাদের অপকর্ম চালাবার মতো সাহস ও শক্তি পায় না। ফলে ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাধরদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জনমনে জেগেছে বিরাট প্রশ্ন।
পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পঞ্চায়েতের কর্তৃত্ব নিয়ে আবদুল আলী বাগাল ও তার পুত্র রুবেল-জুয়েল পঞ্চায়েতের চার শিশু শুভ, ইসমাইল, তাজেল ও মনিরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আলোচনায় চলে আসে আবদুল আলী বাগাল ও তার পুত্রদের কু-কীর্তির কথা। হত্যাকাণ্ডের পর বাহুবলের বিসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এই মর্মে শপথ নেয় যে, তারা এলাকায় আর কোনো রুবেল-জুয়েল সৃষ্টি হতে দেবে না। তাদের প্রতি ঘ্রণাস্বরূপ আর কারো নাম রুবেল-জুয়েল না রাখার ঘোষণাও দেন তারা। ছাত্ররাতো ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শপথ নিয়ে তাদের মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেছে। তাদের এই শপথ যেন হবিগঞ্জের বাহুবল ও সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মানুষের আকাক্সক্ষাকেই ব্যক্ত করেছে। কিন্তু এলাকার জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার অনুকূলে কাজ করতে জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ প্রশাসন কতটা এগিয়ে আসেন- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আমরা তো এ কথা জানি যে, মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠন করেছে মানবিক মর্যাদাসহ উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্যে। এজন্য তারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে, ট্যাক্সও দেয়। বিষয়টি আমাদের জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও প্রশাসনকে উপলব্ধি করতে হবে। তাদের আরও অনুধাবন করতে হবে যে, তাদের দায়িত্ব জনগণের সেবা করা, কর্তৃত্বের ছড়ি ঘোরানো নয়। দায়িত্ব ভুলে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা কর্তৃত্বের ছড়ি ঘোরাতে শুরু করলে জনগণের দুঃখ বাড়ে, রাষ্ট্রও হয়ে পড়ে দুর্বল। এমন অবস্থা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাম্য হতে পারে না। আমরা জানি, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন রাজনীতিবিদরাই। কারণ তারাই দেশ পরিচালনা করেন এবং প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এ কারণে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় রাজনীতিবিদদেরই।
আমরা জানি, বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রকে ভালবাসে। গণতন্ত্রের চেতনায় এই জনপদের মানুষ ভাষা আন্দোলন করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে এখনও গণতন্ত্রই সবচাইতে সমাদৃত বিষয়। শুধু জনগণই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাও গণতন্ত্রের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ। সরকার ও গণতন্ত্রের ঝা-াকে উড্ডীন রাখার পক্ষেই কথা বলে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এত ইতিবাচক উচ্চারণের পরেও দেশে গণতন্ত্রের এমন হাল হলো কেমন করে? সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচনেও ভোটার ছাড়া নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন! এমন চিত্রকে কোনোভাবেই সুলক্ষণ বলে বিবেচনা করা যায় না। এ যেন গণতন্ত্রের জন্য এক অশনি সংকেত।
এমন বাতাবরণে ৫ মার্চ তারিখে মুদ্রিত প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম করা হয়েছে- “ফেনীর পরশুরামে নির্বাচন মানেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা!” খবরটিতে বলা হয়, ফেনীর পরশুরাম পৌরসভা নির্বাচনে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে মেয়র ও ১২টি কাউন্সিলরের প্রতিটিতেই একক প্রার্থী ছিলেন। ফলে তারা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এবার পরশুরামের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটতে চলেছে। তিনটি ইউপিতেই চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী থাকায় তারাও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন। দুই মাস আগে পরশুরাম, দাগনভূঞা ও ফেনী পৌরসভা নির্বাচনে তিন মেয়র ও ৪৮ সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরের মধ্যে ২জন মেয়র ও ৪৩ জন কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য যে, পরশুরামের ৩ ইউপি বিএনপির চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন- হুমকি, ভয়ভীতি ও এলাকা ছাড়ার কারণে তারা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এমন নির্বাচন এবং ভয়-ভীতিও হুমকি-ধমকির এমন পরিবেশ যে, গণতন্ত্রের বার্তা বহন করে না- তা স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করা যায়।
আমরা তো এ কথা জানি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলেই ছিল অধিকার সচেতন মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনা। এখন সেই দেশেই যদি গণতন্ত্রের এমন করুণ হাল হয়, তাহলে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, দেশের রাজনীতি সঠিক পথে এগুচ্ছে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা তো প্রায়শই বলে থাকেন যে, ব্যক্তির চাইতে দল বড়, দলের চাইতে দেশ বড়। এমন বক্তব্যে আস্থা থাকলে আজ দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বদলে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির এমন দৌরাত্ম্য চলে কেমন করে? মানুষ যদি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে না পারে, নির্বাচনে নির্ভয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে তাহলে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে কেমন করে? প্রসঙ্গত এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও একমাত্র বিষয় নয়। আর যে কোনোভাবে কেউ নির্বাচিত হয়ে গেলেই তিনি জনগণের কিংবা গণতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়ে যান না। যারা গণতন্ত্রের কিংবা জনগণের প্রতিনিধি হবেন তাদের অবশ্যই গণতন্ত্রের রীতি-নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তারা হুমকি-ধমকি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের বদলে জনস্বার্থের অনুকূলে কাজ করে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটের প্রতি আস্থাশীল থাকবেন। বাংলাদেশের জনগণ এমন গণতন্ত্রই চান। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা অতীতে এমন গণতন্ত্রের চর্চাই করেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতাগ্রাসের যে অপরাজনীতি চলছে তা জনগণের কাম্য নয়।
গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে জড়িয়ে বর্তমান সময়ে প্রতারণা, শঠতা ও জোর-জবরদস্তির যে রাজনীতি চলছে তার প্রতি জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। ফলে অনাকাক্সিক্ষত এমন রাজনীতির প্রতি জনমনে অনীহার মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়টি একটি স্বাধীন জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক। কারণ রাজনীতি ছাড়া কোনো জাতি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। প্রতিযোগিতামূলক বর্তমান বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্রের রোডম্যাপেই চলতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা তাদের দায়িত্ব পালন করলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজেদের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করবে। তখন রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্যও হ্রাস পাবে। আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা রাজনীতির সঠিক রোডম্যাপে চলেন কি না- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এ নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বরং কর্তব্যকর্মে মনোযোগী হয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করাই হবে আসল কাজ। অন্যের মন্দ তো আছেই, তবে আগে নিজেদেরটাই সংশোধন করতে হবে। গত কয়েকদিন ধরেই বাহুবলের ঘটনা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি মানবজমিন পত্রিকায় মুদ্রিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘অপরাধের ষোলকলা পূর্ণ রুবেল-জুয়েলের’। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, হামলা, ভাঙচুর, চুরি-ডাকাতির পর এবার খুনির খাতায় নাম লিখিয়ে ষোলকলা পূর্ণ করলো দুই ভাই রুবেল ও জুয়েল। তাদের ভয়ে কোনো কিশোরী শিক্ষার্থী একা স্কুলে যেতে ভয় পেত। ফলে দলবেঁধে তারা বিদ্যালয়ে যেত। তারপরেও রক্ষা হতো না তাদের। হঠাৎ কাউকে আগলে ধরে খাতা টেনে নিয়ে ফোন নম্বর লিখে বলতো- ফোন নম্বর লিখে দিলাম, রাতে ফোন না দিলে তোর খবর আছে, তোরে আমি ভালবাসি। কোনো কিশোরীকে প্রকাশ্যে জাপটে ধরে বলতো- আজ সন্ধ্যায় বাড়ির পশ্চিম পাশের মাঠে আসবি, তোরে আমি ভালবাসার কথা কইমু। এভাবেই চলতো তাদের দৌরাত্ম্য ও বখাটেপনা। এ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও ছাত্রীদের সংকটের সমাধান হয়নি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি ওদের ডেকে শাসন করতে চাইলে ওরা সন্ত্রাসের ভাষায় কথা বলতো। ছাত্রীদের অভিভাবকরা ওদের অপতৎপরতার প্রতিবাদ করলে ওরা দলবল নিয়ে তাদের ওপরও আক্রমণ করে। এমন এক ঘটনায় পুলিশ উপস্থিত হয়ে ওদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। পরে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। এ ব্যাপারে বাহুবল মডেল থানার ওসি মোশাররফ হোসেন বলেন, রুবেল ও জুয়েল বখাটে। তাদের নিয়ে এলাকাবাসী আতঙ্কে ছিল। এবার আর তারা ছাড় পাবে না।
বখাটে দুই ভাই প্রকাশ্যে যেভাবে ইভটিজিং, নারী-নির্যাতন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তাতে আমাদের প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের প্রশংসা করা যায় না। বরং তাঁরা অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন কেন সেই প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী বলেন, আমি ব্যর্থ। অনেকবার পুলিশকে পাঠিয়েছি ওদের ধরতে। শুনেছি তাদের ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু পথিমধ্যে অদৃশ্য ফোনে ওদের ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওইসব অদৃশ্য ব্যক্তিরাই অশান্তির মূল। তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আবদুল আলী বাগাল ও তার পুত্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সংসদ সদস্য তো অদৃশ্য ব্যক্তিদের কথা বললেন। অদৃশ্য ব্যক্তিদের ফোনের কারণেই বখাটে দুই ভাইকে পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এমন বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, অদৃশ্য ব্যক্তিরা খুবই ক্ষমতাধর, নইলে তাদের ফোনে অপরাধীদের পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে কেন? আর এমন ক্ষমতাধরদের তো স্থানীয় সংসদ সদস্যের না চেনার কথা নয়। বখাটেদের প্রশ্রয় দিয়ে যারা এলাকাবাসীর জীবন-যাপনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তাদের নাম গোপন করা তো কোনো সংসদ সদস্য কিংবা পুলিশের কাজ হতে পারে না। বরং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সংসদ সদস্য ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তব্য ছিল। কিন্তু তেমন কর্তব্য পালিত হতে দেখা যায়নি। ফলে বখাটে দুই ভাই ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের দৌরাত্ম্য ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। আর এই বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে যে, ক্ষমতাধরদের প্রশ্রয় ছাড়া বখাটেরা তাদের অপকর্ম চালাবার মতো সাহস ও শক্তি পায় না। ফলে ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাধরদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জনমনে জেগেছে বিরাট প্রশ্ন।
পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পঞ্চায়েতের কর্তৃত্ব নিয়ে আবদুল আলী বাগাল ও তার পুত্র রুবেল-জুয়েল পঞ্চায়েতের চার শিশু শুভ, ইসমাইল, তাজেল ও মনিরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আলোচনায় চলে আসে আবদুল আলী বাগাল ও তার পুত্রদের কু-কীর্তির কথা। হত্যাকাণ্ডের পর বাহুবলের বিসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এই মর্মে শপথ নেয় যে, তারা এলাকায় আর কোনো রুবেল-জুয়েল সৃষ্টি হতে দেবে না। তাদের প্রতি ঘ্রণাস্বরূপ আর কারো নাম রুবেল-জুয়েল না রাখার ঘোষণাও দেন তারা। ছাত্ররাতো ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শপথ নিয়ে তাদের মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেছে। তাদের এই শপথ যেন হবিগঞ্জের বাহুবল ও সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মানুষের আকাক্সক্ষাকেই ব্যক্ত করেছে। কিন্তু এলাকার জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার অনুকূলে কাজ করতে জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ প্রশাসন কতটা এগিয়ে আসেন- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আমরা তো এ কথা জানি যে, মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠন করেছে মানবিক মর্যাদাসহ উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্যে। এজন্য তারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে, ট্যাক্সও দেয়। বিষয়টি আমাদের জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও প্রশাসনকে উপলব্ধি করতে হবে। তাদের আরও অনুধাবন করতে হবে যে, তাদের দায়িত্ব জনগণের সেবা করা, কর্তৃত্বের ছড়ি ঘোরানো নয়। দায়িত্ব ভুলে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা কর্তৃত্বের ছড়ি ঘোরাতে শুরু করলে জনগণের দুঃখ বাড়ে, রাষ্ট্রও হয়ে পড়ে দুর্বল। এমন অবস্থা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাম্য হতে পারে না। আমরা জানি, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন রাজনীতিবিদরাই। কারণ তারাই দেশ পরিচালনা করেন এবং প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এ কারণে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় রাজনীতিবিদদেরই।
আমরা জানি, বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রকে ভালবাসে। গণতন্ত্রের চেতনায় এই জনপদের মানুষ ভাষা আন্দোলন করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে এখনও গণতন্ত্রই সবচাইতে সমাদৃত বিষয়। শুধু জনগণই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাও গণতন্ত্রের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ। সরকার ও গণতন্ত্রের ঝা-াকে উড্ডীন রাখার পক্ষেই কথা বলে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এত ইতিবাচক উচ্চারণের পরেও দেশে গণতন্ত্রের এমন হাল হলো কেমন করে? সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচনেও ভোটার ছাড়া নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন! এমন চিত্রকে কোনোভাবেই সুলক্ষণ বলে বিবেচনা করা যায় না। এ যেন গণতন্ত্রের জন্য এক অশনি সংকেত।
এমন বাতাবরণে ৫ মার্চ তারিখে মুদ্রিত প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম করা হয়েছে- “ফেনীর পরশুরামে নির্বাচন মানেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা!” খবরটিতে বলা হয়, ফেনীর পরশুরাম পৌরসভা নির্বাচনে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে মেয়র ও ১২টি কাউন্সিলরের প্রতিটিতেই একক প্রার্থী ছিলেন। ফলে তারা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এবার পরশুরামের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটতে চলেছে। তিনটি ইউপিতেই চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী থাকায় তারাও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন। দুই মাস আগে পরশুরাম, দাগনভূঞা ও ফেনী পৌরসভা নির্বাচনে তিন মেয়র ও ৪৮ সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরের মধ্যে ২জন মেয়র ও ৪৩ জন কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য যে, পরশুরামের ৩ ইউপি বিএনপির চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন- হুমকি, ভয়ভীতি ও এলাকা ছাড়ার কারণে তারা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এমন নির্বাচন এবং ভয়-ভীতিও হুমকি-ধমকির এমন পরিবেশ যে, গণতন্ত্রের বার্তা বহন করে না- তা স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করা যায়।
আমরা তো এ কথা জানি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলেই ছিল অধিকার সচেতন মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনা। এখন সেই দেশেই যদি গণতন্ত্রের এমন করুণ হাল হয়, তাহলে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, দেশের রাজনীতি সঠিক পথে এগুচ্ছে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা তো প্রায়শই বলে থাকেন যে, ব্যক্তির চাইতে দল বড়, দলের চাইতে দেশ বড়। এমন বক্তব্যে আস্থা থাকলে আজ দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বদলে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির এমন দৌরাত্ম্য চলে কেমন করে? মানুষ যদি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে না পারে, নির্বাচনে নির্ভয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে তাহলে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে কেমন করে? প্রসঙ্গত এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও একমাত্র বিষয় নয়। আর যে কোনোভাবে কেউ নির্বাচিত হয়ে গেলেই তিনি জনগণের কিংবা গণতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়ে যান না। যারা গণতন্ত্রের কিংবা জনগণের প্রতিনিধি হবেন তাদের অবশ্যই গণতন্ত্রের রীতি-নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তারা হুমকি-ধমকি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের বদলে জনস্বার্থের অনুকূলে কাজ করে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটের প্রতি আস্থাশীল থাকবেন। বাংলাদেশের জনগণ এমন গণতন্ত্রই চান। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা অতীতে এমন গণতন্ত্রের চর্চাই করেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতাগ্রাসের যে অপরাজনীতি চলছে তা জনগণের কাম্য নয়।
গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে জড়িয়ে বর্তমান সময়ে প্রতারণা, শঠতা ও জোর-জবরদস্তির যে রাজনীতি চলছে তার প্রতি জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। ফলে অনাকাক্সিক্ষত এমন রাজনীতির প্রতি জনমনে অনীহার মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়টি একটি স্বাধীন জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক। কারণ রাজনীতি ছাড়া কোনো জাতি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। প্রতিযোগিতামূলক বর্তমান বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্রের রোডম্যাপেই চলতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা তাদের দায়িত্ব পালন করলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজেদের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করবে। তখন রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্যও হ্রাস পাবে। আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা রাজনীতির সঠিক রোডম্যাপে চলেন কি না- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন