বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ, ২০১৬

আইনের শাসন বনাম শাসনের আইন


সংবিধান মোতাবেক বিচারপতি কে. এম. হাসান যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা না হতে পারেন এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নানাবিধ জটিলতা শুরু করলে বিচারপতি হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার অপারগতা জানিয়ে চিঠি, ২৮ অক্টোবর-২০০৬ লগি-বৈঠার তা-ব, তদুপরি ২২ জানুয়ারি ২০০৭ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও ৩ জানুয়ারি ২০০৭ আওয়ামী লীগ সকল প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহারে একটি পরিকল্পিত কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পরিস্থিতিকে ভারসাম্যহীন করে দেয়া হয়। ব্যক্তিত্বহীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন (শেখ হাসিনার ভাষায় ইয়েস উদ্দিন) সততা ও সাহসিকতার সহিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারায়, তার অসহায়ত্তের কারণেই সিভিল সোসাইটির ছদ্মাবরণে সেনাবাহিনী ১১ জানুয়ারি-২০০৭ ক্ষমতা দখল করে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং বলেন যে - “এটা আমাদের আন্দোলনের ফসল”। এছাড়াও বিমানবন্দরে তিনি বলেন যে, “এ সরকার যাহাই করুক না আমি তার বৈধতা দিব”। কিন্তু খালেদা জিয়া শপথ অনুষ্ঠানে যান নাই বরং তাকে জেলে দেয়ার পরও তিনি বলেছেন যে, “৯ মাস কেন ৯ বছর জেলে থাকলেও” অবৈধ সরকারের সাথে আপোষ নয়। খালেদা জিয়াকে বাগে আনার জন্য ১/১১ সরকার চেষ্টা করতে থাকে এবং তার ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য তার পুত্র তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকো ও ভাই শামীম ইসকান্দারকে গ্রেফতার করে। শুধু তাই নয় ১/১১ সরকার তাদের বৈধতার জন্য কিছু “খয়ের খাঁ” (সাধারণ ভাষায় যাদের দালাল বলা হয়) সৃষ্টি করে। ঐ সময় ১/১১ সরকারের পক্ষে যারা কথা বলেন তাদের অনেকেই এখন আবার দুই নেত্রীর আশপাশেই স্থান করে নিয়েছে। উল্লেখ্য, এক সময় যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অশালীন ভাষায় কটূক্তি করেছেন তারাও এখন শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই করে নিয়েছেন।
১/১১ সরকারের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন, সেনাপ্রধান মঈন উদ্দিন এবং ৯ম ডিভিশনের জিওসি মাসুদ উদ্দিনের প্রভাবে সরকার পরিচালিত হতো বিধায় এ সরকার “উদ্দিন” সরকার নামে পরিচিতি লাভ করে। এ সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে ক্ষমতায় আসলেও ক্ষমতায় এসেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তৎসময়ে ব্যারিস্টার রফিকুল হকের ভাষায় দুদকের নাম শুনলে ২ বৎসরের শিশুও আঁতকে উঠতো। হাইকোর্টের বিচারপতিরা পর্যন্ত কলম ধরতেন না। শুধুমাত্র বিচারপতি এস এ এন মোমিনুর রহমান ও বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদার ১/১১ সরকারের নির্যাতিতদের পক্ষে আইনের মুখ খোলেন। তৎকালীন রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের নির্যাতিতদের পক্ষে তারাই হাইকোর্টের বন্ধ দরজা খোলেছেন। তৎসময়ে প্রধান বিচারপতি মোঃ রুহুল আমিন শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন নাই বরং তাদের সাথে হাত মিলিয়ে ছিলেন। হাইকোর্টে তামাশা করে তখন তাকে মেজর রুহুল আমিন বলা হতো। 
১/১১ অবৈধ সরকারের সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে ১৯/১/২০১৬ বিদায় সংবর্ধনায় লিখিত বক্তব্যে ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকে জঙ্গি শাসন হিসেবে অভিহিত করে বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদার বলেন, “ওই সময়টা এক ধরনের শাসন ছিল যাকে ব্রুটল (BROUT LAW)  বলা চলে। সে সময় আমার ওপর ফৌজদারি বেঞ্চের দায়িত্ব পড়েছিল। যেদিক দিয়ে জামিন দেই না কেন, আপিল বিভাগে গিয়ে স্থগিত। খন্দকার মাহবুব হোসেন সাহেব তো একবার সাবমিশন করলেন যে ‘আমাকে স্বাভাবিক জামিন দিন - আইন প্রতিষ্ঠার দরকার নেই’। যে পথে জনগণকে পথ দেখাই না কেন - আপিল বিভাগ খড়গ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু যে পথ করতে জানে তার পথ রুখবে কে? ৫৬১-এ তে চলে গেলাম। যেটি হাইকোর্টের একক অধিকার। বর্তমানের প্রায় সব রাজনৈতিক নেতাকর্মী জামিন পেল। আবার পথ হলো নির্বাচনের। ওই সময় যদি আপিল বিভাগের দিকে তাকিয়ে থাকতাম তবে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মুক্ত আকাশে বিচরণ করতে পারতেন না। মুচলেকা দিয়ে কালো আইনের তাঁবেদার হয়ে বাঁচতে হতো। একজন বিচারককে বুঝতে হবে কোনটা আইনের শাসন আর কোনটা শাসনের আইন”।
তৎসময়ে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন যে, আমরা ন্যায় বিচারে অক্ষম, আহ্কামুল হাকেমিনের নিকট বিচার দেন।
উল্লেখ্য, নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে বিএনপি মহানুভবতা দেখিয়ে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনকে ০৬/৯/২০০২ তারিখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যে দূরদর্শী ভূমিকা রাখা দরকার ছিল সে ধরনের ব্যক্তিত্ব ছিল না বলেই ২৯/১০/২০০৬ তারিখে তিনি নিজেই প্রধান উপদেষ্টার পদে অধিষ্ঠিত হলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হতে থাকে।
মাইনাস টু ফর্মুলা সফলের লক্ষ্যে দুই পরিবারের অনুগতদের সাজা দিয়ে অযোগ্য ঘোষণার মূল লক্ষ্য ছিল কিংস পার্টি গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে দীর্ঘায়িত করা। সে সময়ে ড. ইউনূস নিজেও একটি রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করে কোন সাড়া পান নাই। অন্যদিকে কিংস পার্টির মুখপাত্র হিসেবে ফেরদৌস আহাম্মদ কোরেশী তৎপরতা চালিয়েও অগ্রসর হতে পারেন নাই। তবে বিএনপি/আওয়ামী লীগ থেকেও বড় বড় হোমড়া-চোমড়ারা কিংস পার্টির দিকে এগুতে থাকে। কিন্তু তারা সংস্কারবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়ায় নেতাকর্মীদের দ্বারা নানাভাবে নাজেহাল হওয়ার কারণে কিংস পার্টি সংঘবদ্ধ হতে পারে নাই।
তৃণমূলের নেতাকর্মী ও জেলে আবদ্ধ নেতাদের সমর্থকরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজ নিজ অনুগত নেত্রীর প্রতি অবিচল থাকে। এজন্য শহীদ জিয়ার মাজারে সংস্কারপন্থীদের জুতা মারার ঘটনাও ঘটেছে এবং পরিতাপের বিষয় এই যে, পরবর্তীতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চেয়ে সংস্কারবাদীরাই বিএনপিতে বেশি মূল্যায়িত হয়েছে; ২০১৪-১৫ আন্দোলনেও সংস্কারবাদীদের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা না গেলেও দলে তাদের অবস্থা অটুট রয়েছে। এতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা থাকলেও তারাই জিয়া পরিবারের প্রতি এখনো আস্থায় অবিচল।
তত্ত্ব¡াবধায়ক ব্যানারে ১/১১ সরকার দুটি দলের নেতৃবৃন্দকে দুদকের মোকদ্দমায় জড়িত করলেও সাজার প্রশ্নে বিএনপির দিকে এগুতে থাকে। ১/১১ সরকার জনসমর্থন হারিয়ে নিজেদের Exit  খুঁজতে থাকে। পরবর্তীতে ২৮ ডিসেম্বর/২০০৮ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতা গ্রহণের পরও চলে বিরোধী দলের ওপর স্টিম রোলার; যে রোলার এখনো ক্ষান্ত হয় নাই।
আওয়ামী ক্ষমতায় আসার পরই প্রধানমন্ত্রীসহ তাদের মামলার জট একে একে খুলতে থাকে। কিন্তু দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতাদের মোকদ্দমায় একের পর এক সাজা হতে থাকে এবং সে ধারা বিএনপিপন্থীদের প্রশ্নে এখনো অব্যাহত রয়েছে। আদালত মানুষের শেষ আশ্রয়। কিন্তু সে আদালত যখন ক্ষমতাসীনরা দখল করে তখন মানুষের আস্থা অনাস্থায় পরিণত হয় এবং দিন দিন নিরপেক্ষতার প্রশ্নে আদালতের ওপর গণমানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। যা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধান বিচারপতি প্রায়ই বক্তব্য দিয়ে বিচার বিভাগের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয়; কেউ সমালোচনা করলে তাকে স্বশরীরেও আদালতে ডাকা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কাউকেও গুরু বা কাউকেও লঘু সাজা দিয়েছেন, এটাও হয়েছে (গুরু ও লঘু) রাজনৈতিক বিবেচনার বলেই কোর্ট প্রাঙ্গণের আকাশ বাতাসের বক্তব্য।
মাইনাস টু নিয়ে ১/১১-এর একটি অংশ এগুতে থাকলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলিয়েই তারা EXIT  খুঁজতে থাকে এবং সেভাবেই সফল হয়। এতে একদিকে আওয়ামী লীগ তাদের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পেরেছে, অন্যদিকে বিএনপি তথা জিয়া পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার পথ খোলা হয়েছিল। শেষাব্দি ১/১১ নির্যাতনের নিপীড়নের স্টিম রোলারে বিএনপি ও জিয়া পরিবারকে টার্গেট করা হয়েছে; যা কার্যক্রম এখনো অব্যাহত। তদুপরি দেশনেত্রী খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের প্রশ্নে একচুল আপোষ করে নাই। তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায় মাকে হারিয়েছেন, অবরুদ্ধ অবস্থায় নিজ পুত্রকে হারিয়েছেন, জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে ১/১১ সরকার পঙ্গু করে দিয়েছে। তদুপরি খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের প্রশ্নে অবিচল ছিলেন এবং এখনো আছেন। ১/১১ পরিসমাপ্তি ঘটলে জিয়া পরিবারের ওপরই সরকারের আক্রোশ ও তারাই সরকারের একমাত্র টার্গেট। ফলশ্রুতিতে খালেদা জিয়ার ওপর মামলার পর মামলা এবং আইনি প্রক্রিয়ার ছদ্মাবরণে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। 
এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads