রাজনীতিতে মতভেদ থাকবেই। দলীয় রাজনীতিতে আরও বেশি মতভেদ থাকবে। মতভেদ যদি নাই থাকবে তাহলে তো সকলে মিলে একটি দলই করতেন। তাহলে আর এতগুলো দলের প্রয়োজন হয় কেন? বিদেশী নীতিতেও মতভেদ থাকবে। সে জন্যই এক সময় দেখেছি মার্কিনপন্থী ও সোভিয়েটপন্থী। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর দেখা গেল চীনাপন্থী। মিনি পরাশক্তি হিসাবে উত্থিত হওয়ার পর এখন অনেকেই হচ্ছে ভারতপন্থী। এ ধরনের মতভেদ তো থাকবেই। কোন মতবাদটি ভাল, কোন মতবাদটি খারাপ, সেটির নিষ্পত্তি হবে যুক্তি দিয়ে, তর্ক দিয়ে। সেই পথে না গিয়ে কেউ যদি বস্তিবাসির মত দেশী বা বিদেশী পলিটিশিয়ানকে খিস্তি খেউর করেন, অশ্রাব্য গালিগালাজ করেন তাহলে তিনি নিজেকে কোন্ পর্যায়ে নামিয়ে ফেলেন সেটা চিন্তা করেন না।
আমেরিকার সাথে আওয়ামী সরকারের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রীর কথাবার্তা থেকে এগুলো এখন বোঝা যায়। কিছুদিন আগেও দুই দেশের কিছুটা চিড় ধরা সম্পর্কের খবর রাখতেন শুধুমাত্র সমাজের ওপর তলার মানুষ জন। কিন্তু এখন খবরের কাগজ পড়েন বা টেলিভিশনের নিউজ শোনেন, এমন মানুষও আওয়ামী মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন জানেন। এটিকেও আমরা অস্বাভাবিক বলবো না। ইন্ডিয়া এবং আওয়ামী লীগ হরিহর আত্মা। সেটিকে আমরা সমর্থন করি আর নাই করি, আওয়ামী লীগ সেই ধরনের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে, যেতেই পারে। জনগণ পছন্দ না করলে নির্বাচনের মাধ্যমে বা গণআন্দোলনের মাধ্যমে তাদেরকে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাই বলে একটি দেশের রাষ্ট্রদূতকে ‘কাজের বেটি’ বলা বা কোন দেশের মন্ত্রী বা সহকারী মন্ত্রীকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলা কোন ধরনের রাজনীতি সেটি কারো বোধগম্য নয়। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন যে, আমরা যতই শর্ত পূরণ করি না কেন, আমেরিকা আমাদেরকে আর জিএসপি সুবিধা দেবে না। বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক, তিনি এ ধরনের মন্তব্য করতেই পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুই নম্বর ব্যক্তি, জেনারেল সেক্রেটারি এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হঠাৎ করে রাজনৈতিক সমালোচনায় সভ্যতা এবং ভব্যতা এ ভাবে বিসর্জন দিলেন কেন?
আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এই তিন দিনে সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা তার কোন মন্ত্রীর সাথে নিশা দেশাইয়ের কোন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি বিরল ঘটনা। তিনি দেখা করেছেন দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে। আরও দেখা করেছেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দল বলে নিজেদেরকে জাহির করা জাতীয় পার্টির একাংশের নেত্রী বেগম রওশন এরশাদের সাথে। সরকারের কোনো পর্যায়ের কারো সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। হতে পারে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে সরকারের কোন ফাংশনারীই তার সাথে দেখা করেনি। এই দেখা না করাটাও একান্তভাবে তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এসব ব্যাপার ভাল হচ্ছে না খারাপ হচ্ছে, সেটি বুঝবে সরকার এবং বুঝবে জনগণ। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশরাফ নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য এবং উপহাস করবেন কেন? আশরাফুল ইসলাম বলেছেন যে, নিশা দেশাই ‘চার আনার মন্ত্রী’ও নন। তিনি ‘দুই আনার মন্ত্রী’। সেই দুই আনার মন্ত্রীর সামনে বেগম খালেদা জিয়া নাকি বসে থাকেন। উদ্দেশ্য, নিশা দেশাইরা যদি শেখ হাসিনাকে সরিয়ে খালেদা জিয়াকে পাওয়ারে বসান। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বলে ব্যঙ্গ তামাশা করেছেন। বলেছেন, একজন কাজের মেয়ে খালেদা জিয়াকে পাওয়ারে বসাতে পারবে না।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনাকে আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আশরাফুল ইসলাম কেন কাজের মেয়ে বললেন সে রহস্যও বেশ চিত্তাকর্ষক। কাজের মেয়ে মর্জিনা সৈয়দ আশরাফ ও তার গিন্নিকে নাকি প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আম্মা, টেলিভিশনে ওই ব্যাটারা প্রায়ই আমার নাম বলে কেন?” সৈয়দ আশরাফ, “ওরা তোর নাম বলে না। ওরা বলে মজিনা। আর তুই শুনিস মর্জিনা।” সৈয়দ আশরাফ আরও বলেন, “এই সব কাজের মেয়ে মর্জিনা (মজিনা) কোন দিন বেগম জিয়াকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে না।”
দুই
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শুধু মাত্র আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারিই নন, তিনি একজন মন্ত্রীও বটে। তাকে তো ডিপ্লোম্যাটিক এটিকেট বা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলতেই হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ধারও ধারেননি। এটি কি তার অপরিপক্কতার পরিচায়ক? নাকি ক্ষমতার মদমত্ততায় দুর্বিনীত ঔদ্ধত্যের পরিচয়? কূটনীতির জগতে আপনি দৃঢ় হতে পারেন, এমনকি দৃঢ়তার সাথে আপনার বিদেশী প্রতিপক্ষকে পাল্টা জবাবও দিতে পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আপনার ভাষা হবে স্পষ্ট, সুর হবে নরম। আর যদি মনে করেন যে, আপনি সেই দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাবেন তা হলে সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। নিশা দেশাইকে তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। তার বয়স, তার বৈবাহিক স্ট্যাটাস এবং তার নৃতাত্ত্বিক উৎস নিয়েও কথা বলেছেন। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে যে, তিনি মন্ত্রী হোন আর না হোন, সভ্যতার সূতিকাগার ইংল্যান্ডে তিনি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাটকে কি এ সব ভাষায় আক্রমণ করা যায়? নিশা দেশাই বিবাহিতা কি কুমারী সেই প্রসঙ্গ সৈয়দ আশরাফ তুলবেন কেন? নিশা দেশাই ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিনা, তার বয়স কত, তিনি পুরুষ না রমণী, তিনি কি দুই আনা নাকি ষোল আনার মন্ত্রী, এ সব কিছুই এখানে প্রাসংগিক নয়। কঠোর বাস্তব হলো এই যে, তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন অবিবাহিতা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নিশা দেশাই হিসেবে নয়। তিনি এসেছিলেন মার্কিন সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করতে। ঢাকায় তিনি কি বলেছেন, কাদের সাথে তিনি দেখা করেছেন, এগুলো কোনটাই তার ব্যক্তিগত ক্যাপাসিটিতে করেননি। এগুলো সব কিছুই তিনি করেছেন প্রসিডেন্ট ওবামার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফ যা বলেছেন সেটি আরও কুৎসিত। সৈয়দ আশরাফের কাজের বেটির নাম মর্জিনা। আশরাফ যখন মর্জিনাকে বলেন যে, হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে চায় মজিনা তখন মর্জিনা এতই রেগে গিয়েছিল যে সে তার নামই পাল্টে ফেলতে চেয়েছিল। কারণ তার নামের সাথে মজিনা নামের অনেক মিল রয়েছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে। সেটি হলো, To hit below the belt. সৈয়দ আশরাফ ড্যান মজিনাকে ঠিক সেখানেই আঘাত করেছেন। সৈয়দ আশরাফই তো বলেছেন যে, বাংলাদেশে মজিনার চাকরি শেষ। তিনি শীঘ্রই আমেরিকা ফিরে যাচ্ছেন। এমন একটি সময়ে একজন মানুষকে এভাবে ইনসাল্ট না করলেই কি চলতো না?
তিন
আবুল হাসান মাহমুদ আলী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট। তিনিই বলুন, সৈয়দ আশরাফ যেভাবে বিদেশীদেরকে নিয়ে অপমানজনক ভাষায় কথা বলছেন, সে ভাবে কি বিদেশ নীতি পরিচালনা করা হয়? আমরা আগেই বলেছি যে, দুটো স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে মত ভিন্নতা থাকতেই পারে। বিশ্বায়নের গতি যত বাড়বে আন্তঃদেশীয় নির্ভরশীলতা এবং জটিলতাও তত বাড়বে। দুটি দেশের মত ভিন্নতা যত বাড়বে, দুটি দেশকে সেই ভিন্নতার প্রণালী দিয়েই পথ মাড়াতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ হবে জটিলতার মধ্য দিয়ে দৃঢ়তার সাথে বন্ধুত্বের হাত ধরে রাখা। ভারতের মত দেশ যেমন বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য খুঁজে পেয়েছে আমরাও তেমনি পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনায় মতদ্বৈধতার মাঝে মতৈক্য খুঁজবো।
আরও অবাক ব্যাপার হলো এই যে, সৈয়দ আশরাফের এই অপমানজনক উক্তিতে দুই দেশের সম্পর্কে যে ফাটল ধরলো সে ফাটল দূর করার কোন প্রচেষ্টাই কোন মহল থেকে করা হয়নি। সরকারের কোন মহল থেকেই তার এ মন্তব্য প্রত্যাহার করা হয়নি, কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি বা দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি। এমনও বলা যেতে পারতো যে, আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি মুহূর্তের আবেগ বা উত্তেজনায় এ সব কথা বলে ফেলেছেন। এই মন্তব্যের পর বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু সেই অপমানজনক ও ক্ষতিকর মন্তব্য সম্পর্কে সরকার একেবারেই নির্বিকার। সুতরাং ধরে নেয়া যায় যে, সরকার জেনে শুনেই সৈয়দ আশরাফের মুখ দিয়ে এ কথা বলিয়েছে।
চার
এই লেখা যখন প্রায় শেষ করে এনেছি তখন অর্থাৎ শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আরও সোজাসাপ্টা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের জন্য আমেরিকা অনেক কিছু করেছে। কিন্তু নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। প্রসঙ্গত তিনি বলেন যে, ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে চেয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু পারেনি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন যে, আমেরিকার একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করতে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তার পরিচালনা পরিষদের কোন মিটিং না করে এককভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, কোন একটি দেশ, সে যতই বড় হোক না কেন, সে বা তারা বাংলাদেশের পাশে না আসলেও বাংলাদেশ চলতে পারবে। বিশ্ব ব্যাংক ছাড়াই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ নাকচ করেছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। যুক্তরাষ্ট্রের ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার সাম্প্রতিক মালয়েশিয়া সফর সম্পর্কে অবহিত করতে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স¤পর্কের বিষয়ে আলোকপাত করেন।
প্রধানমন্ত্রীর এ সব বক্তব্যের জবাব দিয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। সেই জবাবে তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পদ্মা সেতুর সমর্থক ছিল এবং বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে এ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্র প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র মনিকা এল শাই শুক্রবার রাতে বলেন, সত্যিকার ঘটনা হল- বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক কানেকটিভিটির গুরুত্ব অনুধাবন করে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পকে সামনে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের কাজ করার একটা উপায় খুঁজে পাওয়ার জোরালো প্রবক্তা ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয় সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র সব রকমের চেষ্টা করেছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সম্পর্কে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবার জানা। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল এ নিয়ে পরিষ্কার মত প্রকাশ করেছেন। তারপর নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট তার সিনেট শুনানিতে এ ব্যাপারে বলেছেন। সর্বশেষ নিশা বিসওয়াল বলেছেন, নির্বাচন কবে হবে সেটা বাংলাদেশের জনগণ নির্ধারণ করবে।
এ সব বাদানুবাদে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হচ্ছে। বাদানুবাদটি হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আমেরিকা এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
আমেরিকার সাথে আওয়ামী সরকারের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রীর কথাবার্তা থেকে এগুলো এখন বোঝা যায়। কিছুদিন আগেও দুই দেশের কিছুটা চিড় ধরা সম্পর্কের খবর রাখতেন শুধুমাত্র সমাজের ওপর তলার মানুষ জন। কিন্তু এখন খবরের কাগজ পড়েন বা টেলিভিশনের নিউজ শোনেন, এমন মানুষও আওয়ামী মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন জানেন। এটিকেও আমরা অস্বাভাবিক বলবো না। ইন্ডিয়া এবং আওয়ামী লীগ হরিহর আত্মা। সেটিকে আমরা সমর্থন করি আর নাই করি, আওয়ামী লীগ সেই ধরনের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে, যেতেই পারে। জনগণ পছন্দ না করলে নির্বাচনের মাধ্যমে বা গণআন্দোলনের মাধ্যমে তাদেরকে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাই বলে একটি দেশের রাষ্ট্রদূতকে ‘কাজের বেটি’ বলা বা কোন দেশের মন্ত্রী বা সহকারী মন্ত্রীকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলা কোন ধরনের রাজনীতি সেটি কারো বোধগম্য নয়। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন যে, আমরা যতই শর্ত পূরণ করি না কেন, আমেরিকা আমাদেরকে আর জিএসপি সুবিধা দেবে না। বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক, তিনি এ ধরনের মন্তব্য করতেই পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুই নম্বর ব্যক্তি, জেনারেল সেক্রেটারি এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হঠাৎ করে রাজনৈতিক সমালোচনায় সভ্যতা এবং ভব্যতা এ ভাবে বিসর্জন দিলেন কেন?
আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এই তিন দিনে সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা তার কোন মন্ত্রীর সাথে নিশা দেশাইয়ের কোন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি বিরল ঘটনা। তিনি দেখা করেছেন দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে। আরও দেখা করেছেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দল বলে নিজেদেরকে জাহির করা জাতীয় পার্টির একাংশের নেত্রী বেগম রওশন এরশাদের সাথে। সরকারের কোনো পর্যায়ের কারো সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। হতে পারে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে সরকারের কোন ফাংশনারীই তার সাথে দেখা করেনি। এই দেখা না করাটাও একান্তভাবে তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এসব ব্যাপার ভাল হচ্ছে না খারাপ হচ্ছে, সেটি বুঝবে সরকার এবং বুঝবে জনগণ। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশরাফ নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য এবং উপহাস করবেন কেন? আশরাফুল ইসলাম বলেছেন যে, নিশা দেশাই ‘চার আনার মন্ত্রী’ও নন। তিনি ‘দুই আনার মন্ত্রী’। সেই দুই আনার মন্ত্রীর সামনে বেগম খালেদা জিয়া নাকি বসে থাকেন। উদ্দেশ্য, নিশা দেশাইরা যদি শেখ হাসিনাকে সরিয়ে খালেদা জিয়াকে পাওয়ারে বসান। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বলে ব্যঙ্গ তামাশা করেছেন। বলেছেন, একজন কাজের মেয়ে খালেদা জিয়াকে পাওয়ারে বসাতে পারবে না।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনাকে আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আশরাফুল ইসলাম কেন কাজের মেয়ে বললেন সে রহস্যও বেশ চিত্তাকর্ষক। কাজের মেয়ে মর্জিনা সৈয়দ আশরাফ ও তার গিন্নিকে নাকি প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আম্মা, টেলিভিশনে ওই ব্যাটারা প্রায়ই আমার নাম বলে কেন?” সৈয়দ আশরাফ, “ওরা তোর নাম বলে না। ওরা বলে মজিনা। আর তুই শুনিস মর্জিনা।” সৈয়দ আশরাফ আরও বলেন, “এই সব কাজের মেয়ে মর্জিনা (মজিনা) কোন দিন বেগম জিয়াকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে না।”
দুই
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শুধু মাত্র আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারিই নন, তিনি একজন মন্ত্রীও বটে। তাকে তো ডিপ্লোম্যাটিক এটিকেট বা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলতেই হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ধারও ধারেননি। এটি কি তার অপরিপক্কতার পরিচায়ক? নাকি ক্ষমতার মদমত্ততায় দুর্বিনীত ঔদ্ধত্যের পরিচয়? কূটনীতির জগতে আপনি দৃঢ় হতে পারেন, এমনকি দৃঢ়তার সাথে আপনার বিদেশী প্রতিপক্ষকে পাল্টা জবাবও দিতে পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আপনার ভাষা হবে স্পষ্ট, সুর হবে নরম। আর যদি মনে করেন যে, আপনি সেই দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাবেন তা হলে সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। নিশা দেশাইকে তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। তার বয়স, তার বৈবাহিক স্ট্যাটাস এবং তার নৃতাত্ত্বিক উৎস নিয়েও কথা বলেছেন। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে যে, তিনি মন্ত্রী হোন আর না হোন, সভ্যতার সূতিকাগার ইংল্যান্ডে তিনি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাটকে কি এ সব ভাষায় আক্রমণ করা যায়? নিশা দেশাই বিবাহিতা কি কুমারী সেই প্রসঙ্গ সৈয়দ আশরাফ তুলবেন কেন? নিশা দেশাই ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিনা, তার বয়স কত, তিনি পুরুষ না রমণী, তিনি কি দুই আনা নাকি ষোল আনার মন্ত্রী, এ সব কিছুই এখানে প্রাসংগিক নয়। কঠোর বাস্তব হলো এই যে, তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন অবিবাহিতা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নিশা দেশাই হিসেবে নয়। তিনি এসেছিলেন মার্কিন সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করতে। ঢাকায় তিনি কি বলেছেন, কাদের সাথে তিনি দেখা করেছেন, এগুলো কোনটাই তার ব্যক্তিগত ক্যাপাসিটিতে করেননি। এগুলো সব কিছুই তিনি করেছেন প্রসিডেন্ট ওবামার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফ যা বলেছেন সেটি আরও কুৎসিত। সৈয়দ আশরাফের কাজের বেটির নাম মর্জিনা। আশরাফ যখন মর্জিনাকে বলেন যে, হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে চায় মজিনা তখন মর্জিনা এতই রেগে গিয়েছিল যে সে তার নামই পাল্টে ফেলতে চেয়েছিল। কারণ তার নামের সাথে মজিনা নামের অনেক মিল রয়েছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে। সেটি হলো, To hit below the belt. সৈয়দ আশরাফ ড্যান মজিনাকে ঠিক সেখানেই আঘাত করেছেন। সৈয়দ আশরাফই তো বলেছেন যে, বাংলাদেশে মজিনার চাকরি শেষ। তিনি শীঘ্রই আমেরিকা ফিরে যাচ্ছেন। এমন একটি সময়ে একজন মানুষকে এভাবে ইনসাল্ট না করলেই কি চলতো না?
তিন
আবুল হাসান মাহমুদ আলী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট। তিনিই বলুন, সৈয়দ আশরাফ যেভাবে বিদেশীদেরকে নিয়ে অপমানজনক ভাষায় কথা বলছেন, সে ভাবে কি বিদেশ নীতি পরিচালনা করা হয়? আমরা আগেই বলেছি যে, দুটো স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে মত ভিন্নতা থাকতেই পারে। বিশ্বায়নের গতি যত বাড়বে আন্তঃদেশীয় নির্ভরশীলতা এবং জটিলতাও তত বাড়বে। দুটি দেশের মত ভিন্নতা যত বাড়বে, দুটি দেশকে সেই ভিন্নতার প্রণালী দিয়েই পথ মাড়াতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ হবে জটিলতার মধ্য দিয়ে দৃঢ়তার সাথে বন্ধুত্বের হাত ধরে রাখা। ভারতের মত দেশ যেমন বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য খুঁজে পেয়েছে আমরাও তেমনি পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনায় মতদ্বৈধতার মাঝে মতৈক্য খুঁজবো।
আরও অবাক ব্যাপার হলো এই যে, সৈয়দ আশরাফের এই অপমানজনক উক্তিতে দুই দেশের সম্পর্কে যে ফাটল ধরলো সে ফাটল দূর করার কোন প্রচেষ্টাই কোন মহল থেকে করা হয়নি। সরকারের কোন মহল থেকেই তার এ মন্তব্য প্রত্যাহার করা হয়নি, কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি বা দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি। এমনও বলা যেতে পারতো যে, আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি মুহূর্তের আবেগ বা উত্তেজনায় এ সব কথা বলে ফেলেছেন। এই মন্তব্যের পর বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু সেই অপমানজনক ও ক্ষতিকর মন্তব্য সম্পর্কে সরকার একেবারেই নির্বিকার। সুতরাং ধরে নেয়া যায় যে, সরকার জেনে শুনেই সৈয়দ আশরাফের মুখ দিয়ে এ কথা বলিয়েছে।
চার
এই লেখা যখন প্রায় শেষ করে এনেছি তখন অর্থাৎ শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আরও সোজাসাপ্টা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের জন্য আমেরিকা অনেক কিছু করেছে। কিন্তু নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। প্রসঙ্গত তিনি বলেন যে, ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে চেয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু পারেনি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন যে, আমেরিকার একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করতে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তার পরিচালনা পরিষদের কোন মিটিং না করে এককভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, কোন একটি দেশ, সে যতই বড় হোক না কেন, সে বা তারা বাংলাদেশের পাশে না আসলেও বাংলাদেশ চলতে পারবে। বিশ্ব ব্যাংক ছাড়াই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ নাকচ করেছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। যুক্তরাষ্ট্রের ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার সাম্প্রতিক মালয়েশিয়া সফর সম্পর্কে অবহিত করতে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স¤পর্কের বিষয়ে আলোকপাত করেন।
প্রধানমন্ত্রীর এ সব বক্তব্যের জবাব দিয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। সেই জবাবে তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পদ্মা সেতুর সমর্থক ছিল এবং বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে এ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্র প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র মনিকা এল শাই শুক্রবার রাতে বলেন, সত্যিকার ঘটনা হল- বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক কানেকটিভিটির গুরুত্ব অনুধাবন করে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পকে সামনে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের কাজ করার একটা উপায় খুঁজে পাওয়ার জোরালো প্রবক্তা ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয় সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র সব রকমের চেষ্টা করেছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সম্পর্কে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবার জানা। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল এ নিয়ে পরিষ্কার মত প্রকাশ করেছেন। তারপর নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট তার সিনেট শুনানিতে এ ব্যাপারে বলেছেন। সর্বশেষ নিশা বিসওয়াল বলেছেন, নির্বাচন কবে হবে সেটা বাংলাদেশের জনগণ নির্ধারণ করবে।
এ সব বাদানুবাদে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হচ্ছে। বাদানুবাদটি হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আমেরিকা এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন