পরের জন্য গর্ত খুঁড়লে সে গর্তে এক সময় নিজেকেই পড়তে হয়। আওয়ামী লীগ সম্ভবত এই অমোঘ সত্যটি ভুলে গেছে। প্রশাসনে তাদের দলীয়করণ এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, এখন প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অফিসার আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারের মত কথা বলছেন। এরা কি ভাবছেন যে, আওয়ামী লীগ রোজ কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে? ভাবে সাবে তাই মনে হচ্ছে। আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগও সেই রকমই ভাবছে। ৫ই জানুয়ারীর আগে তারা ফিরিস্তি দিত, ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা কি কি কাজ করবে। তখনও কিন্তু ৫ই জানুয়ারী ক্ষমতা ছিনতাই করার সময় আসেনি। কিন্তু তাদের মাথার ভেতরে ঐ চিন্তাই ছিল। তাই জনসমর্থনের তোয়াক্কা না করে নেহায়েত বাহুবলে তারা ক্ষমতার সিংহাসন জবর দখল করেছে। তারা যদি জোর করেও ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হয় তা হলেও তারা ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার দাবী করতে পারে। এখন তারা ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কথা তো বলছেই, উপরন্তু ২০২১ সাল পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনা সাজিয়েছে। তাই ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা কি কি করবে, সেগুলো তারা বলে বেড়াচ্ছে। অবাক হই তখনই যখন দেখি যে ইদানীং তারা ২০৪১ সাল পর্যন্ত কি কি করবে তার পরিকল্পনাও শোনাচ্ছে। তা হলে কি তারা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? তাই যদি না হবে তা হলে ২০৪১ সালের কথা তারা বলে কেন? অবশ্য এ বিষয়টি আমার মাথায় আসে না যে, ২০৪১ সাল আসতে এখনও ২৭ বছর বাকি। এই ২৭ বছরে শেখ হাসিনার বয়স হবে ৯৪ বছর। তা হলে শেখ হাসিনা কি ৯৪ বছর বয়স পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন? নাকি থাকতে চান?
দৃশ্যত সেটাই মনে হয়, সেই ধরনের চিন্তা ভাবনাই শাসক দলের মাথায় ঘোরাফেরা করছে। এ ব্যাপারে আমরা কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি। এ সব ঘটনা প্রমাণ করে যে, এই সরকার প্রশাসন যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অফিসারকে দলীয় ক্যাডার বানিয়েছে। তারা এত ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে তারাও রোজ কেয়ামত পর্যন্ত চাকুরি করবে। একটি বিষয়ে আওয়ামী লীগ বা তাদের বশংবদ এ সব অফিসার ভেবে দেখেনি। সেটি হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এরা কোথায় যাবেন? হিন্দি ছবিতে প্রায়শই একটি কথা বলা হয়। সেটি হলো, ‘এ্যায়সা দিন নেহি রাহে গা’। আওয়ামী লীগ পড়ে গেলে এরা পালাবারও পথ পাবে না। কেন পাবেনা সেটির জন্য নীচে কয়েকটি ছোট ছোট ঘটনা উল্লেখ করছি।
গত সোমবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘ধৈর্য ধরুন, ধৈর্য ধরুন। নির্দিষ্ট সময় পর পরই নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে জিতলে ক্ষমতায় যাবেন। জনগণ তখন আপনার কথা শুনবে। আমরাও তখন আপনার নির্দেশ মতো কাজ করব।’ তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, এই সরকার সব মানুষের সরকার নয়, তার এবং তাদের মতো কিছু মানুষের সরকার। দৈনিক প্রথম আলোর কলাম মোতাবেক এই পুলিশ অফিসারের নাম জনাব আবদুল। আবদুল সাহেবের ভাষায়, ‘আমার সরকার গণতান্ত্রিক সরকার। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা গণতন্ত্রের শীর্ষে অবস্থান করছি। পুলিশকে ঢিল মারা, গাড়িতে আগুন দেয়া গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। পুলিশ কমিশনার জনাব আবদুল আরও বলেন, ‘অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে এ সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা এসেছে। এই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। সব নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক ছিল। ভালো যত কাজ আছে সেখানেও বিতর্ক আছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নতির হাতিকে কিছু দুষ্কৃতকারী পেছনের দিক থেকে টেনে ধরতে চাচ্ছে। তারা উন্নতির এই হাতিকে আটকাতে পারবে না।’ তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘কেউ যদি পুলিশের দিকে ঢিল ছোঁড়ে, পুলিশের লাঠি তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।’ (দৈনিক প্রথম আলো-১০.১২.১৪ তারিখ)। দীর্ঘ ৪০ বছর হলো সাংবাদিকতা করছি এবং কলাম লিখছি। কিন্তু কোন পুলিশ অফিসার বা অন্য কোন অফিসারের মুখে এ রকম সরাসরি দলীয় রাজনীতির কথা শুনিনি।
দুর্নীতি দমন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাদের কাজ হলো, দুর্নীতি দমন করা। শুধু ঘুষ খেলেই দুর্নীতি হয় না। অনিয়ম করলেও দুর্নীতি হয়। স্বজন প্রীতি করলেও দুর্নীতি হয়। তেমনি কোন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বড়সড় অফিসার যদি দলবাজি করেন তা হলে তিনি শুধু দুর্নীতিই করেন না। তিনি রীতি মত সংবিধান লঙ্ঘন করেন। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন তা হলে সাধারণ মানুষ যায় কোথায়? তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। কমিশনের সদস্য জনাব শাহাবুদ্দিন চুপ্পু কমিশনের অস্থায়ী চেয়ারম্যান। কয়েকদিন আগে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে শাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যে দুর্নীতি হয়েছে, তা বিশ্ববাসী জানেন। ওই সময় আমরা চারবার দুর্নীতিতে চ্যা¤িপয়ন হয়েছি। আপনাদের আমলের দুর্নীতিকে আপনারা চোখে দেখেননি। আপনারা তা আলমারিতে আটকে রেখেছিলেন।’ (দৈনিক ইনকিলাব-১০.১২.১৪ ইং )।
দুই
দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন চুপ্পু টিআইবির ওপরও এক হাত নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘টিআইবি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এরা ঘরের শত্রু বিভীষণ। তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, দুদককে যে দায়মুক্তি কমিশন বলে আখ্যায়িত করেছেন তার প্রমাণ আপনাকে দিতে হবে। তিনি খালেদা জিয়াকে আয়নায় নিজের চেহারা দেখার পরামর্শ দেন। কারণ আপনার আমলেই বিশ্বে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিপয়ন হয়েছিল।’ (দৈনিক সংগ্রাম-১০.১২.১৪ ইং)। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যারা শত শত হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কাজ করে। এই ধরনের কাজে সকলকে সন্তুষ্ট করা যায় না। কোন কোন কাজে তারা প্রশংসা পাবেন, আবার কোন কোন কাজে নিন্দাবাদ কুড়াতে হবে। বিচারকরা যে রায় দেন, সেই রায়ে কি সকল পক্ষই খুশি হয়? কোন কোন পক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়। তাই বলে বিচারপতি কি সংক্ষুব্ধ পার্টিকে গালাগালি করবেন? দুদকের ব্যাপারটাও তাই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের কোন বক্তব্যের সাথে দুদক একমত নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই একমত না হওয়ার কারণটি তারা প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে জানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সে দিকে না যেয়ে টিআইবিকে ঘরের শত্রু বিভীষণ বলে গালাগালি করার অধিকার কি চুপ্পু সাহেবের আছে? কার এজেন্ডা টিআইবি বাস্তবায়িত করছে? যে ভাষায় তিনি কথা বলেছেন সেই ভাষা হলো শাসক দলের ভাষা। আওয়ামী লীগের হার্ডকোর কর্মী অথবা লিডারের ভাষায় তিনি কথা বলবেন কেন? শোনা যায় যে, ছাত্র জীবনে নাকি তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পরেও তিনি ছাত্রলীগের আচার আচরণ ও কথাবার্তা ভুলতে পারেন নি। তাই তিনি ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বারের মত কথা বলছেন। চুপ্পু সাহেব হয়তো ভুলে গেছেন যে, আওয়ামী লীগ অনন্ত দিন ক্ষমতায় থাকবে না। আর তিনিও ততদিন ক্ষমতায় থাকবেন না। সুতরাং ঐ চেয়ারে বসে কথাবার্তা বলার সময় অবশ্যই হুস করে কথা বলতে হবে।
তিন
আমরা সাধারণত ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোতো দূরের কথা, তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কদাচিৎ আলোচনা করি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত যখন তখন নাক গলাচ্ছে। এমনকি কোন দলকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেওয়া এবং কোন দলকে ক্ষমতায় বসানোর কাজে ভারত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। শুধু তাই নয়, কোন দল ক্ষমতায় থাকলে সে দল যাতে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হয় সে ব্যাপারেও ভারত সরাসরি কাজ করে। তারা বিএনপি এবং জামায়াতকে ক্ষমতায় আসতে দেয় না এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর পর আওয়ামী লীগ যাতে বাপ দাদার চৌদ্দ পুরুষ ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারে সে জন্য প্রকাশ্য এবং নগ্ন ভাবে কাজ করে।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে ধিকৃত করার জন্য ভারত সেদিন সারদা ফান্ড নিয়ে অনেক খেলা খেলেছে। রাজ্যসভার তৃণমূল সদস্য ইমরান হোসেন, সীমান্ত দিয়ে বস্তা বস্তা টাকা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর কাছে প্রেরণ ইত্যাদি অনেক আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে। অবশেষে দেখা গেছে সব কিছুই শূন্যগর্ভ। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিম বঙ্গের আনন্দ বাজারীরা কাছা খুলে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে এবং জামায়াত ও বিএনপির বিরোধীতা করেছে। কিন্তু আখেরে দেখে গেলো সব প্রচারণাই মিথ্যা। জামায়াত তো দূরের কথা, সারদা ফান্ডের এক কানা কড়িও বাংলাদেশে আসেনি। ইমরান হোসেনও কলকাতায় বহাল তবিয়তেই আছেন। বরং লড়াই শুরু হয়েছে দিল্লী বনাম কলকাতার মধ্যে। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, পশ্চিম বঙ্গের পরিবহন মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর ঘনিষ্ঠ জন বলে পরিচিত মদন মিত্রকে ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেষ্টিগেশন (সিবিআই) গত শুক্রবার ১২ ডিসেম্বর গ্রেফতার করেছে। এর আগে তৃণমূল দলীয় দুই জন পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) কুনাল ঘোষ এবং সৃঞ্জয় বোসকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে। উভয় এমপিকেই গ্রেফতার করা হয়েছে অর্থ কেলেঙ্কারির দায়ে। এদের গ্রেফতারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। এসব গ্রেফতারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং প্রতিহিংসামূলক বলেছেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। পশ্চিম বঙ্গের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা এবং পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মূখার্জী সিবিআইকে বিজেপির ক্রীড়নক বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিজেপির পশ্চিম বঙ্গ শাখা বলেছে যে, সিবিআই তদন্ত যে ভাবে এগোচ্ছে সেভাবে এগোতে থাকলে দেখা যাবে যে, এই তদন্ত মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানাজীর দোর গোড়ায় পৌঁছেছে।
একজন রাগান্বিত মমতা ব্যানার্জী বলেছেন যে, এটি হলো তৃণমূলের বিরুদ্ধে দিল্লী সরকারের নোংরা রাজনীতি। যদি তাদের সাহস থাকে তা হলে তারা আমাকে গ্রেফতার করুক। আমি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলবো, সাহস থাকলে সর্বাগ্রে আমাকে গ্রেফতার করুন। যখন মদন মিত্রকে হাসপাতালে আনা হবে তখন আমি তাকে দেখতে যাবো। তখন নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ তাদের যত পুলিশ আছে নিয়ে আসুক এবং আমাকে গ্রেফতার করুক। আমরা তাদের মুখোস ছিড়ে ফেলবো। দিল্লীর রাজ পথে তাদের সাথে সংগ্রাম করবো।
ভারতে কেন্দ্র এবং প্রদেশের লড়াই জমে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষ এ লড়াইয়ের শেষ দেখার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে।
দৃশ্যত সেটাই মনে হয়, সেই ধরনের চিন্তা ভাবনাই শাসক দলের মাথায় ঘোরাফেরা করছে। এ ব্যাপারে আমরা কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি। এ সব ঘটনা প্রমাণ করে যে, এই সরকার প্রশাসন যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অফিসারকে দলীয় ক্যাডার বানিয়েছে। তারা এত ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে তারাও রোজ কেয়ামত পর্যন্ত চাকুরি করবে। একটি বিষয়ে আওয়ামী লীগ বা তাদের বশংবদ এ সব অফিসার ভেবে দেখেনি। সেটি হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এরা কোথায় যাবেন? হিন্দি ছবিতে প্রায়শই একটি কথা বলা হয়। সেটি হলো, ‘এ্যায়সা দিন নেহি রাহে গা’। আওয়ামী লীগ পড়ে গেলে এরা পালাবারও পথ পাবে না। কেন পাবেনা সেটির জন্য নীচে কয়েকটি ছোট ছোট ঘটনা উল্লেখ করছি।
গত সোমবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘ধৈর্য ধরুন, ধৈর্য ধরুন। নির্দিষ্ট সময় পর পরই নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে জিতলে ক্ষমতায় যাবেন। জনগণ তখন আপনার কথা শুনবে। আমরাও তখন আপনার নির্দেশ মতো কাজ করব।’ তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, এই সরকার সব মানুষের সরকার নয়, তার এবং তাদের মতো কিছু মানুষের সরকার। দৈনিক প্রথম আলোর কলাম মোতাবেক এই পুলিশ অফিসারের নাম জনাব আবদুল। আবদুল সাহেবের ভাষায়, ‘আমার সরকার গণতান্ত্রিক সরকার। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা গণতন্ত্রের শীর্ষে অবস্থান করছি। পুলিশকে ঢিল মারা, গাড়িতে আগুন দেয়া গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। পুলিশ কমিশনার জনাব আবদুল আরও বলেন, ‘অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে এ সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা এসেছে। এই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। সব নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক ছিল। ভালো যত কাজ আছে সেখানেও বিতর্ক আছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নতির হাতিকে কিছু দুষ্কৃতকারী পেছনের দিক থেকে টেনে ধরতে চাচ্ছে। তারা উন্নতির এই হাতিকে আটকাতে পারবে না।’ তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘কেউ যদি পুলিশের দিকে ঢিল ছোঁড়ে, পুলিশের লাঠি তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।’ (দৈনিক প্রথম আলো-১০.১২.১৪ তারিখ)। দীর্ঘ ৪০ বছর হলো সাংবাদিকতা করছি এবং কলাম লিখছি। কিন্তু কোন পুলিশ অফিসার বা অন্য কোন অফিসারের মুখে এ রকম সরাসরি দলীয় রাজনীতির কথা শুনিনি।
দুর্নীতি দমন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাদের কাজ হলো, দুর্নীতি দমন করা। শুধু ঘুষ খেলেই দুর্নীতি হয় না। অনিয়ম করলেও দুর্নীতি হয়। স্বজন প্রীতি করলেও দুর্নীতি হয়। তেমনি কোন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বড়সড় অফিসার যদি দলবাজি করেন তা হলে তিনি শুধু দুর্নীতিই করেন না। তিনি রীতি মত সংবিধান লঙ্ঘন করেন। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন তা হলে সাধারণ মানুষ যায় কোথায়? তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। কমিশনের সদস্য জনাব শাহাবুদ্দিন চুপ্পু কমিশনের অস্থায়ী চেয়ারম্যান। কয়েকদিন আগে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে শাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যে দুর্নীতি হয়েছে, তা বিশ্ববাসী জানেন। ওই সময় আমরা চারবার দুর্নীতিতে চ্যা¤িপয়ন হয়েছি। আপনাদের আমলের দুর্নীতিকে আপনারা চোখে দেখেননি। আপনারা তা আলমারিতে আটকে রেখেছিলেন।’ (দৈনিক ইনকিলাব-১০.১২.১৪ ইং )।
দুই
দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন চুপ্পু টিআইবির ওপরও এক হাত নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘টিআইবি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এরা ঘরের শত্রু বিভীষণ। তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, দুদককে যে দায়মুক্তি কমিশন বলে আখ্যায়িত করেছেন তার প্রমাণ আপনাকে দিতে হবে। তিনি খালেদা জিয়াকে আয়নায় নিজের চেহারা দেখার পরামর্শ দেন। কারণ আপনার আমলেই বিশ্বে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিপয়ন হয়েছিল।’ (দৈনিক সংগ্রাম-১০.১২.১৪ ইং)। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যারা শত শত হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কাজ করে। এই ধরনের কাজে সকলকে সন্তুষ্ট করা যায় না। কোন কোন কাজে তারা প্রশংসা পাবেন, আবার কোন কোন কাজে নিন্দাবাদ কুড়াতে হবে। বিচারকরা যে রায় দেন, সেই রায়ে কি সকল পক্ষই খুশি হয়? কোন কোন পক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়। তাই বলে বিচারপতি কি সংক্ষুব্ধ পার্টিকে গালাগালি করবেন? দুদকের ব্যাপারটাও তাই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের কোন বক্তব্যের সাথে দুদক একমত নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই একমত না হওয়ার কারণটি তারা প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে জানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সে দিকে না যেয়ে টিআইবিকে ঘরের শত্রু বিভীষণ বলে গালাগালি করার অধিকার কি চুপ্পু সাহেবের আছে? কার এজেন্ডা টিআইবি বাস্তবায়িত করছে? যে ভাষায় তিনি কথা বলেছেন সেই ভাষা হলো শাসক দলের ভাষা। আওয়ামী লীগের হার্ডকোর কর্মী অথবা লিডারের ভাষায় তিনি কথা বলবেন কেন? শোনা যায় যে, ছাত্র জীবনে নাকি তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পরেও তিনি ছাত্রলীগের আচার আচরণ ও কথাবার্তা ভুলতে পারেন নি। তাই তিনি ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বারের মত কথা বলছেন। চুপ্পু সাহেব হয়তো ভুলে গেছেন যে, আওয়ামী লীগ অনন্ত দিন ক্ষমতায় থাকবে না। আর তিনিও ততদিন ক্ষমতায় থাকবেন না। সুতরাং ঐ চেয়ারে বসে কথাবার্তা বলার সময় অবশ্যই হুস করে কথা বলতে হবে।
তিন
আমরা সাধারণত ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোতো দূরের কথা, তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কদাচিৎ আলোচনা করি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত যখন তখন নাক গলাচ্ছে। এমনকি কোন দলকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেওয়া এবং কোন দলকে ক্ষমতায় বসানোর কাজে ভারত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। শুধু তাই নয়, কোন দল ক্ষমতায় থাকলে সে দল যাতে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হয় সে ব্যাপারেও ভারত সরাসরি কাজ করে। তারা বিএনপি এবং জামায়াতকে ক্ষমতায় আসতে দেয় না এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর পর আওয়ামী লীগ যাতে বাপ দাদার চৌদ্দ পুরুষ ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারে সে জন্য প্রকাশ্য এবং নগ্ন ভাবে কাজ করে।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে ধিকৃত করার জন্য ভারত সেদিন সারদা ফান্ড নিয়ে অনেক খেলা খেলেছে। রাজ্যসভার তৃণমূল সদস্য ইমরান হোসেন, সীমান্ত দিয়ে বস্তা বস্তা টাকা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর কাছে প্রেরণ ইত্যাদি অনেক আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে। অবশেষে দেখা গেছে সব কিছুই শূন্যগর্ভ। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিম বঙ্গের আনন্দ বাজারীরা কাছা খুলে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে এবং জামায়াত ও বিএনপির বিরোধীতা করেছে। কিন্তু আখেরে দেখে গেলো সব প্রচারণাই মিথ্যা। জামায়াত তো দূরের কথা, সারদা ফান্ডের এক কানা কড়িও বাংলাদেশে আসেনি। ইমরান হোসেনও কলকাতায় বহাল তবিয়তেই আছেন। বরং লড়াই শুরু হয়েছে দিল্লী বনাম কলকাতার মধ্যে। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, পশ্চিম বঙ্গের পরিবহন মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর ঘনিষ্ঠ জন বলে পরিচিত মদন মিত্রকে ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেষ্টিগেশন (সিবিআই) গত শুক্রবার ১২ ডিসেম্বর গ্রেফতার করেছে। এর আগে তৃণমূল দলীয় দুই জন পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) কুনাল ঘোষ এবং সৃঞ্জয় বোসকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে। উভয় এমপিকেই গ্রেফতার করা হয়েছে অর্থ কেলেঙ্কারির দায়ে। এদের গ্রেফতারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। এসব গ্রেফতারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং প্রতিহিংসামূলক বলেছেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। পশ্চিম বঙ্গের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা এবং পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মূখার্জী সিবিআইকে বিজেপির ক্রীড়নক বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিজেপির পশ্চিম বঙ্গ শাখা বলেছে যে, সিবিআই তদন্ত যে ভাবে এগোচ্ছে সেভাবে এগোতে থাকলে দেখা যাবে যে, এই তদন্ত মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানাজীর দোর গোড়ায় পৌঁছেছে।
একজন রাগান্বিত মমতা ব্যানার্জী বলেছেন যে, এটি হলো তৃণমূলের বিরুদ্ধে দিল্লী সরকারের নোংরা রাজনীতি। যদি তাদের সাহস থাকে তা হলে তারা আমাকে গ্রেফতার করুক। আমি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলবো, সাহস থাকলে সর্বাগ্রে আমাকে গ্রেফতার করুন। যখন মদন মিত্রকে হাসপাতালে আনা হবে তখন আমি তাকে দেখতে যাবো। তখন নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ তাদের যত পুলিশ আছে নিয়ে আসুক এবং আমাকে গ্রেফতার করুক। আমরা তাদের মুখোস ছিড়ে ফেলবো। দিল্লীর রাজ পথে তাদের সাথে সংগ্রাম করবো।
ভারতে কেন্দ্র এবং প্রদেশের লড়াই জমে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষ এ লড়াইয়ের শেষ দেখার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন