গত ২৪ ডিসেম্বর পুরনো ঢাকার আলিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে স্থাপিত বিশেষ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিতে যাওয়ার পথে সুপরিকল্পিত সশস্ত্র হামলার কবলে পড়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এই হামলা যে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরাই চালিয়েছে সে সম্পর্কে এরই মধ্যে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। হামলাকারীদের মারপিট ও কর্মকান্ডের দৃশ্যগুলো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে সব সংবাদপত্রেও। বিশেষ করে পিস্তল দিয়ে গুলীবর্ষণরত সন্ত্রাসীর পরিচিতি সবিস্তারে ছাপা হয়েছে পরদিনের সংবাদপত্রগুলোতে। এই কীর্তিমানের নাম আবদুল আজিজ ফয়েজ। সে ঢাকা কলেজের একজন ছাত্রলীগ কর্মীকে হত্যার মামলায় দু’ নম্বর আসামী। ছাত্রলীগ তাকে কাগজে-কলমে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু অন্য অনেক উপলক্ষের মতো বকশীবাজারের হামলা ও তান্ডবের সময়ও তাকে প্রকাশ্যে তৎপর দেখা গেছে। তার আশেপাশে যারা ছিল তারাও ছাত্রলীগেরই চিহ্নিত সন্ত্রাসী। সে খবরও তাদের নাম ও পরিচিতি সহকারেই প্রকাশিত হয়েছে।
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ছাত্রলীগের নেতারা তো বটেই, আওয়ামী লীগের নেতারাও ওই ফয়েজ এবং অন্য ক’জন ‘আপনজন’কে চিনতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তো বলেই বসেছেন, ছাত্রলীগের কোনো সোনার ছেলেই ঘটনাস্থলে ছিল না। তিনি উল্টো প্রশ্ন করেছেন, তারা ওখানে যাবেই বা কেন? ওদিকে আরেক আলোচিত মন্ত্রী কামরুল ইসলাম কিন্তু হাটেহাড়ি ভাঙার মতো বক্তব্য রেখেছেন। ২৬ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উৎসাহ যোগাতে গিয়ে বলেছেন, তারা যেন আরো জোরেশোরে এবং বলিষ্ঠতার সঙ্গে তাদের প্রতিরোধের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। বিএনপি যেন মাঠেই থাকতে না পারে। অন্য কিছু তথ্যও জানানো দরকার। এরকম একটি তথ্য হলো, পুলিশ কিন্তু ছাত্রলীগের কারো গায়ে একটি টোকাও দেয়নি। লাঠিচার্জ থেকে টিয়ার শেল পর্যন্ত সব পুলিশি অ্যাকশনের শিকার হয়েছেন বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাই। মামলাও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধেই ঠুকেছে। একটি মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগের এমপি ছবি বিশ্বাসের গাড়িতে আগুন ধরানোর অভিযোগে। প্রশ্ন উঠেছে, এমপি তিনি নেত্রকোনার, কিন্তু ওই বিশেষ সময়ে ছবি বিশ্বাস কেন বকশীবাজারেই মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির হয়েছিলেন? তাহলে বেগম জিয়ার ওপর হামলা চালানোর পেছনে তারও কি সরাসরি ভ’মিকা ছিল?
তথ্যগুলো কিন্তু অকারণে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে না। ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যাবে, এরই নাম আওয়ামী লীগ। বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা কাকে বলে তা জানার জন্যও ইতিহাসের দিকেই চোখ ফেরাতে হবে। সে ইতিহাসে জানা যাবে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব সম্পর্কেও। প্রথমে একটি উদাহরণ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৫৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তখন আওয়ামী লীগের প্রধান কর্মসূচি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন আদায় করা। দাবিটি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে অবিভক্ত বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ‘শেরে বাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। হক-ভাসানীর পাশাপাশি তৃতীয় প্রধান নেতা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বেই ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ শেরে বাংলার সঙ্গে যৌথভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছিল। ৯২-ক ধারার আড়ালে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। দ্বিতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৫৬ সালে। সেবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন আতাউর রহমান খান। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ দলের অন্য নেতারাও মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। একই সময়ে অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়েছির। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে পরিপন্থী অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনকি একথা পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নাকি ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে! এর প্রতিবাদে এবং স্বায়ত্তশাসন আদায় ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর জন্য বিখ্যাত কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সংঘাতের পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তাঁর নিজের গড়ে তোলা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করতে হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু মওলানা ভাসানীর তথা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভূমিকা পালন করেননি। শুধু তাই নয়, ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই পুরনো ঢাকার ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে যখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন অধিবেশন চলছিল তখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী গুন্ডারা হামলা চালিয়ে অধিবেশনকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। প্রথমদিন পাল্টা প্রতিরোধে পিছিয়ে গেলেও দ্বিতীয় দফা হামলা চালানো হয়েছিল পল্টন ময়দানের সমাবেশে। সেদিনও শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই আওয়ামী গুন্ডারা মওলানা ভাসানীর এবং খান আবদুল গাফফার খানসহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নেতাদের অনেকেরই মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। ইট-পাটকেলের ঢিল শুধু নয়, লাঠির আঘাতও সহ্য করতে হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে। ফলে পল্টন ময়দানের সমাবেশ অনেকাংশে ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল। এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে, গুন্ডামি করার এবং সন্ত্রাসী হামলা চালানোর শিক্ষাটাও উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ।
পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের এই গুন্ডামি ও বর্বরতা দিন দিন শুধু আরো মারাত্মক হয়েছে। পাকিস্তান যুগে মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই বিশেষ করে পল্টন ময়দানে বাধাহীনভাবে সমাবেশ করতে পারেনি। প্রতিটি সমাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আওয়ামী গুন্ডারা। বাংলাদেশ হওয়ার পর দলটির বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মিছিল সমাবেশে হামলা তো চালিয়েছেই, ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেককে জখম ও খুন করেছে আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা। পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীকেও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছেন নেতারা। ভাসানী ন্যাপ এবং জাসদের অনেক নেতাকেই আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হতে হয়েছে। ন্যক্কারজনক সে বর্বরতাই এখনও চালাচ্ছে দলটি।
প্রসঙ্গক্রমে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশল সম্পর্কে বলা দরকার। ১৯৫০-এর দশকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন দলটি স্বায়ত্তশাসনের তো বটেই, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেও ভূমিকা পালন করেছে। এরপর এসেছে ১৯৬০-এর দশক। এখন গালগল্প শোনানো হলেও সত্য হচ্ছে, গণতন্ত্রের জন্য কোনো আন্দোলনেই আওয়ামী লীগ যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। দলটি বরং প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের মাধ্যমে অন্যের সাফল্যকে দখল করেছে। একটি উদাহরণ হিসেবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করা যায়। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের মে থেকে বন্দী থাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থা তখন ছিল শোচনীয়। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে ছয়টি ভাগে আলাদা করে শেখ মুজিব তার ছয় দফা পেশ করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ছয় দফার প্রশ্নেই ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। শেখ মুজিব ছিলেন ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সে সময় এতটাই খারাপ ছিল যে, শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামী বানানোর পরও দলটির পক্ষ থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা, ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে বরং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার জন্য ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণঅভ্যুত্থানে যোগ দেয়ার পরিবর্তে ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ গিয়ে এমন এক জোট ‘ড্যাক’ বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির সদস্য হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান। ‘ড্যাক’-এর আট দফায় স্বায়ত্তশাসন শব্দটি পর্যন্ত ছিল না এবং শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হলেও তার নামের আগে-পরে ছিল ওয়ালী খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম। ‘ড্যাক’-এর মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি ও কাউন্সিল মুসলিম লীগসহ পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক দলগুলো। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী ‘ড্যাক’-এর সঙ্গে যুক্ত হননি। কিন্তু বাঙালীর জন্য সংগ্রামের কৃতিত্ব দখলকারী দল ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ ‘ড্যাক’-এ গিয়েছিল।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেন, ৪ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা পল্টন ময়দানের সমাবেশ থেকে গিয়ে গবর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করে। পুলিশের গুলীতে আন্দোলনকারীদের মৃত্যু ও সরকারি দমন-নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী পরপর দু’দিন হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্র সমাজের ১১ দফা, আর ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানেই মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দীরা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত এবং শেষ পর্যন্ত ভন্ডুল করেছিলেন শেখ মুজিব। যে ১১ দফার ভিত্তিতে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন সে ১১ দফাকে পরিত্যাগ করে নিজের ছয় দফাকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়েও তিনি নিজের মনোভাব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনাও পিতাকেই অনুসরণ করে চলেছেন। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাকশালী শাসনের পতন-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যায়। প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যাক। আবদুল মালেক উকিল তখন সভাপতি। আওয়ামী লীগ সেবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ এবং ১৯৭৪ সালে নিজেদেরই পাস করা চতুর্থ সংশোধনী বাতিলসহ চারটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছিল। নেতারা জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, যেন চার দফা পূরণ না করা হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অন্যদিকে কোনো একটি দাবি পূরণ করা দূরে থাকুক, মেনে নেয়ার আশ্বাস পর্যন্ত দেয়নি জেনারেল জিয়ার সরকার। তা সত্ত্বেও ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল।
১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেও আওয়ামী লীগ ন্যক্কারজনক প্রতারণা করেছিল। নির্বাচনের তারিখ পেছানো, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি ছিল চার দফায়। কিন্তু শুধু নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবিটি পূরণ করাতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বড় কথা, নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচারে মৃত্যু দন্ডাদেশপ্রাপ্ত ১২ জন সামরিক অফিসারের সঙ্গে গুরুতর প্রতারণা করেছিল।
আওয়ামী লীগের প্রতারণার ধারাবাহিকতায় আরো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে। তারও আগে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ এরশাদের অবৈধ অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছিল। সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারের নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। প্রকাশ্য রাজনীতিতে নানান পূর্বশর্ত জুড়ে দেয়ার পাশাপাশি এভাবেই নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। দলটির উদ্দেশ্য এবং কৌশলগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে অন্যদের ব্যবহার করা এবং কাজ ‘উদ্ধার’ হয়ে গেলে পাশ কাটিয়ে চলা- কখনো একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।
ধারণা দেয়ার জন্য এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলে ভাঙন ঘটিয়ে এবং আন্দোলনের প্রধান সহযোগী সাতদলীয় জোটের সঙ্গে প্রতারণা করে রাতারাতি তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গভীর রাতে এমন এক সময়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যখন চাইলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হতো না। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি আসলে অন্যদের সাফল্য একাই ভোগ-দখল করতে চেয়েছিলেন। জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ না করে সামরিক শাসক এরশাদকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে প্রতারণার আরো একটি উদাহরণ। সেবার, ১৯৮৭ সালের নবেম্বরে আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে জেনারেল এরশাদের পতন ঘটতো। জামায়াতের এমপিরা আগেই পদত্যাগ করেছিলেন, আওয়ামী লীগের এমপিরাও নেত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু আজ দেই, কাল দেই করে শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্রগুলো জমা দেননি। ফলে জেনারেল এরশাদ শুধু টিকেই যাননি, সংসদের বিলুপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা দেখানোরও সুযোগ পেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। সঙ্গী বামপন্থীরা তো বটেই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সকল বিরোধী দলও এতে অংশ নিয়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পরও দলটি আন্দোলনের সহযোগী ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোনো দলের কোনো নেতাকে মন্ত্রী বানায়নি। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বাম ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের শুধু ব্যবহারই করেছিল।
পরবর্তীকালেও আওয়ামী লীগ প্রতারণা ও ঐক্যের অভিনয় থেকে সরে আসেনি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি মহাজোট গঠন করেছে। নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মেলানোয় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ংকর প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজিরও শেখ হাসিনা বারবার স্থাপন করেছেন। এজন্যই জনগণও তার আহ্বানে কখনো সাড়া দেয়নি- তারা শেখ হাসিনার মতো জোট সরকারের পদত্যাগ রোগে আক্রান্ত হয়নি। একই কারণে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। লগি-বৈঠার ধারাবাহিকতায় নিজেদের ‘নিয়ে আসা’ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে দলটি। গণতন্ত্রের ব্যাপারে এতটাই সততা আওয়ামী লীগের! এ প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে আরো লেখার ইচ্ছা রইল।
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ছাত্রলীগের নেতারা তো বটেই, আওয়ামী লীগের নেতারাও ওই ফয়েজ এবং অন্য ক’জন ‘আপনজন’কে চিনতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তো বলেই বসেছেন, ছাত্রলীগের কোনো সোনার ছেলেই ঘটনাস্থলে ছিল না। তিনি উল্টো প্রশ্ন করেছেন, তারা ওখানে যাবেই বা কেন? ওদিকে আরেক আলোচিত মন্ত্রী কামরুল ইসলাম কিন্তু হাটেহাড়ি ভাঙার মতো বক্তব্য রেখেছেন। ২৬ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উৎসাহ যোগাতে গিয়ে বলেছেন, তারা যেন আরো জোরেশোরে এবং বলিষ্ঠতার সঙ্গে তাদের প্রতিরোধের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। বিএনপি যেন মাঠেই থাকতে না পারে। অন্য কিছু তথ্যও জানানো দরকার। এরকম একটি তথ্য হলো, পুলিশ কিন্তু ছাত্রলীগের কারো গায়ে একটি টোকাও দেয়নি। লাঠিচার্জ থেকে টিয়ার শেল পর্যন্ত সব পুলিশি অ্যাকশনের শিকার হয়েছেন বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাই। মামলাও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধেই ঠুকেছে। একটি মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগের এমপি ছবি বিশ্বাসের গাড়িতে আগুন ধরানোর অভিযোগে। প্রশ্ন উঠেছে, এমপি তিনি নেত্রকোনার, কিন্তু ওই বিশেষ সময়ে ছবি বিশ্বাস কেন বকশীবাজারেই মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির হয়েছিলেন? তাহলে বেগম জিয়ার ওপর হামলা চালানোর পেছনে তারও কি সরাসরি ভ’মিকা ছিল?
তথ্যগুলো কিন্তু অকারণে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে না। ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যাবে, এরই নাম আওয়ামী লীগ। বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা কাকে বলে তা জানার জন্যও ইতিহাসের দিকেই চোখ ফেরাতে হবে। সে ইতিহাসে জানা যাবে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব সম্পর্কেও। প্রথমে একটি উদাহরণ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৫৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তখন আওয়ামী লীগের প্রধান কর্মসূচি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন আদায় করা। দাবিটি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে অবিভক্ত বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ‘শেরে বাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। হক-ভাসানীর পাশাপাশি তৃতীয় প্রধান নেতা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বেই ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ শেরে বাংলার সঙ্গে যৌথভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছিল। ৯২-ক ধারার আড়ালে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। দ্বিতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৫৬ সালে। সেবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন আতাউর রহমান খান। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ দলের অন্য নেতারাও মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। একই সময়ে অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়েছির। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে পরিপন্থী অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনকি একথা পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নাকি ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে! এর প্রতিবাদে এবং স্বায়ত্তশাসন আদায় ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর জন্য বিখ্যাত কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সংঘাতের পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তাঁর নিজের গড়ে তোলা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করতে হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু মওলানা ভাসানীর তথা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভূমিকা পালন করেননি। শুধু তাই নয়, ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই পুরনো ঢাকার ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে যখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন অধিবেশন চলছিল তখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী গুন্ডারা হামলা চালিয়ে অধিবেশনকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। প্রথমদিন পাল্টা প্রতিরোধে পিছিয়ে গেলেও দ্বিতীয় দফা হামলা চালানো হয়েছিল পল্টন ময়দানের সমাবেশে। সেদিনও শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই আওয়ামী গুন্ডারা মওলানা ভাসানীর এবং খান আবদুল গাফফার খানসহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নেতাদের অনেকেরই মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। ইট-পাটকেলের ঢিল শুধু নয়, লাঠির আঘাতও সহ্য করতে হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে। ফলে পল্টন ময়দানের সমাবেশ অনেকাংশে ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল। এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে, গুন্ডামি করার এবং সন্ত্রাসী হামলা চালানোর শিক্ষাটাও উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ।
পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের এই গুন্ডামি ও বর্বরতা দিন দিন শুধু আরো মারাত্মক হয়েছে। পাকিস্তান যুগে মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই বিশেষ করে পল্টন ময়দানে বাধাহীনভাবে সমাবেশ করতে পারেনি। প্রতিটি সমাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আওয়ামী গুন্ডারা। বাংলাদেশ হওয়ার পর দলটির বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মিছিল সমাবেশে হামলা তো চালিয়েছেই, ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেককে জখম ও খুন করেছে আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা। পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীকেও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছেন নেতারা। ভাসানী ন্যাপ এবং জাসদের অনেক নেতাকেই আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হতে হয়েছে। ন্যক্কারজনক সে বর্বরতাই এখনও চালাচ্ছে দলটি।
প্রসঙ্গক্রমে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশল সম্পর্কে বলা দরকার। ১৯৫০-এর দশকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন দলটি স্বায়ত্তশাসনের তো বটেই, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেও ভূমিকা পালন করেছে। এরপর এসেছে ১৯৬০-এর দশক। এখন গালগল্প শোনানো হলেও সত্য হচ্ছে, গণতন্ত্রের জন্য কোনো আন্দোলনেই আওয়ামী লীগ যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। দলটি বরং প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের মাধ্যমে অন্যের সাফল্যকে দখল করেছে। একটি উদাহরণ হিসেবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করা যায়। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের মে থেকে বন্দী থাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থা তখন ছিল শোচনীয়। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে ছয়টি ভাগে আলাদা করে শেখ মুজিব তার ছয় দফা পেশ করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ছয় দফার প্রশ্নেই ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। শেখ মুজিব ছিলেন ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সে সময় এতটাই খারাপ ছিল যে, শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামী বানানোর পরও দলটির পক্ষ থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা, ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে বরং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার জন্য ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণঅভ্যুত্থানে যোগ দেয়ার পরিবর্তে ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ গিয়ে এমন এক জোট ‘ড্যাক’ বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির সদস্য হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান। ‘ড্যাক’-এর আট দফায় স্বায়ত্তশাসন শব্দটি পর্যন্ত ছিল না এবং শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হলেও তার নামের আগে-পরে ছিল ওয়ালী খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম। ‘ড্যাক’-এর মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি ও কাউন্সিল মুসলিম লীগসহ পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক দলগুলো। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী ‘ড্যাক’-এর সঙ্গে যুক্ত হননি। কিন্তু বাঙালীর জন্য সংগ্রামের কৃতিত্ব দখলকারী দল ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ ‘ড্যাক’-এ গিয়েছিল।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেন, ৪ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা পল্টন ময়দানের সমাবেশ থেকে গিয়ে গবর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করে। পুলিশের গুলীতে আন্দোলনকারীদের মৃত্যু ও সরকারি দমন-নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী পরপর দু’দিন হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্র সমাজের ১১ দফা, আর ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানেই মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দীরা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত এবং শেষ পর্যন্ত ভন্ডুল করেছিলেন শেখ মুজিব। যে ১১ দফার ভিত্তিতে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন সে ১১ দফাকে পরিত্যাগ করে নিজের ছয় দফাকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়েও তিনি নিজের মনোভাব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনাও পিতাকেই অনুসরণ করে চলেছেন। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাকশালী শাসনের পতন-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যায়। প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যাক। আবদুল মালেক উকিল তখন সভাপতি। আওয়ামী লীগ সেবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ এবং ১৯৭৪ সালে নিজেদেরই পাস করা চতুর্থ সংশোধনী বাতিলসহ চারটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছিল। নেতারা জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, যেন চার দফা পূরণ না করা হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অন্যদিকে কোনো একটি দাবি পূরণ করা দূরে থাকুক, মেনে নেয়ার আশ্বাস পর্যন্ত দেয়নি জেনারেল জিয়ার সরকার। তা সত্ত্বেও ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল।
১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেও আওয়ামী লীগ ন্যক্কারজনক প্রতারণা করেছিল। নির্বাচনের তারিখ পেছানো, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি ছিল চার দফায়। কিন্তু শুধু নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবিটি পূরণ করাতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বড় কথা, নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচারে মৃত্যু দন্ডাদেশপ্রাপ্ত ১২ জন সামরিক অফিসারের সঙ্গে গুরুতর প্রতারণা করেছিল।
আওয়ামী লীগের প্রতারণার ধারাবাহিকতায় আরো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে। তারও আগে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ এরশাদের অবৈধ অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছিল। সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারের নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। প্রকাশ্য রাজনীতিতে নানান পূর্বশর্ত জুড়ে দেয়ার পাশাপাশি এভাবেই নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। দলটির উদ্দেশ্য এবং কৌশলগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে অন্যদের ব্যবহার করা এবং কাজ ‘উদ্ধার’ হয়ে গেলে পাশ কাটিয়ে চলা- কখনো একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।
ধারণা দেয়ার জন্য এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলে ভাঙন ঘটিয়ে এবং আন্দোলনের প্রধান সহযোগী সাতদলীয় জোটের সঙ্গে প্রতারণা করে রাতারাতি তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গভীর রাতে এমন এক সময়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যখন চাইলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হতো না। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি আসলে অন্যদের সাফল্য একাই ভোগ-দখল করতে চেয়েছিলেন। জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ না করে সামরিক শাসক এরশাদকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে প্রতারণার আরো একটি উদাহরণ। সেবার, ১৯৮৭ সালের নবেম্বরে আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে জেনারেল এরশাদের পতন ঘটতো। জামায়াতের এমপিরা আগেই পদত্যাগ করেছিলেন, আওয়ামী লীগের এমপিরাও নেত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু আজ দেই, কাল দেই করে শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্রগুলো জমা দেননি। ফলে জেনারেল এরশাদ শুধু টিকেই যাননি, সংসদের বিলুপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা দেখানোরও সুযোগ পেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। সঙ্গী বামপন্থীরা তো বটেই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সকল বিরোধী দলও এতে অংশ নিয়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পরও দলটি আন্দোলনের সহযোগী ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোনো দলের কোনো নেতাকে মন্ত্রী বানায়নি। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বাম ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের শুধু ব্যবহারই করেছিল।
পরবর্তীকালেও আওয়ামী লীগ প্রতারণা ও ঐক্যের অভিনয় থেকে সরে আসেনি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি মহাজোট গঠন করেছে। নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মেলানোয় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ংকর প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজিরও শেখ হাসিনা বারবার স্থাপন করেছেন। এজন্যই জনগণও তার আহ্বানে কখনো সাড়া দেয়নি- তারা শেখ হাসিনার মতো জোট সরকারের পদত্যাগ রোগে আক্রান্ত হয়নি। একই কারণে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। লগি-বৈঠার ধারাবাহিকতায় নিজেদের ‘নিয়ে আসা’ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে দলটি। গণতন্ত্রের ব্যাপারে এতটাই সততা আওয়ামী লীগের! এ প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে আরো লেখার ইচ্ছা রইল।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন