বর্তমান বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয়ে থাকে। এসব রাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পদ্ধতি হলো, গণতান্ত্রিক পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই রাষ্ট্রগুলোয় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নিজ নিজ সংবিধান ও আইন মোতাবেক নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এ নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন। ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের শাসনাধীন থাকাবস্থায় একটি একক রাষ্ট্র ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের আইনসভায় সাধারণ জনগণের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়ে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্র জন্মলাভ করলে প্রথমোক্ত রাষ্ট্রটি জন্মের পর থেকে কেন্দ্র ও প্রদেশে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখে। কিন্তু শেষোক্ত রাষ্ট্রটির ক্ষেত্রে দেখা যায়, জন্মের পর থেকে বেসামরিক ও সামরিক শাসনের অধীনে ১৯৭০ অবধি যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর মাধ্যমে গঠিত সংসদের কোনোটিই নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। অবিভক্ত পাকিস্তানে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওই নির্বাচনের ভিত্তিতে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদই গঠিত হতে পারেনি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত জাতীয় সংসদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে দলটি পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা পরিচালনার বৈধ অধিকার লাভ করে। কিন্তু তৎকালীন সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কিছুতেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের ওপর ন্যস্ত করতে রাজি ছিলেন না। এ কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায়, ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করে রাষ্ট্রটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের অখণ্ডতা হয়তো ক্ষুণœ হতো না। ভারত ও পাকিস্তান এ দু’টি রাষ্ট্র যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তিতে গঠিত হলেও উভয় রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিসত্তার লোকজন বসবাস করে। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু তবে সেখানে প্রধান ৩৬টি জাতিসত্তাসহ ছোট-বড় শতাধিক জাতিসত্তা রয়েছে। অবিভক্ত পাকিস্তানে পাঁচটি প্রধান জাতিসত্তাসহ আরো প্রায় ক্ষুদ্র ৩০টির মতো জাতিসত্তা ছিল। ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতির প্রধান ধর্ম হিন্দু ও ইসলাম হলেও বিভিন্ন জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিতে ভিন্নতা রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো জাতির ভাষা অন্য জাতির কাছে দুর্বোধ্য। অনুরূপভাবে, এক জাতির সংস্কৃতি অন্য জাতির কাছে নিজস্ব ধ্যানধারণা ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী। জাতিগত বৈচিত্র্যে ভরপুর ভারত রাষ্ট্র হিসেবে জন্মের পর থেকে অদ্যাবধি কেন্দ্র ও রাজ্যে (প্রদেশ) সরকার পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে গণতান্ত্রিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ অনুসরণ করেছে। ফলে এ রাষ্ট্রটি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের অখণ্ডতা অক্ষুণœ রাখতে পেরেছে এবং আশা করা যায়, গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্রটি অখণ্ডতা ধরে রাখতে সক্ষম হবে। বর্তমান পাকিস্তান চারটি প্রধান জাতিসত্তা এবং ১০-১২টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও পশ্চিম পাকিস্তান নামে একসময় পরিচিত পাকিস্তানের মূল অংশে দুইবার দীর্ঘ মেয়াদি সামরিক শাসনের আবির্ভাব ঘটেছিল। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বারবার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে দেশটিতে এখনো গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, যে কারণে দেশটি কাক্সিক্ষত অগ্রগতি অর্জনেও সক্ষম হয়নি। পাকিস্তানে বিগত সাধারণ নির্বাচনটি তুলনামূলক বিচারে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হলেও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে দেশটিকে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এ পথ পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ থেকে যদি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা না আসে, তাহলে আশা করা যায় পাকিস্তান তার অখণ্ডতা ধরে রেখে ভবিষ্যতে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবে। গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হওয়ার কারণে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটায় এখানকার মানুষ আশাবাদ পোষণ করেছিল যে, এ দেশে কখনো গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হবে না। কিন্তু দেশটির অভ্যুদয়ের চার বছর পার হওয়ার আগেই দেখা গেল, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা’র মানসে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ স্বাধীনতার অব্যবহিত পর নেয়া হলে হয়তো জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো। একদলীয় শাসনব্যবস্থা এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের এক বছর অতিক্রান্ত না হতে এটিকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখিয়ে একটি হৃদয়বিদারক বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসমেত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তার সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও বিভিন্ন ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে অল্প সময়ে তার বিদায় ঘটে এবং রাজনৈতিক মঞ্চে আসেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের প্রধান বৈশিষ্ট্য, তিনি এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জনমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। সামরিক শাসক হলেও তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকাকালে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে যে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা প্রতিযোগিতামূলক ছিল নাÑ এমন দাবি করার অবকাশ সীমিত। জিয়া যে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করেছিলেন তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হলে সে গণতন্ত্র হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেত। কিন্তু তার ও দেশের দুর্ভাগ্যÑ একটি দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য দ্বারা তার জীবনাবসান ঘটে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকলে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। কিন্তু সেনাপ্রধান এরশাদের কূটকৌশলে নতি স্বীকার করে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরশাদ প্রায় ৯ বছর শক্ত হাতে দেশ শাসন করেন। তার শাসনামলে যে দু’টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এর প্রথমটিতে আওয়ামী লীগের বিজয়কে নস্যাৎ করা হয়েছিল এবং দ্বিতীয়টি ছিল একটি প্রহসনের নির্বাচন। এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচন সম্মিলিতভাবে সব বিরোধী দল বর্জন করলে সামরিক শাসক এরশাদের শাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। ’৮৬’র সংসদ নির্বাচনে কী কারণে এবং কার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল সেটি রহস্যাবৃত। ’৯০ এর গণ-আন্দোলনে এরশাদের পতন হলেও সে গণ-আন্দোলন এককভাবে এরশাদের পতন নিশ্চিত করেছে, নাকি তার ওপর থেকে সামরিক বাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহার পতনকে অবশ্যম্ভাবী করেছে, সে প্রশ্নে বিতর্ক রয়েছে। তবে এ বিতর্কের পাল্লা কোন দিকে ভারী সে বিষয়টি রাজনৈতিক বোদ্ধা অনেকের কাছে অস্পষ্ট নয়। ’৯০-এর গণ-আন্দোলনের আগে চারটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ চারটি নির্বাচনই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রত্যেকটি নির্বাচনেই দলীয় সরকার সমর্থিত দল ‘নিরঙ্কুশ বিজয়’ লাভ করে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ওই সরকারের সমর্থিত দলের বিজয় এ দেশের জনগণের মধ্যে এমন ধারণা জন্ম দেয় যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অর্থ ক্ষমতাসীনদের বিজয় এবং বিরোধীদের পরাজয়। এ ধারণা থেকেই এ দেশে নিরপেক্ষ ব্যক্তির পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ওঠে এবং এর ফলে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। এ তিনটি নির্বাচনে অব্যবহিত আগের ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় ঘটে এবং বিরোধী দল বিজয় লাভ করে। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অভিনব ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু নবম সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা এবং এ কারণে এ দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে তা বলা কঠিন। নবম সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলেও এ নির্বাচনে অত্যধিক ভোটার উপস্থিতি আমাদের দেশের অতীতের নির্বাচনগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এ বিষয়ে সে সময়কার নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। দশম সংসদ নির্বাচন প্রকৃত অর্থেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার এতই নগণ্য ছিল যে, এটিকে গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে কোনোভাবেই নির্বাচন বলার অবকাশ নেই। তা ছাড়া এ নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন, যা সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটে। সে বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতায় বারবার গণতন্ত্র অবদমিত হয়েছে। আমাদের দেশে রাজনীতিতে ’৯০ সালের পরবর্তীকালে যে দু’টি দল প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এদের অভ্যন্তরে যেমন গণতন্ত্র নেই, ঠিক তেমন এ দু’টি দলের কোনোটিই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনে একনিষ্ঠ হতে পারেনি। এ কারণে আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বলা যায় এক ধরনের অনিশ্চিত। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ কথাটি বিশ্বাস করার মতো সঙ্গত কারণ রয়েছে যে, গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হওয়ার প্রতিবন্ধকতা যতক্ষণ পর্যন্ত অপসারিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বড় দু’টি দলের কোনোটিরই পরিণাম ভালো নয়।
ইকতেদার আহমেদ
ইকতেদার আহমেদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন