বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ ২০১৪ সাল ছেড়ে ২০১৫ সালের পথে পা বাড়িয়েছে। বছরের শেষ দিনগুলোও হরতাল-আন্দোলনে প্রকম্পিত। আজকেও শুরু হয়েছে একটি পূর্ণ হরতাল। ফলে সামনের নতুন বছরের আশা ও সম্ভাবনা যতটুকু রয়েছে, তার চেয়ে বেশিই আছে হতাশা, শঙ্কা। মানুষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা যায় নি; গণতন্ত্রের সুফলও প্রস্ফুটিত হয়নি। নাগরিক সংগঠন ‘সুজন’ বলছে, ‘গণতন্ত্রের নামে চলছে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’। তারা তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে গণভোটের প্রস্তাব করেছে। ‘সুজন’-এর উক্ত সভায় ড. আকবর আলি খান বলেছেন, ‘দেশে অনুদার গণতন্ত্র বিরাজ করছে।’ শামসুল হুদা বলেছেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়া হয়েছে।’ অতএব বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা কথা বের হয়ে আসতে শুরু করেছে।
এমতাবস্থায় জনগণের প্ল্যাটফরম নামে পরিচিত ২০ দলীয় জোট আসন্ন ৫ জানুয়ারির ভোট ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে উদ্যোগী হয়েছে এবং সরকার যথারীতি জনসমাবেশ করতে না দেয়ার পথে এগুচ্ছে। এতে স্পষ্ট হয় যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে কিছু আলাপ-আলোচনা হোক, সেটা সরকার চায় না। তারা কলঙ্ক লুকানোর মতো বিষয়টিকে লুক্কায়িত রাখতে চায়।
কিন্তু লুকিয়ে রাখতে চাইলেই সব কিছু লুকানো বা আড়াল করা যায় না। কারো চরিত্র, তার উপাধি, কারো অর্জন, কারো বিসর্জন লুকানোর বিষয় নয়। শেরে বাংলা বলতে মানুষ তার ভালো-মন্দ সব কিছুই অনুভব করে। সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, জিয়া, খালেদা, হাসিনা বা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কথা উঠলে মানুষ সেসব ব্যক্তি বা দলের ভালো বা মন্দ, অর্জন বা বিসর্জন, সব কিছুতেই চোখের সামনে দেখতে চায়। হয়তো ভয়ে, চাপে, আতঙ্কে সব কথা খোলামেলা বলতে পারে না। তবে সময়মতো সেগুলো বলার জন্য বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখে। একদিন ভয়ে কেউ বলতে পারেনি বলেই কোনোদিন বলতে পারবে না, এমন নয়। সময় ও সুযোগমতো আমলনামা প্রকাশ পাবেই।
২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে প্রবেশের মুখে ব্যক্তি বা দলের আমলনামাও সঙ্গে থাকবে। এটাই ইতিহাসের নিয়ম। ইতিহাস সর্বদাই জনগণের পক্ষে থাকে। যদি কেউ জানতে চায় ২০১৪ সালের প্রত্যাশা কি ছিল? তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে ইতিহাস মানবকণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলবে, ২০১৪ সালের প্রত্যাশা ছিল গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের প্রত্যাশা। প্রতিপক্ষ নিধন আর চরিত্র হননের রাজনীতির অবসান কামনা। ২০১৪ সালে মানুষের এসব প্রত্যাশা পূর্ণতা পায়নি। ২০১৫ সালেও বাংলাদেশের মানুষ এসব প্রত্যাশায় রাজপথ প্রকম্পিত করবে।
অথচ নতুন একটি বছরে মানুষকে সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়ে আশাবাদের প্রত্যয় জাগিয়ে দিতে পারতেন পদাধিকারী নেতৃত্ব। নতুন বছরে নতুন স্বপ্নে যদি আরো একজন মানুষকেও ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টির কবল থেকে বাঁচানো যায়, সেটাও বড় অর্জন হবে। সেটা না করে, সামনের দিকে এক কদমও অগ্রসর হওয়ার আশাবাদ না জাগিয়ে নিজস্ব ক্ষমতার বলয়কে মজবুত করার ঘৃণ্য অপচেষ্টাই বরং উগ্রভাবে দেখানো হচ্ছে। বিরোধী দলকে সম্মানজনক জায়গা দেয়া তো দূরের কথা, তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর কটু-কাটব্য করে বিকৃত আনন্দ লাভ করা হচ্ছে। একদিকে জেল, জুলুম, ফাঁসি চলছে। অন্যদিকে সভা-সমাবেশের রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের এই অবস্থাকে নানা নামে ডাকা হচ্ছে দেশ-বিদেশ থেকে। সর্বশেষ উপাধি দিয়েছে ‘সুজন’: ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’।
‘সুজন’ জ্ঞানী-গুণীদের সংগঠন। তারা যখন কোনো কথা বলে, তখন ধরে নিতে হয় যে, বুঝে-শুনেই বলছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ অ্যাখ্যা দিয়ে তারা কি জ্ঞানের পরিচয় দিলেন? নাকি মূর্খতার প্রচার করলেন? ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে কয়েকটি কারণে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ উপাধিটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ: ১. যেখানে ভোট হয়নি, ভোটার আসেনি, সেখানে স্বৈরতন্ত্রের সামনে ‘নির্বাচিত’ শব্দটি কি করে ব্যবহার করা যায়? ২. স্বৈরতন্ত্রের মতো একটি নিকৃষ্ট কুশাসনের কাঁধে ‘নির্বাচিত’ তকমা লাগিয়ে দিয়ে সেটার বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? ৩. সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মতো সুস্পষ্ট পরিস্থিতিতে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে লাঠি না ভেঙে সাপ মারার ধূর্ততার শামিল নয় কি? ৪. প্রায়ই একটি বিশেষ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতাকালে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিত্ব ও মেরুদন্ডহীনতার কথা বলে। ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে দুই কূল রক্ষার মানসিকতা সে সমালোচনাকে সত্য প্রমাণ করবে। ৫. সমালোচনাও করা হলো, পুরস্কারও দেয়া হলো ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করে। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। অনেকেই বলবে, স্বৈরাচার হলেও তারা তো নির্বাচিত! কিন্তু আসলে সেখানে ভোট, ভোটার আর নির্বাচনের অস্তিত্ব নিয়েই বিরোধী দলের প্রধান সমালোচনা। বৈধতার সঙ্কটটিও সেখানেই। অতএব চটকদার শোনালেও ‘সুজন’ বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে উল্লেখ করে প্রকৃত সত্যের উদ্ভাসন ঘটায়নি।
ইতিহাস থেকে আমাদের জানতে হবে যে, জনপ্রিয় বা নির্বাচিত স্বৈরাচার ছিল জার্মানীর হিটলার। কারণ, হিটলার সম্পূর্ণ অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হন। পরে অবশ্য তিনি স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হন। আমাদের জানা-শোনার মধ্যেও অনেকেই প্রথমে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও পরে একদলীয় বা স্বৈরাচারী হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যে স্বৈরাচার নির্বাচিতই হয়নি, সেটাকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলার মানে কি? ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচনও গত নির্বাচনের চেয়ে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছিল। তারপরেও কেউ কখনো এরশাদকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলেনি। বলেছে স্বৈরাচারী এরশাদ। আর এখন প্রবল সমালোচনামুখর নির্বাচনের পর কাউকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’-এর সার্টিফিকেট দেয়া কি করে সম্ভব?
জানি না, আওয়ামী লীগ ‘সুজন’-এর বক্তব্যের জবাবে বা প্রতিবাদে কি বলবে। সেই বক্তব্য শুনেই অনুধাবন করা যাবে যে, ‘সুজন’-এর উপমা তারা পছন্দ করেছে কি না! বিএনপি, জামায়াত বা অপরাপর বিরোধী দল ‘সুজন’-এর বক্তব্যের সাথে একমত হবে বলে মনে হয় না। স্বৈরাচারকে কেউই ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ হিসাবে মানবে বলে মনে হয় না। তাহলে ‘সুজন’-এর বক্তব্যের তাৎপর্য ও সার্থকতা কি? তাৎপর্য বা মূলমর্ম এটাই যে, পরিস্থিতি এখন এতটাই স্পষ্ট ও বিভাজিত যে কর্তাভজা কথায় আর কাজ হবে না। শ্যাম বা কূল একটা রাখতে হবে। ‘সুজন’কে এটা বুঝতে হবে।
বাংলাদেশ নতুন বছরে আরো তীব্রভাবে গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের দাবিতে সোচ্চার হবে। বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদী একদলীয় শাসন বা স্বৈরতন্ত্র কায়েম হওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এ কথাই বলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাচ্ছে। দেশের মানুষও সেটাই চাইছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে সংলাপ বা আলোচনায় মোটেই আগ্রহী বলে মনে হয় না। বরং হামলা-মামলা চালানো হচ্ছে। সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে বিরোধী দলের সামনে আন্দোলন ও লড়াই ছাড়া বিকল্প কি থাকতে পারে? বিরোধী দল আর গণতন্ত্রকামী মানুষকেও তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। কার্যকর কিছু করতে হলে বাস্তবতার পথ ধরেই করতে হবে। বাস্তবতা যদি সংলাপের পথে যায়, ভালো। নইলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে কে জানে! কারণ আজও একটি হরতাল শুরু হয়েছে। লাগাতার হরতাল ও আন্দোলন-অবরোধের ডাকও দেয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের প্রতি বার বার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাও বোধ হয় ঠিক হবে না। কারণ গণআন্দোলনকে কখনোই ছোট করে দেখতে নেই। গণআন্দোলনকে ছোট করে দেখে যারা, তারা গণতন্ত্রের পক্ষের লোক নয়। বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের পক্ষ আর বিপক্ষের স্পষ্ট বিভাজন হয়ে গেছে। এটাই ২০১৪ সালের বাস্তবতা। ২০১৫ সালে গণতন্ত্র বাংলাদেশে বিজয়ী হবে এটাই সবাই প্রত্যাশা করছে। বাংলাদেশ ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বা অন্য কিছুর অধীনে নয়; বাংলাদেশ প্রথমত ও শেষত থাকবে গণতন্ত্রেরই নিয়ন্ত্রণাধীন। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনগণ স্বৈরাচার বা একদলীয় শাসন কখনোই মানবে না। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পক্ষেই পথ চলবে ২০১৫ সালে। এটাই নতুন বছরের প্রত্যাশা।
এমতাবস্থায় জনগণের প্ল্যাটফরম নামে পরিচিত ২০ দলীয় জোট আসন্ন ৫ জানুয়ারির ভোট ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে উদ্যোগী হয়েছে এবং সরকার যথারীতি জনসমাবেশ করতে না দেয়ার পথে এগুচ্ছে। এতে স্পষ্ট হয় যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে কিছু আলাপ-আলোচনা হোক, সেটা সরকার চায় না। তারা কলঙ্ক লুকানোর মতো বিষয়টিকে লুক্কায়িত রাখতে চায়।
কিন্তু লুকিয়ে রাখতে চাইলেই সব কিছু লুকানো বা আড়াল করা যায় না। কারো চরিত্র, তার উপাধি, কারো অর্জন, কারো বিসর্জন লুকানোর বিষয় নয়। শেরে বাংলা বলতে মানুষ তার ভালো-মন্দ সব কিছুই অনুভব করে। সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, জিয়া, খালেদা, হাসিনা বা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কথা উঠলে মানুষ সেসব ব্যক্তি বা দলের ভালো বা মন্দ, অর্জন বা বিসর্জন, সব কিছুতেই চোখের সামনে দেখতে চায়। হয়তো ভয়ে, চাপে, আতঙ্কে সব কথা খোলামেলা বলতে পারে না। তবে সময়মতো সেগুলো বলার জন্য বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখে। একদিন ভয়ে কেউ বলতে পারেনি বলেই কোনোদিন বলতে পারবে না, এমন নয়। সময় ও সুযোগমতো আমলনামা প্রকাশ পাবেই।
২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে প্রবেশের মুখে ব্যক্তি বা দলের আমলনামাও সঙ্গে থাকবে। এটাই ইতিহাসের নিয়ম। ইতিহাস সর্বদাই জনগণের পক্ষে থাকে। যদি কেউ জানতে চায় ২০১৪ সালের প্রত্যাশা কি ছিল? তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে ইতিহাস মানবকণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলবে, ২০১৪ সালের প্রত্যাশা ছিল গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের প্রত্যাশা। প্রতিপক্ষ নিধন আর চরিত্র হননের রাজনীতির অবসান কামনা। ২০১৪ সালে মানুষের এসব প্রত্যাশা পূর্ণতা পায়নি। ২০১৫ সালেও বাংলাদেশের মানুষ এসব প্রত্যাশায় রাজপথ প্রকম্পিত করবে।
অথচ নতুন একটি বছরে মানুষকে সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়ে আশাবাদের প্রত্যয় জাগিয়ে দিতে পারতেন পদাধিকারী নেতৃত্ব। নতুন বছরে নতুন স্বপ্নে যদি আরো একজন মানুষকেও ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টির কবল থেকে বাঁচানো যায়, সেটাও বড় অর্জন হবে। সেটা না করে, সামনের দিকে এক কদমও অগ্রসর হওয়ার আশাবাদ না জাগিয়ে নিজস্ব ক্ষমতার বলয়কে মজবুত করার ঘৃণ্য অপচেষ্টাই বরং উগ্রভাবে দেখানো হচ্ছে। বিরোধী দলকে সম্মানজনক জায়গা দেয়া তো দূরের কথা, তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর কটু-কাটব্য করে বিকৃত আনন্দ লাভ করা হচ্ছে। একদিকে জেল, জুলুম, ফাঁসি চলছে। অন্যদিকে সভা-সমাবেশের রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের এই অবস্থাকে নানা নামে ডাকা হচ্ছে দেশ-বিদেশ থেকে। সর্বশেষ উপাধি দিয়েছে ‘সুজন’: ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’।
‘সুজন’ জ্ঞানী-গুণীদের সংগঠন। তারা যখন কোনো কথা বলে, তখন ধরে নিতে হয় যে, বুঝে-শুনেই বলছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ অ্যাখ্যা দিয়ে তারা কি জ্ঞানের পরিচয় দিলেন? নাকি মূর্খতার প্রচার করলেন? ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে কয়েকটি কারণে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ উপাধিটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ: ১. যেখানে ভোট হয়নি, ভোটার আসেনি, সেখানে স্বৈরতন্ত্রের সামনে ‘নির্বাচিত’ শব্দটি কি করে ব্যবহার করা যায়? ২. স্বৈরতন্ত্রের মতো একটি নিকৃষ্ট কুশাসনের কাঁধে ‘নির্বাচিত’ তকমা লাগিয়ে দিয়ে সেটার বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? ৩. সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মতো সুস্পষ্ট পরিস্থিতিতে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে লাঠি না ভেঙে সাপ মারার ধূর্ততার শামিল নয় কি? ৪. প্রায়ই একটি বিশেষ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতাকালে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিত্ব ও মেরুদন্ডহীনতার কথা বলে। ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে দুই কূল রক্ষার মানসিকতা সে সমালোচনাকে সত্য প্রমাণ করবে। ৫. সমালোচনাও করা হলো, পুরস্কারও দেয়া হলো ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করে। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। অনেকেই বলবে, স্বৈরাচার হলেও তারা তো নির্বাচিত! কিন্তু আসলে সেখানে ভোট, ভোটার আর নির্বাচনের অস্তিত্ব নিয়েই বিরোধী দলের প্রধান সমালোচনা। বৈধতার সঙ্কটটিও সেখানেই। অতএব চটকদার শোনালেও ‘সুজন’ বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে উল্লেখ করে প্রকৃত সত্যের উদ্ভাসন ঘটায়নি।
ইতিহাস থেকে আমাদের জানতে হবে যে, জনপ্রিয় বা নির্বাচিত স্বৈরাচার ছিল জার্মানীর হিটলার। কারণ, হিটলার সম্পূর্ণ অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হন। পরে অবশ্য তিনি স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হন। আমাদের জানা-শোনার মধ্যেও অনেকেই প্রথমে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও পরে একদলীয় বা স্বৈরাচারী হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যে স্বৈরাচার নির্বাচিতই হয়নি, সেটাকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলার মানে কি? ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচনও গত নির্বাচনের চেয়ে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছিল। তারপরেও কেউ কখনো এরশাদকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলেনি। বলেছে স্বৈরাচারী এরশাদ। আর এখন প্রবল সমালোচনামুখর নির্বাচনের পর কাউকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’-এর সার্টিফিকেট দেয়া কি করে সম্ভব?
জানি না, আওয়ামী লীগ ‘সুজন’-এর বক্তব্যের জবাবে বা প্রতিবাদে কি বলবে। সেই বক্তব্য শুনেই অনুধাবন করা যাবে যে, ‘সুজন’-এর উপমা তারা পছন্দ করেছে কি না! বিএনপি, জামায়াত বা অপরাপর বিরোধী দল ‘সুজন’-এর বক্তব্যের সাথে একমত হবে বলে মনে হয় না। স্বৈরাচারকে কেউই ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ হিসাবে মানবে বলে মনে হয় না। তাহলে ‘সুজন’-এর বক্তব্যের তাৎপর্য ও সার্থকতা কি? তাৎপর্য বা মূলমর্ম এটাই যে, পরিস্থিতি এখন এতটাই স্পষ্ট ও বিভাজিত যে কর্তাভজা কথায় আর কাজ হবে না। শ্যাম বা কূল একটা রাখতে হবে। ‘সুজন’কে এটা বুঝতে হবে।
বাংলাদেশ নতুন বছরে আরো তীব্রভাবে গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের দাবিতে সোচ্চার হবে। বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদী একদলীয় শাসন বা স্বৈরতন্ত্র কায়েম হওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এ কথাই বলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাচ্ছে। দেশের মানুষও সেটাই চাইছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে সংলাপ বা আলোচনায় মোটেই আগ্রহী বলে মনে হয় না। বরং হামলা-মামলা চালানো হচ্ছে। সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে বিরোধী দলের সামনে আন্দোলন ও লড়াই ছাড়া বিকল্প কি থাকতে পারে? বিরোধী দল আর গণতন্ত্রকামী মানুষকেও তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। কার্যকর কিছু করতে হলে বাস্তবতার পথ ধরেই করতে হবে। বাস্তবতা যদি সংলাপের পথে যায়, ভালো। নইলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে কে জানে! কারণ আজও একটি হরতাল শুরু হয়েছে। লাগাতার হরতাল ও আন্দোলন-অবরোধের ডাকও দেয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের প্রতি বার বার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাও বোধ হয় ঠিক হবে না। কারণ গণআন্দোলনকে কখনোই ছোট করে দেখতে নেই। গণআন্দোলনকে ছোট করে দেখে যারা, তারা গণতন্ত্রের পক্ষের লোক নয়। বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের পক্ষ আর বিপক্ষের স্পষ্ট বিভাজন হয়ে গেছে। এটাই ২০১৪ সালের বাস্তবতা। ২০১৫ সালে গণতন্ত্র বাংলাদেশে বিজয়ী হবে এটাই সবাই প্রত্যাশা করছে। বাংলাদেশ ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বা অন্য কিছুর অধীনে নয়; বাংলাদেশ প্রথমত ও শেষত থাকবে গণতন্ত্রেরই নিয়ন্ত্রণাধীন। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনগণ স্বৈরাচার বা একদলীয় শাসন কখনোই মানবে না। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পক্ষেই পথ চলবে ২০১৫ সালে। এটাই নতুন বছরের প্রত্যাশা।
কনক জ্যোতি
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন