মারমুখী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যে অতুলনীয় সে কথা সম্ভবত বলার অপেক্ষা রাখে না। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এ ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই যথারীতি নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। প্রতিপক্ষকে ধোয়ামোছা করার ব্যাপারে তিনি যে আসলেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী তার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রধানমন্ত্রীর গত কয়েকদিনের বক্তৃতায়। যেমন গত ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে একদলীয় অনুষ্ঠানে আবারও ব্যক্তিগতভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে এক হাত নিয়ে ছেড়েছেন তিনি। এবারের উপলক্ষ ছিল বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রধানমন্ত্রীর মরহুম পিতা সম্পর্কিত সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্য। ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত বলে মন্তব্যগুলো নিয়ে নতুন করে আলোচনার দরকার পড়ে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ছাড় দেননি একচুল পরিমাণও। বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আপনার ‘কুপুত্র’কে জিভ সামাল দিয়ে কথা বলতে বলবেন। তিনি নন, ‘সে’ যেভাবে ইতিহাস বিকৃত করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে বাংলার মানুষ তা সহ্য করবে না। তার অর্থাৎ তারেক রহমানের হাতে নাকি আইভি রহমানসহ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নিহত ২৪ জন নেতা-কর্মীর অনেক রক্ত- কথাটা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেভাবে হচ্ছে ঠিক সেভাবেই গ্রেনেড হামলারও বিচার হবে। ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি’- স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতারের এই স্লোগান স্মরণ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইয়াহিয়া খান ছিল একটা জানোয়ার। তার (তারেক রহমানের) কথায়ও ইয়াহিয়ার সুর শুনতে পাচ্ছেন জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ছেলেদের কি শিক্ষা দিলেন? রাষ্ট্রের টাকায় পুত্রদের মানুষ না বানিয়ে ‘বড় চোর’ বানিয়েছেন। তার (তারেক রহমানের) নাম নিতেও নাকি প্রধানমন্ত্রীর ঘৃণা লাগে জানিয়ে তিনি বলেছেন, লেখাপড়া শিখলে সে মানুষের মতো কথা বলতো। ইতিহাস বিকৃত করতো না। সতর্কও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, জানোয়ারকে কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তা দেশের মানুষ জানে। শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, বিএনপির নেত্রী নাকি টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না এবং এতিমদের অর্থ চুরি করেছেন বলেই কোর্টে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন, এত সাধু হলে কোর্টে যেতে ভয় পান কেন? ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ওদিকে প্রধানমন্ত্রী বলতে না বলতেই পাল্লা দিয়ে ময়দানে হাজির হয়েছেন তার অধীনস্থজনেরাও। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের সকলেই বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেছেন। সবার মুখেই দেখে নেয়ার হুমকি উচ্চারিত হচ্ছে। ধমক দিয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে এবং ক্ষমা চাইতে তো বলেছেনই, সৌজন্যের সীমানা ছাড়িয়ে একজন মন্ত্রী একথা পর্যন্ত বলেছেন যে, সম্মানের সঙ্গে তারা বেগম খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণ করতেও রাজি নন। ওই মন্ত্রী বিএনপির নেত্রীকে ‘মহিলা’ বলে সম্বোধন করেছেন। হুংকার দিয়ে তারা জানিয়ে রেখেছেন, বেগম জিয়া যেন আন্দোলনের চেষ্টা করে দেখেন। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটকে আন্দোলন করতে দেয়া দূরে থাকুক, রাজপথেও দাঁড়াতে দেবেন না তারা। রাজপথ তাদের দখলেই থাকবে। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তারা বলেছেন, কার কত শক্তি তা রাজপথেই দেখে নেয়া হবে।
অন্যদিকে যথেষ্ট কষে জবাব দিলেও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কিন্তু গণতন্ত্রসম্মত সৌজন্যের বাইরে যাননি। পরদিন, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯০-এর ছাত্র নেতাদের কনভেনশনে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আপনি আগে আপনার নিজের জিহ্বাকে সামলান। নিজের মুখ সংযত করুন। ভাষা সুন্দর করুন। যেখানে বসে আছেন (প্রধানমন্ত্রীর আসন) সেখানে বসে এসব কথাবার্তা শোভা পায় না। বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী বা তার অধীনস্থজনেরা নন, সংযম এবং ভদ্রতার জন্য জনগণের সমর্থন পেয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। চোর ও কুপুত্র ধরনের শব্দযোগে বক্তব্য রাখার কারণে প্রধানমন্ত্রী বরং নিন্দিত হয়েছেন। অন্য কিছু বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। যেমন প্রধানমন্ত্রী যেখানে ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ বলে কোর্টে না যাওয়ার কারণে উপহাস করেছেন জনগণের মধ্যে সেখানে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা আর্থিক দুর্নীতিকেন্দ্রিক দুটি মামলা শেষ করার জন্য সরকারের তাড়াহুড়ো উল্টো প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। কারণ, বিচারক বদল এবং সময় চেয়ে করা বেগম জিয়ার প্রতিটি আপিলই খারিজ করা হয়েছে। বিচারিক আদালতও স্থাপিত হয়েছে সিএমএম কোর্ট এলাকার বাইরে পৃথক একটি স্থানে, যেখানে বিএনপি নেত্রীর জন্য নিরাপত্তার প্রচন্ড ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া বেগম জিয়া যেদিনই হাজির হতে গেছেন সেদিনই আদালত ভবনের লিফ্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ সবাই জানে, পায়ের অসুবিধার কারণে বেগম জিয়ার পক্ষে হেঁটে চারতলায় ওঠা সম্ভব নয়। ফলে বুঝতে অসুধিা হয়নি, সরকার চায় না, তিনি হাজির হোন এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করে অভিযোগের জবাব দিন। এ বিষয়টিকেই প্রধানমন্ত্রী উপহাস এবং আক্রমণের অজুহাত বানিয়েছেন।
বর্তমান পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ কেন এতটা মারমুখী হয়ে উঠেছেন তার কারণ জানতে হলে সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা দরকার। আসল কারণ হলো, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে নিজেদের বৈধতার সংকট এরই মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। এজন্যই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখে এবং সম্ভব হলে ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ঘটিয়ে নতুন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু করেছেন তারা। এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে বিশেষ করে মামলা দায়েরের এবং বিচার কাজ শেষ করার কার্যক্রম থেকে। সরকার মামলার পর মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিএনপি ও জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীদের ব্যতিব্যস্ত রাখার এবং দন্ড দেয়ার অপকৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সরকারের আসল লক্ষ্য, যে কোনোভাবে তাদের সাজা দেয়া বা দন্ডিত করা, যাতে তারা পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষিত হন। এই অভিযোগের পক্ষে তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিগত কয়েকদিনে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে অন্তত ২৯টি মামলা দায়ের করেছে সরকার। এসবের মধ্যে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের আর্থিক দুর্নীতিকেন্দ্রিক দুটি মামলা শেষ করার জন্য সরকারের তড়িঘড়ি এমনকি সাধারণ মানুষকেও বিস্মিত করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার অতি দ্রুত বিচার কাজ শেষ করতে চায়। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মামলার রায়ও সরকার সম্ভবত ঠিক করে রেখেছে। সে রায়ে বেগম খালেদা জিয়াকে কোনো না কোনো ধরনের দন্ড দেয়া হবে, যাতে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন। একইভাবে তার বড় ছেলে এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও সরকার অন্তত ২২টি মামলা ঠুকে রেখেছে। লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানকে মামলায় হাজির হওয়ার জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি করিয়েছে সরকার। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, হাজির হোন আর নাই হোন, তারেক রহমানকেও দন্ডিত করা হবে এবং তিনিও পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। উল্লেখ্য, বিএনপির অন্য সকল শীর্ষ নেতাকেও মামলায় জড়িয়ে ধাওয়ার মুখে রেখেছে সরকার। ৪১ জন বিশিষ্ট নেতার বিচারও শুরু হয়েছে সম্প্রতি। বলা হচ্ছে, সরকারের উদ্দেশ্য এসব নেতাকে দন্ডিত করা, যাতে তাদের পক্ষে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্ভব না হয়।
দৃশ্যত গণহারে মনে হলেও বাস্তবে বেছে বেছে এমন সব নেতার বিরুদ্ধেই মামলার পর মামলা দায়ের করা হচ্ছে, যারা ভবিষ্যতের নির্বাচনে অংশ নিতে এবং বিরাট ব্যবধানে জিততে পারেন। এটা যাতে ঘটতে না পারে এবং আওয়ামী লীগের জন্য যাতে নতুন পর্যায়েও ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হয় সেজন্যই সরকার মামলা দায়ের এবং কোনোভাবে দন্ড দেয়ার পন্থাকে আশ্রয় করেছে। একযোগে চালানো হচ্ছে গ্রেফতারের অভিযানও। এসব অভিযানের শিকার হচ্ছেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩০ হাজারের বেশি মামলা দায়ের করা আছে। ওদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। মামলাগুলোতে আসামী করা হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ নেতা-কর্মী ও সমর্থককে। লক্ষণীয় যে, জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা কোনোরকম রাখঢাক পর্যন্ত করছেন না। ২০০৯ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর পর যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ শীর্ষ নেতাদের কারাগারে ঢুকিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানসহ জামায়াতের অন্য শীর্ষ নেতারা ফাঁসির মঞ্চে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছেন। ১৯৭১ সালের পর জন্ম নেয়া বা কম বয়সের কারণে জামায়াতের যেসব নেতাকে যুদ্ধাপরাধী বানানো সম্ভব হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে মানুষ হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই একটি বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা কতটা মারমুখী ও মরীয়া তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ঢাকা মহানগরী জামায়াতের আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা থেকে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অন্তত দুইশ মামলা দায়ের করেছেন ক্ষমতাসীনরা। বর্তমান সময়ে মামলা দায়েরের পাশাপাশি চার্জশিট দেয়ার এবং কোনোভাবে রায় আদায় করার ব্যাপারেই বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের। বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে নতুন পর্যায়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করতে না করতেই ক্ষমতাসীনরা পুলিশের ওপর হুকুম জারি করে বসেছেন। সে অনুযায়ী পুলিশও নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠেছে। এভাবে সব মিলিয়েই সরকার এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। উদ্দেশ্য একটাই- বিরোধী দল যাতে আন্দোলন করতে না পারে। যাতে পরবর্তী নির্বাচন থেকে তাদের বাইরে রাখা যায়।
দেশের ভেতরে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেবল নয়, বিদেশেও- এমনকি সরকারি পর্যায়েও সরকারের এই নীতি ও কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও প্রকাশিত হতে বাকি থাকছে না। ক্ষমতাসীনরা কথায় কথায় যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দোহাই দিয়ে থাকেন তারাও সরকার সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে সম্পূর্ণরূপে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এখনো কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনরা বুঝতেই চাচ্ছেন না, মামলা এবং দমন-নির্যাতনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনই প্রতিহত করা যায় না। অন্যদিকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে উচিত যেখানে আলোচনা ও সমঝোতার পথে পা বাড়ানো এবং বিরোধী দলের দাবি মেনে নেয়া ক্ষমতাসীনরা সেখানে আরো একবার প্রধান দলগুলোকে বাইরে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৌশল নিয়েছেন। একটি সত্য তারা বুঝতেই পারছেন না। সে সত্যটি হলো, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রধান দলগুলোকে সাময়িককালের জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে না দেয়া গেলেও জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া ঘটবে তার ফল ক্ষমতাসীনদের জন্য অশুভ হয়ে উঠতে বাধ্য। ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন যে বারবার অনুষ্ঠান করা যাবে না এবং কোনোভাবে করা গেলেও তেমন নির্বাচন যে ক্ষমতাসীনদের বৈধতা এবং অস্তিত্বকেই উল্টো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে সে কথাটাও তারা সময় থাকতে অনুধাবন করতে পারছেন না। ক্ষমতাসীনরা বরং এগিয়ে চলেছেন উল্টোপথে। তারা বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখে নতুন একটি নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগোতে শুরু করেছেন। তাদের ধারণা, কোনোভাবে ৫ জানুয়ারির তুলনায় কিছুটা ভালো নির্বাচন করা গেলেই নতুন সরকারকে এখনকার মতো বৈধতার সংকটে পড়তে হবে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা কিন্তু মনেই করেন না যে, এভাবে যেনতেন ধরনের কোনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। নতুন সরকারকে এখনকার মতো বৈধতার সংকটে পড়তে হবে না।
ঘটনাপ্রবাহে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে একদলীয় বাকশাল শাসনের কথা। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পথই ধরেছেন। ৫ জানুয়ারির মিশন ব্যর্থ হলেও নতুন পর্যায়ে আবারও কোনোভাবে একটি সংসদ নির্বাচন করতে পারলেই প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটাবেন প্রধানমন্ত্রী। এমন অনুমানকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। উদ্বেগের কারণ হলো, বাকশাল অর্থ এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যার অধীনে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া দ্বিতীয় কোনো দল থাকতে পারবে না। ভিন্নমতাবলম্বী কোনো রাজনৈতিক দলকে কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী মাত্র সাড়ে তিন বছরে শুধু রক্ষীবাহিনীই বিরোধী দলের ৩৭ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছিল। এর বাইরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও লাল বাহিনীসহ আওয়ামী শিবিরের হাতেও অনেকের মৃত্যু ঘটেছিল। এসব হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মূল করা এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া। এ লক্ষ্যে সেকালের মুজিব সরকারের প্রচন্ড দমন-নির্যাতনে বিরোধী দলের কোমর ভেঙে গিয়েছিল। ফলে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সামনে কোনো প্রতিপক্ষই তখন ছিল না। তেমন এক পরিস্থিতিতেই, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সব দল নিষিদ্ধ করে সর্বময় ক্ষমতা নিয়েছিলেন নিজের হাতে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পথেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। একই উদ্দেশ্যে তিনি বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোকে নির্মূল করতে চাচ্ছেন। চাচ্ছেন একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসতে। সে লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যেই তিনি একের পর এক ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপ নিচ্ছেন, জাতিকে নতুন চেহারার বাকশাল দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ অবস্থায় ভিন্নমতও কিন্তু রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সবকিছু তার ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। কারণ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে দেশে এখন অত্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। সুতরাং শেখ হাসিনার পক্ষে পিতার মতো একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা উল্টো কুফলেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া বেগম খালেদা জিয়া বলে রেখেছেন, বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। আমরা জানি না, প্রধানমন্ত্রী এই কথাটার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন কি না। তেমন লক্ষণ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। কারণ সর্বশেষ উপলক্ষেও তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে ব্যঙ্গ-তামাশাই করেছেন। যে ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন তাকে আর যা-ই হোক, অন্তত ভদ্র এবং গণতন্ত্রসম্মত বলা যায় না।
ওদিকে প্রধানমন্ত্রী বলতে না বলতেই পাল্লা দিয়ে ময়দানে হাজির হয়েছেন তার অধীনস্থজনেরাও। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের সকলেই বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেছেন। সবার মুখেই দেখে নেয়ার হুমকি উচ্চারিত হচ্ছে। ধমক দিয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে এবং ক্ষমা চাইতে তো বলেছেনই, সৌজন্যের সীমানা ছাড়িয়ে একজন মন্ত্রী একথা পর্যন্ত বলেছেন যে, সম্মানের সঙ্গে তারা বেগম খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণ করতেও রাজি নন। ওই মন্ত্রী বিএনপির নেত্রীকে ‘মহিলা’ বলে সম্বোধন করেছেন। হুংকার দিয়ে তারা জানিয়ে রেখেছেন, বেগম জিয়া যেন আন্দোলনের চেষ্টা করে দেখেন। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটকে আন্দোলন করতে দেয়া দূরে থাকুক, রাজপথেও দাঁড়াতে দেবেন না তারা। রাজপথ তাদের দখলেই থাকবে। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তারা বলেছেন, কার কত শক্তি তা রাজপথেই দেখে নেয়া হবে।
অন্যদিকে যথেষ্ট কষে জবাব দিলেও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কিন্তু গণতন্ত্রসম্মত সৌজন্যের বাইরে যাননি। পরদিন, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯০-এর ছাত্র নেতাদের কনভেনশনে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আপনি আগে আপনার নিজের জিহ্বাকে সামলান। নিজের মুখ সংযত করুন। ভাষা সুন্দর করুন। যেখানে বসে আছেন (প্রধানমন্ত্রীর আসন) সেখানে বসে এসব কথাবার্তা শোভা পায় না। বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী বা তার অধীনস্থজনেরা নন, সংযম এবং ভদ্রতার জন্য জনগণের সমর্থন পেয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। চোর ও কুপুত্র ধরনের শব্দযোগে বক্তব্য রাখার কারণে প্রধানমন্ত্রী বরং নিন্দিত হয়েছেন। অন্য কিছু বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। যেমন প্রধানমন্ত্রী যেখানে ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ বলে কোর্টে না যাওয়ার কারণে উপহাস করেছেন জনগণের মধ্যে সেখানে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা আর্থিক দুর্নীতিকেন্দ্রিক দুটি মামলা শেষ করার জন্য সরকারের তাড়াহুড়ো উল্টো প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। কারণ, বিচারক বদল এবং সময় চেয়ে করা বেগম জিয়ার প্রতিটি আপিলই খারিজ করা হয়েছে। বিচারিক আদালতও স্থাপিত হয়েছে সিএমএম কোর্ট এলাকার বাইরে পৃথক একটি স্থানে, যেখানে বিএনপি নেত্রীর জন্য নিরাপত্তার প্রচন্ড ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া বেগম জিয়া যেদিনই হাজির হতে গেছেন সেদিনই আদালত ভবনের লিফ্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ সবাই জানে, পায়ের অসুবিধার কারণে বেগম জিয়ার পক্ষে হেঁটে চারতলায় ওঠা সম্ভব নয়। ফলে বুঝতে অসুধিা হয়নি, সরকার চায় না, তিনি হাজির হোন এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করে অভিযোগের জবাব দিন। এ বিষয়টিকেই প্রধানমন্ত্রী উপহাস এবং আক্রমণের অজুহাত বানিয়েছেন।
বর্তমান পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ কেন এতটা মারমুখী হয়ে উঠেছেন তার কারণ জানতে হলে সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা দরকার। আসল কারণ হলো, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে নিজেদের বৈধতার সংকট এরই মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। এজন্যই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখে এবং সম্ভব হলে ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ঘটিয়ে নতুন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু করেছেন তারা। এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে বিশেষ করে মামলা দায়েরের এবং বিচার কাজ শেষ করার কার্যক্রম থেকে। সরকার মামলার পর মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিএনপি ও জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীদের ব্যতিব্যস্ত রাখার এবং দন্ড দেয়ার অপকৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সরকারের আসল লক্ষ্য, যে কোনোভাবে তাদের সাজা দেয়া বা দন্ডিত করা, যাতে তারা পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষিত হন। এই অভিযোগের পক্ষে তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিগত কয়েকদিনে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে অন্তত ২৯টি মামলা দায়ের করেছে সরকার। এসবের মধ্যে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের আর্থিক দুর্নীতিকেন্দ্রিক দুটি মামলা শেষ করার জন্য সরকারের তড়িঘড়ি এমনকি সাধারণ মানুষকেও বিস্মিত করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার অতি দ্রুত বিচার কাজ শেষ করতে চায়। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মামলার রায়ও সরকার সম্ভবত ঠিক করে রেখেছে। সে রায়ে বেগম খালেদা জিয়াকে কোনো না কোনো ধরনের দন্ড দেয়া হবে, যাতে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন। একইভাবে তার বড় ছেলে এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও সরকার অন্তত ২২টি মামলা ঠুকে রেখেছে। লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানকে মামলায় হাজির হওয়ার জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি করিয়েছে সরকার। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, হাজির হোন আর নাই হোন, তারেক রহমানকেও দন্ডিত করা হবে এবং তিনিও পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। উল্লেখ্য, বিএনপির অন্য সকল শীর্ষ নেতাকেও মামলায় জড়িয়ে ধাওয়ার মুখে রেখেছে সরকার। ৪১ জন বিশিষ্ট নেতার বিচারও শুরু হয়েছে সম্প্রতি। বলা হচ্ছে, সরকারের উদ্দেশ্য এসব নেতাকে দন্ডিত করা, যাতে তাদের পক্ষে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্ভব না হয়।
দৃশ্যত গণহারে মনে হলেও বাস্তবে বেছে বেছে এমন সব নেতার বিরুদ্ধেই মামলার পর মামলা দায়ের করা হচ্ছে, যারা ভবিষ্যতের নির্বাচনে অংশ নিতে এবং বিরাট ব্যবধানে জিততে পারেন। এটা যাতে ঘটতে না পারে এবং আওয়ামী লীগের জন্য যাতে নতুন পর্যায়েও ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হয় সেজন্যই সরকার মামলা দায়ের এবং কোনোভাবে দন্ড দেয়ার পন্থাকে আশ্রয় করেছে। একযোগে চালানো হচ্ছে গ্রেফতারের অভিযানও। এসব অভিযানের শিকার হচ্ছেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩০ হাজারের বেশি মামলা দায়ের করা আছে। ওদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। মামলাগুলোতে আসামী করা হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ নেতা-কর্মী ও সমর্থককে। লক্ষণীয় যে, জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা কোনোরকম রাখঢাক পর্যন্ত করছেন না। ২০০৯ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর পর যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ শীর্ষ নেতাদের কারাগারে ঢুকিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানসহ জামায়াতের অন্য শীর্ষ নেতারা ফাঁসির মঞ্চে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছেন। ১৯৭১ সালের পর জন্ম নেয়া বা কম বয়সের কারণে জামায়াতের যেসব নেতাকে যুদ্ধাপরাধী বানানো সম্ভব হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে মানুষ হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই একটি বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা কতটা মারমুখী ও মরীয়া তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ঢাকা মহানগরী জামায়াতের আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা থেকে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অন্তত দুইশ মামলা দায়ের করেছেন ক্ষমতাসীনরা। বর্তমান সময়ে মামলা দায়েরের পাশাপাশি চার্জশিট দেয়ার এবং কোনোভাবে রায় আদায় করার ব্যাপারেই বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের। বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে নতুন পর্যায়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করতে না করতেই ক্ষমতাসীনরা পুলিশের ওপর হুকুম জারি করে বসেছেন। সে অনুযায়ী পুলিশও নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠেছে। এভাবে সব মিলিয়েই সরকার এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। উদ্দেশ্য একটাই- বিরোধী দল যাতে আন্দোলন করতে না পারে। যাতে পরবর্তী নির্বাচন থেকে তাদের বাইরে রাখা যায়।
দেশের ভেতরে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেবল নয়, বিদেশেও- এমনকি সরকারি পর্যায়েও সরকারের এই নীতি ও কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও প্রকাশিত হতে বাকি থাকছে না। ক্ষমতাসীনরা কথায় কথায় যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দোহাই দিয়ে থাকেন তারাও সরকার সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে সম্পূর্ণরূপে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এখনো কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনরা বুঝতেই চাচ্ছেন না, মামলা এবং দমন-নির্যাতনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনই প্রতিহত করা যায় না। অন্যদিকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে উচিত যেখানে আলোচনা ও সমঝোতার পথে পা বাড়ানো এবং বিরোধী দলের দাবি মেনে নেয়া ক্ষমতাসীনরা সেখানে আরো একবার প্রধান দলগুলোকে বাইরে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৌশল নিয়েছেন। একটি সত্য তারা বুঝতেই পারছেন না। সে সত্যটি হলো, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রধান দলগুলোকে সাময়িককালের জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে না দেয়া গেলেও জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া ঘটবে তার ফল ক্ষমতাসীনদের জন্য অশুভ হয়ে উঠতে বাধ্য। ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন যে বারবার অনুষ্ঠান করা যাবে না এবং কোনোভাবে করা গেলেও তেমন নির্বাচন যে ক্ষমতাসীনদের বৈধতা এবং অস্তিত্বকেই উল্টো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে সে কথাটাও তারা সময় থাকতে অনুধাবন করতে পারছেন না। ক্ষমতাসীনরা বরং এগিয়ে চলেছেন উল্টোপথে। তারা বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখে নতুন একটি নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগোতে শুরু করেছেন। তাদের ধারণা, কোনোভাবে ৫ জানুয়ারির তুলনায় কিছুটা ভালো নির্বাচন করা গেলেই নতুন সরকারকে এখনকার মতো বৈধতার সংকটে পড়তে হবে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা কিন্তু মনেই করেন না যে, এভাবে যেনতেন ধরনের কোনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। নতুন সরকারকে এখনকার মতো বৈধতার সংকটে পড়তে হবে না।
ঘটনাপ্রবাহে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে একদলীয় বাকশাল শাসনের কথা। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পথই ধরেছেন। ৫ জানুয়ারির মিশন ব্যর্থ হলেও নতুন পর্যায়ে আবারও কোনোভাবে একটি সংসদ নির্বাচন করতে পারলেই প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটাবেন প্রধানমন্ত্রী। এমন অনুমানকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। উদ্বেগের কারণ হলো, বাকশাল অর্থ এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যার অধীনে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া দ্বিতীয় কোনো দল থাকতে পারবে না। ভিন্নমতাবলম্বী কোনো রাজনৈতিক দলকে কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী মাত্র সাড়ে তিন বছরে শুধু রক্ষীবাহিনীই বিরোধী দলের ৩৭ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছিল। এর বাইরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও লাল বাহিনীসহ আওয়ামী শিবিরের হাতেও অনেকের মৃত্যু ঘটেছিল। এসব হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মূল করা এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া। এ লক্ষ্যে সেকালের মুজিব সরকারের প্রচন্ড দমন-নির্যাতনে বিরোধী দলের কোমর ভেঙে গিয়েছিল। ফলে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সামনে কোনো প্রতিপক্ষই তখন ছিল না। তেমন এক পরিস্থিতিতেই, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সব দল নিষিদ্ধ করে সর্বময় ক্ষমতা নিয়েছিলেন নিজের হাতে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পথেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। একই উদ্দেশ্যে তিনি বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোকে নির্মূল করতে চাচ্ছেন। চাচ্ছেন একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসতে। সে লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যেই তিনি একের পর এক ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপ নিচ্ছেন, জাতিকে নতুন চেহারার বাকশাল দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ অবস্থায় ভিন্নমতও কিন্তু রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সবকিছু তার ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। কারণ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে দেশে এখন অত্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। সুতরাং শেখ হাসিনার পক্ষে পিতার মতো একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা উল্টো কুফলেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া বেগম খালেদা জিয়া বলে রেখেছেন, বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। আমরা জানি না, প্রধানমন্ত্রী এই কথাটার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন কি না। তেমন লক্ষণ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। কারণ সর্বশেষ উপলক্ষেও তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে ব্যঙ্গ-তামাশাই করেছেন। যে ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন তাকে আর যা-ই হোক, অন্তত ভদ্র এবং গণতন্ত্রসম্মত বলা যায় না।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন