এক অশীতিপর প্রতিবেশী নাজিম উদ্দিন (মরহুম) আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। এই বয়োবৃদ্ধ আমাকে কেন অপার স্নেহে সিক্ত করতেন তা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। এজমার জটিল রোগী লাঠির উপর ভর দিয়ে প্রায়ই আমার কাছে আসতেন। বাড়ির দরজায় ডাক দিয়ে বলতেন, ‘মাচু’ বাড়ি আছ ? থাকলে সাড়া দিতে মোটেই বিলম্ব করতাম না। না থাকলে ‘মাচুকে কখন পাওয়া যাবে’ তা নিয়ে মা ব্যাপক প্রশ্নের সম্মুখীন হতেন। একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষের কিশোর প্রীতি বেশ উপভোগই করতাম আমি।
তখন আমার কৈশোর চললেও এই বর্ষীয়ান হয়তো মনে করতেন এই বিশ্বচরাচরে যা ঘটে তার সবই আমার নখদর্পণে। আর জ্ঞান-গরিমায় আমার জুরি মেলা ভার। ভাবটা সেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ট্রেনের সহযাত্রীর মত। আলাপচারিতায় কবির মনে হয়েছিল যে, হয়তো স্রষ্টা সেই সহযাত্রীর সাথে পরামর্শ করেই সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। বৃদ্ধের ভাবসাব দেখে মনে হয় তিনিও হয়তো মনে করতেন দুনিয়াতে আমার অজানা বলতে কিছু নেই। আমি মনে হয় একেবারে ‘সবজান্তা সমশের’।
তিনি প্রায় প্রতিদিনই এসে নামাযের সুরা-কেরাত, তাসবীহ-তাহলীল, দোয়া-দরুদগুলোর সঠিকতা ও বিশুদ্ধতা যাচাই করার চেষ্টা করতেন আমার কাছে। একমাত্র বয়সের ভারে ন্যুব্জ হওয়ায় স্মৃতিশক্তির সমস্যা ছাড়া আমার জানামতে তার এসবে তেমন বড় ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়নি। তবে বার্ধক্যের কারণে উচ্চারণ বিভ্রাটটা ছিল কিছুটা। আমি একথা উপলব্ধি করতে পারতাম যে, তার সমস্যাগুলো শুধুই বার্ধক্যজনিত। তাই তাকে প্রবোধ দিয়ে বলতাম, ‘সব ঠিক আছে’। অন্যরা হয়তো বিভিন্ন ছুতা-নাতায় শুধুই তার ভুল তালাশ করতেন। এটাই বৃদ্ধের কিশোরে তুষ্টির কারণ হতে পারে।
একদিন অতিপ্রত্যুষেই এই বয়োবৃদ্ধ লাঠির উপর ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ‘মাচু!’ বলে দরজায় হাঁক দিলেন। বাড়িতে থাকায় আমি সাড়া দিতে মোটেই বিলম্ব করিনি। দরজায় বের হয়ে দেখি বৃদ্ধ ততক্ষণে বসে পড়েছেন। লাঠির উপর ভর দিয়ে হাঁপাচ্ছেন। অন্যদিনের তুলনায় সেদিন তার শ্বাসকষ্টটা আমার কাছে প্রকটই মনে হয়েছিল। তার এ দুরবস্থা দেখে আমি দু’হাত দিয়ে তাকে ধরলাম। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধুই বললেন, ‘চুদরাম, চুদরাম!!!’ তার কথার কোন মাথা-মুন্ডু না পেলেও বুঝলাম যে, কথিত এই ‘চুদরাম’ সম্পর্কে তিনি আমার কাছে কিছু জানতে চাইছেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে ‘চুদরাম’এর পরিচয় আবিষ্কার করতে পারলাম না। একটু পরেই বৃদ্ধের ছেলেরা এসে তাকে নিয়ে গেলেন।
পরে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম স্থানীয় একটি বাজারে গতরাতে বড় ধরনের ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষুব্ধ জনতা ডাকাত দলকে ব্যাপক গণপিটুনি দিয়ে কয়েকজনকে মারাত্মকভাবে যখম করেছে। পাঁচ-সাত জনের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। সেই দলেরই একজন আমাদেরই হিন্দু প্রতিবেশী শ্রী সুদাম চন্দ্র মহন্তও (প্রয়াত) ব্যাপকভাবে প্রহৃত হয়েছে। প্রতিবেশী হওয়ায় বৃদ্ধের উদ্বেগটা বোধহয় সেখানেই। তিনি এ বিষয়েই সর্বশেষ খবরটা আমার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন বলেই আমার মনে হয়েছিল।
সেদিনের গণপিটুিনতে ডাকাত দলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এমনকি ডাকাত দলের তিন সহোদরও মারাত্মকভাবে জখমের ঘটনাও ঘটেছে। পরবর্তীতে ২ ভাইয়ের মৃত্যুর কারণও ছিল এই গণপিটুনি। কিন্তু এই ডাকাত দলের নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচারে মানুষ এত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন যে এ ঘটনাকে সকল শ্রেণির মানুষই স্বাগত জানিয়েছিল। গণপিটুনির ঘটনা হওয়ায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোন মামলাও হয়নি। ফলে একথা ধরে নেয়া যায় যে, স্থানীয় প্রশাসনও বিষয়টি ইতিবাচক হিসাবেই নিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি সৃষ্টি হয়েছিল অন্যখানে।
গণপিটুিন নিয়ে সেদিন কারো কোন প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু শ্রী সুদাম চন্দ্র মহন্তের গণপিটুিনটা সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়েছিল বেশ জোরেশোরেই। ডাকাত দলের একমাত্র হিন্দু সদস্য ছিল সে সুদাম চন্দ্র তথা বৃদ্ধ কথিত ‘চুদরাম’। একশ্রেণির মতলববাজদের প্রচারণায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, সংখ্যালঘু জন্যই সুদামকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এমনকি এ বিচার দেয়া হয়েছিল প্রতিবেশী দেশেও। কিন্তু ঘটনাটা মোটেই সাম্প্রদায়িক বা সংখ্যালঘু বিষয়ক ছিল না বরং ডাকাতি সংক্রান্ত ছিল না। কিন্তু এদেশের একশ্রেণির মওকাবাজ ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে মোটেই কুণ্ঠাবোধ করেনি। আর বৃদ্ধ নাজিম উদ্দীন তো প্রতিবেশী হওয়ার কারণে সুদাম চন্দ্রের উপর সহানুভূতিশীল ছিলেন।
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরের কথা। সে নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছিল। এসবের মধ্যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। গণমাধ্যমে খবর আসতে শুরু করলো যে, ৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক সহিংসতা চালাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এমনকি নারীরাও পাশবিক ও আদিম লালসা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। একটা ঘটনা আমার মনে বেশ জোরেশোরে নাড়া দিয়েছিল তা হলো ৪ দলীয় নেতাকর্মীরা একজন হিন্দু হোটেল কর্মচারীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা। এই ঘটনায় আমি যারপর নাই ব্যথিত হয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই যখন জানতে পারলাম ঘটনাটা কোন হত্যাকা- ছিল না বরং ছিল একটি নিছক দুর্ঘটনা। হোটেলের কেরোসিনের চুলা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন সেই হোটেল কর্মচারী। তখন এই রটনার ঘটক-অনুঘটকদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করা ছাড়া উপায় ছিল না। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, এরা আর কেউ ছিল না বরং ঘরের শত্রু বিভীষণরাই এই কল্পকাহিনী প্রচার করেছিল।
এঘটনার পর কৌতূহল বশতই ছুটে গিয়েছিলাম আমার এক বর্ষীয়ান হিন্দু প্রতিবেশী জগবন্ধুর কাছে। তিনি নবীনদের কাছে ‘যোগা কাকা’ নামে পরিচিত। আমিও তার নাম না নিয়ে ‘কাকা’ বলেই সম্বোধন করে থাকি। আমি তাকে সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে বেশ সম্মানের চোখেই দেখতাম। তিনিও আমাকে স্নেহবশত ‘বাবু’ বলে ডাকতেন।
একদিন খুব সকালেই যোগা কাকার দরজায় কড়া নাড়লাম। সাড়াও পাওয়া গেল দ্রুতই। তিনি আমাকে ঘরের মধ্যে বসালেন। আমি তার কাছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলাম। তিনি একগাদা নতুন-পুরাতন পত্রিকা আমার সামনে হাজির করে সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ক সংবাদ একটা একটা করে আমাকে দেখাতে লাগলেন। আমি অবাক বিস্ময়ে একটার পর একটা দেখতে লাগলাম। দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রটা আমার সামনে ভেসে উঠলো। তিনি হিন্দু হোটেল কর্মচারীকে পুড়িয়ে হত্যার সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরটা বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখালেন। তিনি সার্বিকভাবে আমার কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে, বাংলাদেশে কোন হিন্দু যুবতীর সম্ভ্রম এখন আর অবশিষ্ট নেই বরং সব লুটিয়ে নিয়েছে ৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা।
তার সব কথায় মনোযোগ দিয়ে শুনলাম আমি। সবকিছুই বোঝার চেষ্টাও করলাম। তার কথা বলার সময় কোন বাধা দিলাম না। তার কথা শেষ হলে বললাম, ‘কাকা, দীর্ঘদিন এক সাথেই বসবাস করি। আমরা মুসলমানরা নিজেরা নিজেরা মারামারি করলেও আপনাদের সাথে তো কখনো জোরে কথাও বলেছি বলে তো স্মরণ হয় না। আমাদের এলাকায় তো সংখ্যালঘু নিগ্রহের ঘটনা তো চোখে পড়ে না। তাহলে কী পত্রিকায় প্রকাশিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্রগুলো কী বাস্তব ? শুনেছি হোটেল কর্মচারী কেরোসিনের চুলা বিস্ফোরণে মারা গেছেন। আমাদের এলাকায় কোন সংখ্যালঘু নারীর সম্ভ্রম হারানোর কোন রেকর্ড আছে?
মুখে খই ফোটানো যোগা কাকা এবার কিছুটা থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর যা বললেন, তার নির্যাসটা হলো, গণমাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্বাচনের যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে তার সবই সত্য। কেরোসিনের চুলা দুর্ঘটনায় হোটেল কর্মচারীর মৃত্যুর ঘটনাও তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। তার বক্তব্যের উপসংহার হলো শুধুমাত্র আমাদের এলাকার সংখ্যালঘুরা মোটামোটি ভাল আছেন। তা ছাড়া গোটা দেশের চিত্র খুবই ভয়াবহ। কোন উঠতি বয়সের সংখ্যালঘু তরুণীর সম্ভ্রম নিয়ে বেঁচে আছেন বলে তিনি মনে করেন না।
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার বক্তব্য শুনছিলাম। আশাহত হয়েছি এই জন্য যে, যোগা কাকার মত সজ্জন মানুষের কাছে আরও দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করেছিলাম। কিন্তু তিনি সে আশায় গুড়ে বালি দিয়েছেন। বক্তব্য রেখেছেন সম্পূর্ণ একপেশে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। যা তার ব্যক্তিত্বের সাথে সঙ্গতিহীনই মনে হয়েছে আমার কাছে। হয়তো অতিমূল্যায়নের কারণেই আমার এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল।
আমাদের দেশের একশ্রেণির বিভীষণ রয়েছেন যারা বিভিন্ন ছুতা-নাতায় দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জিগির তোলেন। সামাজিক কিছু অপরাধকে সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসাবে চালিয়ে দেয়া হয়। মুসলামানের ছেলে মুসলমানের ছেলের সাথে মারামারি করে মারা গেলে তা পত্রিকার কোন খবর হয় না। কিন্তু মুসলিম-হিন্দু ‘বচসা’ হলেই সেখানে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খোঁজা হয়। মুসলমান চোর মুসলমানের ঘরে চুরি করলে সমস্যা হয় না। কিন্তু হিন্দু চোরও যদি হিন্দুর বাড়িতে চুরি করে তখন সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন ওঠে। আমার জীবদ্দশায় আমাদের গোয়াল থেকে তিনবার হালের গরু চুরি হয়েছে। এটাকে আমরা চুরি হিসাবেই দেখেছি। বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আমরা ঘটনা দুর্বৃত্তায়ন হিসাবেই চিহ্নিত করেছি। কিন্তু হিন্দুর পুকুরে কেউ জাল ফেললে বা বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটলেও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। প্রতিনিয়তই তো সংখ্যাগুরু মহিলারা ধর্ষণ ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু কোথাও যদি একজন সংখ্যালঘু মহিলা নিগ্রহের শিকার হন, সেটাকে নিয়েই তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক সামাজিক অপরাধ মনে করা হচ্ছে না।
মূলত প্রতিটি সমাজেই কিছু অপরাধ প্রবণ লোক থাকে। এদের কাজই হলো অপরাধ করা। এদের কোন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নেই। যেখানেই সুযোগ পায় সেখানেই তারা অপকর্ম করে বসে। আর দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার তো সবসময়ই হয়ে এসেছে। যেহেতু সংখ্যালঘুরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল তাই এসব অপরাধীরা অপরাধ প্রবণতা তাদের উপর বেশী। তাই এসব ঘটনার সাথে দেশের কোন ধর্মের বা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোন সম্পর্ক নেই বরং অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা। কিন্তু আমাদের দেশেরই একশ্রেণির মওকাবাজ এসব ঘটনার দায়দায়িত্ব দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও ধর্মপ্রাণ মানুষের উপর চাপিয়ে ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টায় লিপ্ত। যা আমাদের জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।
আমাদের দেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন যাদের অসাম্প্রদায়িকা ও সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার কথিত অবস্থান জীবন-জীবিকার প্রধান মূলধন। এরা দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের লীলাভূমি প্রমাণ করতেই বেশ পুলকবোধ করেন। কল্পকাহিনী রচনা করে ও তুচ্ছ ঘটনাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে রং চড়িয়ে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে আত্মস্বার্থ ও হীনস্বার্থ চরিতার্থ করেন। আর এধরনের গুরুতর অভিযোগে বিগত ৪দলীয় জোট সরকারের সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের আপত্তিকর ভিডিওসহ বিমানবন্দরে আটক হয়েছিলেন ঘাদানিক সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তার এসব ডকুমেন্টারি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এসবের সাথে সত্যতার দূরতম সম্পর্ক নেই বরং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ও বিশেষ উদ্দেশ্যে চিত্রায়ন করা হয়েছে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতার অন্যতম দিকপাল হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুনতাসির মামুন। তিনি চুন থেকে পান খসলেই দেশে সাম্প্রাদায়িক শক্তির উত্থান ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে পুলকবোধ করেন। কিন্তু হালে তার বোধোদয় হয়েছে বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু উপলব্ধিটা বিলম্বিত হলেও তাকে সাধুবাদ জানাতে কার্পণ্য করা মোটেই উচিত নয়। যাহোক ‘সংখ্যালঘু’, ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এসব বিষয়ে সোচ্চার ও এই ইস্যুর জনক অধ্যাপক মুনতাসির মামুনও তার সম্প্রতি তার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন বলেই মনে হচ্ছে। তিনি বোধহয় উপলব্ধি করতে পেরেছেন হিন্দু জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ২০ জুন ২০১৬, তারিখে বাংলাদেশে উগ্রহিন্দুত্ববাদের উত্থানের বিরুদ্ধে কলাম লিখেছে ‘দৈনিক জনকণ্ঠে’ । কলামের অংশ বিশেষ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি-
তিনি তার নিবন্ধে লিখেছেন,
১) “এ প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়ে লিখতে হচেছ। বিশেষ করে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক যখন প্ররোচনামূলক মিথ্যা বক্তব্য রাখেন তখন কিছু বলতেই হয়।”
২) “হিন্দু মহাজোট, হিন্দু সমাজ সংস্কারক সমিতি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের অনেক নেতাই বিভিন্নভাবে কথাবার্তা বলছেন। রানা দাশগুপ্ত নতুনভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার কথা বলেছি, রাস্তায় থেকেছি, তাদের অনেকের কাছে এ ঘটনাগুলো শুভবুদ্ধির পরিচায়ক বলে মনে হচ্ছে না। অন্তিমে তা হিন্দু সম্প্রদায়ের তো বটেই দেশেরও ক্ষতি হবে।”
৩) “হিন্দু মহিলারা বোরকা পরে চলাফেরা করেন, শাখা সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে, পুজো হয় না। এগুলো সর্বৈব মিথ্যা কথা। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা যদি এর জোরালো প্রতিবাদ না করেন তা’হলে বুঝতে হবে এই মিথ্যাচারের সঙ্গে তারাও যুক্ত। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের অবিলম্বে এর প্রতিবাদ জানান উচিত। না হলে, বুঝতে হবে নিজেদের উচ্চাকাক্সক্ষা মেটানোর জন্য তারা পরিকল্পনা করছেন। যদি সেটি করে থাকেন তবে নিশ্চিত তা বাস্তবায়িত হবে না। মুরুব্বি ধরে কোন লাভ হবে না। তিনি কিছুই করতে পারবেন না।”
৪) “ভারতের বিজেপি ঘোষণা করেছে, নির্যাতিত হয়ে ভারতে হিন্দুরা এলে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এর পরপরই বাংলদেশ থেকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা দিল্লি যান এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন গণ্যমান্য আমাকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, পরিষদের দু’একজন নেতা তাকে সফরসঙ্গী হতে বলেছিলেন। তিনি যাননি। যারা গিয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই আমাদের পরিচিত, ব্যক্তিগত বন্ধু, যদিও সফরটি একান্ত গোপনীয়তায় হয়েছে। আমাদের ঐ বন্ধু বললেন, ‘মোদির আমন্ত্রণে তাদের উল্লাস যদি দেখতেন! ব্যাপারটা আমার কাছে ভাল ঠেকেনি। মোদির কাছে আমরা কেন নালিশ করতে যাব?’ তাকে বলা হয়েছিল, মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে তিনি ভুল করেছেন। গোবিন্দ প্রামাণিকের প্রেস কনফারেন্সের পর, তিনি আমাকে জানালেন, না গিয়ে তিনি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে টার্গেট কিলিং শুরু হয়। ‘হিন্দুরা ভয়ে দেশত্যাগ করছে’ এ রকম হিড়িক তোলা হয়, রানা দাশগুপ্তের বক্তব্য প্রকাশিত হয়।
৫) “পশ্চিমবঙ্গে গত নির্বাচনে বিজেপির ভোট বেড়েছে। এটি আরও বৃদ্ধি পাবে যদি এখান থেকে বড় সংখ্যক হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। এখন যেহেতু ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রশ্ন আসছে, অনেকেই তাতে সাড়া দেবেন। পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎ আসা হিন্দু নাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিজিপি লাভবান হবে। অসমে বাংলাদেশী [মুসলমান] খেদাও আন্দোলন করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে যেটি কেউ সম্ভব বলে মনে করেননি।”
৬) “আমরা কে হিন্দু বা মুসলমান ধর্মাবলম্বী সেটি কখনও মনে করিনি, অন্তত আমার মনে কখনও আসেনি। আজ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে দেখছি, এখন আমরা প্রত্যেকে একে অপরকে চিহ্নিত করছি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ হিসেবে। বাঙালি পরিচয়টি এখন গৌণ। আমার মনে হয়েছে, আমাদের অধিকাংশ একটি পর্যায় পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক। একটা পর্যায়ের পর ধর্ম বিষয়টি চলেই আসে। এটি অস্বীকার করতে পারেন গায়ের জোরে, কিন্তু এটিই বাস্তব।”
আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে মানুষে মানুষে কোন বিভাজন সৃষ্টি করা হয়নি। সংবিধানে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু বলেও কোন কথা নেই। বরং সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (All citizens are equal before law and are entitled equal protection of law) অর্থাৎ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের সমাজ অধিকার নিশ্চিত করা হলেও মহল বিশেষ সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু প্রশ্ন তুলে জাতিকে বহুধাবিভক্ত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ ষড়যন্ত্রের সাথে যেমন যুক্ত আছেন একশ্রেণির বিভিষণ ও বিশেষ শ্রেণির মওকাবাজ সংখ্যালঘুও। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই অশুভ শক্তিকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের মত আমাদের সকলেরই শুভবুদ্ধির উদয় হোক এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
তখন আমার কৈশোর চললেও এই বর্ষীয়ান হয়তো মনে করতেন এই বিশ্বচরাচরে যা ঘটে তার সবই আমার নখদর্পণে। আর জ্ঞান-গরিমায় আমার জুরি মেলা ভার। ভাবটা সেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ট্রেনের সহযাত্রীর মত। আলাপচারিতায় কবির মনে হয়েছিল যে, হয়তো স্রষ্টা সেই সহযাত্রীর সাথে পরামর্শ করেই সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। বৃদ্ধের ভাবসাব দেখে মনে হয় তিনিও হয়তো মনে করতেন দুনিয়াতে আমার অজানা বলতে কিছু নেই। আমি মনে হয় একেবারে ‘সবজান্তা সমশের’।
তিনি প্রায় প্রতিদিনই এসে নামাযের সুরা-কেরাত, তাসবীহ-তাহলীল, দোয়া-দরুদগুলোর সঠিকতা ও বিশুদ্ধতা যাচাই করার চেষ্টা করতেন আমার কাছে। একমাত্র বয়সের ভারে ন্যুব্জ হওয়ায় স্মৃতিশক্তির সমস্যা ছাড়া আমার জানামতে তার এসবে তেমন বড় ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়নি। তবে বার্ধক্যের কারণে উচ্চারণ বিভ্রাটটা ছিল কিছুটা। আমি একথা উপলব্ধি করতে পারতাম যে, তার সমস্যাগুলো শুধুই বার্ধক্যজনিত। তাই তাকে প্রবোধ দিয়ে বলতাম, ‘সব ঠিক আছে’। অন্যরা হয়তো বিভিন্ন ছুতা-নাতায় শুধুই তার ভুল তালাশ করতেন। এটাই বৃদ্ধের কিশোরে তুষ্টির কারণ হতে পারে।
একদিন অতিপ্রত্যুষেই এই বয়োবৃদ্ধ লাঠির উপর ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ‘মাচু!’ বলে দরজায় হাঁক দিলেন। বাড়িতে থাকায় আমি সাড়া দিতে মোটেই বিলম্ব করিনি। দরজায় বের হয়ে দেখি বৃদ্ধ ততক্ষণে বসে পড়েছেন। লাঠির উপর ভর দিয়ে হাঁপাচ্ছেন। অন্যদিনের তুলনায় সেদিন তার শ্বাসকষ্টটা আমার কাছে প্রকটই মনে হয়েছিল। তার এ দুরবস্থা দেখে আমি দু’হাত দিয়ে তাকে ধরলাম। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধুই বললেন, ‘চুদরাম, চুদরাম!!!’ তার কথার কোন মাথা-মুন্ডু না পেলেও বুঝলাম যে, কথিত এই ‘চুদরাম’ সম্পর্কে তিনি আমার কাছে কিছু জানতে চাইছেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে ‘চুদরাম’এর পরিচয় আবিষ্কার করতে পারলাম না। একটু পরেই বৃদ্ধের ছেলেরা এসে তাকে নিয়ে গেলেন।
পরে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম স্থানীয় একটি বাজারে গতরাতে বড় ধরনের ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষুব্ধ জনতা ডাকাত দলকে ব্যাপক গণপিটুনি দিয়ে কয়েকজনকে মারাত্মকভাবে যখম করেছে। পাঁচ-সাত জনের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। সেই দলেরই একজন আমাদেরই হিন্দু প্রতিবেশী শ্রী সুদাম চন্দ্র মহন্তও (প্রয়াত) ব্যাপকভাবে প্রহৃত হয়েছে। প্রতিবেশী হওয়ায় বৃদ্ধের উদ্বেগটা বোধহয় সেখানেই। তিনি এ বিষয়েই সর্বশেষ খবরটা আমার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন বলেই আমার মনে হয়েছিল।
সেদিনের গণপিটুিনতে ডাকাত দলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এমনকি ডাকাত দলের তিন সহোদরও মারাত্মকভাবে জখমের ঘটনাও ঘটেছে। পরবর্তীতে ২ ভাইয়ের মৃত্যুর কারণও ছিল এই গণপিটুনি। কিন্তু এই ডাকাত দলের নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচারে মানুষ এত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন যে এ ঘটনাকে সকল শ্রেণির মানুষই স্বাগত জানিয়েছিল। গণপিটুনির ঘটনা হওয়ায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোন মামলাও হয়নি। ফলে একথা ধরে নেয়া যায় যে, স্থানীয় প্রশাসনও বিষয়টি ইতিবাচক হিসাবেই নিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি সৃষ্টি হয়েছিল অন্যখানে।
গণপিটুিন নিয়ে সেদিন কারো কোন প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু শ্রী সুদাম চন্দ্র মহন্তের গণপিটুিনটা সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়েছিল বেশ জোরেশোরেই। ডাকাত দলের একমাত্র হিন্দু সদস্য ছিল সে সুদাম চন্দ্র তথা বৃদ্ধ কথিত ‘চুদরাম’। একশ্রেণির মতলববাজদের প্রচারণায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, সংখ্যালঘু জন্যই সুদামকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এমনকি এ বিচার দেয়া হয়েছিল প্রতিবেশী দেশেও। কিন্তু ঘটনাটা মোটেই সাম্প্রদায়িক বা সংখ্যালঘু বিষয়ক ছিল না বরং ডাকাতি সংক্রান্ত ছিল না। কিন্তু এদেশের একশ্রেণির মওকাবাজ ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে মোটেই কুণ্ঠাবোধ করেনি। আর বৃদ্ধ নাজিম উদ্দীন তো প্রতিবেশী হওয়ার কারণে সুদাম চন্দ্রের উপর সহানুভূতিশীল ছিলেন।
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরের কথা। সে নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছিল। এসবের মধ্যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। গণমাধ্যমে খবর আসতে শুরু করলো যে, ৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক সহিংসতা চালাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এমনকি নারীরাও পাশবিক ও আদিম লালসা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। একটা ঘটনা আমার মনে বেশ জোরেশোরে নাড়া দিয়েছিল তা হলো ৪ দলীয় নেতাকর্মীরা একজন হিন্দু হোটেল কর্মচারীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা। এই ঘটনায় আমি যারপর নাই ব্যথিত হয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই যখন জানতে পারলাম ঘটনাটা কোন হত্যাকা- ছিল না বরং ছিল একটি নিছক দুর্ঘটনা। হোটেলের কেরোসিনের চুলা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন সেই হোটেল কর্মচারী। তখন এই রটনার ঘটক-অনুঘটকদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করা ছাড়া উপায় ছিল না। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, এরা আর কেউ ছিল না বরং ঘরের শত্রু বিভীষণরাই এই কল্পকাহিনী প্রচার করেছিল।
এঘটনার পর কৌতূহল বশতই ছুটে গিয়েছিলাম আমার এক বর্ষীয়ান হিন্দু প্রতিবেশী জগবন্ধুর কাছে। তিনি নবীনদের কাছে ‘যোগা কাকা’ নামে পরিচিত। আমিও তার নাম না নিয়ে ‘কাকা’ বলেই সম্বোধন করে থাকি। আমি তাকে সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে বেশ সম্মানের চোখেই দেখতাম। তিনিও আমাকে স্নেহবশত ‘বাবু’ বলে ডাকতেন।
একদিন খুব সকালেই যোগা কাকার দরজায় কড়া নাড়লাম। সাড়াও পাওয়া গেল দ্রুতই। তিনি আমাকে ঘরের মধ্যে বসালেন। আমি তার কাছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলাম। তিনি একগাদা নতুন-পুরাতন পত্রিকা আমার সামনে হাজির করে সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ক সংবাদ একটা একটা করে আমাকে দেখাতে লাগলেন। আমি অবাক বিস্ময়ে একটার পর একটা দেখতে লাগলাম। দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রটা আমার সামনে ভেসে উঠলো। তিনি হিন্দু হোটেল কর্মচারীকে পুড়িয়ে হত্যার সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরটা বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখালেন। তিনি সার্বিকভাবে আমার কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে, বাংলাদেশে কোন হিন্দু যুবতীর সম্ভ্রম এখন আর অবশিষ্ট নেই বরং সব লুটিয়ে নিয়েছে ৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা।
তার সব কথায় মনোযোগ দিয়ে শুনলাম আমি। সবকিছুই বোঝার চেষ্টাও করলাম। তার কথা বলার সময় কোন বাধা দিলাম না। তার কথা শেষ হলে বললাম, ‘কাকা, দীর্ঘদিন এক সাথেই বসবাস করি। আমরা মুসলমানরা নিজেরা নিজেরা মারামারি করলেও আপনাদের সাথে তো কখনো জোরে কথাও বলেছি বলে তো স্মরণ হয় না। আমাদের এলাকায় তো সংখ্যালঘু নিগ্রহের ঘটনা তো চোখে পড়ে না। তাহলে কী পত্রিকায় প্রকাশিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্রগুলো কী বাস্তব ? শুনেছি হোটেল কর্মচারী কেরোসিনের চুলা বিস্ফোরণে মারা গেছেন। আমাদের এলাকায় কোন সংখ্যালঘু নারীর সম্ভ্রম হারানোর কোন রেকর্ড আছে?
মুখে খই ফোটানো যোগা কাকা এবার কিছুটা থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর যা বললেন, তার নির্যাসটা হলো, গণমাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্বাচনের যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে তার সবই সত্য। কেরোসিনের চুলা দুর্ঘটনায় হোটেল কর্মচারীর মৃত্যুর ঘটনাও তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। তার বক্তব্যের উপসংহার হলো শুধুমাত্র আমাদের এলাকার সংখ্যালঘুরা মোটামোটি ভাল আছেন। তা ছাড়া গোটা দেশের চিত্র খুবই ভয়াবহ। কোন উঠতি বয়সের সংখ্যালঘু তরুণীর সম্ভ্রম নিয়ে বেঁচে আছেন বলে তিনি মনে করেন না।
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার বক্তব্য শুনছিলাম। আশাহত হয়েছি এই জন্য যে, যোগা কাকার মত সজ্জন মানুষের কাছে আরও দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করেছিলাম। কিন্তু তিনি সে আশায় গুড়ে বালি দিয়েছেন। বক্তব্য রেখেছেন সম্পূর্ণ একপেশে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। যা তার ব্যক্তিত্বের সাথে সঙ্গতিহীনই মনে হয়েছে আমার কাছে। হয়তো অতিমূল্যায়নের কারণেই আমার এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল।
আমাদের দেশের একশ্রেণির বিভীষণ রয়েছেন যারা বিভিন্ন ছুতা-নাতায় দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জিগির তোলেন। সামাজিক কিছু অপরাধকে সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসাবে চালিয়ে দেয়া হয়। মুসলামানের ছেলে মুসলমানের ছেলের সাথে মারামারি করে মারা গেলে তা পত্রিকার কোন খবর হয় না। কিন্তু মুসলিম-হিন্দু ‘বচসা’ হলেই সেখানে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খোঁজা হয়। মুসলমান চোর মুসলমানের ঘরে চুরি করলে সমস্যা হয় না। কিন্তু হিন্দু চোরও যদি হিন্দুর বাড়িতে চুরি করে তখন সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন ওঠে। আমার জীবদ্দশায় আমাদের গোয়াল থেকে তিনবার হালের গরু চুরি হয়েছে। এটাকে আমরা চুরি হিসাবেই দেখেছি। বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আমরা ঘটনা দুর্বৃত্তায়ন হিসাবেই চিহ্নিত করেছি। কিন্তু হিন্দুর পুকুরে কেউ জাল ফেললে বা বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটলেও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। প্রতিনিয়তই তো সংখ্যাগুরু মহিলারা ধর্ষণ ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু কোথাও যদি একজন সংখ্যালঘু মহিলা নিগ্রহের শিকার হন, সেটাকে নিয়েই তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক সামাজিক অপরাধ মনে করা হচ্ছে না।
মূলত প্রতিটি সমাজেই কিছু অপরাধ প্রবণ লোক থাকে। এদের কাজই হলো অপরাধ করা। এদের কোন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নেই। যেখানেই সুযোগ পায় সেখানেই তারা অপকর্ম করে বসে। আর দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার তো সবসময়ই হয়ে এসেছে। যেহেতু সংখ্যালঘুরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল তাই এসব অপরাধীরা অপরাধ প্রবণতা তাদের উপর বেশী। তাই এসব ঘটনার সাথে দেশের কোন ধর্মের বা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোন সম্পর্ক নেই বরং অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা। কিন্তু আমাদের দেশেরই একশ্রেণির মওকাবাজ এসব ঘটনার দায়দায়িত্ব দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও ধর্মপ্রাণ মানুষের উপর চাপিয়ে ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টায় লিপ্ত। যা আমাদের জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।
আমাদের দেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন যাদের অসাম্প্রদায়িকা ও সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার কথিত অবস্থান জীবন-জীবিকার প্রধান মূলধন। এরা দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের লীলাভূমি প্রমাণ করতেই বেশ পুলকবোধ করেন। কল্পকাহিনী রচনা করে ও তুচ্ছ ঘটনাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে রং চড়িয়ে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে আত্মস্বার্থ ও হীনস্বার্থ চরিতার্থ করেন। আর এধরনের গুরুতর অভিযোগে বিগত ৪দলীয় জোট সরকারের সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের আপত্তিকর ভিডিওসহ বিমানবন্দরে আটক হয়েছিলেন ঘাদানিক সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তার এসব ডকুমেন্টারি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এসবের সাথে সত্যতার দূরতম সম্পর্ক নেই বরং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ও বিশেষ উদ্দেশ্যে চিত্রায়ন করা হয়েছে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতার অন্যতম দিকপাল হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুনতাসির মামুন। তিনি চুন থেকে পান খসলেই দেশে সাম্প্রাদায়িক শক্তির উত্থান ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে পুলকবোধ করেন। কিন্তু হালে তার বোধোদয় হয়েছে বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু উপলব্ধিটা বিলম্বিত হলেও তাকে সাধুবাদ জানাতে কার্পণ্য করা মোটেই উচিত নয়। যাহোক ‘সংখ্যালঘু’, ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এসব বিষয়ে সোচ্চার ও এই ইস্যুর জনক অধ্যাপক মুনতাসির মামুনও তার সম্প্রতি তার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন বলেই মনে হচ্ছে। তিনি বোধহয় উপলব্ধি করতে পেরেছেন হিন্দু জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ২০ জুন ২০১৬, তারিখে বাংলাদেশে উগ্রহিন্দুত্ববাদের উত্থানের বিরুদ্ধে কলাম লিখেছে ‘দৈনিক জনকণ্ঠে’ । কলামের অংশ বিশেষ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি-
তিনি তার নিবন্ধে লিখেছেন,
১) “এ প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়ে লিখতে হচেছ। বিশেষ করে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক যখন প্ররোচনামূলক মিথ্যা বক্তব্য রাখেন তখন কিছু বলতেই হয়।”
২) “হিন্দু মহাজোট, হিন্দু সমাজ সংস্কারক সমিতি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের অনেক নেতাই বিভিন্নভাবে কথাবার্তা বলছেন। রানা দাশগুপ্ত নতুনভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার কথা বলেছি, রাস্তায় থেকেছি, তাদের অনেকের কাছে এ ঘটনাগুলো শুভবুদ্ধির পরিচায়ক বলে মনে হচ্ছে না। অন্তিমে তা হিন্দু সম্প্রদায়ের তো বটেই দেশেরও ক্ষতি হবে।”
৩) “হিন্দু মহিলারা বোরকা পরে চলাফেরা করেন, শাখা সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে, পুজো হয় না। এগুলো সর্বৈব মিথ্যা কথা। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা যদি এর জোরালো প্রতিবাদ না করেন তা’হলে বুঝতে হবে এই মিথ্যাচারের সঙ্গে তারাও যুক্ত। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের অবিলম্বে এর প্রতিবাদ জানান উচিত। না হলে, বুঝতে হবে নিজেদের উচ্চাকাক্সক্ষা মেটানোর জন্য তারা পরিকল্পনা করছেন। যদি সেটি করে থাকেন তবে নিশ্চিত তা বাস্তবায়িত হবে না। মুরুব্বি ধরে কোন লাভ হবে না। তিনি কিছুই করতে পারবেন না।”
৪) “ভারতের বিজেপি ঘোষণা করেছে, নির্যাতিত হয়ে ভারতে হিন্দুরা এলে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এর পরপরই বাংলদেশ থেকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা দিল্লি যান এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন গণ্যমান্য আমাকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, পরিষদের দু’একজন নেতা তাকে সফরসঙ্গী হতে বলেছিলেন। তিনি যাননি। যারা গিয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই আমাদের পরিচিত, ব্যক্তিগত বন্ধু, যদিও সফরটি একান্ত গোপনীয়তায় হয়েছে। আমাদের ঐ বন্ধু বললেন, ‘মোদির আমন্ত্রণে তাদের উল্লাস যদি দেখতেন! ব্যাপারটা আমার কাছে ভাল ঠেকেনি। মোদির কাছে আমরা কেন নালিশ করতে যাব?’ তাকে বলা হয়েছিল, মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে তিনি ভুল করেছেন। গোবিন্দ প্রামাণিকের প্রেস কনফারেন্সের পর, তিনি আমাকে জানালেন, না গিয়ে তিনি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে টার্গেট কিলিং শুরু হয়। ‘হিন্দুরা ভয়ে দেশত্যাগ করছে’ এ রকম হিড়িক তোলা হয়, রানা দাশগুপ্তের বক্তব্য প্রকাশিত হয়।
৫) “পশ্চিমবঙ্গে গত নির্বাচনে বিজেপির ভোট বেড়েছে। এটি আরও বৃদ্ধি পাবে যদি এখান থেকে বড় সংখ্যক হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। এখন যেহেতু ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রশ্ন আসছে, অনেকেই তাতে সাড়া দেবেন। পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎ আসা হিন্দু নাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিজিপি লাভবান হবে। অসমে বাংলাদেশী [মুসলমান] খেদাও আন্দোলন করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে যেটি কেউ সম্ভব বলে মনে করেননি।”
৬) “আমরা কে হিন্দু বা মুসলমান ধর্মাবলম্বী সেটি কখনও মনে করিনি, অন্তত আমার মনে কখনও আসেনি। আজ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে দেখছি, এখন আমরা প্রত্যেকে একে অপরকে চিহ্নিত করছি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ হিসেবে। বাঙালি পরিচয়টি এখন গৌণ। আমার মনে হয়েছে, আমাদের অধিকাংশ একটি পর্যায় পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক। একটা পর্যায়ের পর ধর্ম বিষয়টি চলেই আসে। এটি অস্বীকার করতে পারেন গায়ের জোরে, কিন্তু এটিই বাস্তব।”
আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে মানুষে মানুষে কোন বিভাজন সৃষ্টি করা হয়নি। সংবিধানে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু বলেও কোন কথা নেই। বরং সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (All citizens are equal before law and are entitled equal protection of law) অর্থাৎ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের সমাজ অধিকার নিশ্চিত করা হলেও মহল বিশেষ সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু প্রশ্ন তুলে জাতিকে বহুধাবিভক্ত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ ষড়যন্ত্রের সাথে যেমন যুক্ত আছেন একশ্রেণির বিভিষণ ও বিশেষ শ্রেণির মওকাবাজ সংখ্যালঘুও। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই অশুভ শক্তিকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের মত আমাদের সকলেরই শুভবুদ্ধির উদয় হোক এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন