বুধবার, ১৫ জুন, ২০১৬

কারাগারে ঠাঁই নেই


দেশের কারাগারগুলোতে ‘ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বন্দীর সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার তিন-চার গুণেরও বেশি হয়ে যাওয়ায় পালা বা শিফ্ট করে ঘুমাতে তো হচ্ছেই, অনেককে এমনকি বাথরুমেও রাত কাটাতে হচ্ছে। গত সোমবার দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, সারাদেশের বিভিন্ন কারাগারে যেখানে বড় জোর ৩৪ হাজার ৭৯৬ জন থাকতে পারে, সেখানে বর্তমানে ৭৫ হাজারের বেশি বন্দীকে কোনোভাবে থাকতে হচ্ছে। এটা অবশ্য চূড়ান্ত হিসাব নয়। কারণ, মাস তিনেক আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, কারাগারগুলোতে ৩৪ হাজার ৭৯৬ জনের স্থলে রয়েছে ৬৯ হাজার ৭৭৪ জন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাব দেয়ার পর একদিকে তিন মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে, অন্যদিকে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা। বিশেষ করে বিগত কিছুদিন ধরে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দমনের নামে পুলিশ গণহারে গ্রেফতারের অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযানে প্রকৃত বা প্রমাণিত জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা আদৌ গ্রেফতার হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে সঙ্গত কারণে। কেননা, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, পুলিশ প্রধানত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করছে। ধরেই সোজা চালান করে দিচ্ছে সাজানো মামলায়। এর ফলে গণতান্ত্রিক তৎপরতায় জড়িত রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা রাতারাতি জঙ্গি-সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন।
ওদিকে কারাগারগুলো ঠাঁই দিতে পারছে না এত বেশি বন্দীকে। নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা সরকারের পক্ষ থেকে যে পরিসংখ্যানই দেয়া হোক না কেন, বন্দীদের সংখ্যা এরই মধ্যে এক লাখ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ধারণ ক্ষমতার চার গুণের বেশি বন্দী রয়েছে কারাগারগুলোতে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই নানামুখী সমস্যায় পড়েছে বন্দীরা। আরামে ঘুমানোর মতো জায়গা পাওয়া দূরে থাকুক, অধিকাংশ বন্দীকে বরং পালা করে ঘুমাতে হচ্ছে। একজনের জায়গায় পাঁচ থেকে সাতজনকে শুতে হচ্ছে। একদল বন্দী যখন কোনোভাবে শোয়ার সুযোগ পাচ্ছে, অন্যদলকে তখন বসে কাটাতে হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, অসংখ্য বন্দী বাধ্য হয়ে বাথরুমে পর্যন্ত গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই। কারণ, কারো না কারো বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে যখন-তখন। শোয়ার ও ঘুমানোর সুযোগ পাওয়াটাই কারাগারের ভেতরের একমাত্র সমস্যা নয়। মশার উপদ্রব তো রয়েছেই, সেই সাথে আছে ছারপোকা ও তেলাপোকার মতো আরো কিছু যন্ত্রণা। তাছাড়া সাধারণভাবেও কারা অভ্যন্তরের পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। এমন অবস্থায় বন্দী মাত্রের জীবনই প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে পড়েছে। খবরে বলা হয়েছে, সব মিলিয়ে কারাগারগুলোর অভ্যন্তরে মানবিক বিপর্যয় ঘটতে শুরু করেছে।
আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এমন অবস্থা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আপত্তির কারণ শুধু ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি বন্দীকে জোর করে আটক রাখা নয়, ঘটনাপ্রবাহে প্রাধান্যে এসেছে সরকারের উদ্দেশ্যের দিকটি। এই উদ্দেশ্য যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও শায়েস্তা করা সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে ২০০৮ সালের ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নাটক সাজিয়ে ক্ষমতা দখলে নেয়ার পর বিরোধী দলকে দমনের ব্যাপারে সরকার উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। এই পর্যায়ে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসী তো দেয়া হয়েছেই, একযোগে সীমা ছাড়িয়ে গেছে দমন-নির্যাতনও। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দেশের কোথাও সভা-সমাবেশ ও মিছিল করতে দেয়া হয়নি। মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে পর্যন্ত ভণ্ডুল করে দিয়েছে পুলিশ। এসব অভিযানে পুলিশের সঙ্গে র‌্যাব’র পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও  আওয়ামী লীগের গুণ্ডা-সন্ত্রাসীরাও রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে অংশ নিয়েছে। ফলে বিরোধী দলের শত শত নেতা-কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। আহত ও পঙ্গু  হয়েছেন হাজার হাজার নেতা-কর্মী। তেমন অবস্থাই এখনো চলছে।
অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময়ও সরকারকে একই ধরনের মারমুখী  ভূমিকায় দেখা গেছে। বিএনপি ও জামায়াতের কারো পক্ষেই নির্বিঘেœ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বা প্রচারণা চালানো সম্ভব হয়নি। ফলে ‘নির্বাচিত’ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ‘জনপ্রিয়’ লোকজন। ইউপি নির্বাচনের  বিষয়টি সারা বিশ্বেই জানাজানি হয়েছে। নিন্দিত হয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু এতেও সরকারের নীতি-উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। সরকার বরং এমন নিষ্ঠুরতার সঙ্গেই দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতারের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে দেশে কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব না থাকে। কোনোভাবে টিকে থাকলেও কোনোদলের পক্ষেই যাতে সরকারের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন বা আন্দোলন করা সম্ভব না হয়। এটাই আসলে কারাগারগুলোতে ‘ঠাঁই’ না থাকার প্রধান কারণ। আমরা এমন অবস্থার বিরোধিতা করি এবং অনতিবিলম্বে কারাগারের অভ্যন্তরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দাবি জানাই। সরকারকে এজন্য ঢালাও গ্রেফতার অভিযান বন্ধ করতে হবে এবং সাজানো মামলায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কারাগারে পাঠানো চলবে না। একই সঙ্গে এমন ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দেশের কোনো কারাগারেই ধারণ ক্ষমতার বেশি বন্দী না রাখতে হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads