অবশেষে খুলনা মহানগরীর তিন নিখোঁজ যুবকের খোঁজ পাওয়া গেছে। তারা এখন ঢাকা কারাগারে আছেন।
সংবাদপত্রের সাথে জড়িত নন, এমন ছাপোষা মানুষদের পক্ষে নিজের পয়সায় রোজ একাধিক খবরের কাগজ কিনে পড়া কষ্টসাধ্যই বটে। সরকারের দাবি অনুযায়ী আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। আমরা নিম্নমধ্যবিত্তের পর্যায়ে পৌঁছে গেছি এবং ২০১৮ সালের মধ্যে মধ্যবিত্তের পর্যায়ে পৌঁছতে চলেছি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মোতাবেক বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ ডলার। জাতিসংঘসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিকে সমর্থন করছে। সুতরাং আমারও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার কথা স্বীকার করছি। কিন্তু দু:খের বিষয়, এ রকম কোনো আর্থিক উন্নতি আমার ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি না। শুধু একটি উদাহরণ দেই। ২০১৫ সালের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতেও আমার সামর্থ্য অনুযায়ী মাসে ৩ কেজি গরুর গোশত (তখন ২৮০-৩০০টাকা কেজি ছিল) কিনতাম। বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হওয়ায় মার্চ মাস থেকে দাম বেড়ে যখন ৪শ’ ছুঁতে চলল তখন গরুর গোশত কেনার পরিমাণ মাসে ৩ কেজি থেকে কমে ১ কেজিতে ঠেকল। কারণ গরুর গোশতের দাম বাড়লেও আমার পয়সার যোগান বাড়েনি। এখন এত আর্থিক উন্নতি দেশের, অনেক মানুষের, কিন্তু আমার গরুর গোশত কেনার সামর্থ্য ঐ ১ কেজি ছাড়ায়নি। তাহলে আয়টা বাড়ল কাদের, আর আয় বৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে কারা? এর জবাব আমি জানি না, সরকারের সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা জানেন। দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে না তা নয়, তবে সত্য হচ্ছে যে হারে ঢাক-ঢোল পেটানো হচ্ছে সে হারে হচ্ছে না। আর যা হচ্ছে তার সুফলটুকু ভোগ করছে বিশেষ একটি শ্রেণি।
যে কারণে এত কথা বলা তা হলো, সব সংবাদপত্রই সব খবর ছাপে না। তা বলে কারো পক্ষে সকল সংবাদ জানার জন্য রোজ একাধিক পত্রিকা কেনাও সম্ভব নয়। যাহোক, গত ১৭ জুন দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় একটি খবর চোখে পড়ল। তাহলো- ‘এক মাস পর ঢাকা কারাগারে খোঁজ মিলল খুলনার গুম হওয়া তিন যুবকের।’ আর কারা এ খবরটি ছেপেছে জানি না। তবে ইন্টারনেটে প্রধান ২-৩টি পত্রিকায় সন্ধান করে দেখা গেল তারা এ খবরটি ছাপেনি। কেন, তা তাদের ব্যাপার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, খুলনা মহানগরীতে একই দিনে তিন জায়গা থেকে তিন যুবককে তুলে নেয়া হয় গত ১২ মে। তারা হচ্ছেন : হরিণটানা থানার বিসমিল্লাহ নগর কওমি মাদরাসা ও এতিমখানার দু’শিক্ষক শোয়াইব বিশ্বাস ও আবদুল্লাহ সাইম তূর্য এবং ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মনিরুল ইসলাম। সবাইকে তুলে নেয় ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন। বহু চেষ্টা করেও খুলনার থানা পুলিশ ও ডিবির কাছ থেকে তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি। ঘটনার পর খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (ডিবি) মো. কামরুল ইসলাম ডিবি পরিচয়ে কাউকে তুলে নেয়ার ঘটনা তাদের জানা নেই বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘তাদের নিখোঁজের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তাদের উদ্ধারেও কাজ করছে ডিবি।’ ভীষণ উদ্বিগ্ন তাদের পিতারা অপহৃত পুত্রদের ব্যাপারে সবাই থানায় মামলা ও জিডি করেন। তাতে কোনো ফল না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে তিন জনের অসহায় পিতা ২৬ মে খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তারা ‘আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দাও’ বলে প্রশাসনের কাছে আকুল আবেদন জানান। কিন্তু অসহায় পিতাদের সে আহাজারি কারো কানে পৌঁছেনি। সে সংবাদ সম্মেলনের খবরটি দৈনিক সংগ্রামসহ কয়েকটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। সেই পিতাদের মর্মস্পর্শী আহাজারি নিয়ে ১১ জুন দৈনিক সংগ্রামে উপসম্পাদকীয় কলামে ‘আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দাও’ নামে একটি নিবন্ধও প্রকাশিত হয়।
গত ১৭ জুন সংগ্রামে “এক মাস পর ঢাকা কারাগারে খোঁজ মিলল খুলনার গুম হওয়া তিন যুবকের” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। এ খবরে বলা হয়, তিন যুবক নিখোঁজ হওয়ার একমাস পর তাদের সন্ধান পাওয়া গেছে। ১২ জুন তাদের যাত্রাবাড়ি থানায় দায়েরকৃত সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। এ মামলায় তাদের রিমান্ডেও নেয়া হয়। তারা সবাই ডিএমপির ডিবির হেফাজতে ছিল। ১৬ জুন ঐ রিপোর্ট লেখার দিনটিতে তারা সবাই ঢাকার কারাগারে ছিল বলে বলা হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে এ দেশে প্রবাদ প্রচলিত হয়েছিলঃ বাঘে ছুঁলে এক ঘা, আর পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা।
পরবর্তীতে পুলিশের নিগ্রহ সম্পর্কে আরেকটি প্রবাদ জনগণের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ঃ আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। একজন সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষকেও তারা অপরাধ আইনের কোনো এক ধারায় আটকে তার জীবনকে দোযখ বানিয়ে দিতে পারে। বস্তুত পুলিশ যে কি করে আর কি করে না, কি পারে আর কি পারে না, তার কোনো সীমা-সরহদ নেই। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে পুলিশের ভালো কাজের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। নানা অভিযোগ-অসন্তোষের মাঝেও পুলিশই আমাদের ভরসা যদিও সে ভরসা পরে কোনো কোনো সময় হতাশায় পরিণত হয়। মাঝে-মধ্যেই তাদের কোনো খারাপ কাজ সকল ভালো কাজের ঔজ্জ্বল্যকে ম্লান করে দেয়। তবুও পুলিশ ছাড়া আমাদের চলে না। তো, খুলনার দু’ মাদরাসা শিক্ষক এবং একজন ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি খুলনাতে অবস্থান করে কীভাবে যাত্রাবাড়ি থানার সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় গ্রেফতার হতে পারেন, তা শুধু পুলিশের পক্ষেই বোধ হয় বলা সম্ভব। কিন্তু তিনজন মানুষকে ১২মে থেকে ১২ জুন পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাস গুম করে রাখা তথা তাদের পরিবারকে কিছু না জানানো, তাও তাদের পক্ষেই সম্ভব। কথা হচ্ছে, এটা কোন আইনে পড়ে? আইনের প্রয়োগকারী পুলিশই যদি আইনের লংঘন করে তাহলে তার বিচার কি? উদ্বেগের কথা, তাদের যখন আটক করা হয় তখন পুলিশ কোনো নিয়ম মানেনি। তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে অন্ধকারে রেখেছে। দেশের আদালতে পুলিশের বিরুদ্ধে এ বেআইনি কাজের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় কিনা আমাদের জানা নেই। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনকে আইন কঠোরভাবে মেনে চলতে বাধ্য করতে আদালত অবশ্যই বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশ্বের প্রতিটি সভ্য দেশেই বিচারককে পৃথিবীতে স্রষ্টার প্রতিনিধি বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে মানুষের মনে সে ধারণা অনেক দুর্বল।
নিখোঁজ তিন যুবকের পিতারা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে, তাদের পুত্ররা কোনো অন্যায় কাজের সাথে জড়িত বলে তাদের জানা নেই। তারপরও তারা যা কিছুই করে থাক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক, বিচার করা হোক। ধরে নেয়া যাক যে পুলিশ তাদের সম্পর্কে অনেক বেশি জানে ও নিশ্চিত যে তারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত। তাই তাদের আটক করা হয়েছে। আটক যদি করাই হয় তবে তা স্বীকার করায় অসুবিধা কি? আটকও করবে আবার তা অস্বীকারও করবে, তা কি হয়? এতে পরিবারকে অযথা হয়রানি করা হয়। আটকের পর আটক ব্যক্তিদের আইনি সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে। তার সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করে, তাদের নিখোঁজ রেখে পরিবারকে দুঃসহ উদ্বেগ-দুশ্চিন্তায় ফেলে ডিবি পুলিশের লাভ কি? কেন তারা এটা করে? তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি এসব অনিয়ম, অমানবিক কার্যকলাপ দেখে না? এর কি অবসান করা যায় না?
দেখা যাচ্ছে যে এ ধরনের আটক নিয়ে বহু লেখালেখি, জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং এভাবে আটক নিষিদ্ধ করে সর্বোচ্চ আদালতের রায় সত্ত্বেও ডিবি পুলিশের এ আটক অভিযান বন্ধ হয়নি। যেমন ১৭ জুন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, ১৪ জুন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের সামনে থেকে শাহাজান আলী নামের এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গেছে ডিবি পুলিশ। জানা গেছে, তিনি একজন জামায়াত কর্মী। তিনি পুলিশের মামলায় জেলে আটক ছিলেন। জামিন পেয়ে ঐদিন তিনি জেল থেকে বের হলে এ ঘটনা ঘটে। ১৬ জুন পর্যন্ত তিন দিনেও তার কোনো খোঁজ মেলেনি। তার স্বজনেরা থানায় তাকে পাননি।
গত ২৪ মে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, বিনা পরোয়ানায় ও সাদা পোশাকে কাউকে আটক করা যাবে না। গ্রেফতার করতে হলে নিয়ম মানতে হবে। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। কিন্তু শাহাজান আলীর ক্ষেত্রে এসবের কোনোটিই অনুসরণ করা হয়নি। তিনি জেল থেকে বেরিয়ে মুক্ত আলো আলো-হাওয়ায় একটুক্ষণ নিঃশ্বাস নেয়ারও সুযোগ পাননি। ডিবি পুলিশ তাকে নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি নিখোঁজ।
এ নিখোঁজ হওয়া যে কোনো সময় তথাকথিত বন্দুক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে যার পরিণতি হতে পারে শাহাজান আলীর লাশ। উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশের পর আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর সকল নির্দেশনা মেনে চলা হবে। এই যদি তার নমুনা হয় তাহলে উদ্বেগের ব্যাপার।
জানা যায়, উচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে সারা দেশে সাদা পোশাকে গ্রেফতারের ঘটনা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এটা আশার কথা। কেউ অপরাধ করে থাকলে গ্রেফতার হবে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপারে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার দাবি দীর্ঘদিনের। ক’দিন আগে প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার জন্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সরকার সে আহ্বানে সাড়া দেবে, থানা পুলিশ, ডিবি, র্যাব প্রমাণ ছাড়া কাউকে আর গ্রেফতার করবে না, কাউকে গ্রেফতার করা হলে নিয়ম মেনেই করা হবে, এ আশা আমরা নিশ্চয়ই করতে পারি।
সংবাদপত্রের সাথে জড়িত নন, এমন ছাপোষা মানুষদের পক্ষে নিজের পয়সায় রোজ একাধিক খবরের কাগজ কিনে পড়া কষ্টসাধ্যই বটে। সরকারের দাবি অনুযায়ী আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। আমরা নিম্নমধ্যবিত্তের পর্যায়ে পৌঁছে গেছি এবং ২০১৮ সালের মধ্যে মধ্যবিত্তের পর্যায়ে পৌঁছতে চলেছি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মোতাবেক বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ ডলার। জাতিসংঘসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিকে সমর্থন করছে। সুতরাং আমারও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার কথা স্বীকার করছি। কিন্তু দু:খের বিষয়, এ রকম কোনো আর্থিক উন্নতি আমার ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি না। শুধু একটি উদাহরণ দেই। ২০১৫ সালের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতেও আমার সামর্থ্য অনুযায়ী মাসে ৩ কেজি গরুর গোশত (তখন ২৮০-৩০০টাকা কেজি ছিল) কিনতাম। বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হওয়ায় মার্চ মাস থেকে দাম বেড়ে যখন ৪শ’ ছুঁতে চলল তখন গরুর গোশত কেনার পরিমাণ মাসে ৩ কেজি থেকে কমে ১ কেজিতে ঠেকল। কারণ গরুর গোশতের দাম বাড়লেও আমার পয়সার যোগান বাড়েনি। এখন এত আর্থিক উন্নতি দেশের, অনেক মানুষের, কিন্তু আমার গরুর গোশত কেনার সামর্থ্য ঐ ১ কেজি ছাড়ায়নি। তাহলে আয়টা বাড়ল কাদের, আর আয় বৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে কারা? এর জবাব আমি জানি না, সরকারের সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা জানেন। দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে না তা নয়, তবে সত্য হচ্ছে যে হারে ঢাক-ঢোল পেটানো হচ্ছে সে হারে হচ্ছে না। আর যা হচ্ছে তার সুফলটুকু ভোগ করছে বিশেষ একটি শ্রেণি।
যে কারণে এত কথা বলা তা হলো, সব সংবাদপত্রই সব খবর ছাপে না। তা বলে কারো পক্ষে সকল সংবাদ জানার জন্য রোজ একাধিক পত্রিকা কেনাও সম্ভব নয়। যাহোক, গত ১৭ জুন দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় একটি খবর চোখে পড়ল। তাহলো- ‘এক মাস পর ঢাকা কারাগারে খোঁজ মিলল খুলনার গুম হওয়া তিন যুবকের।’ আর কারা এ খবরটি ছেপেছে জানি না। তবে ইন্টারনেটে প্রধান ২-৩টি পত্রিকায় সন্ধান করে দেখা গেল তারা এ খবরটি ছাপেনি। কেন, তা তাদের ব্যাপার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, খুলনা মহানগরীতে একই দিনে তিন জায়গা থেকে তিন যুবককে তুলে নেয়া হয় গত ১২ মে। তারা হচ্ছেন : হরিণটানা থানার বিসমিল্লাহ নগর কওমি মাদরাসা ও এতিমখানার দু’শিক্ষক শোয়াইব বিশ্বাস ও আবদুল্লাহ সাইম তূর্য এবং ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মনিরুল ইসলাম। সবাইকে তুলে নেয় ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন। বহু চেষ্টা করেও খুলনার থানা পুলিশ ও ডিবির কাছ থেকে তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি। ঘটনার পর খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (ডিবি) মো. কামরুল ইসলাম ডিবি পরিচয়ে কাউকে তুলে নেয়ার ঘটনা তাদের জানা নেই বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘তাদের নিখোঁজের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তাদের উদ্ধারেও কাজ করছে ডিবি।’ ভীষণ উদ্বিগ্ন তাদের পিতারা অপহৃত পুত্রদের ব্যাপারে সবাই থানায় মামলা ও জিডি করেন। তাতে কোনো ফল না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে তিন জনের অসহায় পিতা ২৬ মে খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তারা ‘আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দাও’ বলে প্রশাসনের কাছে আকুল আবেদন জানান। কিন্তু অসহায় পিতাদের সে আহাজারি কারো কানে পৌঁছেনি। সে সংবাদ সম্মেলনের খবরটি দৈনিক সংগ্রামসহ কয়েকটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। সেই পিতাদের মর্মস্পর্শী আহাজারি নিয়ে ১১ জুন দৈনিক সংগ্রামে উপসম্পাদকীয় কলামে ‘আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দাও’ নামে একটি নিবন্ধও প্রকাশিত হয়।
গত ১৭ জুন সংগ্রামে “এক মাস পর ঢাকা কারাগারে খোঁজ মিলল খুলনার গুম হওয়া তিন যুবকের” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। এ খবরে বলা হয়, তিন যুবক নিখোঁজ হওয়ার একমাস পর তাদের সন্ধান পাওয়া গেছে। ১২ জুন তাদের যাত্রাবাড়ি থানায় দায়েরকৃত সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। এ মামলায় তাদের রিমান্ডেও নেয়া হয়। তারা সবাই ডিএমপির ডিবির হেফাজতে ছিল। ১৬ জুন ঐ রিপোর্ট লেখার দিনটিতে তারা সবাই ঢাকার কারাগারে ছিল বলে বলা হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে এ দেশে প্রবাদ প্রচলিত হয়েছিলঃ বাঘে ছুঁলে এক ঘা, আর পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা।
পরবর্তীতে পুলিশের নিগ্রহ সম্পর্কে আরেকটি প্রবাদ জনগণের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ঃ আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। একজন সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষকেও তারা অপরাধ আইনের কোনো এক ধারায় আটকে তার জীবনকে দোযখ বানিয়ে দিতে পারে। বস্তুত পুলিশ যে কি করে আর কি করে না, কি পারে আর কি পারে না, তার কোনো সীমা-সরহদ নেই। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে পুলিশের ভালো কাজের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। নানা অভিযোগ-অসন্তোষের মাঝেও পুলিশই আমাদের ভরসা যদিও সে ভরসা পরে কোনো কোনো সময় হতাশায় পরিণত হয়। মাঝে-মধ্যেই তাদের কোনো খারাপ কাজ সকল ভালো কাজের ঔজ্জ্বল্যকে ম্লান করে দেয়। তবুও পুলিশ ছাড়া আমাদের চলে না। তো, খুলনার দু’ মাদরাসা শিক্ষক এবং একজন ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি খুলনাতে অবস্থান করে কীভাবে যাত্রাবাড়ি থানার সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় গ্রেফতার হতে পারেন, তা শুধু পুলিশের পক্ষেই বোধ হয় বলা সম্ভব। কিন্তু তিনজন মানুষকে ১২মে থেকে ১২ জুন পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাস গুম করে রাখা তথা তাদের পরিবারকে কিছু না জানানো, তাও তাদের পক্ষেই সম্ভব। কথা হচ্ছে, এটা কোন আইনে পড়ে? আইনের প্রয়োগকারী পুলিশই যদি আইনের লংঘন করে তাহলে তার বিচার কি? উদ্বেগের কথা, তাদের যখন আটক করা হয় তখন পুলিশ কোনো নিয়ম মানেনি। তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে অন্ধকারে রেখেছে। দেশের আদালতে পুলিশের বিরুদ্ধে এ বেআইনি কাজের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় কিনা আমাদের জানা নেই। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনকে আইন কঠোরভাবে মেনে চলতে বাধ্য করতে আদালত অবশ্যই বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশ্বের প্রতিটি সভ্য দেশেই বিচারককে পৃথিবীতে স্রষ্টার প্রতিনিধি বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে মানুষের মনে সে ধারণা অনেক দুর্বল।
নিখোঁজ তিন যুবকের পিতারা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে, তাদের পুত্ররা কোনো অন্যায় কাজের সাথে জড়িত বলে তাদের জানা নেই। তারপরও তারা যা কিছুই করে থাক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক, বিচার করা হোক। ধরে নেয়া যাক যে পুলিশ তাদের সম্পর্কে অনেক বেশি জানে ও নিশ্চিত যে তারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত। তাই তাদের আটক করা হয়েছে। আটক যদি করাই হয় তবে তা স্বীকার করায় অসুবিধা কি? আটকও করবে আবার তা অস্বীকারও করবে, তা কি হয়? এতে পরিবারকে অযথা হয়রানি করা হয়। আটকের পর আটক ব্যক্তিদের আইনি সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে। তার সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করে, তাদের নিখোঁজ রেখে পরিবারকে দুঃসহ উদ্বেগ-দুশ্চিন্তায় ফেলে ডিবি পুলিশের লাভ কি? কেন তারা এটা করে? তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি এসব অনিয়ম, অমানবিক কার্যকলাপ দেখে না? এর কি অবসান করা যায় না?
দেখা যাচ্ছে যে এ ধরনের আটক নিয়ে বহু লেখালেখি, জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং এভাবে আটক নিষিদ্ধ করে সর্বোচ্চ আদালতের রায় সত্ত্বেও ডিবি পুলিশের এ আটক অভিযান বন্ধ হয়নি। যেমন ১৭ জুন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, ১৪ জুন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের সামনে থেকে শাহাজান আলী নামের এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গেছে ডিবি পুলিশ। জানা গেছে, তিনি একজন জামায়াত কর্মী। তিনি পুলিশের মামলায় জেলে আটক ছিলেন। জামিন পেয়ে ঐদিন তিনি জেল থেকে বের হলে এ ঘটনা ঘটে। ১৬ জুন পর্যন্ত তিন দিনেও তার কোনো খোঁজ মেলেনি। তার স্বজনেরা থানায় তাকে পাননি।
গত ২৪ মে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, বিনা পরোয়ানায় ও সাদা পোশাকে কাউকে আটক করা যাবে না। গ্রেফতার করতে হলে নিয়ম মানতে হবে। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। কিন্তু শাহাজান আলীর ক্ষেত্রে এসবের কোনোটিই অনুসরণ করা হয়নি। তিনি জেল থেকে বেরিয়ে মুক্ত আলো আলো-হাওয়ায় একটুক্ষণ নিঃশ্বাস নেয়ারও সুযোগ পাননি। ডিবি পুলিশ তাকে নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি নিখোঁজ।
এ নিখোঁজ হওয়া যে কোনো সময় তথাকথিত বন্দুক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে যার পরিণতি হতে পারে শাহাজান আলীর লাশ। উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশের পর আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর সকল নির্দেশনা মেনে চলা হবে। এই যদি তার নমুনা হয় তাহলে উদ্বেগের ব্যাপার।
জানা যায়, উচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে সারা দেশে সাদা পোশাকে গ্রেফতারের ঘটনা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এটা আশার কথা। কেউ অপরাধ করে থাকলে গ্রেফতার হবে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপারে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার দাবি দীর্ঘদিনের। ক’দিন আগে প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার জন্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সরকার সে আহ্বানে সাড়া দেবে, থানা পুলিশ, ডিবি, র্যাব প্রমাণ ছাড়া কাউকে আর গ্রেফতার করবে না, কাউকে গ্রেফতার করা হলে নিয়ম মেনেই করা হবে, এ আশা আমরা নিশ্চয়ই করতে পারি।
হোসেন মাহমুদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন