বুধবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৫৭ ধারাই নয় সকল কালাকানুনের রদ প্রয়োজন


আমাদের সাংবাদিকতার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। একটা সময় সংবাদমাধ্যমের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ছিল। একটা সময় ছিল যখন ঢাকা শহরে কোনো দৈনিক সংবাদপত্রই ছিল না। সেই অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে বলতে হবে, আমরা অনেক অনেক দূর এগিয়েছি। সংবাদমাধ্যমেও সেটা আছে। পৃথিবীর কোন কোন দেশে সবচেয়ে ভালো সাংবাদিকতা হচ্ছে, এটার কোনো মাপকাঠি নেই, বিভিন্ন উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের সাংবাদিকতার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে। এই উন্নতি বা অগ্রসরতা এককথায় বিস্ময়কর, গুণগত মান এবং বিস্তৃতি-উভয় দিক থেকেই।
রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। দেশে ও বিশ্বের অন্যত্র কোথায় উল্লেখযোগ্য কী ঘটছে তা সচিত্র প্রকাশ ও প্রচার করা গণমাধ্যমের অন্যতম প্রধান কাজ। এ দ্বারা জনগণের জানার আগ্রহ নিবৃত্ত হচ্ছে। দেশাভ্যন্তরে উন্নয়ন-অনুন্নয়নের চিত্র ও সমস্যাদি তুলে ধরে এ ব্যাপারে তাদেরকে সজাগ করে তুলছে। গণমাধ্যমের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও বিনোদন চর্চাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে জনমত গঠনে এর ভূমিকা সমাজ জীবনে গণমাধ্যমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান এ শেষোক্ত ও অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান তখনই সার্থক হয় যখন মিডিয়া একাধারে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে একাত্ম তৎপর থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মিডিয়ার স্বাধীনতা সর্বাংশে সরকারি প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যমকে বোঝায়।
তবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংবাদ কর্মীরা কতখানি স্বাধীনতা ভোগ করে আর কতখানি মালিক ও সম্পাদকের প্রভাবে কাজ করে তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। মালিক-সম্পাদকদের নিজস্ব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনা থাকা স্বাভাবিক- আবার বিত্তশালী গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত হওয়াও অসম্ভব নয়। এসব কারণে মিডিয়া কর্মীদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রে ও বহুজাতিক সমাজে গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা অপরিহার্য হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এ নিরপেক্ষতা একটা অবাস্তব কল্পনায় পর্যবসিত হয়।
একটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক মনে করছি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কনসেপ্ট বা ধারণাটি কার স্বার্থে? সংবাদ কর্মীর নিজ স্বার্থে নাকি যে পাঠকবর্গ বা জনগণের উদ্দেশ্যে তারা লেখালেখি করে থাকে তাদের অবগতির স্বার্থে? সাংবাদিকের নিজের স্বার্থে হলে, পাঠক-শ্রোতার কোনো বক্তব্য থাকে না। সাংবাদিকরা যে সংবাদ পরিবেশন করবে তা পাঠ করেই পাঠকবর্গকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
পক্ষান্তরে, লেখার উদ্দেশ্য যদি হয় অগণিত পাঠক-পাঠিকার বরাবরে সত্য, বস্তুনিষ্ট ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন তাহলে সে রকম সংবাদ পরিবেশনের দায়িত্ব সাংবাদিক ও সম্পাদক উভয়ের ওপরই বর্তায়। মিডিয়ার কাজ সংবাদ পরিবেশন করা। অবশ্য সুষ্ঠু, বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর সংবাদ পরিবেশন করাতেই মিডিয়ার সার্থকতা। মিডিয়া সোচ্চার মিডিয়া কর্মীদের স্বাধীন সংবাদ পরিবেশনের অধিকার নিয়ে, অপরদিকে পাঠক বা জনগণের অধিকার বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রাপ্তির। মিডিয়া কর্মীরা সংবাদ পরিবেশনে যতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করে, পাঠকরা সত্য, বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এর এক-দশমাংশ অধিকারও ভোগ করে কী? না করার মূল কারণ গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শকরা এক অসংগঠিত জনগোষ্ঠী।
সংবাদমাধ্যম কি শুধু পর্যবেক্ষক হিসেবে যা দেখবে তা-ই লিখবে? নাকি সংকট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে? সংবাদমাধ্যমের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব পর্যবেক্ষক ও সংবাদ পরিবেশকের। এটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব, এ বিষয় তাদের একটা নীতি আছে। তবে সাংবাদিকরা একই সঙ্গে দেশের নাগরিকও বটে। নাগরিকের দায়িত্বও তাদের পালন করা উচিত। সংবাদমাধ্যম যদি চলমান সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করায় ভূমিকা রাখতে চায়, তাহলে আগে সাংবাদিকদের সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কী পন্থায় কী ভূমিকা নিতে চান। শান্তির সময়ে সংবাদমাধ্যমের প্রধান ভূমিকা পর্যবেক্ষক ও সংবাদ পরিবেশকের। আর বিশেষ সংকটময় সময় দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, এমনকি পৃথিবী ও সভ্যতার প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেও সাংবাদিকরা সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে পারেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও ঘোষণা করা হয়েছে: ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ (সূত্র : ৭(২) ধারা)
বাংলাদেশের সংবিধান জনগণকে ‘সকল ক্ষমতার মালিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে মালিকানাটি জনগণের কাছে আছে কি না, সে প্রশ্ন করার অধিকার জনগণের কতটা আছে, তা তারা জানে না। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় হেভিয়াস কর্পাস মামলায় প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞদের এ সম্পর্কে মতামতও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘সংবিধান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য সব আইনগুলো সংবিধানের কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হয়। সংবিধান সর্বোচ্চ আইন কারণ সে বিদ্যমান, সে বিদ্যমান কারণ তাতে জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত।’ (সূত্র : ২৫ ঢাকা ল রিপোর্টস, পৃ. ৩৩৫)
চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা আমাদের সংবিধান খুব স্পষ্টভাবেই প্রত্যেক নাগরিককে দিয়েছে। তবে একই সঙ্গে ‘... জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ- সাপেক্ষে’র কথাও লেখা আছে। (সূত্র : ৩৯ (২) ধারা)
চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার কথা যে বলা হয়েছে তা দুটি আলাদা শব্দ হলেও তার মর্মার্থ এক। অবাধ অর্থাৎ যা খুশি তা-ই চিন্তা করে তা প্রকাশের স্বাধীনতা নয়, বিবেকসম্মত চিন্তার স্বাধীনতার কথাই বলা হয়েছে। বিবেকসম্মত চিন্তা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। বিবেকসম্মত চিন্তার সংজ্ঞা হচ্ছে সর্বসম্মতভাবে মানুষ যে কাজটি ‘ভালো’ এবং যে কাজটি ‘মন্দ’ বলে মনে করে।
স্বাধীনতাবিহীন সংবাদমাধ্যম হলো স্রেফ অপপ্রচারযন্ত্র। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের গণমাধ্যম রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে কমই স্বাধীন। যে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কষাঘাতে বিদ্ধ হয়ে নিজেকে খুঁজে পায়, সেটি চূড়ান্ত বিচারে মানুষের আস্থা অর্জন ও জনমত প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়। মানুষ এখন কেবল একটি নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল নয়। মুখের কথা থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষণকারী ব্লগ-রাঘব বোয়ালদের অপরাধ খুঁজে বের করতে সবসময় কিছু মানুষ থাকবেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হয়তো কিছু বিষয়কে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলে। এছাড়া কিছু মানুষ থাকেই, যারা গণমাধ্যমকে উটকো আপদ ভাবে। তবে গণমাধ্যমকে ঠেকানো তখনই উচিত, কেবল যখন এটি নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করে। অথবা যখন এর কর্মকাণ্ডের ফলে জনমানুষের ক্ষতি হতে পারে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ সমস্ত সীমা নির্ধারণ করে দেবে কে? তবে এ ধরনের বিতর্ক খুব বেশি দূর এগোয় না।
সংবাদপত্র ও সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবসমই ক্ষমতাবান মহল থেকে প্রচ্ছন্ন ও সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে। এসব ক্ষমতাবান মহলের মধ্যে রয়েছে সরকার, কর্পোরেশন, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন গোষ্ঠী। এটি সারা বিশ্বেই কমবেশি ঘটে থাকে। বাংলাদেশে ক্রটিপূর্ণ একটি নির্বাচনের পর সরকারের বৈধতাই প্রশ্নের সম্মুখীন। সেখানে চিন্তার স্বাধীনতা দমন করাটাই ভিন্নমত দমন ও অন্যায্য দলীয় কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা প্রতিপাদনের সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশী গণমাধ্যমে সবসময়ই কিছু নিষিদ্ধ বিষয় (ট্যাবু) ছিল, এখনও আছে। যেমন : সামরিক বাহিনীকে ছোঁয়া যায় না। টেলিযোগাযোগ কর্পোরেশনগুলোর বিরুদ্ধেও কিছু বলা যায় না, কেননা তারাই দেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনদাতা। এমনকি দাতা সম্প্রদায় ও গণমাধ্যম নিজেরা বেশ সতর্কতার সঙ্গে চলে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সরকারি মিডিয়া চ্যানেলগুলো ঢাকায় সরকারের জন্য স্রেফ প্রচারযন্ত্র (প্রোপাগান্ডা আউটলেট) হয়ে উঠেছে। সরকারের সমালোচকদের টক-শোতে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। সরকারের একটি ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে উপস্থাপকদের পক্ষপাতিত্বমূলক প্রশ্ন তোলাটাই সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। (সূত্র : দৈনিক মানব জমিন ১ মে ২০১৫)
এসব নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক ইস্যু। তবে গণমাধ্যমের প্রতি সরাসরি হুমকি, ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী সম্পাদক’দের গ্রেফতার, সাংবাদিক ও ব্লগারদের ওপর হামলা এর চেয়েও অনেক বড় উদ্বেগের কারণ। কর্তৃপক্ষ অস্বাভাবিক মাত্রায় ‘আদালত অবমাননা’র অভিযোগ তুলছে। এ বিষয়টিও ভয়ের সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। অসহনশীল সংস্কৃতির ফলাফলস্বরূপ, বহু মুক্তমনা সহিংসতার শেষ দেখেছেন। এর আগে কখনই আজকের মতো সমালোচনামূলক ভাবনার প্রয়োজন দেখা দেয়নি। আর এখনকার মতো আর কখনই সমালোচক হওয়াটা এত বিপজ্জনকও ছিল না।
বস্তুত মতামত, ভিন্নমত ও স্বাধীনমত পোষণ করা মানুষের স্বভাব। প্রাণ দিয়েও মানুষ নিজের মতকে রক্ষা করে। মতামত ছাড়া জন্তুদের পক্ষেই বাঁচা সম্ভব, মানুষের পক্ষে নয়। কারণ, মানুষ বুদ্ধিমান ও রাজনৈতিক জীব। বেঁচে থাকার জন্য সে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো করে চিন্তাও করে।
 দৈনিক আমার দেশ’, ‘দিগন্ত টিভি’ ‘ইসলামিক টিভি’, ‘চ্যানেল ওয়ান’ বন্ধ। বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধের জন্যে বিটিআরসির নির্বাহী আদেশই যথেষ্ট। ‘আমার দেশ’ এবং ‘দৈনিক ইনকিলাব’র প্রেসে তালা ঝুলানো হয়েছে তথ্য প্রযুক্তি আইনের অজুহাতে। এখন দারোগাই প্রেসে তালা দিতে এবং সাংবাদিকদের অজামিনযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করতে পারেন এবং এ আমলে করে দেখিয়েছেও। তারপর পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী সংবিধানের সমালোচনা করা যাবে না অথবা মূলনীতি থেকে বিসমিল্লাহ বাদ গেল কেন জিজ্ঞেস করলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। মাহমুদুর রহমানকে জেলে পচানো হচ্ছে এবং এর আগে আদালত অবমাননার মামলায় আইন-বর্ণিত মেয়াদেরও বেশি ছয় মাস কারাবাস তাকে দেয়া হয়েছিল।
তাকে রিমান্ডে বিবস্ত্র করে শেখ হাসিনা সরকার অত্যাচারও করেছে। অন্যদিকে উচ্চ আদালত কর্তৃক ঘন ঘন আদালত অবমাননার রুল তো আছেই। যে আইনের সম্ভাব্য সংশোধনী নিয়ে আমরা এখন উচ্চকণ্ঠ, ডিসিরা এখন পত্রিকা বন্ধ করতে না পারলেও গত কয়েক বছর নানা অজুহাতে যেমন অনিয়মিত প্রকাশনা, সরকার বিরোধী প্রচারণা, অশ্লীলতার দোহাইয়ে বহু পত্রিকার প্রকাশনা লাইসেন্স রদ করা হয়েছে। এসব নিয়ে মামলাও আছে জেলা আদালতগুলোতে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেস ক্লাবে হামলা ও ভাংচুর চালানো হয়েছে। সাংবাদিকদের হত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রত্যক্ষ নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন ছাড়াও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা হয়েছে আইনি হাতিয়ার প্রয়োগের মাধ্যমেও। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানির ঘটনাও বিস্তর।
সরকারের পক্ষ থেকে যা-ই দাবি করা হোক না কেন, বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না, তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে। ওই বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ জাতীয়  দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর জেলা সংবাদদাতাদের ওপর পুলিশ, প্রভাবশালী রাজনীতিক ও স্থানীয় অপরাধীদের নির্যাতন-হয়রানির ক্রমবর্ধমান ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
স্বাধীনভাবে চিন্তা করার, স্বাধীনমত পোষণ করার, স্বাধীনভাবে বিশ্বাস করার, স্বাধীনভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ধর্মীয় বিশ্বাস বললে অবশ্য খ্রিস্ট ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, ইহুদি ধর্ম ইত্যাদি ধর্মের মতো আনুষ্ঠানিক ও বহুজন সমর্থিত ধর্মকেই বোঝায় না। তা ব্যক্তিগত ধর্মও হতে পারে। কেউ ইচ্ছা করলে এক ধর্ম ত্যাগ করে আরেক ধর্ম পালন করতে পারে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারও তার জন্মগত, যদিও প্রকাশ্যে মতপ্রকাশ করে অন্যের অনুভূতিকে আঘাত করার অধিকার তার আছে কি না, তা বিতর্কের বিষয়। অন্তত অন্যের আবেগকে আহত করার উদ্দেশ্যে মতপ্রকাশের অধিকার তার নেই।
একনায়ক অথবা স্বৈরাচারীকে মানুষ পছন্দ করে না। কারণ, একনায়ক অন্যদের মতামতকে গ্রাহ্য করে না। সে চায় নিজের মতঅনুসারে অন্যদের চালাতে। মানুষ কেবল খেয়ে সুখী হলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাবার সংগ্রহ করতো না। বরং বিনা পরিশ্রমে খাওয়াদাওয়া করে কারাগারে বাস করতো। অথবা একনায়কের মতো অনুসারে চলে বৈষয়িক উন্নতি করতো। কিন্তু মানুষ তা করে না। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ২৭ মার্চ ২০১৫)
দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ, পুলিশী হয়রানি, মিথ্যা মামলাসহ নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনের অজস্র ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর কোনো আইনী প্রতিকার হয়নি। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য সাংবাদিকরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন।
সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ হয় রাজনৈতিক দলের লোকজন, পুলিশ, অপরাধী চক্র এমনকি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজনের তরফ থেকেও। রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে সংবাদ, আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তুলতে গিয়ে সরকারি দলের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। ভোটের দিন সকাল থেকে ভোট কেন্দ্রে অবৈধভাবে সীল মারাসহ নানা অনিয়মের সংবাদ সংগ্রহ করার সময় তারা সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলার শিকার হন। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ওবায়েদ অংশুমান, একই পত্রিকার সিনিয়র ফটো সাংবাদিক শামীম নূর, যমুনা টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন আখলাক সাফা, একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার আজাদ তালুকদার, ক্যামেরাপার্সন জহিরুল ইসলাম, আরটিভির ক্যামেরাপার্সন পারভেজুর রহমান এবং  দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টার সুজয় মহাজন। সরকারদলীয় ক্যাডারদের গুলীতে অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডির রিপোর্টার ইয়াসিন রাব্বী আহত হন। এছাড়া লাঞ্ছিত হয়েছেন দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র প্রতিবেদক আশীষ-উর রহমান শুভ ও মোশতাক আহমেদ, দৈনিক সকালের খবরের ফটোসাংবাদিক বুলবুল আহমেদ, বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম মহসীন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি কবি আবদুল হাই সিকদার, জাতীয় প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাদের গণি চৌধুরী, দৈনিক সংগ্রামের স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ জাফর ইকবাল ও দৈনিক মানব জমিনের স্টাফ রিপোর্টার কাফি কামাল।
দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ওবায়েদ অংশুমান জানিয়েছেন, রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আশরাফুজ্জামান ফরিদের (রেডিও প্রতীক) লোকেরা আহমেদাবাদ হাইস্কুলের সামনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আজাদ মোহাম্মদ সাদেকুল ইসলামের (করাত প্রতীক) লোকদের ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে ফরিদের লোকেরা সাদেকুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে তার কর্মীদেরকে কোপাতে থাকে। এরপর আওয়ামী সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আশরাফুজ্জামান ফরিদের লোকেরা কমলাপুর হাইস্কুল কেন্দ্রে প্রবেশ করে প্রায় ৩শ’ ব্যালটে পুলিশের সামনেই সীল মারে। এতে পুলিশ সহযোগিতাও করে।
ওবায়েদ অংশুমান আরো জানান, কাউন্সিলর প্রার্থী ফরিদের লোকদের করা এসব অনিয়মের স্টিল ও ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিলেন তিনি। এতে ক্যাডাররা তার ওপর হামলা চালায় এবং ক্যামেরা ও তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনগুলো ছিনিয়ে নেয়। তিনি জানান, আহমেদাবাদ স্কুল রোডে অবস্থান করার সময় আশরাফুজ্জামান ফরিদের নেতৃত্বে ক্যাডাররা ‘ধর ধর’ করে তার ওপর হামলা হালায়। এ সময় ক্যাডারদের হামলায় সাংবাদিক ওবায়েদ অংশুমান মারাত্মকভাবে আহত হন। এ সময় ক্যাডাররা তার পরিধানের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে।
অন্যদিকে সকালে ডিএসসিসির মেয়র প্রার্থী বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের সামনে যমুনা টিভির ক্যামেরাপার্সন আখলাক সাফার ওপর হামলা চালায় আওয়ামী গুন্ডারা। এতে তিনি আহত হন। সকাল সাড়ে আটটায় সেগুনবাগিচা স্কুল কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের হামলার শিকার হন দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র ফটো সাংবাদিক শামীম নূর। হামলার পর ক্যাডাররা তাকে কিছু সময় অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে সংবাদ পেয়ে অন্যান্য ফটো সাংবাদিকরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে।
রাজধানীর শাহজাহানপুরের মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে দুপুর দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে প্রকাশ্যে ভোটচুরির ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার সুজয় মহাজন। এ সময় হামলাকারীরা তার দুটি মোবাইল ফোন, প্রথম আলোর পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) ও নির্বাচন কমিশন থেকে দেয়া পরিচয়পত্রও কেড়ে নেয়। ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং পুলিশ ও আনসার সদস্যরাও এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। পরে পুলিশের সহায়তায় হামলাকারীদের হাত থেকে রক্ষা পান সুজয়। ঘটনার খবর পেয়ে শাহজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) পুলিশের একটি দল উপস্থিত হয়। এ সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হামলাকারীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা মোবাইল ফোন ফেরত দেবে বলে পুলিশকে জানায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলেই নিগ্রহের শিকার সাংবাদিককে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করে। তবে শেষ পর্যন্ত ফোন দুটি উদ্ধার হয়নি। 
জিবলু রহমান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads