শিরোনাম দেখে পাঠকদের অনেকে বিস্মিত হতে পারেন। অনেকের মনে জিজ্ঞাসাও উঁকি দিতে পারে। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে দেখুন। এই তো ক’দিন আগে, গত ৭ সেপ্টেম্বর আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এবং জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ১৩ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা মামলা ছাড়াই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ বলেছে, ওই নেতারা নাকি দেশের গার্মেন্ট সেক্টরে নাশকতা চালানোর ষড়যন্ত্র করছিলেন! নাশকতা নাকি আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহার প্রাক্কালে চালানো হতো! ভেবে দেখুন পুলিশের যোগ্যতা সম্পর্কে। পুলিশ কথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও জানে! অথচ ষড়যন্ত্র সব সময় গোপনে করা হয়। তাছাড়া জামায়াতে ইসলামী যেমন একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনও তেমনি শ্রম আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত একটি ট্রেড ইউনিয়ন। সুতরাং দেশের যে কোনো স্থানে এর নেতাদের সভা ও বৈঠক করার আইনত অধিকার রয়েছে। সেদিনও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাই আয়োজিত হয়েছিল। বৈঠকটি নিতান্ত ঘরোয়া ছিল বলে এজন্য সরকারের অনুমতি নেয়ার বা পুলিশকে আগে থেকে অবহিত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করা হয়নি। প্রয়োজন আসলে নেইও। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ বলে কথা! গ্রেফতার তো করেছেই, তথাকথিত ষড়যন্ত্র তত্ত্বও আবিষ্কার করে বসেছে পুলিশ। পুলিশের আচরণেও ক্ষুব্ধ হয়েছে মানুষ। ১৩ জন নেতাকেই হাতকড়া পরিয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করেছিল পুলিশ। আপত্তি উঠেছে বিশেষ করে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এবং জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের ব্যাপারে। কারণ, তারা সাবেক এমপি এবং দু’জনেই জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সুতরাং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যে কোনো বিষয়ে তাদের বিশেষ মর্যাদা ও অধিকার রয়েছে। অন্যদিকে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও মিয়া গোলাম পরওয়ারের ক্ষেত্রে পুলিশকে অত্যন্ত অভদ্রোচিত আচরণ করতে দেখা গেছে। সাবেক এ দু’জন এমপিকেও পুলিশ হাতে হাতকড়া লাগিয়ে মিডিয়ার সামনে এমনভাবে হাজির করেছে যা দেখে মনে হতে পারে যেন তারা কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী সংগঠনের পলাতক নেতা!
এভাবেই চলছে আওয়ামী রাজত্ব আর সে রাজত্বেই বসবাস করতে হচ্ছে আমাদের। কথা উঠেছে একটি বিশেষ কারণে। দেশের ভেতরে কর্তৃত্ব ফলাতে পারলেও একই সরকার কিন্তু ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কোনো বিষয়েই সামান্য অর্জন করতে পারছে না। সরকারের এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সীমান্তে হত্যার পর হত্যা করা হচ্ছে কিন্তু সরকার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রেখেছে। কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি পয়েন্ট ব্ল্যাংক অর্থাৎ মাত্র সাত-আট হাত দূর থেকে গুলী করে হত্যা করার পর ফেলানীকে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল বিএসএফ। গুলী করেছিল অমিয় ঘোষ নামে এক হাবিলদার। ঝুলন্ত ফেলানীর ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশে^র দেশে দেশে ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার উঠেছিল। নিন্দায় ও বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল বিশ্ববাসী। মূলত সে দাবির মুখেই ভারত হাবিলদার অমিয় ঘোষকে গ্রেফতার করে বিভাগীয় আইনে তার বিচারের পদক্ষেপ নিয়েছিল। কোচবিহারে বিএসএফ-এর বিশেষ আদালতে এই বিচার চলছে ২০১২ সালের আগস্ট থেকে। কিন্তু পুরো বিষয়টিই যে ভারতের সাজানো নাটক ছিল তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। ঘোষিত রায়ে বিএসএফ-এর বিশেষ আদালত খুনি হাবিলদার অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দিয়েছিল। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ফেলানীর বাবা ও মামাসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং তথ্য-প্রমাণের কোনো কিছুকেই বিবেচনায় নেননি বিচারকরা। তারা বরং সচেষ্ট থেকেছেন অভিযুক্ত হাবিলদারকে রেহাই দেয়ার জন্য। অথচ দেশী-বিদেশী সকল অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে, ফেলানীকে রীতিমতো টার্গেট করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক দূরত্ব থেকে হত্যা করেছিল অমিয় ঘোষ। বিএসএফ-এর আইনেও এ অপরাধের ন্যূনতম শাস্তি সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। তাছাড়া নারী ও শিশুদের ব্যাপারে খোদ বিএসএফ-এরই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নিরস্ত্র কোনো নারী-শিশুকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বা চোরাচালানীদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। অন্যদিকে ফেলানীকে সরাসরি হত্যা করেছিল হাবিলদার অমিয় ঘোষ। কিন্তু এত নিষ্ঠুর একটি হত্যাকাণ্ডের পরও খুনি অমিয় ঘোষকে কোনো দণ্ডই দেয়া হয়নি।
এ পর্যন্ত এসে শেষ হলেও হয়তো কথা বাড়াতে হতো না। কিন্তু যাকে বলে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’! কিশোরী ফেলানীকে নিয়ে নতুন পর্যায়ে কুটিল রাজনীতি শুরু করেছে ভারত সরকার। গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে এতদিন পর এসে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ফেলানী হত্যার দায় নাকি তার পিতা নূরুল ইসলামের। কারণ, ফেলানী ও তার পরিবার নাকি অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছিল। ঘটনার দিন দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢোকার সময় বাবার চাপাচাপিতে ফেলানী মই বেয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার চেষ্টা করে এবং বিএসএফ-এর গুলীতে নিহত হয়। বিএসএফ তার ‘দায়িত্ব’ পালন করেছে বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, ফেলানীর হত্যাকারী অমিয় ঘোষ বিএসএফ সদর দফতরের জারি করা নির্দেশনা লংঘন করেছে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কেউ প্ররোচিত করলেও সীমান্ত এলাকায় নারী ও শিশুদের হত্যা করা চলবে না। কিন্তু হাবিলদার অমিয় ঘোষ সদর দফতরের নির্দেশনা অমান্য ও লংঘন করেছে।
বলা দরকার, এতদিন পর ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্টো ফেলানীর বাবাকে দায়ী করতে চাইলেও স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হলো, ফেলানীদের বাড়ি কুড়িগ্রামে এবং তাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অসহায় শিকার বানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, কোচবিহারের বিশেষ আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেও কোনো লাভ হয়নি। অভিযুক্ত অমিয় ঘোষ নিজে গুলী করার কথা স্বীকার করলেও তাকে এই যুক্তিতে খালাস দেয়া হয়েছে যে, সে নাকি তার ‘দায়িত্ব পালন’ করেছে! স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে দেশপ্রেমিকদের মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। স্মরণ করা দরকার, প্রথম দফা বিচারের পরও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন দেশের বিশিষ্টজনরা। রায়কে বিচারের নামে প্রহসন হিসেবে আখ্যায়িত করে তারা বলেছিলেন, এর মাধ্যমে ফেলানীকে দ্বিতীয়বার খুন করেছে বিএসএফ। আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির সুযোগেই যে ভারতীয়রা প্রহসনের সাহস পেয়েছে সে কথাও বলেছিলেন তারা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। তারা ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানোর, আপিলের পাশাপাশি নতুন করে বিচারের আয়োজন করার এবং বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছিলেন।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন ব্যাখ্যাসহ সর্বশেষ খবরের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিচারের নামে বিএসএফ তথা ভারতের পক্ষ থেকে সত্যিকার অর্থেই নাটক সাজানো হয়েছে। তথ্যনির্ভর যে কোনো পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বিএসএফ-এর খুনি ও সন্ত্রাসী সৈনিকরা স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করে আসছে। অন্যদিকে সব জেনে-শুনেও ভারতের কাছে বলিষ্ঠভাবে প্রতিবাদ পর্যন্ত জানাচ্ছে না আওয়ামী লীগ সরকার। এ অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে বিএসএফ। এর খুনি ও সন্ত্রাসী সৈনিকরা শুধু নিরীহ মানুষই হত্যা করছে না, কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর মতো কাউকে কাউকে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখারও দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এদিকে বিএসএফকে প্রতিহত করার পরিবর্তে আওয়ামী লীগ সরকার বরং বিডিআরের বিলুপ্তি ঘটানোর মধ্য দিয়ে বিএসএফ-এর হত্যাকাণ্ডকে আরো বাধাহীন করেছে। অমিয় ঘোষদের দিয়েছে প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়। স্মরণ করা দরকার, বিডিআর থাকাকালে বিএসএফ কিন্তু এত বেশি দুঃসাহস দেখাতো না। পাদুয়াসহ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় মাঝে-মধ্যেই সমুচিত জবাব দেয়ায় বিডিআরকে বিএসএফ বরং বাঘের মতো ভয় করতো। একই বিএসএফ বর্তমান বিজিবিকে গণনায়ই আনছে না, সামান্য পাত্তা পর্যন্ত দিচ্ছে না। এদিকে ফেলানীর আগে-পরে অসংখ্য নিরীহ বাংলাদেশীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগ সরকার কিছুই বলছে না। মনে হচ্ছে সরকার যেন ‘সন্ন্যাসব্রত’ পালন করছে! সন্ন্যাসব্রতের আড়ালে এই ‘উদারতা’র কারণ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর দরকার পড়ে না। সরকার দেশের নাগরিক জীবনকে গুরুত্ব দিলে অবশ্যই প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতো। বিষয়টিকে সরকার জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উপস্থাপন করতো। কিন্তু অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। সরকার সবকিছু নীরবে হজম করে চলেছে। যেন বাংলাদেশীদের জীবনের কোনো দাম নেই!
উদাহরণ দেয়ার জন্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। ২০১৩ সালে প্রথম বিচারের রায় প্রকাশিত হওয়ার পরপর ১২ সেপ্টেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ফেলানী হত্যাকাণ্ডের বিচারে খুনি বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ বেকসুর খালাস পেয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, বিচারের ওই রায়ে মন্ত্রী ও তাদের সরকার সন্তুষ্ট কি না এবং সন্তুষ্ট না হয়ে থাকলে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা তারা ভাবছেন কি না? এর জবাবেই দীপু মনি ‘বন্ধু’ হিসেবে ভারতকে না হারানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তারা নাকি ভারতের আইন সম্পর্কে ‘জানার চেষ্টা’ করছেন এবং জানার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবেন, এ ব্যাপারে কোন ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায়!
বলা দরকার, তেমন কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। আর এ অবস্থারই পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে চলেছে ভারত সরকার। ফেলানী হত্যাকাণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া দূরে থাকুক সরকার আসলে কোনো চিন্তা পর্যন্ত করেনি। বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার যে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা ও আইন সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং না জেনেই যে বাংলাদেশের গলায় একের পর এক ফাঁস পরিয়ে চলেছে সে কথা জানা গেছে তিস্তা চুক্তি থেকে সীমান্ত প্রটোকল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে। তিস্তা চুক্তির কথাই ধরা যাক। এটা আটকে গেছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে। এই বিরোধিতা মমতা ব্যানিার্জি কিন্তু আইনসম্মতভাবেই করেছেন। তিস্তার মতো যে কোনো বিষয়ে চুক্তি করতে হলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের অনুমতি নিতে হয়- যে অনুমতি এখন দরকার পশ্চিমবঙ্গের। সে জন্যই রাজধানী দিল্লী¬তে বসে কিংবা ঢাকায় বেড়াতে এসে ড. মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্রনাথ মোদিরা যত আশ্বাসের কথাই শোনান না কেন, তারা চাইলেই বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে বা তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না। এজন্য আবার ভারতের সংবিধানও সংশোধন করতে হবে। আসলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য এটা ভারতীয়দের চমৎকার একটি কৌশলও বটে। এখানে শুধু এটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট হওয়া উচিত যে, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের যে বন্ধুত্বের জন্য ট্রানজিট-করিডোরসহ সবকিছুই ভারতকে দিয়ে ফেলেছেন এবং এখনো শুধু দিতেই ব্যস্ত রয়েছেন সে বন্ধুত্বের নাগাল তারা কোনোদিনই পাবেন না। কারণ, সেবাদাসদের ভারত শুধু সেবাদাস হিসেবেই ব্যবহার করে, কাজে লাগায়।
প্রসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে ‘ফার্স্ট পোস্ট’ নামে ভারতীয় অনলাইন পত্রিকার একটি রিপোর্টের উল্লেখ করা যায়। ‘সাকসেস স্টোরি’ শিরোনামে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর রচিত ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার ভারত সরকারের জন্য ‘সাফল্যের বিরাট সিঁড়ি নির্মাণ করেছে’। এই সিঁড়ি বেয়েই ঝুড়ি বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে ভারত। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সম্পর্কে পত্রিকাটি লিখেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করা ছাড়া পরাষ্ট্রনীতিতে কোনো সফলতাই অর্জন করতে পারেননি তিনি। তার সরকারের একমাত্র সাফল্য বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং ওই সরকারের কাছ থেকে একের পর এক ভারতের বিভিন্ন স্বার্থ আদায় করা। নিজেরা আদায় করলেও ভারত সরকার যে বাংলাদেশের কোনো একটি অনুরোধই রক্ষা করেনি সে কথাটাও জানিয়েছে ‘ফার্স্ট পোস্ট’। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিস্তা চুক্তির উল্লখ করে বলেছে, মনমোহন সিং ও নরেন্দ্রনাথ মোদির উভয় সরকারই মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতার অজুহাত দেখিয়ে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থেকেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘ফার্স্ট পোস্ট’-এর রিপোর্টটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয়দের প্রকৃত মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে বহুবার শোনা আশ্বাসের বাইরে ‘এক চুল’ পরিমাণও আদায় করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। অর্থাৎ নানা কথার মারপ্যাঁচে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বিরাট একটি ‘না’ পাঠিয়েছে ভারত। সব মিলিয়েই ভারতের কাছ থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে সরকারকে। এই ‘না’-এর মধ্য দিয়ে আসলে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারতীয়রা নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ত্যাগ করতে রাজি নন। ভারতীয়দের জন্য এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা স্বাধীনতার পর থেকেই এ মনোভাব দেখিয়ে চলেছে।
বর্তমান পর্যায়ে ফেলানীকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের মধ্য দিয়েও বাংলাদেশের প্রতি একই মোনোভাব ও কৌশলের প্রকাশ ঘটেছে। একই কারণে সরকারের দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে। দেশপ্রেমিকরা মনে করেন, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই সরকারের উচিত সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যা বন্ধ ও প্রতিহত করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া। এ উদ্দেশ্যে বিজিবির লোকবল ও মনোবল বাড়াতে হবে, বিজিবির জওয়ানদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তুলে দিতে হবে। সীমান্তে সেনাবাহিনীকেও মোতায়েন করা ও তৎপর রাখা দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারি পর্যায়ে গুলী ও হত্যা বিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়া। পাশাপাশি সরকারের উচিত কূটনৈতিক পর্যায়ে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। অবস্থান পাল্টাতে ভারত সম্মত না হলে ফেলানীর বিষয়টিকে অবশ্যই অন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপন করতে হবে। আমরা চাই, কেবলই বিএনপি-জামায়াতকে নির্মূল করার ভয়ংকর অভিযান চালানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে সমানে সমান হিসেবে অবস্থান নেয়ার এবং বাংলাদেশের সকল পাওনা আদায়ের চেষ্টা করা।
এভাবেই চলছে আওয়ামী রাজত্ব আর সে রাজত্বেই বসবাস করতে হচ্ছে আমাদের। কথা উঠেছে একটি বিশেষ কারণে। দেশের ভেতরে কর্তৃত্ব ফলাতে পারলেও একই সরকার কিন্তু ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কোনো বিষয়েই সামান্য অর্জন করতে পারছে না। সরকারের এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সীমান্তে হত্যার পর হত্যা করা হচ্ছে কিন্তু সরকার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রেখেছে। কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি পয়েন্ট ব্ল্যাংক অর্থাৎ মাত্র সাত-আট হাত দূর থেকে গুলী করে হত্যা করার পর ফেলানীকে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল বিএসএফ। গুলী করেছিল অমিয় ঘোষ নামে এক হাবিলদার। ঝুলন্ত ফেলানীর ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশে^র দেশে দেশে ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার উঠেছিল। নিন্দায় ও বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল বিশ্ববাসী। মূলত সে দাবির মুখেই ভারত হাবিলদার অমিয় ঘোষকে গ্রেফতার করে বিভাগীয় আইনে তার বিচারের পদক্ষেপ নিয়েছিল। কোচবিহারে বিএসএফ-এর বিশেষ আদালতে এই বিচার চলছে ২০১২ সালের আগস্ট থেকে। কিন্তু পুরো বিষয়টিই যে ভারতের সাজানো নাটক ছিল তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। ঘোষিত রায়ে বিএসএফ-এর বিশেষ আদালত খুনি হাবিলদার অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দিয়েছিল। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ফেলানীর বাবা ও মামাসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং তথ্য-প্রমাণের কোনো কিছুকেই বিবেচনায় নেননি বিচারকরা। তারা বরং সচেষ্ট থেকেছেন অভিযুক্ত হাবিলদারকে রেহাই দেয়ার জন্য। অথচ দেশী-বিদেশী সকল অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে, ফেলানীকে রীতিমতো টার্গেট করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক দূরত্ব থেকে হত্যা করেছিল অমিয় ঘোষ। বিএসএফ-এর আইনেও এ অপরাধের ন্যূনতম শাস্তি সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। তাছাড়া নারী ও শিশুদের ব্যাপারে খোদ বিএসএফ-এরই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নিরস্ত্র কোনো নারী-শিশুকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বা চোরাচালানীদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। অন্যদিকে ফেলানীকে সরাসরি হত্যা করেছিল হাবিলদার অমিয় ঘোষ। কিন্তু এত নিষ্ঠুর একটি হত্যাকাণ্ডের পরও খুনি অমিয় ঘোষকে কোনো দণ্ডই দেয়া হয়নি।
এ পর্যন্ত এসে শেষ হলেও হয়তো কথা বাড়াতে হতো না। কিন্তু যাকে বলে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’! কিশোরী ফেলানীকে নিয়ে নতুন পর্যায়ে কুটিল রাজনীতি শুরু করেছে ভারত সরকার। গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে এতদিন পর এসে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ফেলানী হত্যার দায় নাকি তার পিতা নূরুল ইসলামের। কারণ, ফেলানী ও তার পরিবার নাকি অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছিল। ঘটনার দিন দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢোকার সময় বাবার চাপাচাপিতে ফেলানী মই বেয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার চেষ্টা করে এবং বিএসএফ-এর গুলীতে নিহত হয়। বিএসএফ তার ‘দায়িত্ব’ পালন করেছে বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, ফেলানীর হত্যাকারী অমিয় ঘোষ বিএসএফ সদর দফতরের জারি করা নির্দেশনা লংঘন করেছে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কেউ প্ররোচিত করলেও সীমান্ত এলাকায় নারী ও শিশুদের হত্যা করা চলবে না। কিন্তু হাবিলদার অমিয় ঘোষ সদর দফতরের নির্দেশনা অমান্য ও লংঘন করেছে।
বলা দরকার, এতদিন পর ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্টো ফেলানীর বাবাকে দায়ী করতে চাইলেও স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হলো, ফেলানীদের বাড়ি কুড়িগ্রামে এবং তাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অসহায় শিকার বানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, কোচবিহারের বিশেষ আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেও কোনো লাভ হয়নি। অভিযুক্ত অমিয় ঘোষ নিজে গুলী করার কথা স্বীকার করলেও তাকে এই যুক্তিতে খালাস দেয়া হয়েছে যে, সে নাকি তার ‘দায়িত্ব পালন’ করেছে! স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে দেশপ্রেমিকদের মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। স্মরণ করা দরকার, প্রথম দফা বিচারের পরও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন দেশের বিশিষ্টজনরা। রায়কে বিচারের নামে প্রহসন হিসেবে আখ্যায়িত করে তারা বলেছিলেন, এর মাধ্যমে ফেলানীকে দ্বিতীয়বার খুন করেছে বিএসএফ। আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির সুযোগেই যে ভারতীয়রা প্রহসনের সাহস পেয়েছে সে কথাও বলেছিলেন তারা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। তারা ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানোর, আপিলের পাশাপাশি নতুন করে বিচারের আয়োজন করার এবং বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছিলেন।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন ব্যাখ্যাসহ সর্বশেষ খবরের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিচারের নামে বিএসএফ তথা ভারতের পক্ষ থেকে সত্যিকার অর্থেই নাটক সাজানো হয়েছে। তথ্যনির্ভর যে কোনো পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বিএসএফ-এর খুনি ও সন্ত্রাসী সৈনিকরা স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করে আসছে। অন্যদিকে সব জেনে-শুনেও ভারতের কাছে বলিষ্ঠভাবে প্রতিবাদ পর্যন্ত জানাচ্ছে না আওয়ামী লীগ সরকার। এ অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে বিএসএফ। এর খুনি ও সন্ত্রাসী সৈনিকরা শুধু নিরীহ মানুষই হত্যা করছে না, কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর মতো কাউকে কাউকে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখারও দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এদিকে বিএসএফকে প্রতিহত করার পরিবর্তে আওয়ামী লীগ সরকার বরং বিডিআরের বিলুপ্তি ঘটানোর মধ্য দিয়ে বিএসএফ-এর হত্যাকাণ্ডকে আরো বাধাহীন করেছে। অমিয় ঘোষদের দিয়েছে প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়। স্মরণ করা দরকার, বিডিআর থাকাকালে বিএসএফ কিন্তু এত বেশি দুঃসাহস দেখাতো না। পাদুয়াসহ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় মাঝে-মধ্যেই সমুচিত জবাব দেয়ায় বিডিআরকে বিএসএফ বরং বাঘের মতো ভয় করতো। একই বিএসএফ বর্তমান বিজিবিকে গণনায়ই আনছে না, সামান্য পাত্তা পর্যন্ত দিচ্ছে না। এদিকে ফেলানীর আগে-পরে অসংখ্য নিরীহ বাংলাদেশীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগ সরকার কিছুই বলছে না। মনে হচ্ছে সরকার যেন ‘সন্ন্যাসব্রত’ পালন করছে! সন্ন্যাসব্রতের আড়ালে এই ‘উদারতা’র কারণ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর দরকার পড়ে না। সরকার দেশের নাগরিক জীবনকে গুরুত্ব দিলে অবশ্যই প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতো। বিষয়টিকে সরকার জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উপস্থাপন করতো। কিন্তু অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। সরকার সবকিছু নীরবে হজম করে চলেছে। যেন বাংলাদেশীদের জীবনের কোনো দাম নেই!
উদাহরণ দেয়ার জন্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। ২০১৩ সালে প্রথম বিচারের রায় প্রকাশিত হওয়ার পরপর ১২ সেপ্টেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ফেলানী হত্যাকাণ্ডের বিচারে খুনি বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ বেকসুর খালাস পেয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, বিচারের ওই রায়ে মন্ত্রী ও তাদের সরকার সন্তুষ্ট কি না এবং সন্তুষ্ট না হয়ে থাকলে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা তারা ভাবছেন কি না? এর জবাবেই দীপু মনি ‘বন্ধু’ হিসেবে ভারতকে না হারানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তারা নাকি ভারতের আইন সম্পর্কে ‘জানার চেষ্টা’ করছেন এবং জানার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবেন, এ ব্যাপারে কোন ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায়!
বলা দরকার, তেমন কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। আর এ অবস্থারই পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে চলেছে ভারত সরকার। ফেলানী হত্যাকাণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া দূরে থাকুক সরকার আসলে কোনো চিন্তা পর্যন্ত করেনি। বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার যে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা ও আইন সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং না জেনেই যে বাংলাদেশের গলায় একের পর এক ফাঁস পরিয়ে চলেছে সে কথা জানা গেছে তিস্তা চুক্তি থেকে সীমান্ত প্রটোকল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে। তিস্তা চুক্তির কথাই ধরা যাক। এটা আটকে গেছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে। এই বিরোধিতা মমতা ব্যানিার্জি কিন্তু আইনসম্মতভাবেই করেছেন। তিস্তার মতো যে কোনো বিষয়ে চুক্তি করতে হলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের অনুমতি নিতে হয়- যে অনুমতি এখন দরকার পশ্চিমবঙ্গের। সে জন্যই রাজধানী দিল্লী¬তে বসে কিংবা ঢাকায় বেড়াতে এসে ড. মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্রনাথ মোদিরা যত আশ্বাসের কথাই শোনান না কেন, তারা চাইলেই বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে বা তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না। এজন্য আবার ভারতের সংবিধানও সংশোধন করতে হবে। আসলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য এটা ভারতীয়দের চমৎকার একটি কৌশলও বটে। এখানে শুধু এটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট হওয়া উচিত যে, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের যে বন্ধুত্বের জন্য ট্রানজিট-করিডোরসহ সবকিছুই ভারতকে দিয়ে ফেলেছেন এবং এখনো শুধু দিতেই ব্যস্ত রয়েছেন সে বন্ধুত্বের নাগাল তারা কোনোদিনই পাবেন না। কারণ, সেবাদাসদের ভারত শুধু সেবাদাস হিসেবেই ব্যবহার করে, কাজে লাগায়।
প্রসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে ‘ফার্স্ট পোস্ট’ নামে ভারতীয় অনলাইন পত্রিকার একটি রিপোর্টের উল্লেখ করা যায়। ‘সাকসেস স্টোরি’ শিরোনামে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর রচিত ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার ভারত সরকারের জন্য ‘সাফল্যের বিরাট সিঁড়ি নির্মাণ করেছে’। এই সিঁড়ি বেয়েই ঝুড়ি বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে ভারত। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সম্পর্কে পত্রিকাটি লিখেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করা ছাড়া পরাষ্ট্রনীতিতে কোনো সফলতাই অর্জন করতে পারেননি তিনি। তার সরকারের একমাত্র সাফল্য বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং ওই সরকারের কাছ থেকে একের পর এক ভারতের বিভিন্ন স্বার্থ আদায় করা। নিজেরা আদায় করলেও ভারত সরকার যে বাংলাদেশের কোনো একটি অনুরোধই রক্ষা করেনি সে কথাটাও জানিয়েছে ‘ফার্স্ট পোস্ট’। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিস্তা চুক্তির উল্লখ করে বলেছে, মনমোহন সিং ও নরেন্দ্রনাথ মোদির উভয় সরকারই মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতার অজুহাত দেখিয়ে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থেকেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘ফার্স্ট পোস্ট’-এর রিপোর্টটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয়দের প্রকৃত মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে বহুবার শোনা আশ্বাসের বাইরে ‘এক চুল’ পরিমাণও আদায় করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। অর্থাৎ নানা কথার মারপ্যাঁচে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বিরাট একটি ‘না’ পাঠিয়েছে ভারত। সব মিলিয়েই ভারতের কাছ থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে সরকারকে। এই ‘না’-এর মধ্য দিয়ে আসলে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারতীয়রা নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ত্যাগ করতে রাজি নন। ভারতীয়দের জন্য এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা স্বাধীনতার পর থেকেই এ মনোভাব দেখিয়ে চলেছে।
বর্তমান পর্যায়ে ফেলানীকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের মধ্য দিয়েও বাংলাদেশের প্রতি একই মোনোভাব ও কৌশলের প্রকাশ ঘটেছে। একই কারণে সরকারের দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে। দেশপ্রেমিকরা মনে করেন, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই সরকারের উচিত সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যা বন্ধ ও প্রতিহত করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া। এ উদ্দেশ্যে বিজিবির লোকবল ও মনোবল বাড়াতে হবে, বিজিবির জওয়ানদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তুলে দিতে হবে। সীমান্তে সেনাবাহিনীকেও মোতায়েন করা ও তৎপর রাখা দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারি পর্যায়ে গুলী ও হত্যা বিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়া। পাশাপাশি সরকারের উচিত কূটনৈতিক পর্যায়ে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। অবস্থান পাল্টাতে ভারত সম্মত না হলে ফেলানীর বিষয়টিকে অবশ্যই অন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপন করতে হবে। আমরা চাই, কেবলই বিএনপি-জামায়াতকে নির্মূল করার ভয়ংকর অভিযান চালানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে সমানে সমান হিসেবে অবস্থান নেয়ার এবং বাংলাদেশের সকল পাওনা আদায়ের চেষ্টা করা।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন