গত ১৭ই সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির চাকরি জীবন শেষ হলো Unceremoniously. আপিল বিভাগ তো দূরের কথা, হাইকোর্ট বিভাগেরও অনেক বিচারপতিকে অবসরে যাওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট বার থেকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। আর আপিল বিভাগের বিচারপতিগণকে সুপ্রিম কোর্ট বার তো বটেই, এটর্নি জেনারেলের অফিস থেকেও ফেয়ার ওয়েল দেয়া হয়। কিন্তু আজকে যাকে নিয়ে আলোচনা করছি সেই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতি সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাকে ফেয়ার ওয়েল দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। পত্র পত্রিকায় বলা হয়েছে যে, বার সমিতি তাকে বিদায় সংবর্ধনা না দিলেও এটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে সেটি দেয়া হবে। কিন্তু ১৮ তারিখের পত্র পত্রিকায় দেখলাম, এটর্নি জেনারেলের অফিসও তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানায়নি। এটি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। বার সমিতি বিরত থাকবে, সেটি তো জানা কথা। কারণগুলোও তারা গোপন করেনি। বরং কি কারণে তারা সংবর্ধনা দেবে না সেসব কারণ একটি প্রস্তাবে সন্নিবেশ করা হয়েছে।
আইনজীবীদের সাধারণ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিভিন্ন কার্যকলাপ জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। তার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমেদ মৃত্যু বরণ করেন। তার কারণে ১৪ জন আইনজীবীকে কারাগারে যেতে হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে শপথ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা দুঃখজনক। আইনজীবীদের উন্নয়নমূলক কাজের বিরোধিতা করেছেন তিনি। এসব কারণে সাধারণ সভায় আইনজীবীরা তার সংবর্ধনা প্রদানের বিরোধিতা করেছেন।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেয়া হবে কি না এ বিষয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ওই বিচারপতিকে ছয়টি কারণে সংবর্ধনা না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সরকারের এটর্নি জেনারেলের কার্যালয় সংবর্ধনা দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
সাধারণ সভায় গৃহীত ছয়টি সিদ্ধান্ত হলো:
১. বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এবং আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তার বিভিন্ন কার্যকলাপ জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ায় এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ায় এই সভা তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে।
২. তার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। এডভোকেট মোজাম্মেলসহ অনেক আইনজীবীর সঙ্গে অসদাচরণ ও অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে সভায় উপস্থিত সাধারণ আইনজীবীরা তাকে সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়ার বিরোধিতা করেন।
৩. জনাব মানিক অতীত অসদাচরণের ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফসহ ১৪ জন আইনজীবীকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছিলেন। এজন্য সভা তার তীব্র নিন্দা জানায় এবং উপস্থিত সাধারণ আইনজীবীরা তাকে সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়ার বিরোধিতা করেন।
৪. পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেছেন যে বিচারপতি পদে শপথ নেয়ার সময় শামসুদ্দিন চৌধুরী ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে শপথ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা দুঃখজনক। দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তার উক্তরূপ অনিয়মের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেতন, ভাতা ও পেনশন প্রদান না করতে প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ এবং দুদককে এ ব্যাপারে তদন্ত করার আহ্বান জানানো হয়।
৫. জনাব মানিক বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের সুযোগ-সুবিধা রক্ষা এবং উন্নয়নমূলক কাজের বিরোধিতা করেছেন। আইনজীবীদের কিউবিক্যালস ভবন নির্মাণে নগ্ন বিরোধিতা করেন যার ফলে বারের অনেক আইনজীবী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
৬. এই বিতর্কিত বিচারপতি তথ্য গোপন করে দীর্ঘদিনের কার্যক্রম অনৈতিক ও বেআইনি মর্মে গোচরীভূত হওয়ায়, সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধনা না জানানোর জন্য সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
॥দুই॥
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির অভিসংশন বা ইম্পচমেন্ট চেয়ে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠির অনুলিপি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, আইনমন্ত্রী এবং সমস্ত বিচারপতির কাছে। তার এই কাজের সমালোচনা করেছেন বার সমিতির সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার অভিসংশন চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর আবেদন করা শোভনীয় হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। হাইকোর্টে থাকাকালে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করেছেন সেটাও শামসুদ্দিন চৌধুরীর জন্য শোভনীয় নয়। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়া হবে না বলেও সাংবাদিকদের জানান তিনি।
একজন আপিল বিভাগের বিচারপতির পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়ে এই প্রথম আবেদন। কোনো দেশের কোনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অপসারণের জন্য আবেদন শোভনীয় নয়।
সংবর্ধনা না দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বার বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেবে না সেটা মেজরিটির সিদ্ধান্ত তাই তার একার সিদ্ধান্তে কিছু হবে না। আমার মতামতও তাদের পক্ষে রয়েছে। এর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে আমরা সংবর্ধনা দেইনি। তিনি তা বুঝতে পেরে আগেই বলেছিলেন, বারের পক্ষ থেকে আমি সংবর্ধনা চাই না। আশা করি ভবিষ্যতে তার এই আচরণ থেকে অন্য সবাই শিক্ষা নেবেন। মনে রাখতে হবে ক্ষমতা জিনিসটা স্থায়ী না। ভয় রাখতে হয়। যে চেয়ারটায় তিনি আছেন সেই চেয়ারটা চিরদিনের জন্য নয়।
কোনো আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা ছাড়াই বিদায় নিয়েছেন আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এটাই ছিল আপিল বিভাগের প্রথম কোনো বিচারপতির সংবর্ধনাহীন বিদায়ের ঘটনা। প্রথা ও রীতি অনুযায়ী আপিল বিভাগের বিচারপতিরা অবসরে গেলে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন ও এটর্নি জেনারেল কার্যালয় সংবর্ধনা দিয়ে থাকে। তবে নানা বিতর্কিত ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট বার আগেই সাধারণ সভা ডেকে জানায় তারা বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেবে না। তবে এটর্নি জেনারেল কার্যালয় জানিয়েছিল বিদায়ী বিচারপতিকে সংবর্ধনা দেয়া হবে।
কিন্তু গত বৃহস্পতিবার এটর্নি জেনারেল বা সরকার সমর্থক আইনজীবীদের কেউই সংবর্ধনা দেয়নি। সরকার সমর্থকরা মিলনায়তনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এটর্নি জেনারেল কার্যালয়ও জানিয়েছিল, বিদায়ী বিচারপতিকে সংবর্ধনা জানানো হবে। তবে শেষ পর্যন্ত কেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো না সে বিষয়ে সরকার সমর্থক কোনো আইনজীবী বা এটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। অভিসংশন করার আবেদন জানিয়ে বিচারপতি চৌধুরী যে চিঠি দিয়েছিলেন সেটির প্রাপ্তি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী বা স্পীকার - কেউই স্বীকার করেননি। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, জনাব চৌধুরীর অভিসংশনের আবেদন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কেউই ভাল চোখে দেখেননি। তাই তারা তার চিঠিটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মনোভাব টের পেয়ে এটর্নি জেনারেলের অফিসও ফেয়ার ওয়েল দেয়ার জন্য এগিয়ে যাননি।
এই ব্যাপারে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বিচারপতি মানিককে ‘এক্সট্রিমলি রং হেডেড’ বলে অভিহিত করেছেন। আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, গত কয়দিন আগে দেশের বিচারালয়ে খুব বড় মাপের প্রলয় বয়ে গেছে। যদিও গণমাধ্যমে খবরটি এসেছে খুব ছোট করে।
বিএনপির এ নেতা বলেন, প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে বিচারপতি মানিকের যে অভিযোগ, তার চেয়েও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার (মানিক) বিরুদ্ধে। তিনি সব সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। তিনি অতীতে সংসদের স্পীকারকে মূর্খ বলেছেন। দেশের সম্মানিত নাগরিকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। মানুষকে হেনস্থা করেছেন। বিচারপতির দায়িত্বে থেকে অযাচিতভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে মানিককে উচ্চ আদালতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বিএনপি তাকে স্থায়ী করেনি। এটা বিএনপির সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ বিএনপি তার সম্পর্কে ভাল করেই জানতো তিনি টোটালি রং হেডেড।
॥তিন॥
দুই বিচারপতির মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত হয় বিচারপতি মানিকের অবসরকালীন পেনশন এবং অন্যান্য ভাতা নিয়ে। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল তাকে জানিয়েছেন যে, জনাব মানিক সকল রায় লেখা শেষ না করা পর্যন্ত তার পেনশন সংক্রান্ত প্রক্রিয়া যেন শুরু করা না হয়। জবাবে জনাব মানিক প্রধান বিচারপতির কাছে প্রেরিত চিঠিতে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতির পেনশন তার কাজ শেষ করার ওপর নির্ভর করে বলে কোনো আইনি উপাদানের কথা যেমন আমার জানা নেই, তেমনই এটাও আমার জানা নেই যে রায় লেখা শেষ না করলে কোনো সহকর্মী বিচারপতির পেনশন আটকে রাখার জন্য প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিতে পারেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী তার চিঠিতে লিখেছেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতিরও পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে কয়েক মাস সময় লেগে যায় এবং আপনিও অবসরে যাওয়ার সময় পূর্ণাঙ্গ রায় অপেক্ষমাণ থাকবে। এটা খুবই স্বাভাবিক। শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশের জন্যই এটা স্বাভাবিক বিষয় কারণ রাতারাতি রায় লেখা সম্ভব নয়।
তিনি লিখেছেন, অতীতের সকল বিচারপতির ক্ষেত্রে এ রকম হয়েছে এবং এমন কোনো উদাহরণ নেই যেখানে মাননীয় প্রধান বিচারপতির নির্দেশে কোনো বিচারপতির অবসরকালীন ভাতার বিষয়টি রায় লেখা শেষ করার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কোনো বিচারপতির পক্ষেই সব রায় লেখা শেষ করে অবসরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার বক্তব্যের স্বপক্ষে তিনি প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকসহ ৯ জন বিচারপতির নাম উল্লেখ করেছেন যারা অবসরে যাওয়ার আগে রায় লেখা শেষ করতে পারেননি।
এর উত্তরে প্রধান বিচারপতির অফিস থেকে বলা হয় যে, তিনি যেহেতু ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী তাই রায় না লিখে বিদেশে চলে গেলে জটিলতা সৃষ্টি হবে। এতে জনগণের ভোগান্তি আরো বাড়বে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি।
এরপর বিরোধ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। বিচারপতি মানিক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অভিসংশন দাবি করে প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি দেন।
॥চার॥
কোনো দেশের উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি তার প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিসংশন বা ইম্পিচমেন্টের দাবি তুলেছেন, এমন কথা অতীতে শোনা যায়নি। আমাদের পাশের দেশগুলো অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ প্রভৃতি দেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেদিক দিয়ে জনাব শামসুদ্দিন মানিক নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
এ ব্যাপারে কোনোরূপ মন্তব্য না করেও বলা যায় যে, যিনি এই দাবিটি তুলেছেন, অতীতে তাকে অভিসংশন করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে একাধিকবার দাবি উত্থাপিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১২ সালের ১৮ জুন স্পীকার আব্দুল হামিদ সংসদে একটি রুলিং দেন। রুলিংয়ে তিনি বলেন, “হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেছেন, আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। আমার বক্তব্যের কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহীতা কি, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহীতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন, এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি তার বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।”
রুলিংয়ে ঐ বিচারপতিকে অপসারণে সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর যে প্রস্তাব করেন স্পীকার তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, “গত ৫ জুন ২০১২ সংসদ সদস্যরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের এক পর্যায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন পূর্বক উক্ত বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে একটি রেজ্যুলেশন গ্রহণ করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রেরণের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। আপনাদের (সংসদ সদস্যদের) প্রস্তাবকে আমি সমর্থন করে বলতে চাই, একজন বিচারকের অশোভন আচরণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারে না।”
পরবর্তীকালে বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োজিত হন। ভাগ্যের পরিহাস, সেই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আজ প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে অভিসংশনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদকে। দুই বিচারপতির এই লড়াই কোনখানে গিয়ে শেষ হয় সেটি দেখার জন্য দেশবাসী গভীর আগ্রহ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং বঙ্গ ভবনের দিকে তাকিয়ে আছে। লড়াই যেখানেই শেষ হোক না কেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মান মর্যাদা এবং ভাবমূর্তিকে যে হুমকির মুখে ফেলেছে সে ব্যাপারে সুধী এবং বোদ্ধা মহলের কোনো সন্দেহ নাই।
আইনজীবীদের সাধারণ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিভিন্ন কার্যকলাপ জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। তার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমেদ মৃত্যু বরণ করেন। তার কারণে ১৪ জন আইনজীবীকে কারাগারে যেতে হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে শপথ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা দুঃখজনক। আইনজীবীদের উন্নয়নমূলক কাজের বিরোধিতা করেছেন তিনি। এসব কারণে সাধারণ সভায় আইনজীবীরা তার সংবর্ধনা প্রদানের বিরোধিতা করেছেন।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেয়া হবে কি না এ বিষয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ওই বিচারপতিকে ছয়টি কারণে সংবর্ধনা না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সরকারের এটর্নি জেনারেলের কার্যালয় সংবর্ধনা দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
সাধারণ সভায় গৃহীত ছয়টি সিদ্ধান্ত হলো:
১. বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এবং আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তার বিভিন্ন কার্যকলাপ জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ায় এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ায় এই সভা তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে।
২. তার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। এডভোকেট মোজাম্মেলসহ অনেক আইনজীবীর সঙ্গে অসদাচরণ ও অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে সভায় উপস্থিত সাধারণ আইনজীবীরা তাকে সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়ার বিরোধিতা করেন।
৩. জনাব মানিক অতীত অসদাচরণের ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফসহ ১৪ জন আইনজীবীকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছিলেন। এজন্য সভা তার তীব্র নিন্দা জানায় এবং উপস্থিত সাধারণ আইনজীবীরা তাকে সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়ার বিরোধিতা করেন।
৪. পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেছেন যে বিচারপতি পদে শপথ নেয়ার সময় শামসুদ্দিন চৌধুরী ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে শপথ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে, যা দুঃখজনক। দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তার উক্তরূপ অনিয়মের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেতন, ভাতা ও পেনশন প্রদান না করতে প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ এবং দুদককে এ ব্যাপারে তদন্ত করার আহ্বান জানানো হয়।
৫. জনাব মানিক বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের সুযোগ-সুবিধা রক্ষা এবং উন্নয়নমূলক কাজের বিরোধিতা করেছেন। আইনজীবীদের কিউবিক্যালস ভবন নির্মাণে নগ্ন বিরোধিতা করেন যার ফলে বারের অনেক আইনজীবী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
৬. এই বিতর্কিত বিচারপতি তথ্য গোপন করে দীর্ঘদিনের কার্যক্রম অনৈতিক ও বেআইনি মর্মে গোচরীভূত হওয়ায়, সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধনা না জানানোর জন্য সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
॥দুই॥
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির অভিসংশন বা ইম্পচমেন্ট চেয়ে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠির অনুলিপি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, আইনমন্ত্রী এবং সমস্ত বিচারপতির কাছে। তার এই কাজের সমালোচনা করেছেন বার সমিতির সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার অভিসংশন চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর আবেদন করা শোভনীয় হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। হাইকোর্টে থাকাকালে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করেছেন সেটাও শামসুদ্দিন চৌধুরীর জন্য শোভনীয় নয়। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়া হবে না বলেও সাংবাদিকদের জানান তিনি।
একজন আপিল বিভাগের বিচারপতির পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়ে এই প্রথম আবেদন। কোনো দেশের কোনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অপসারণের জন্য আবেদন শোভনীয় নয়।
সংবর্ধনা না দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বার বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেবে না সেটা মেজরিটির সিদ্ধান্ত তাই তার একার সিদ্ধান্তে কিছু হবে না। আমার মতামতও তাদের পক্ষে রয়েছে। এর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে আমরা সংবর্ধনা দেইনি। তিনি তা বুঝতে পেরে আগেই বলেছিলেন, বারের পক্ষ থেকে আমি সংবর্ধনা চাই না। আশা করি ভবিষ্যতে তার এই আচরণ থেকে অন্য সবাই শিক্ষা নেবেন। মনে রাখতে হবে ক্ষমতা জিনিসটা স্থায়ী না। ভয় রাখতে হয়। যে চেয়ারটায় তিনি আছেন সেই চেয়ারটা চিরদিনের জন্য নয়।
কোনো আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা ছাড়াই বিদায় নিয়েছেন আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এটাই ছিল আপিল বিভাগের প্রথম কোনো বিচারপতির সংবর্ধনাহীন বিদায়ের ঘটনা। প্রথা ও রীতি অনুযায়ী আপিল বিভাগের বিচারপতিরা অবসরে গেলে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন ও এটর্নি জেনারেল কার্যালয় সংবর্ধনা দিয়ে থাকে। তবে নানা বিতর্কিত ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট বার আগেই সাধারণ সভা ডেকে জানায় তারা বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেবে না। তবে এটর্নি জেনারেল কার্যালয় জানিয়েছিল বিদায়ী বিচারপতিকে সংবর্ধনা দেয়া হবে।
কিন্তু গত বৃহস্পতিবার এটর্নি জেনারেল বা সরকার সমর্থক আইনজীবীদের কেউই সংবর্ধনা দেয়নি। সরকার সমর্থকরা মিলনায়তনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এটর্নি জেনারেল কার্যালয়ও জানিয়েছিল, বিদায়ী বিচারপতিকে সংবর্ধনা জানানো হবে। তবে শেষ পর্যন্ত কেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো না সে বিষয়ে সরকার সমর্থক কোনো আইনজীবী বা এটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। অভিসংশন করার আবেদন জানিয়ে বিচারপতি চৌধুরী যে চিঠি দিয়েছিলেন সেটির প্রাপ্তি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী বা স্পীকার - কেউই স্বীকার করেননি। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, জনাব চৌধুরীর অভিসংশনের আবেদন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কেউই ভাল চোখে দেখেননি। তাই তারা তার চিঠিটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মনোভাব টের পেয়ে এটর্নি জেনারেলের অফিসও ফেয়ার ওয়েল দেয়ার জন্য এগিয়ে যাননি।
এই ব্যাপারে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বিচারপতি মানিককে ‘এক্সট্রিমলি রং হেডেড’ বলে অভিহিত করেছেন। আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, গত কয়দিন আগে দেশের বিচারালয়ে খুব বড় মাপের প্রলয় বয়ে গেছে। যদিও গণমাধ্যমে খবরটি এসেছে খুব ছোট করে।
বিএনপির এ নেতা বলেন, প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে বিচারপতি মানিকের যে অভিযোগ, তার চেয়েও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার (মানিক) বিরুদ্ধে। তিনি সব সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। তিনি অতীতে সংসদের স্পীকারকে মূর্খ বলেছেন। দেশের সম্মানিত নাগরিকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। মানুষকে হেনস্থা করেছেন। বিচারপতির দায়িত্বে থেকে অযাচিতভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে মানিককে উচ্চ আদালতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বিএনপি তাকে স্থায়ী করেনি। এটা বিএনপির সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ বিএনপি তার সম্পর্কে ভাল করেই জানতো তিনি টোটালি রং হেডেড।
॥তিন॥
দুই বিচারপতির মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত হয় বিচারপতি মানিকের অবসরকালীন পেনশন এবং অন্যান্য ভাতা নিয়ে। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল তাকে জানিয়েছেন যে, জনাব মানিক সকল রায় লেখা শেষ না করা পর্যন্ত তার পেনশন সংক্রান্ত প্রক্রিয়া যেন শুরু করা না হয়। জবাবে জনাব মানিক প্রধান বিচারপতির কাছে প্রেরিত চিঠিতে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতির পেনশন তার কাজ শেষ করার ওপর নির্ভর করে বলে কোনো আইনি উপাদানের কথা যেমন আমার জানা নেই, তেমনই এটাও আমার জানা নেই যে রায় লেখা শেষ না করলে কোনো সহকর্মী বিচারপতির পেনশন আটকে রাখার জন্য প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিতে পারেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী তার চিঠিতে লিখেছেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতিরও পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে কয়েক মাস সময় লেগে যায় এবং আপনিও অবসরে যাওয়ার সময় পূর্ণাঙ্গ রায় অপেক্ষমাণ থাকবে। এটা খুবই স্বাভাবিক। শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশের জন্যই এটা স্বাভাবিক বিষয় কারণ রাতারাতি রায় লেখা সম্ভব নয়।
তিনি লিখেছেন, অতীতের সকল বিচারপতির ক্ষেত্রে এ রকম হয়েছে এবং এমন কোনো উদাহরণ নেই যেখানে মাননীয় প্রধান বিচারপতির নির্দেশে কোনো বিচারপতির অবসরকালীন ভাতার বিষয়টি রায় লেখা শেষ করার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কোনো বিচারপতির পক্ষেই সব রায় লেখা শেষ করে অবসরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার বক্তব্যের স্বপক্ষে তিনি প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকসহ ৯ জন বিচারপতির নাম উল্লেখ করেছেন যারা অবসরে যাওয়ার আগে রায় লেখা শেষ করতে পারেননি।
এর উত্তরে প্রধান বিচারপতির অফিস থেকে বলা হয় যে, তিনি যেহেতু ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী তাই রায় না লিখে বিদেশে চলে গেলে জটিলতা সৃষ্টি হবে। এতে জনগণের ভোগান্তি আরো বাড়বে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি।
এরপর বিরোধ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। বিচারপতি মানিক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অভিসংশন দাবি করে প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি দেন।
॥চার॥
কোনো দেশের উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি তার প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিসংশন বা ইম্পিচমেন্টের দাবি তুলেছেন, এমন কথা অতীতে শোনা যায়নি। আমাদের পাশের দেশগুলো অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ প্রভৃতি দেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেদিক দিয়ে জনাব শামসুদ্দিন মানিক নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
এ ব্যাপারে কোনোরূপ মন্তব্য না করেও বলা যায় যে, যিনি এই দাবিটি তুলেছেন, অতীতে তাকে অভিসংশন করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে একাধিকবার দাবি উত্থাপিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১২ সালের ১৮ জুন স্পীকার আব্দুল হামিদ সংসদে একটি রুলিং দেন। রুলিংয়ে তিনি বলেন, “হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেছেন, আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। আমার বক্তব্যের কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহীতা কি, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহীতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন, এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি তার বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।”
রুলিংয়ে ঐ বিচারপতিকে অপসারণে সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর যে প্রস্তাব করেন স্পীকার তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, “গত ৫ জুন ২০১২ সংসদ সদস্যরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের এক পর্যায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন পূর্বক উক্ত বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে একটি রেজ্যুলেশন গ্রহণ করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রেরণের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। আপনাদের (সংসদ সদস্যদের) প্রস্তাবকে আমি সমর্থন করে বলতে চাই, একজন বিচারকের অশোভন আচরণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারে না।”
পরবর্তীকালে বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োজিত হন। ভাগ্যের পরিহাস, সেই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আজ প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে অভিসংশনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদকে। দুই বিচারপতির এই লড়াই কোনখানে গিয়ে শেষ হয় সেটি দেখার জন্য দেশবাসী গভীর আগ্রহ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং বঙ্গ ভবনের দিকে তাকিয়ে আছে। লড়াই যেখানেই শেষ হোক না কেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মান মর্যাদা এবং ভাবমূর্তিকে যে হুমকির মুখে ফেলেছে সে ব্যাপারে সুধী এবং বোদ্ধা মহলের কোনো সন্দেহ নাই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন