অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের শত এলোমেলো কথাবার্তা আর জেদাজেদি সত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছে। সরকার তাদের টিউশন ফি’র ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। সচেতন শিক্ষার্থী সমাজকে আন্তরিক অভিন্দন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের গুণের কোনো শেষ নেই। তিরাশি বছর বয়স্ক এই ভদ্রলোক আবার অতীব প্রভুভক্ত। যখন যে প্রভু, তার পায়ে হাজারো সালাম। তার জীবনে প্রভুর বদল হয়েছে বারবার। কিন্তু ভক্তির ঘাটতি কখনও দেখা যায়নি। দক্ষতার সঙ্গে সেবা করেছেন পাকিস্তান সরকারকে। আমলা হিসেবে সচিব ছিলেন অনেক দিন। তারপর থেকেই তার ডিগবাজির ইতিহাস শুরু। সেক্ষেত্রে তিনি স্বৈরাচারী গণতন্ত্রীতে কোনো ভেদ করেননি। সুবিধার দিকে সব সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আর তাই ১৯৮২ সালে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হঠিয়ে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন সঙ্গে সঙ্গেই তার মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন এই আবুল মাল মুহিত।
আসলে তার গোটা জীবনটাই গণবিরোধীদের সেবায় নিয়োজিত থেকেছে ও আছে। আসলে এরশাদের সঙ্গে যোগ দেওয়াটাও ছিল তার গণবিরোধী পথযাত্রার একটি সিঁড়ি। সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে তিনি কাজ করেছেন বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের শোষণ লুণ্ঠনকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কর্মকর্তা হিসেবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো পৃথিবীর দরিদ্র মানুষদের গরীব করে রাখা আর সেভাবে তাদের শোষণ করে যাওয়া। মুহিত তাদের সহযোগী হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে দরিদ্র দেশগুলোর এই অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম প্রধান পথ হলো উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা। মুহিত এবার তাই পুরানা অভ্যাসে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর হাত দিয়েছেন।
এক-এগারোর স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে যখন এদেশের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তখনও মুহিত ছিলেন নিরাপদ দূরত্বে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা সামরিক সরকারের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে যে সরকার গঠন করেন, তাতে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নাজেল হন আবুল মাল মুহিত। তারপর থেকেই আছেন। বেশ আছেন। জনগণকে শোষণ লুণ্ঠনের ধারাবাহিক কর্মকা- তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার চেয়ে গণবিরোধী আর কাউকে পাওয়া যায়নি বলেই সম্ভবত তিনি বহালও আছেন।
কিন্তু বছরখানেক ধরে তিনি ধারাবাহিকভাবে নানা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে তিনি বারবার নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসছেন। কখনও বলেন, তিনি আর মন্ত্রী থাকতে চান না। কখনও বলেন মন্ত্রিত্ব কি আর সহজে ছাড়া যায়। আর এখন তিনি তার সাবেক প্রভু এরশাদের মতো কথা বলতে শুরু করেছেন। সকালে যেকথা বলেন, বিকালে বলেন তার ঠিক উল্টো কথা। আজ যা বলেন, কাল বলেন তার বিপরীত কথা। কখনও বলেন, বুড়ো মানুষ, কখন কি বলি ঠিক নেই। যাদের উদ্দেশ্যে বাজে কথা বলেন, তারা যেন কিছু মনে না করেন। সব চেয়ে বিপদ হলো তিনি নিজেকে ছাড়া এই বাংলাদেশে আর কাউকে মানুষই মনে করেন না। বাংলাদেশে তার মতো ‘শিক্ষিত’ আর কোনো লোক আছে বলেও তিনি মনে করেন না। জানি না, দুনিয়ায় আছে বলে মনে করেন কিনা। ফলে যা কিছু তার মন মতো নয়, তার সব কিছুকেই তিনি ‘রাবিশ’ আর ‘স্টুপিড’ বলে গাল দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। ফলে কখনও কখনও তাকে অপ্রকৃতিস্থ উন্মাদ বলে মনে হয়।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ও টিউশন ফি’তে ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে তার বক্তব্যে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। ছাত্ররা এই ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন গত জুন থেকেই। সে সময়ই মুহিত ঘোষণা করেন যে, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের টিউশন ফি’র ওপর ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। তখন থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। তারা মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, স্মারকলিপি প্রদান প্রভৃতি কর্মসূচি পালন করে যেতে থাকেন। তাদের বক্তব্য ছিল, শিক্ষা কোনো পণ্য নয় যে, তার ওপর ভ্যাট বসাতে হবে। শিক্ষা অধিকার । অতএব এর ওপর কোনো ভ্যাট বসানো যাবে না।
কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার বা তার অর্থমন্ত্রী শ্রবণ প্রতিবন্ধীর মতো আচরণ শুরু করেন। দেশের শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী সমাজও এর প্রতিবাদ করতে থাকেন। কিন্তু মুহিত বলেন, যেখানেই ভ্যাট পাওয়া যাবে, সেখানেই খোঁচা দিতে হবে। এমন কি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফও বলেন যে, ৬০ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী ছয় হাজার কোটি টাকার সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। এর কোনো কিছুই তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। সর্বশেষ সরকারি কর্মচারীদের পে-স্কেল চূড়ান্ত করতে গিয়ে মুহিত ঘোষণা করেন যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাড়ে সাত শতাংশ হারে ভ্যাট দিতেই হবে। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা হাতে লেখা নানা ধরনের প্লাকার্ড ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। ফলে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার বাইরেও। তখন অর্থমন্ত্রী প্রথমে ঘোষণা করেন যে, এই ভ্যাট ছাত্রদের দিতে হবে না। ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ছাত্ররা। কারণ, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, কোনো না কোনো নামে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই আদায় করবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও জানায় যে, তারা এই টাকা বাড়ি থেকে এনে দেবে না। সুতরাং বিকল্প কোনো পথে তাদের এ টাকার সংস্থান করতে হবে। মানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই নেয়া হবে।
ইতিমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। পে স্কেলে বেতন তাদেরও বাড়ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের মর্যাদা নামিয়ে দেয়া হয়েছে আমলাদের চেয়ে দু’ ধাপ নিচে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে একটা ‘রাবিশ’ মন্তব্য করে বসলেন মুহিত। তিনি বললেন, ‘জ্ঞানের অভাবে’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। শিক্ষকগণ এটা মেনে নিতে পারেননি। তারা মুহিতকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চেয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার আল্টিমেটাম দেন। মুহিত সম্ভবত পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে বিশ্ববিদালয় শিক্ষকদের সম্পর্কে তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ঐ বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। তবে সে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেন যে, টিউশন ফির ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট শিক্ষার্থীদেরই দিতে হবে।
তারপর তিনি পথের পাশের মুদি দোকানির মতো হিসাব কষে আমাদের বলে দিলেন যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে তাদের দৈনিক খরচ হয় এক হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকার অতিরিক্ত দৈনিক মাত্র ৭৫ টাকা চায়, এটা এমন কিছু বেশি নয়। অর্থমন্ত্রী মুহিতের এই হিসাবের ভিত্তিও অজানা। তিনি বলে দিলেন হয়ে গেল। তাই যদি হয়, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন, তারা মাসে বেতন দেন মাত্র ১৫ টাকা। তাদের কাছ থেকে মাসে ৭৫ টাকা ভ্যাট আদায় করে দেখান দেখি। অর্থাৎ অর্থমন্ত্রীর ধারণা হয়েছে যে, যাদের সন্তানরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের মাসিক উপার্জন লাখ লাখ টাকা। এটাও চরম অজ্ঞতা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এত আসন নেই যে, সকল শিক্ষার্থীকে সেখানে ভর্তি করা যাবে। অনেকেই জায়গা-জমি বিক্রি করে, ধারদেনা করে, চাকরি বাকরি বা প্রাইভেট পড়িয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ যোগাড় করেন ভবিষ্যতের আশায়। সেটা মুহিত সাহেবের ধারণার ভেতরেও নেই।
এর পরদিন আবার কথা ঘোরালেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বললেন, না, ভ্যাট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই দিতে হবে। আর ছাত্রছাত্রীরা যেন সতর্ক থাকে, যাতে তাদের কাছ থেকে কোনো অছিলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভ্যাটের টাকা আদায় করে নিতে না পারে। এর অর্থ দাঁড়ালো, এখানকার শিক্ষার্থীরা সারা বছর ধরে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে থাকবে। লেখাপড়া শিকায় উঠবে। আর মুহিতের লক্ষ্যও এটাই।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে অনড় থাকেন। তাদের বক্তব্য, শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। অতএব শিক্ষার ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। আন্দোলন চলতে থাকলো। দাবি একটাই। ভ্যাট দেব না, গুলী কর। অচল হয়ে পড়ল ঢাকাসহ সারা দেশ। এখানে বিস্ময়করভাবে একশ্রেণীর সরকারি তাঁবেদার মিডিয়ার গণবিরোধী ভূমিকা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। হ্যাঁ এই আন্দোলনে অচল হয়ে গেছে ঢাকা। বহু মানুষকে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। কোনো কোনো প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনকে নয়, সেই দুর্ভোগকেই প্রধান করে দেখাবার প্রাণান্ত কোশেশ করে ব্যর্থ হলো। মিডিয়ায় সরকারের এমন বেহায়া দালালি অনেকদিন পর প্রাণভরে উপভোগ করলাম।
একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখলাম, পথের ওপর দাঁড়িয়ে খুব সাধারণ মানুষকে ধরে ধরে সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। নিম্নমধ্যবিত্ত এক বোরখা-পরা মাঝবয়সী মাকে আটকে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করল, এই যে এতদূর থেকে এলেন, যানবাহন নেই। আপনার কষ্ট হচ্ছে না? কষ্ট তো হচ্ছেই। তবু আপনি কি ছাত্রদের এ আন্দোলন সমর্থন করেন? নিশ্চয়ই করি। ছেলেপেলে পড়াতে এমনিতেই যে খরচ, তার ওপর আরও টাকা কেন দিতে হবে? সন্তানদের জন্য এটুকু কষ্ট তো মেনে নিতেই হবে। কেউ কেউ বললেন, সরকারি কর্মচারিদের বেতন কিছু কমিয়ে সেখান থেকে এই টাকা নেয়া যেত। শিক্ষায় আবার ভ্যাট কেন? ছাত্রদের কাছ থেকে নিতে হবে কেন? একজন লোকও পাওয়া গেল না, যিনি বললেন, যেহেতু ছাত্রদের আন্দোলনে কষ্ট হচ্ছে, অতএব পিটিয়ে এদের রাস্তা থেকে তুলে দিয়ে রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক করে আনা হোক। ছাত্ররা করজোড়ে পথচারিদের কাছে মাফ চাচ্ছিলেন, কোনো কোনো প্রবীণ মানুষের বোঝা কিছু দূর বয়ে নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছিলেন। শিশুদের স্কুলব্যাগ নিজের পিঠে তুলে নিয়ে আগায়ে দিচ্ছিলেন।
ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত এই আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত তারা জয়ী হয়েছে। সরকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তাদের প্রতিবাদী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আনন্দ মিছিলে রূপ নিয়েছিল। তারা আবার স্ব স্ব ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন। এই আন্দোলনে ছাত্রদের জয় থেকে আবারও একটা বিষয় প্রমাণিত হলো যে, জনতার ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কখনও বৃথা যায় না। বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের গুণের কোনো শেষ নেই। তিরাশি বছর বয়স্ক এই ভদ্রলোক আবার অতীব প্রভুভক্ত। যখন যে প্রভু, তার পায়ে হাজারো সালাম। তার জীবনে প্রভুর বদল হয়েছে বারবার। কিন্তু ভক্তির ঘাটতি কখনও দেখা যায়নি। দক্ষতার সঙ্গে সেবা করেছেন পাকিস্তান সরকারকে। আমলা হিসেবে সচিব ছিলেন অনেক দিন। তারপর থেকেই তার ডিগবাজির ইতিহাস শুরু। সেক্ষেত্রে তিনি স্বৈরাচারী গণতন্ত্রীতে কোনো ভেদ করেননি। সুবিধার দিকে সব সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আর তাই ১৯৮২ সালে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হঠিয়ে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন সঙ্গে সঙ্গেই তার মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন এই আবুল মাল মুহিত।
আসলে তার গোটা জীবনটাই গণবিরোধীদের সেবায় নিয়োজিত থেকেছে ও আছে। আসলে এরশাদের সঙ্গে যোগ দেওয়াটাও ছিল তার গণবিরোধী পথযাত্রার একটি সিঁড়ি। সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে তিনি কাজ করেছেন বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের শোষণ লুণ্ঠনকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কর্মকর্তা হিসেবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো পৃথিবীর দরিদ্র মানুষদের গরীব করে রাখা আর সেভাবে তাদের শোষণ করে যাওয়া। মুহিত তাদের সহযোগী হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে দরিদ্র দেশগুলোর এই অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম প্রধান পথ হলো উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা। মুহিত এবার তাই পুরানা অভ্যাসে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর হাত দিয়েছেন।
এক-এগারোর স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে যখন এদেশের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তখনও মুহিত ছিলেন নিরাপদ দূরত্বে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা সামরিক সরকারের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে যে সরকার গঠন করেন, তাতে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নাজেল হন আবুল মাল মুহিত। তারপর থেকেই আছেন। বেশ আছেন। জনগণকে শোষণ লুণ্ঠনের ধারাবাহিক কর্মকা- তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার চেয়ে গণবিরোধী আর কাউকে পাওয়া যায়নি বলেই সম্ভবত তিনি বহালও আছেন।
কিন্তু বছরখানেক ধরে তিনি ধারাবাহিকভাবে নানা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে তিনি বারবার নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসছেন। কখনও বলেন, তিনি আর মন্ত্রী থাকতে চান না। কখনও বলেন মন্ত্রিত্ব কি আর সহজে ছাড়া যায়। আর এখন তিনি তার সাবেক প্রভু এরশাদের মতো কথা বলতে শুরু করেছেন। সকালে যেকথা বলেন, বিকালে বলেন তার ঠিক উল্টো কথা। আজ যা বলেন, কাল বলেন তার বিপরীত কথা। কখনও বলেন, বুড়ো মানুষ, কখন কি বলি ঠিক নেই। যাদের উদ্দেশ্যে বাজে কথা বলেন, তারা যেন কিছু মনে না করেন। সব চেয়ে বিপদ হলো তিনি নিজেকে ছাড়া এই বাংলাদেশে আর কাউকে মানুষই মনে করেন না। বাংলাদেশে তার মতো ‘শিক্ষিত’ আর কোনো লোক আছে বলেও তিনি মনে করেন না। জানি না, দুনিয়ায় আছে বলে মনে করেন কিনা। ফলে যা কিছু তার মন মতো নয়, তার সব কিছুকেই তিনি ‘রাবিশ’ আর ‘স্টুপিড’ বলে গাল দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। ফলে কখনও কখনও তাকে অপ্রকৃতিস্থ উন্মাদ বলে মনে হয়।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ও টিউশন ফি’তে ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে তার বক্তব্যে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। ছাত্ররা এই ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন গত জুন থেকেই। সে সময়ই মুহিত ঘোষণা করেন যে, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের টিউশন ফি’র ওপর ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। তখন থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। তারা মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, স্মারকলিপি প্রদান প্রভৃতি কর্মসূচি পালন করে যেতে থাকেন। তাদের বক্তব্য ছিল, শিক্ষা কোনো পণ্য নয় যে, তার ওপর ভ্যাট বসাতে হবে। শিক্ষা অধিকার । অতএব এর ওপর কোনো ভ্যাট বসানো যাবে না।
কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার বা তার অর্থমন্ত্রী শ্রবণ প্রতিবন্ধীর মতো আচরণ শুরু করেন। দেশের শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী সমাজও এর প্রতিবাদ করতে থাকেন। কিন্তু মুহিত বলেন, যেখানেই ভ্যাট পাওয়া যাবে, সেখানেই খোঁচা দিতে হবে। এমন কি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফও বলেন যে, ৬০ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী ছয় হাজার কোটি টাকার সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। এর কোনো কিছুই তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। সর্বশেষ সরকারি কর্মচারীদের পে-স্কেল চূড়ান্ত করতে গিয়ে মুহিত ঘোষণা করেন যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাড়ে সাত শতাংশ হারে ভ্যাট দিতেই হবে। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা হাতে লেখা নানা ধরনের প্লাকার্ড ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। ফলে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার বাইরেও। তখন অর্থমন্ত্রী প্রথমে ঘোষণা করেন যে, এই ভ্যাট ছাত্রদের দিতে হবে না। ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ছাত্ররা। কারণ, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, কোনো না কোনো নামে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই আদায় করবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও জানায় যে, তারা এই টাকা বাড়ি থেকে এনে দেবে না। সুতরাং বিকল্প কোনো পথে তাদের এ টাকার সংস্থান করতে হবে। মানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই নেয়া হবে।
ইতিমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। পে স্কেলে বেতন তাদেরও বাড়ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের মর্যাদা নামিয়ে দেয়া হয়েছে আমলাদের চেয়ে দু’ ধাপ নিচে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে একটা ‘রাবিশ’ মন্তব্য করে বসলেন মুহিত। তিনি বললেন, ‘জ্ঞানের অভাবে’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। শিক্ষকগণ এটা মেনে নিতে পারেননি। তারা মুহিতকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চেয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার আল্টিমেটাম দেন। মুহিত সম্ভবত পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে বিশ্ববিদালয় শিক্ষকদের সম্পর্কে তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ঐ বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। তবে সে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেন যে, টিউশন ফির ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট শিক্ষার্থীদেরই দিতে হবে।
তারপর তিনি পথের পাশের মুদি দোকানির মতো হিসাব কষে আমাদের বলে দিলেন যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে তাদের দৈনিক খরচ হয় এক হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকার অতিরিক্ত দৈনিক মাত্র ৭৫ টাকা চায়, এটা এমন কিছু বেশি নয়। অর্থমন্ত্রী মুহিতের এই হিসাবের ভিত্তিও অজানা। তিনি বলে দিলেন হয়ে গেল। তাই যদি হয়, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন, তারা মাসে বেতন দেন মাত্র ১৫ টাকা। তাদের কাছ থেকে মাসে ৭৫ টাকা ভ্যাট আদায় করে দেখান দেখি। অর্থাৎ অর্থমন্ত্রীর ধারণা হয়েছে যে, যাদের সন্তানরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের মাসিক উপার্জন লাখ লাখ টাকা। এটাও চরম অজ্ঞতা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এত আসন নেই যে, সকল শিক্ষার্থীকে সেখানে ভর্তি করা যাবে। অনেকেই জায়গা-জমি বিক্রি করে, ধারদেনা করে, চাকরি বাকরি বা প্রাইভেট পড়িয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ যোগাড় করেন ভবিষ্যতের আশায়। সেটা মুহিত সাহেবের ধারণার ভেতরেও নেই।
এর পরদিন আবার কথা ঘোরালেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বললেন, না, ভ্যাট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই দিতে হবে। আর ছাত্রছাত্রীরা যেন সতর্ক থাকে, যাতে তাদের কাছ থেকে কোনো অছিলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভ্যাটের টাকা আদায় করে নিতে না পারে। এর অর্থ দাঁড়ালো, এখানকার শিক্ষার্থীরা সারা বছর ধরে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে থাকবে। লেখাপড়া শিকায় উঠবে। আর মুহিতের লক্ষ্যও এটাই।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে অনড় থাকেন। তাদের বক্তব্য, শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। অতএব শিক্ষার ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। আন্দোলন চলতে থাকলো। দাবি একটাই। ভ্যাট দেব না, গুলী কর। অচল হয়ে পড়ল ঢাকাসহ সারা দেশ। এখানে বিস্ময়করভাবে একশ্রেণীর সরকারি তাঁবেদার মিডিয়ার গণবিরোধী ভূমিকা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। হ্যাঁ এই আন্দোলনে অচল হয়ে গেছে ঢাকা। বহু মানুষকে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। কোনো কোনো প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনকে নয়, সেই দুর্ভোগকেই প্রধান করে দেখাবার প্রাণান্ত কোশেশ করে ব্যর্থ হলো। মিডিয়ায় সরকারের এমন বেহায়া দালালি অনেকদিন পর প্রাণভরে উপভোগ করলাম।
একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখলাম, পথের ওপর দাঁড়িয়ে খুব সাধারণ মানুষকে ধরে ধরে সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। নিম্নমধ্যবিত্ত এক বোরখা-পরা মাঝবয়সী মাকে আটকে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করল, এই যে এতদূর থেকে এলেন, যানবাহন নেই। আপনার কষ্ট হচ্ছে না? কষ্ট তো হচ্ছেই। তবু আপনি কি ছাত্রদের এ আন্দোলন সমর্থন করেন? নিশ্চয়ই করি। ছেলেপেলে পড়াতে এমনিতেই যে খরচ, তার ওপর আরও টাকা কেন দিতে হবে? সন্তানদের জন্য এটুকু কষ্ট তো মেনে নিতেই হবে। কেউ কেউ বললেন, সরকারি কর্মচারিদের বেতন কিছু কমিয়ে সেখান থেকে এই টাকা নেয়া যেত। শিক্ষায় আবার ভ্যাট কেন? ছাত্রদের কাছ থেকে নিতে হবে কেন? একজন লোকও পাওয়া গেল না, যিনি বললেন, যেহেতু ছাত্রদের আন্দোলনে কষ্ট হচ্ছে, অতএব পিটিয়ে এদের রাস্তা থেকে তুলে দিয়ে রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক করে আনা হোক। ছাত্ররা করজোড়ে পথচারিদের কাছে মাফ চাচ্ছিলেন, কোনো কোনো প্রবীণ মানুষের বোঝা কিছু দূর বয়ে নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছিলেন। শিশুদের স্কুলব্যাগ নিজের পিঠে তুলে নিয়ে আগায়ে দিচ্ছিলেন।
ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত এই আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত তারা জয়ী হয়েছে। সরকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তাদের প্রতিবাদী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আনন্দ মিছিলে রূপ নিয়েছিল। তারা আবার স্ব স্ব ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন। এই আন্দোলনে ছাত্রদের জয় থেকে আবারও একটা বিষয় প্রমাণিত হলো যে, জনতার ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কখনও বৃথা যায় না। বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন