মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

টাঙ্গাইল হত্যাকাণ্ড মেয়রের পুত্রহত্যা ও চেয়ারম্যানের গালের চড়


এক.
গত ১৮ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলী বর্ষণে চারজন নিরস্ত্র গ্রামবাসী নিহতের ঘটনায় শোকে ক্ষোভে মুহ্যমান হয়ে পড়ে গোটা এলাকার মানুষ। স্তম্ভিত গোটা দেশের মানুষ। এক মা ও তার ছেলের ওপর এলাকার এক প্রভাবশালীর পৈশাচিক যৌন নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে পুলিশের কাছে কোনো প্রতিকার না পেয়ে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মহাসড়কে এক মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল। নির্যাতনকারীর পক্ষ নিয়ে ক্ষুব্ধ সেই গ্রামবাসীদের ওপর নির্বিচার গুলী চালায় পুলিশ। তাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় তিনজন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরও একজন। আহত হয়েছেন প্রায় ৫০ জন গ্রামবাসী।
ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর কালিহাতির সাতুটিয়া গ্রামে এক মা ও তার ছেলেকে শ্লীলতাহানি ঘটায় সেখানকার প্রভাবশালী রফিকুল ইসলাম রোমা ও তার ভগ্নিপতি হাফিজুর রহমান। তারা প্রথমে ঘরে ঢুকিয়ে মায়ের শ্লীলতাহানি ঘটায়। তারপর জোর করে সেইঘরে তার কিশোর ছেলেকে নিয়ে গিয়ে নগ্ন করে তার মায়ের শ্লীলতাহানি করতে বাধ্য করে। ছেলের আর্ত চিৎকারে এলাকাবাসী এগিয়ে এসে ঐ দুজনকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করতে থাকে। ইতিমধ্যে গোটা এলাকায় এ ঘটনার খবর পৌঁছে যায়। ফুঁসে উঠতে শুরু করে কালিহাতি ও ঘাটাইল উপজেলার মানুষ। গ্রামবাসীর বারবার আবেদন সত্ত্বেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো মামলা করে না। বরং অভিযোগ আছে যে, টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেয়। এতে ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে।
এর প্রতিকারের দাবিতেই পাশাপাশি এই দুই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে কালিহাতি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সমবেত হতে থাকে। এর একপর্যায়ে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে কয়েকটি গাড়ি ভাংচুরও হয়। তখন পুলিশ এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করে। এতে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আরও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তারা থানার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। তখন পুলিশ সরাসরি বিক্ষোভকারীদের বুক বরাবর নির্বিচার গুলী চালালে ঐ চারজন খুন হয়।
এ ব্যাপাারে পুলিশের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তাই মিডিয়ার সামনে মুখ খুলতে রাজি হননি। আমরা টেলিভিশনের ভিডিও ফুটেজেও দেখেছি, তারা বলছেন, এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাবে না। তদন্ত চলছে। এই বলে বলে তারা দ্রুত সরে গেছেন ক্যামেরার সামনে থেকে। তারপর পুলিশ তাদের কর্তব্যে বাধা দেয়ার অভিযোগে নয় শ’ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এখন হয়রানির পালা শুরু হলো বলে। কিংবা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
এই গুলী চালানো নিয়ে সকল মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। অনেকেই বলছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় গুলী করা জরুরি ছিল না। গুলী না চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। পুলিশ গুলী চালিয়েছে মাথা ও বুক বরাবর। পুলিশ প্রবিধানে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষা ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিধান রয়েছে। ‘নাশকতাকারী’দের বারবার সতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও তারা ছত্রভঙ্গ না হলে পুলিশ গুলী বর্ষণ করতে পারে। তবে সাধারণ রীতি অনুযায়ী পুলিশ গুলী করে কোমরের নিচে। টাঙ্গাইলের ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের গুলী করা হয়েছে বুকে ও মাথায়। নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, বিনা কারণে তাদের গুলী করে হত্যা করা হয়েছে।
এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত সাতজন পুলিশকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাহার কোনো শাস্তি হতে পারে না। এটা লোক দেখানো কৌশল মাত্র। কিছুদিন পর এরা অন্য কোনো থানায় পোস্টিং পাবে। আবারও হয়তো আগের মতো নির্দ্বিধায় নাগরিকদের বুক বরাবর গুলী চালাবে। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, সংশ্লিষ্ট পুলিশদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। প্রত্যাহার বা ক্লোজ করা কোনো শাস্তি হতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, গুলী করেছে পুলিশ, বিচার করতে হবে পুলিশেরই। পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজিপি বলেছেন, এর পেছনে কারও ইন্ধন থাকতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত জয় হচ্ছে জনতার ওপর গুলীবর্ষণকারী পুলিশেরই। অথচ এলাকার জনগণ অকল্পনীয় আল্লাহর আরশ কাঁপানো এক পৈশাচিকতার বিচার দাবি করতে গিয়েছিল। বিচারের বাণী আর কতকাল নিভৃতে কাঁদতেই থাকবে?
দুই.
গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি আতাউর রহমানের নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে সাম্য (১৬) গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিকাল তিনটায় বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় পরও সে বাসায় ফিরে না এলে পরিবারের পক্ষ থেকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। এ সময় সাম্যের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় সাম্যের বাবা মেয়র আতাউর বিষয়টি থানার ওসিকে অবহিত করেন। তিনি জিডি করতে চাইলে ওসি তা গ্রহণ না করে তাকে ফিরিয়ে দেন। খোঁজাখুঁজি চলতে থাকে। এর এক পর্যায়ে মেয়রের লোকজন পৌর এলাকার তাজুল ইসলামের ছেলে হৃদয়কে ধরে থানায় নিয়ে আসে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে হৃদয় স্বীকার করে যে, মেয়রের ছেলে সাম্যকে হত্যা করে পৌরসভা কার্যালয়ের সামনের একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে রাখা হয়েছে।
হৃদয়ের স্বীকারোক্তির পরও পুলিশ রহস্যজনক কারণে লাশ উদ্ধারে নানা টালবাহানা শুরু করে। তখন সাম্যের আত্মীয়-স্বজনরা ঐ বাড়ির বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। এক পর্যায়ে ভবনটির ছাদের ওপর সাম্যের গেঞ্জি স্যান্ডেল ও কিছু রশি পড়ে থাকতে দেখে। এতে তাদের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হতে থাকে। আরও ব্যাপক তল্লাশি শুরু হয়। এর এক পর্যায়ে ঐ বাড়ির লেট্রিনের সেফটি ট্যাঙ্কের ভেতরে থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বস্তাবন্দী সাম্যের লাশ উদ্ধার করা হয়।
লাশ উদ্ধারেরও দীর্ঘ চার ঘণ্টা পর পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে লাশ থানায় নিয়ে যায়। লাশ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়লে শত শত বিক্ষুব্ধ মানুষ সমবেত হয়ে পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড কমিশনার আর এক আওয়ামী লীগার জয়নাল আবেদিনের বাসাসহ বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে আগুন দেয় ও ভাঙচুর করে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ শেষ পর্যন্ত হৃদয় ও তার মাসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। সাম্যের বাবা মেয়র আতাউর রহমান জয়নাল আবেদিনসহ ১১ জনকে আসামী করে গোবিন্দগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী এই জয়নালের ইন্ধন ও পরিকল্পনায়ই সাম্যকে হত্যা করা হয়েছে। ঈদের দিন দুটি জানাযার পর সাম্যের লাশ দাফন করা হয়।
এদিকে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি এবিএম জাহিদুল ইসলামের অপসারণ দাবিতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ নারী-পুরুষ পৌর শহরের চতুরঙ্গের মোড়ে অবস্থান নিয়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। রাতেই জনতার দাবি মেনে নিয়ে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে ওসি জাহিদুলকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কিন্তু তাতেও ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি সাধারণ মানুষের। শহরে এখনও টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় পৌর এলাকায় র‌্যাব, বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
তিন.
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ধামরাইয়ে ভিজিএফ-এর চাল বিতরণকে কেন্দ্র করে সহস্রাধিক লোকের সামনে ধামরাইয়ের চৌহাট ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত নারী ইউপি চেয়ারম্যানকে চড়-থাপ্পড় মেরেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার সময় ভিজিএফ-এর চাল নিতে আসা হতদরিদ্র মানুষেরা ভয়ে সেখান থেকে দৌড়ে চলে যান। খবরে বলা হয়েছে, ইউনিয়নের ১৫০৮ জন হতদরিদ্রকে চাল দেয়ার জন্য ভিজিএফ কার্ড বিতরণ করা হয়। ঈদের আগের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর চাল নিতে কার্ডধারীরা ইউপি ভবনে আসেন। তখন হঠাৎ করেই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম কয়েকজন যুবককে নিয়ে মোটর সাইকেলে করে সেখানে আসেন এবং কোনো কথা না বলে সকলের সামনেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আনিচ্ছা হাশেম লাভলীকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। এতে চাল নিতে আসা লোকজন আতঙ্কে চাল না নিয়েই দৌড়ে বাড়ি চলে যান। সে সময় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবু তালেব খানসহ আওয়ামী লীগের স্থানীয় অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। জানা যায়, নজরুল আনিচ্ছার কাছে ৭০০ ভিজিএফ কার্ড চেয়েছিলেন। না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে চড়-থাপ্পড় মারেন। আর নজরুল সাংবাদিকদের বলেছেন যে, স্থানীয় এমপি এমএ মালেককে নিয়ে কটূক্তি করায় তাকে পরিষদে গিয়েই থাপ্পড় মেরেছি। সাবাস আওয়ামী বীর!
দেশে প্রতিদিন সংঘটিত হাজারো ঘটনার মধ্যে এই তিনটি ঘটনা তুলে ধরা হলো একথা বোঝাবার জন্য যে, সরকারের মদত ও প্রশ্রয়ে, নির্বিচার দায়মুক্তি ও পক্ষপাতিত্বে পুলিশ বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ত্রাস কোন মাত্রায় পৌঁছেছে। এরা আরও বেশি মাত্রায় ফ্রাঙ্কেস্টাইনের দানব হয়ে উঠেছে। এক সময় এরা প্রশ্রয়দাতাদের ঘাড়ও মটকে দিতে পারে। তার আলামত এখন আর অস্পষ্ট নেই।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads