আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-নির্যাতনের শিকার বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক অর্থে ধান্দাবাজ ও সুযোগসন্ধানীদের দৌরাত্ম্যও বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে তিক্ততা ও বিভেদ সৃষ্টি এবং ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ঘটানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর ধান্দাবাজ ও সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিএনপিকে ‘হেদায়েত’ করার কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বিএনপি কেন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না, সাংগঠনিকভাবে দলটি কেন পিছিয়ে ও দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং আবারও ঘুরে দাঁড়াতে হলে বিএনপিকে কিভাবে এগোতে হবে- এসব বিষয়ে উপদেশ ‘খয়রাত’ করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন অনেকেই। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, ‘খয়রাত’ যারা করছেন তারা বিএনপির শুভাকাংক্ষী হিসেবে পরিচিত। এ পরিচিতিরই সদ্ব্যবহার করছেন তারা।
এমন একজন কথিত শুভাকাংক্ষী সম্প্রতি একটি দৈনিকের নিবন্ধে বিএনপিকে যথেচ্ছভাবে উপদেশ ‘খয়রাত’ করেছেন (দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ সেপ্টেম্বর,২০১৫)। তা তিনি করতেই পারেন, কিন্তু আপত্তি উঠেছে তার যুক্তি ও কৌশলের কারণে। ইতিহাস টেনে আনার ক্ষেত্রেও ভুল করেছেন তিনি। এককালের বামপন্থী এই ছাত্রনেতা বিএনপির বর্তমান অবস্থাকে ১৯৬০-এর দশকে আওয়ামী লীগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ছয় দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের ওপরও “এক ধরনের ‘ক্র্যাকডাউন’ নেমে এসেছিল। শেখ হাসিনার লীগ সরকার বিএনপির ওপর যেভাবে ‘চড়াও’ হয়েছে, পঞ্চাশ বছর আগে আইউব খানের লীগ সরকারও একইভাবে ‘চড়াও’ হয়েছিল।...দলের সব নেতাকেই ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস- ডিপিআর নামক আইনের অপপ্রয়োগ করে কারারুদ্ধ করা হয়। একমাত্র আমেনা বেগম আওয়ামী লীগ অফিসে বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। সেই সময়টি ছিল আওয়ামী লীগের দুঃসময়। তখনো মুসলিম লীগের পা-ারা বলত, ‘আওয়ামী লীগ শেষ। বাতি জ্বালিয়েও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ কিন্তু বেশি দিন লাগল না, আওয়ামী লীগ আবার জনগণের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে জেগে উঠল এবং চিরতরে হারিয়ে গেল মুসলিম লীগ।” এরপর সাবেক এই বামপন্থী লিখেছেন, “আওয়ামী লীগের যারা ‘বিএনপি শেষ’, আহ, দেশে একটা বিরোধী দল নেই বলে কৌতুক করছেন, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন, তাদের অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে বলি।... দেশি-বিদেশি এমন সব রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কাহিনী জানা থাকলে বিএনপি নিয়ে তাদের হাসি-তামাশা থেমে যেত।”
কথাগুলো শুনলে মনে হতে পারে, নিতান্ত নিরীহ একজন শুভাকাংক্ষীর মতো বলেছেন তিনি। টেনে এনেছেন বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসও। অন্যদিকে ইতিহাসের আলোকে পর্যালোচনায় কিন্তু দেখা যাবে, আওয়ামী লীগকে প্রাধান্যে আনার এবং বিএনপিকে আরো পেছনে ঠেলে দেয়ার সুচিন্তিত উদ্দেশ্য থেকে সুকৌশলে ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন তিনি। উদাহরণ দেয়ার জন্য ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখ করা দরকার। শুনতে কারো কারো খারাপ লাগতেই পারে কিন্তু সত্য হলো, এই গণঅভ্যুত্থানে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এবং নেতা হিসেবে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। এর কারণ, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছয় দফা ঘোষণার পরপর মে মাসে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছিলেন। ছয় দফা ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সেদিনের আওয়ামী লীগ কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কারণ, কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্রসহ মেহনতী মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো দাবি না থাকায় এবং মূলত সাংবিধানিক পরিবর্তনের কর্মসূচি হওয়ায় ছয় দফা জনগণের সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। এখানে তৎকালীন আওয়ামী লীগের অবস্থা সম্পর্কেও ধারণা দেয়া দরকার। প্রথমত, ছয় দফার প্রশ্নে ১৯৬৬ সালেই আওয়ামী লীগ দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ‘ছয় দফাপন্থী’ হিসেবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধুরন্ধর নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ‘পিডিএমপন্থী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি ছিল না। দলের অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, ’৬৮ সালের জানুয়ারিতে দলের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী করার পরও দলটি সামান্য প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। ২১ জানুয়ারি অনেকটা গোপনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভার এক প্রস্তাবে অভিযুক্ত নেতাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার জন্য দাবি নয়, সরকারের কাছে ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল। ’৬৮ সাল জুড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি চলেছে, শুনানির বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, যার ভিত্তিতে বলা যাবে যে, ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ মামলাটির বিরুদ্ধে এবং নেতার মুক্তির দাবিতে কোনো মিছিল বা সমাবেশ করেছিল। ঢাকায় তো বটেই, প্রদেশের অন্য কোথায়ও দলটির তৎপরতা দেখা যায়নি। অনেকস্থানে আওয়ামী লীগের নেতারা বরং দলীয় অফিসে যাতায়াত পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখানে কৌত’হলোদ্দীপক একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। তথ্যটি হলো, শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান কৌসুলী বা আইনজীবী হিসেবে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেনÑ যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা কখনো তার নামই মুখে নেন না।
‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সম্পর্কিত দ্বিতীয় তথ্য হলো, দলটি ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে গঠিত ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি বা ড্যাক নামের আটদলীয় জোটে যোগ দিয়েছিল। তথ্যটি উল্লেখ করার কারণ, ড্যাক-এর প্রধান নেতা ছিলেন শেখ মুজিবের কঠোর সমালোচক ও প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান। ড্যাক-এর শরিক দলগুলোর নামও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ : কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, এনডিএফ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ওয়ালী) এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। প্রধান দলগুলোর মধ্যে একমাত্র মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী) ড্যাক-এ যোগ দেয়নি। উল্লেখ্য, ড্যাক-এর আট দফায় স্বায়ত্তশাসন শব্দটিও ছিল না। অথচ স্বায়ত্তশাসন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান দাবি। তাছাড়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উল্লেখ পর্যন্ত না করে পশ্চিম পাকিস্তানের দুই নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাশাপাশি শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হয়েছিল পঞ্চম দফায়। অমন একটি জোটে অংশ নেয়ার তথ্যও প্রমাণ করে, ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা আসলেও শোচনীয়ই ছিল। নাহলে স্বায়ত্তশাসন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উল্লেখবিহীন কর্মসূচির ভিত্তিতে দলটি ড্যাক-এ যোগ দিত না।
বাস্তবে শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রিয় নেতা হয়েছিলেন ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানে। এই অভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মহা ধুমধাম করে ১৯৬৮ সালে পালিত ‘উন্নয়ন দশক’-এর শেষ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকায় স্বায়ত্তশাসনের বিরোধিতাসহ উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছিলেন। এর প্রতিবাদে এ্ং ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষে ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে আয়োজিত বিরাট জনসভায় মওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং শেখ মুজিবসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবিতে জনসভার মানুষকে নিয়ে মওলানা ভাসানী গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করেছিলেন। ঘেরাওকারী জনতার ওপর পুলিশ নির্যাতন চালিয়েছিল। প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী ৭ ডিসেম্বর হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে দু’জন শহীদ এবং ১৬ জন আহত হলে মওলানা ভাসানীর ডাকে ৮ ডিসেম্বরও হরতাল পালিত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘ঘেরাও আন্দোলন’। সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র প্রদেশে, আজকের বাংলাদেশে।
মওলানা ভাসানীর ‘ঘেরাও আন্দোলনে’র সাফল্যই প্রদেশের ছাত্রসংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ঘোষিত হয়েছিল ১১ দফা। ছাত্র সংগঠন তিনটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ভাসানীপন্থী, ‘মেনন গ্রুপ’ নামে পরিচিত), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (রুশপন্থী, ‘মতিয়া গ্রুপ’ নামে পরিচিত)। ডাকসুও ১১ দফায় স্বাক্ষর করেছিল। স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের দাবি অন্তর্ভুক্ত থাকায় ১১ দফা ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল, মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ভাসানীপন্থী ছাত্র নেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যু ১১ দফার আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত করেছিল। এর পরপর ২৪ জানুয়ারি স্কুলছাত্র মতিউরের মৃত্যুতে গণঅভ্যুত্থান অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। সে গণঅভ্যুত্থানের চাপেই প্রথমবারের মতো নতিস্বীকার করেছিলেন ‘লৌহ মানব’ নামে পরিচিত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। রাজনীতিকদের তিনি গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবও বন্দি অবস্থাতেই গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে সম্মত হয়েছিলেন। ১৬ ফেবব্রুয়ারি থেকে বৈঠক শুরু হওয়ার কথা ছিল।
অন্যদিকে গোলটেবিল বৈঠকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। পল্টনের জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্টের জেলখানা ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনা হবে (এ ধরনের হুমকি দেয়ার কথা সেকালে কল্পনা করা যেতো না)। এই পর্যায়ে বেগম মুজিবের পীড়াপীড়িতে শেখ মুজিবও প্যারোলে যেতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। তার অস্বীকৃতি গোলটেবিল বৈঠককেই অনিশ্চিত করে তুলেছিল। ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিরা মুক্তি পেয়েছিলেন ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সরকারের পতন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হলেও গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব অংশ নেয়ায় আইয়ুব খান তখনকার মতো বেঁচে গিয়েছিলেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে, নিজেকে রক্ষার এবং গণঅভ্যুত্থানকে বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসেবেই আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করেছিলেন। একই কারণে মওলানা ভাসানী নিজেই শুধু বর্জন করেননি, শেখ মুজিবকেও বৈঠকে অংশ না নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য যেহেতু কোনো গোলটেবিল বৈঠকের প্রয়োজন পড়েনি, সেহেতু স্বায়ত্তশাসনসহ ১১ দফার বাকি দাবিগুলোও আন্দোলনের মাধ্যমেই আদায় করা যাবে। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর পরামর্শ উপেক্ষা করে শেখ মুজিব ২৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি তাই বলে প্রথম রাউন্ডেই ভাষণ দিতে পারেননি, তাকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল আরো পরেÑ ১০ মার্চ। এই প্রক্রিয়ায় আইয়ুব খানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কৌশলই সফল হয়েছিল। ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবের দিকে আশায় তাকিয়ে থাকায় এবং মাঝখানে ঈদুল আযহার ছুটি পড়ে যাওয়ায় গণঅভ্যুত্থান স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে সরে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো প্রবর্তিত হয়েছিল সামরিক শাসন (২৫ মার্চ, ১৯৬৯)। সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
এভাবে তথ্যনির্ভর পর্যালোচনায় দেখা যাবে, ১১ দফাভিত্তিক যে গণঅভ্যুত্থানের সাফল্যে মুক্তি শুধু নয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার ভয়ংকর অভিযোগ থেকেও রেহাই পেয়েছিলেন, সে গণঅভ্যুত্থানকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে ইতিহাসের নামে গালগল্প তৈরি করা হলেও সত্য হলো, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের কোনো ভূমিকা ছিল না। ভূমিকা রাখার মতো অবস্থায় তিনি ছিলেনও না। ওদিকে দল হিসেবে ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থাও তখন ছিল শোচনীয়। দলটিকে এমনকি শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত জোট ড্যাক-এও যোগ দিতে হয়েছিল। শেখ মুজিবকে প্রধান নেতার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থান। মওলানা ভাসানীর পরামর্শ উপেক্ষা করে শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়ায় একদিকে স্বায়ত্তশাসনের প্রধান দাবিসহ ১১ দফার বাকি দাবিগুলো আদায় করা যায়নি, অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানও স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। আইয়ুব খান তো বটেই, পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকরাও সেটাই চেয়েছিলেন। আন্দোলন এড়িয়ে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়ায় শেখ মুজিবকে তারা সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।
এখানেও শেষ নয়, ছাত্র সমাজের যে ১১ দফা তাকে মুক্ত করার পাশাপাশি প্রধান নেতার অবস্থান ও সম্মান এনে দিয়েছিল, জনপ্রিয়তার প্রভাব খাটিয়ে শেখ মুজিব সে ১১ দফাকেও পরিত্যাগ করেছিলেন। প্রথমে ‘১১ দফা ও ছয় দফা’ এবং তার পর কিছুদিন পর্যন্ত ‘ছয় দফা ও ১১ দফা’ বলার পর এক পর্যায়ে তিনি নিজের সেই ছয় দফাকে পুনর্বাসিত করেছিলেন, যে কর্মসূচি জনগণের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার প্রভাবে রাজনৈতিক প্রতারণাই সফল হয়েছে : বিশেষ করে আওয়ামী শিবিরের পক্ষ থেকে এখনো একথাই প্রচার করা হয় যেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ছয় দফার ভিত্তিতে! অন্যদিকে ইতিহাস কিন্তু দাবিটিকে সত্যায়িত করে না।
এখানে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কিছু বিশেষ দিক লক্ষ্য করা দরকার। প্রথমত, নিজেদের নয়, পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হয় জনগণের দাবি ও আকাংক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ থাকাটাই আবার যথেষ্ট নয়, দেখতে হয়, জনগণ আন্দোলনের জন্য তৈরি কি না, তারা আন্দোলনে অংশ নেবে কি না। দ্বিতীয়ত, দলের সাংগঠনিক অবস্থা আন্দোলনের বড় নির্ধারক নয়। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও ভাসানী ন্যাপসহ কোনো দলই সাংগঠনিক দিক থেকে শক্তিশালী ছিল না। উভয় দলের অনেক নেতা কারাগারে ছিলেন, ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহাসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী সাফল্যের সঙ্গে আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটে। তৃতীয়ত, দাবি আদায়সহ আন্দোলনের সফলতার জন্য শরিক বা সহযোগীরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৮-৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রে মওলানা ভাসানী একাকী হয়ে পড়েছিলেন। শেখ মুজিব ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়ায় ১১ দফার আর কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব হয়নি- যেমনটি ঘটেছিল ১৯৮০-র দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়। নির্বাচনে যারা অংশ নেবে তারা ‘জাতীয় বেঈমান’ বলে শেখ হাসিনা নিজে ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালের মে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল বলেই স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটেনি। সুতরাং আন্দোলনে যাওয়ার আগে শরিক বা সহযোগীদের উদ্দেশ্য ও কৌশল সম্পর্কে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করা দরকার। মাঝপথে বিশ্বাসঘাতকতা করার কিংবা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা হাসিল করার মতো কোনো দলকে সঙ্গে রাখার পরিবর্তে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। চতুর্থত, শেখ হাসিনার মতো সরকারের পতন ঘটানোকে একমাত্র স্লোগান বানানোর পরিবর্তে জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করা এবং তাদের অবস্থার উন্নয়নকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা দরকার। সব মিলিয়ে এমন এক সময়ে আন্দোলন শুরু করতে হয়, জনগণ যাতে নিজেদের তাগিদেই সে আন্দোলনে অংশ নেয়, আন্দালনের সাফল্যেও যাতে জনগণই বেশি উপকৃত হতে পারে।
বলা দরকার, তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের এ পর্যায়ে এসেই ধরা পড়ে গেছেন সাবেক সেই বামপন্থী ছাত্রনেতা। পাঠকরাও লক্ষ্য করলে দেখবেন, তিনি এমনভাবে ইতিহাসের উল্লেখ করেছেন যা পড়ে মনে হতে পারে যেন আইয়ুব খানের মুসলিম লীগ সরকার ‘চড়াও’ হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ‘শেষ’ হয়ে যায়নি বরং আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলের অবস্থান অর্জন করেছিল। অন্যদিকে ইতিহাস কিন্তু সে সাক্ষ্য দেয় না। একই কারণে বিএনপির জন্য দরদে উথলে ওঠার বিষয়টিকেও সন্দেহজনক না বলে উপায় থাকে না।
এমন একজন কথিত শুভাকাংক্ষী সম্প্রতি একটি দৈনিকের নিবন্ধে বিএনপিকে যথেচ্ছভাবে উপদেশ ‘খয়রাত’ করেছেন (দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ সেপ্টেম্বর,২০১৫)। তা তিনি করতেই পারেন, কিন্তু আপত্তি উঠেছে তার যুক্তি ও কৌশলের কারণে। ইতিহাস টেনে আনার ক্ষেত্রেও ভুল করেছেন তিনি। এককালের বামপন্থী এই ছাত্রনেতা বিএনপির বর্তমান অবস্থাকে ১৯৬০-এর দশকে আওয়ামী লীগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ছয় দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের ওপরও “এক ধরনের ‘ক্র্যাকডাউন’ নেমে এসেছিল। শেখ হাসিনার লীগ সরকার বিএনপির ওপর যেভাবে ‘চড়াও’ হয়েছে, পঞ্চাশ বছর আগে আইউব খানের লীগ সরকারও একইভাবে ‘চড়াও’ হয়েছিল।...দলের সব নেতাকেই ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস- ডিপিআর নামক আইনের অপপ্রয়োগ করে কারারুদ্ধ করা হয়। একমাত্র আমেনা বেগম আওয়ামী লীগ অফিসে বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। সেই সময়টি ছিল আওয়ামী লীগের দুঃসময়। তখনো মুসলিম লীগের পা-ারা বলত, ‘আওয়ামী লীগ শেষ। বাতি জ্বালিয়েও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ কিন্তু বেশি দিন লাগল না, আওয়ামী লীগ আবার জনগণের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে জেগে উঠল এবং চিরতরে হারিয়ে গেল মুসলিম লীগ।” এরপর সাবেক এই বামপন্থী লিখেছেন, “আওয়ামী লীগের যারা ‘বিএনপি শেষ’, আহ, দেশে একটা বিরোধী দল নেই বলে কৌতুক করছেন, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন, তাদের অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে বলি।... দেশি-বিদেশি এমন সব রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কাহিনী জানা থাকলে বিএনপি নিয়ে তাদের হাসি-তামাশা থেমে যেত।”
কথাগুলো শুনলে মনে হতে পারে, নিতান্ত নিরীহ একজন শুভাকাংক্ষীর মতো বলেছেন তিনি। টেনে এনেছেন বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসও। অন্যদিকে ইতিহাসের আলোকে পর্যালোচনায় কিন্তু দেখা যাবে, আওয়ামী লীগকে প্রাধান্যে আনার এবং বিএনপিকে আরো পেছনে ঠেলে দেয়ার সুচিন্তিত উদ্দেশ্য থেকে সুকৌশলে ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন তিনি। উদাহরণ দেয়ার জন্য ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখ করা দরকার। শুনতে কারো কারো খারাপ লাগতেই পারে কিন্তু সত্য হলো, এই গণঅভ্যুত্থানে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এবং নেতা হিসেবে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। এর কারণ, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছয় দফা ঘোষণার পরপর মে মাসে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছিলেন। ছয় দফা ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সেদিনের আওয়ামী লীগ কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কারণ, কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্রসহ মেহনতী মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো দাবি না থাকায় এবং মূলত সাংবিধানিক পরিবর্তনের কর্মসূচি হওয়ায় ছয় দফা জনগণের সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। এখানে তৎকালীন আওয়ামী লীগের অবস্থা সম্পর্কেও ধারণা দেয়া দরকার। প্রথমত, ছয় দফার প্রশ্নে ১৯৬৬ সালেই আওয়ামী লীগ দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ‘ছয় দফাপন্থী’ হিসেবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধুরন্ধর নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ‘পিডিএমপন্থী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি ছিল না। দলের অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, ’৬৮ সালের জানুয়ারিতে দলের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী করার পরও দলটি সামান্য প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। ২১ জানুয়ারি অনেকটা গোপনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভার এক প্রস্তাবে অভিযুক্ত নেতাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার জন্য দাবি নয়, সরকারের কাছে ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল। ’৬৮ সাল জুড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি চলেছে, শুনানির বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, যার ভিত্তিতে বলা যাবে যে, ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ মামলাটির বিরুদ্ধে এবং নেতার মুক্তির দাবিতে কোনো মিছিল বা সমাবেশ করেছিল। ঢাকায় তো বটেই, প্রদেশের অন্য কোথায়ও দলটির তৎপরতা দেখা যায়নি। অনেকস্থানে আওয়ামী লীগের নেতারা বরং দলীয় অফিসে যাতায়াত পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখানে কৌত’হলোদ্দীপক একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। তথ্যটি হলো, শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান কৌসুলী বা আইনজীবী হিসেবে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেনÑ যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা কখনো তার নামই মুখে নেন না।
‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সম্পর্কিত দ্বিতীয় তথ্য হলো, দলটি ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে গঠিত ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি বা ড্যাক নামের আটদলীয় জোটে যোগ দিয়েছিল। তথ্যটি উল্লেখ করার কারণ, ড্যাক-এর প্রধান নেতা ছিলেন শেখ মুজিবের কঠোর সমালোচক ও প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান। ড্যাক-এর শরিক দলগুলোর নামও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ : কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, এনডিএফ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ওয়ালী) এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। প্রধান দলগুলোর মধ্যে একমাত্র মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী) ড্যাক-এ যোগ দেয়নি। উল্লেখ্য, ড্যাক-এর আট দফায় স্বায়ত্তশাসন শব্দটিও ছিল না। অথচ স্বায়ত্তশাসন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান দাবি। তাছাড়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উল্লেখ পর্যন্ত না করে পশ্চিম পাকিস্তানের দুই নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাশাপাশি শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হয়েছিল পঞ্চম দফায়। অমন একটি জোটে অংশ নেয়ার তথ্যও প্রমাণ করে, ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা আসলেও শোচনীয়ই ছিল। নাহলে স্বায়ত্তশাসন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উল্লেখবিহীন কর্মসূচির ভিত্তিতে দলটি ড্যাক-এ যোগ দিত না।
বাস্তবে শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রিয় নেতা হয়েছিলেন ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানে। এই অভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মহা ধুমধাম করে ১৯৬৮ সালে পালিত ‘উন্নয়ন দশক’-এর শেষ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকায় স্বায়ত্তশাসনের বিরোধিতাসহ উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছিলেন। এর প্রতিবাদে এ্ং ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষে ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে আয়োজিত বিরাট জনসভায় মওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং শেখ মুজিবসহ সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবিতে জনসভার মানুষকে নিয়ে মওলানা ভাসানী গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করেছিলেন। ঘেরাওকারী জনতার ওপর পুলিশ নির্যাতন চালিয়েছিল। প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী ৭ ডিসেম্বর হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে দু’জন শহীদ এবং ১৬ জন আহত হলে মওলানা ভাসানীর ডাকে ৮ ডিসেম্বরও হরতাল পালিত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘ঘেরাও আন্দোলন’। সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র প্রদেশে, আজকের বাংলাদেশে।
মওলানা ভাসানীর ‘ঘেরাও আন্দোলনে’র সাফল্যই প্রদেশের ছাত্রসংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ঘোষিত হয়েছিল ১১ দফা। ছাত্র সংগঠন তিনটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ভাসানীপন্থী, ‘মেনন গ্রুপ’ নামে পরিচিত), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (রুশপন্থী, ‘মতিয়া গ্রুপ’ নামে পরিচিত)। ডাকসুও ১১ দফায় স্বাক্ষর করেছিল। স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের দাবি অন্তর্ভুক্ত থাকায় ১১ দফা ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল, মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ভাসানীপন্থী ছাত্র নেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যু ১১ দফার আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত করেছিল। এর পরপর ২৪ জানুয়ারি স্কুলছাত্র মতিউরের মৃত্যুতে গণঅভ্যুত্থান অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। সে গণঅভ্যুত্থানের চাপেই প্রথমবারের মতো নতিস্বীকার করেছিলেন ‘লৌহ মানব’ নামে পরিচিত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। রাজনীতিকদের তিনি গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবও বন্দি অবস্থাতেই গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে সম্মত হয়েছিলেন। ১৬ ফেবব্রুয়ারি থেকে বৈঠক শুরু হওয়ার কথা ছিল।
অন্যদিকে গোলটেবিল বৈঠকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। পল্টনের জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্টের জেলখানা ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনা হবে (এ ধরনের হুমকি দেয়ার কথা সেকালে কল্পনা করা যেতো না)। এই পর্যায়ে বেগম মুজিবের পীড়াপীড়িতে শেখ মুজিবও প্যারোলে যেতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। তার অস্বীকৃতি গোলটেবিল বৈঠককেই অনিশ্চিত করে তুলেছিল। ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিরা মুক্তি পেয়েছিলেন ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সরকারের পতন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হলেও গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব অংশ নেয়ায় আইয়ুব খান তখনকার মতো বেঁচে গিয়েছিলেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে, নিজেকে রক্ষার এবং গণঅভ্যুত্থানকে বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসেবেই আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করেছিলেন। একই কারণে মওলানা ভাসানী নিজেই শুধু বর্জন করেননি, শেখ মুজিবকেও বৈঠকে অংশ না নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য যেহেতু কোনো গোলটেবিল বৈঠকের প্রয়োজন পড়েনি, সেহেতু স্বায়ত্তশাসনসহ ১১ দফার বাকি দাবিগুলোও আন্দোলনের মাধ্যমেই আদায় করা যাবে। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর পরামর্শ উপেক্ষা করে শেখ মুজিব ২৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি তাই বলে প্রথম রাউন্ডেই ভাষণ দিতে পারেননি, তাকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল আরো পরেÑ ১০ মার্চ। এই প্রক্রিয়ায় আইয়ুব খানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কৌশলই সফল হয়েছিল। ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবের দিকে আশায় তাকিয়ে থাকায় এবং মাঝখানে ঈদুল আযহার ছুটি পড়ে যাওয়ায় গণঅভ্যুত্থান স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে সরে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো প্রবর্তিত হয়েছিল সামরিক শাসন (২৫ মার্চ, ১৯৬৯)। সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
এভাবে তথ্যনির্ভর পর্যালোচনায় দেখা যাবে, ১১ দফাভিত্তিক যে গণঅভ্যুত্থানের সাফল্যে মুক্তি শুধু নয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার ভয়ংকর অভিযোগ থেকেও রেহাই পেয়েছিলেন, সে গণঅভ্যুত্থানকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে ইতিহাসের নামে গালগল্প তৈরি করা হলেও সত্য হলো, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের কোনো ভূমিকা ছিল না। ভূমিকা রাখার মতো অবস্থায় তিনি ছিলেনও না। ওদিকে দল হিসেবে ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থাও তখন ছিল শোচনীয়। দলটিকে এমনকি শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত জোট ড্যাক-এও যোগ দিতে হয়েছিল। শেখ মুজিবকে প্রধান নেতার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থান। মওলানা ভাসানীর পরামর্শ উপেক্ষা করে শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়ায় একদিকে স্বায়ত্তশাসনের প্রধান দাবিসহ ১১ দফার বাকি দাবিগুলো আদায় করা যায়নি, অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানও স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। আইয়ুব খান তো বটেই, পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকরাও সেটাই চেয়েছিলেন। আন্দোলন এড়িয়ে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়ায় শেখ মুজিবকে তারা সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।
এখানেও শেষ নয়, ছাত্র সমাজের যে ১১ দফা তাকে মুক্ত করার পাশাপাশি প্রধান নেতার অবস্থান ও সম্মান এনে দিয়েছিল, জনপ্রিয়তার প্রভাব খাটিয়ে শেখ মুজিব সে ১১ দফাকেও পরিত্যাগ করেছিলেন। প্রথমে ‘১১ দফা ও ছয় দফা’ এবং তার পর কিছুদিন পর্যন্ত ‘ছয় দফা ও ১১ দফা’ বলার পর এক পর্যায়ে তিনি নিজের সেই ছয় দফাকে পুনর্বাসিত করেছিলেন, যে কর্মসূচি জনগণের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার প্রভাবে রাজনৈতিক প্রতারণাই সফল হয়েছে : বিশেষ করে আওয়ামী শিবিরের পক্ষ থেকে এখনো একথাই প্রচার করা হয় যেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ছয় দফার ভিত্তিতে! অন্যদিকে ইতিহাস কিন্তু দাবিটিকে সত্যায়িত করে না।
এখানে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কিছু বিশেষ দিক লক্ষ্য করা দরকার। প্রথমত, নিজেদের নয়, পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হয় জনগণের দাবি ও আকাংক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ থাকাটাই আবার যথেষ্ট নয়, দেখতে হয়, জনগণ আন্দোলনের জন্য তৈরি কি না, তারা আন্দোলনে অংশ নেবে কি না। দ্বিতীয়ত, দলের সাংগঠনিক অবস্থা আন্দোলনের বড় নির্ধারক নয়। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও ভাসানী ন্যাপসহ কোনো দলই সাংগঠনিক দিক থেকে শক্তিশালী ছিল না। উভয় দলের অনেক নেতা কারাগারে ছিলেন, ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহাসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী সাফল্যের সঙ্গে আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটে। তৃতীয়ত, দাবি আদায়সহ আন্দোলনের সফলতার জন্য শরিক বা সহযোগীরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৮-৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রে মওলানা ভাসানী একাকী হয়ে পড়েছিলেন। শেখ মুজিব ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়ায় ১১ দফার আর কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব হয়নি- যেমনটি ঘটেছিল ১৯৮০-র দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়। নির্বাচনে যারা অংশ নেবে তারা ‘জাতীয় বেঈমান’ বলে শেখ হাসিনা নিজে ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালের মে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল বলেই স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটেনি। সুতরাং আন্দোলনে যাওয়ার আগে শরিক বা সহযোগীদের উদ্দেশ্য ও কৌশল সম্পর্কে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করা দরকার। মাঝপথে বিশ্বাসঘাতকতা করার কিংবা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা হাসিল করার মতো কোনো দলকে সঙ্গে রাখার পরিবর্তে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। চতুর্থত, শেখ হাসিনার মতো সরকারের পতন ঘটানোকে একমাত্র স্লোগান বানানোর পরিবর্তে জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করা এবং তাদের অবস্থার উন্নয়নকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা দরকার। সব মিলিয়ে এমন এক সময়ে আন্দোলন শুরু করতে হয়, জনগণ যাতে নিজেদের তাগিদেই সে আন্দোলনে অংশ নেয়, আন্দালনের সাফল্যেও যাতে জনগণই বেশি উপকৃত হতে পারে।
বলা দরকার, তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের এ পর্যায়ে এসেই ধরা পড়ে গেছেন সাবেক সেই বামপন্থী ছাত্রনেতা। পাঠকরাও লক্ষ্য করলে দেখবেন, তিনি এমনভাবে ইতিহাসের উল্লেখ করেছেন যা পড়ে মনে হতে পারে যেন আইয়ুব খানের মুসলিম লীগ সরকার ‘চড়াও’ হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ‘শেষ’ হয়ে যায়নি বরং আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলের অবস্থান অর্জন করেছিল। অন্যদিকে ইতিহাস কিন্তু সে সাক্ষ্য দেয় না। একই কারণে বিএনপির জন্য দরদে উথলে ওঠার বিষয়টিকেও সন্দেহজনক না বলে উপায় থাকে না।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন